Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

‘হাম লড়েঙ্গে সাথী…’

সৃজনী শবনম চৌধুরী

 




লেখক এলাহাবাদের হরিশচন্দ্র রিসার্চ ইন্সটিটিউটে গণিতের রিসার্চ ফেলো।

 

 

 

গত একমাস ধরে সারা দেশজুড়ে যে এনআরসি-সিএএ বিরোধী আন্দোলনের ঢেউ উঠেছে, এলাহাবাদের মতো একটা শান্ত শহরে, ততোধিক শান্ত একটি একাডেমিক ক্যাম্পাসে বসে তার আঁচ পাওয়াও কঠিন। এই টিভি, খবরের কাগজবিহীন জীবনে ফেসবুকই যা একমাত্র বাইরের জানালা.. তো সেই জানালায় চোখ রাখলে দেখতে পাচ্ছিলাম যাদবপুর, জেএনইউ ছাপিয়ে সারা দেশজুড়ে প্রতিদিন লাখ লাখ মানুষের মিছিল, প্রতিরোধ। আর তাতে একটা নতুন মাত্রা যোগ করেছিল মেয়েদের ভূমিকা।

প্রথমে দিল্লির শাহিনবাগ তারপর কলকাতার পার্ক সার্কাসে মহিলারা এই আইনের বিরুদ্ধে ধর্নায় বসেছেন— এ খবর শুনে একটা ছবি তৈরি হচ্ছিল মনের ভেতর। এর মধ্যেই হঠাৎ জানতে পারলাম এলাহাবাদেও নাকি শাহিনবাগের মত, মেয়েরা একটা জায়গায় জমায়েত আন্দোলন শুরু করেছেন, এবং উত্তরপ্রদেশের পুলিশ কোনওমতেই তাদের হঠিয়ে দিতে পারছে না!

প্রথমে বিশ্বাস হয়নি শুনে। যে রাজ্যে এনআরসি-সিএএ বিরোধী আন্দোলন করতে গিয়ে প্রাণ হারাতে হয়, লকআপে ধর্ষিত, অত্যাচারিত হতে হয় এমনকি শিশুদেরও, সেখানে মহিলাদের জমায়েত উঠিয়ে দেওয়া যাচ্ছে না! এও আবার হয় নাকি! অতএব গত ১৫ই জানুয়ারি বিকেলবেলা গুটি গুটি পায়ে শহরের উদ্দেশ্যে যাত্রা করলাম। তারপর রাস্তায় লোকজন আর গুগলভাইকে জিজ্ঞেস করে পৌঁছে গেলাম এলাহাবাদের শাহিনবাগে!

এ জায়গাটার নাম রোশনবাগ। পুরনো এলাহাবাদ শহরের পুরোদস্তুর এক গরীব মুসলিম মহল্লা। সেখানে খোলা আকাশের নীচে মনসুর আলি পার্ক নামের একটা নেড়া মাঠে প্রায় শ পাঁচেক মহিলা বসে আছেন। মাঠের সামনের দিকে কয়েকটা ছোট ছোট প্লাস্টিকের ত্রিপল টাঙানো, বাকি পুরোটাই খোলা। সামনের মঞ্চে বক্তৃতা দিচ্ছেন উপস্থিত মহিলাদেরই কেউ কেউ। প্রায় সবাই বোরখা বা হিজাব পরিহিতা। বেশ কয়েকজনের কোলে ছোট বাচ্চা। তাঁরাই নেতৃত্ব দিচ্ছেন এ আন্দোলনের। সচেতনভাবে।

মাঠের পেছনের দিকে ঘিরে দাঁড়িয়ে বক্তব্য শুনছিলেন বিভিন্ন বয়সী পুরুষেরা। মাঝে মাঝে বক্তৃতাও দিলেন তাদের কয়েকজন। তবে এর বেশি তাদের আর কোনও ভূমিকা বিশেষ চোখে পড়ল না! রাত আটটা-নটাতেও দলে দলে মহিলারা এসে যোগ দিচ্ছিলেন। কয়েকজন বৃদ্ধা মহিলাকে দেখলাম যুবতী মেয়ের কাঁধে ভর দিয়ে বেশ কষ্ট করে এসে বসলেন। কিশোরী মেয়েরা ভলেন্টিয়ারের দায়িত্ব সামলাচ্ছিল নিজে থেকেই। আমার পাশেই বসেছিলেন একজন মধ্যবয়সী মহিলা। কেমন চিন্তাক্লিষ্ট গম্ভীর মুখ, চেহারায় দারিদ্র্যের ছাপ স্পষ্ট। কেন এসেছেন জিজ্ঞেস করতেই বললেন, ‘অনেক কষ্ট করেই দিন কাটাই, জিনিসপত্রের দাম বেড়ে যাচ্ছে, তাও সবই মেনে নিয়েছি। যেমন করে হোক ছেলেমেয়েদের মানুষ করতে চেষ্টা করছি। এখন বলছে দেশ থেকেই নাকি তাড়িয়ে দেবে! কোথায় যাব বলুন তো!’ বলতে বলতে চোখ ঝাপসা হয়ে এল… আমি আর তাকাতে পারিনি।

ওখানে উপস্থিত মানুষজনের বেশিরভাগ মুসলিম হলেও কোনও ধর্মীয় আবেগ চোখে পড়ল না একবারের জন্যেও। বরং একটা ভীষণরকম জাতীয়তাবাদী আবেগে মোড়া ছিল চারপাশটা। মঞ্চে, আশেপাশে অনেকগুলো জাতীয় পতাকা আর ভগৎ সিং, চন্দ্রশেখর আজাদ, মহাত্মা গান্ধির ছবিতে ভরে আছে পুরো মাঠটা। চমকে গেলাম ওখানকার মেয়েদের বক্তৃতা শুনে। কোনও জড়তা নেই, দ্বিধা নেই তাদের গলায়। মঞ্চে দাঁড়িয়ে স্পষ্ট দৃপ্ত কণ্ঠে তারা এক ধর্মনিরপেক্ষ ভারতবর্ষের স্বপ্ন দেখাচ্ছে! পরিষ্কারভাবে বলছে, তারা আর এই দেশকে ভাগ হতে দেবে না হিন্দু-মুসলমানে। এ দেশের সংবিধানকে খুন হতে দেবে না কোনও মূল্যেই। বারবার মনে করিয়ে দিচ্ছে উপস্থিত জনতাকে যে এই লড়াই হিন্দু মুসলমান সবার। ঐক্যবদ্ধ থাকার শপথ নিচ্ছে সবাই। স্লোগান উঠছে ইনকিলাব জিন্দাবাদ, জয় হিন্দ্!

বেশিক্ষণ থাকা হল না। রাত বেড়ে যাচ্ছিল, তাই উঠতে হল একসময়। ফেরার পথে টোটোতে আমারই বয়সি একটি মেয়ে, নিজে থেকেই আলাপ করল। আমাকে জানাল এই আন্দোলন তারা চালিয়ে নিয়ে যাবেই। যেকোনও মূল্যে। হিজাবের আড়াল থেকে বেরিয়ে আসা ওর চোখদুটোতে অনেক স্বপ্ন আর হার-না-মানার জেদ দেখতে পেলাম আমি। সে নেমে যেতে, বোরখা পরিহিতা আরেকজন মহিলা উঠলেন। তিনিও ওখান থেকেই ফিরছেন। বললেন, উত্তরপ্রদেশ সরকার এর মধ্যেই সিএএ-র নোটিস জারি করেছে। এই আন্দোলনকে বিচ্ছিন্ন করার অনেক রকম চেষ্টা চলছে। এবং এই সময়ে অন্যান্য সম্প্রদায়ের, সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষের এই আন্দোলনে যোগ দেওয়াটা যে খুবই জরুরি সেটাও বোঝালেন। অনেক পরিণত কথাবার্তা।

বোরখা হিজাবের তলায়ও এসব ভারি-ভারি ব্যাপার চিন্তা করার মতো একটা মস্তিষ্ক, একটা মন থাকে বুঝি! জানতাম না তো! আসলে আমরা বোধহয় এদের পুরোপুরি মানুষ হিসেবেই দেখিনি কোনওদিন! ভেবেছি, আগে তো বোরখা হিজাবের ঘেরাটোপ থেকে বেরোক, তারপর অন্যকিছু করবে! কিন্তু কাকে কোন লড়াইটা আগে লড়তে হবে, সেটা হয়তো পরিস্থিতিই বলে দেয়।

বহুদিনের অচলায়তন ভেঙে আজ এঁরা বাইরে এসেছেন! আরও অনেক লড়াই বাকি! একটা একটা করে পাহাড় ভেঙে এগোতে হবে আমাদের। ফ্যাসিবাদ সে আজাদি থেকে পিতৃতন্ত্র সে আজাদি! এ লড়াই চলবে…