Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

ছোরার একপিঠে লেখা কবিতা

সুদীপ বসু

 

ধরা যাক যুদ্ধ চলছে। সীমানা যুদ্ধ। সৈনিক সেই সীমানা পাহারা দেয়। দিনরাত্তির। আগুনলাঞ্ছিত গ্রীষ্মের ভরদুপুরে সে সীমানা পাহারা দেয়। হেমন্তের নরম জোছনায়, কুয়াশায় সে সীমানা পাহারা দেয়। দিগন্ত এফোঁড় ওফোঁড় করা বৃষ্টিতে সে সীমানা পাহারা দেয়। কোনও কোনও রাতে তার মাথার ওপরে নক্ষত্রের রূপোলি জাল টাঙানো থাকে। তখনও সে সেই সীমান্তেরই প্রহরী। প্রতিটি সূর্যাস্তে আকাশের শরীর ফাটিয়ে দেওয়া প্রাত্যহিক লাল বিস্ফোরণে তার চোখ সয়ে গেছে। তবু দুর্লভ কোনও একটি মুহূর্তে, তার সেই প্রতিদিনের অভ্যাসের জিনিস, সূর্যাস্ত, তাকে আচম্বিতে অবাক করে দেয়। সম্পূর্ণ অকারণে। এবং আমাদের কার্যকারণবিজ্ঞানের ব্যাখ্যার বাইরে। নীলাঞ্জন হাজরার কবিতায় সেই মুহূর্তটির ভাষা ধরা পড়ে যায়। কম্পন ধরা পড়ে। ধরা পড়ে, অনন্তের দিকে ছোটে। সৈনিকের ভাষা এক। প্রেমিকের ভাষা আর এক। কিন্তু সেনানি হৃদয়ে প্রেমের বিস্ময় যে মুহূর্তে জাগে ঠিক সেই মুহূর্তে এক তৃতীয় ভাষার জন্ম হয়। নীলাঞ্জন এই তৃতীয় ভাষাকে কী অনায়াসে নাগালের মধ্যে পেয়ে যান।

এ প্রেম যুদ্ধকালীন। কোথাও আবহের মধ্যে একটা তৎপরতা রয়েছে। কখনও বা যুদ্ধপ্রস্তুতি। সর্বত্র তেমনভাবে কোনও ঘোষণা নেই কবিতায়। তবু অনুভবে যেন ধরা পড়ে একটা অস্থির সময়, হীন ষড়যন্ত্র আর রক্তপাতের কালো দিন, উদ্বেল উৎকণ্ঠা আর তারই মধ্যে প্রেমের জন্য হাহাকার। হৃদয় নয়, একেবারে শরীরকাঁদানো ঝাঁঝালো প্রেম, আকাঙ্খা—

তারায় ভরা তোমার সিঁথি
সাজিয়ে ফেললে সম্পূর্ণ অন্য বিন্যাসে…. কিন্তু মুশকিল হল
তোমার পায়ের চিহ্ন থেকে
ফুটে ওঠা
ফুটে ফুটে ওঠা
রক্তাক্ত কবিতাগুলো
বারবার তোমায় চিনিয়ে দিচ্ছিল।

নীলাঞ্জনের জুলাই ২০১৯-এ প্রকাশিত কবিতার বই ‘না-থাকা-থাকার কিনারে’ আমাদের পায়ে পায়ে এভাবে অবশ করে দেয়। যেমন আর একটি অংশ—

তুমি দেখতে পাও
আমার লাবডাবের
ঠিক মাঝখানে একটা
ছোরা।

অথবা

সাফল্যের মানচিত্র আমার নেই
রয়েছে
মিছিল
আর
তোমার করতল।

ছোট ছোট আশা, আকাঙ্খা, স্বপ্নকে ছোঁওয়ার স্বপ্ন, ভাঙা জীবনের গানকে জ্যান্ত করে চিনিয়ে দিতে নীলাঞ্জন অনর্গল লাইনগুলিকে ভাঙেন। এও এক অস্থিরতা। আর ভঙ্গুর পংক্তির মাঝখানে পড়ে থাকে নির্জন আফশোস, রক্তাক্ত অভিমান—

হৃদয়ীরা নিয়ে চলে গেছে
তোমার দীর্ঘনিঃশ্বাস
খুলে নিয়েছি
সব ক’টা পাল
জাহাজের
ভুতুড়ে

বন্দরবিহীন।

আর একটি কবিতায় পাই—

আমার হৃদয়ের
অরণ্য পরিবৃত
মফস্‌সল প্রাচীন শহরের
খর দাবদাহের আগুন দিগন্তে
থরথর করে কাঁপছে একটা

বিদায়ের চুমু।

কবি জানেন সব মানুষের জন্য অবশ্য এই চুম্বন নয়, যাদের আমরা বিদায় দিতে নারাজ কেবলমাত্র তাদের জন্যই এই বিদায়চুম্বন। ঠিক এই পরিপ্রেক্ষিতেই মনে আসে ২০১৮-তে প্রকাশিত নীলাঞ্জনের ‘অনাথ দূরত্বেরা করাচির কবিতা’ বইয়ের এই কবিতাটির কথা, যেখানে তিনি বলছেন—

সমস্ত রাত্রি ধরে জেরায়

সত্য, সম্পূর্ণ সত্য, এবং সত্য ছাড়া অন্য কিচ্ছু না বলে
আমি জানিয়েছি
তুমি আমায় কখনও কিছু দাওনি

বিদায়ের চুমুও নয়।

এখানে প্রেমিকার উপেক্ষা ও তাচ্ছিল্য যেমন তাঁকে বিক্ষত করেছে, তেমন কালক্রমে তিনিও এই উপেক্ষা শিখে গেছেন, তাচ্ছিল্যকে হাতিয়ার করেছেন। যুদ্ধবিধ্বস্ত শহর, পাকিস্তানি ট্যাঙ্ক, দুদেশের মানুষের মধ্যে রাজনৈতিকভাবে তৈরি করা দূরত্ব, হিংসা হানাহানি যে লেখাগুলির কেন্দ্রবিন্দু ‘অনাথ দূরত্বেরা করাচির কবিতা’ বইটিতে সেই লেখাগুলির মূল সুর কিন্তু প্রেম— প্রেমের অবগাহন, প্রেমের প্রত্যাখ্যান—

পাড়ি দিই শহর থেকে শহরে শহরে
যেখানে যেখানে তুমি

টায়ারের দাগ
আঙুল ছাপের মতো একা

স্বকীয় চিহ্ন রাখে।

কিন্তু কেমন সে প্রেম? তা কি কেবলই নারী-পুরুষের বাসনা-কামনার রক্তমাংসময় অন্ধকার চিৎকার? নীলাঞ্জন লিখলেন—

কিচ্ছু না থেকে যদি
কিচ্ছু নাই হত

তাহলে রেখা থেকে ফুটে বেরোত না এত রক্ত
…বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেওয়া শিশুদের
গালের ওপর টানা
অশ্রুরেখা থেকে

মগজের ওপর টানা
গোষ্ঠী-পরিচয়ের রেখা থেকে

আমার নিঃসঙ্গতার ওপর টানা
তোমার নামের অক্ষরের রেখা থেকে

ফুটে ফুটে বেরোত না এত রক্ত।

আরো আগে ‘হৃদয়ে পানীয় জল নেই’-তে (জানুয়ারি ২০১০) কবির এই হৃদয়াবেগের তীব্রতা আমরা ধরতে পারি, কিন্তু তার মধ্যে আক্ষেপের ক্ষত যেন আরও বেশি দগদগে ছিল বলে মনে হয়।

মৃত্যুর কোনও মুহূর্তে
কেন
দেখতে পাইনি তোমার মুখ?

দহনে দম নেওয়া এ উড়ান
গর্জন ও বাষ্পের প্রতিশ্রুতিতে
নামাতে পারিনি নির্ভুল
তোমার বুকের জ্যামিতিতে।

অথবা

ভাবতে চাই তোমার কথা
মেঘলা কপালে মৃদু ভাঁজ ব্যথা–ছোঁয়া চিন্তার মতো– মানবিক
ভেবে উঠি ঝলমলে দাঁতে ভরা রাতদিন— সাতদিন হাসি
যাকে আর
কাঁদানো যাবে না কোনওদিন।

হারানোর এই ভয় এই না পাওয়ার শিহরণের শিকড় খুঁজতে খুঁজতে পৌঁছে যেতে হয় নীলাঞ্জনের প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘আমি সেই মুখোশ ফেরিওলা’-তে (২০০৯)।

তোমায়
কিছুতেই গুণতে পারিনি সেই সব তারার মধ্যে
কাল সন্ধ্যায় বাগানে ভেঙে পড়েছিল যার টুকরো।

দশ বছর আগে প্রকাশ পাওয়া এই লাজুক কাব্যগ্রন্থটির আত্মা যেন ধরা আছে আমার বিশেষ পছন্দের এই কবিতাটিতে—

শিরা না কাটলে
গোপনই থাকে
তোমার স্বরের খরস্রোত স্মৃতি

বিপদসংকুল পথেই
যেতে হয়
পাহাড়ি নদীর উৎস সন্ধানে

কী প্রয়োজন?
সামাজিক হাঁসেদের সাথে, আহা,
করব না সে কথোপকথন

রুকস্যাক আবার বেঁধেছি।

সময় বদলেছে, পৃথিবীতে সন্ত্রাসের আবহ জটিল ও ভয়াবহ হয়েছে আরো। স্বাভাবিকভাবেই নীলাঞ্জনের কবিতার পরিপ্রেক্ষিত আরও রহস্যময়, সংঘাত-সংকুল ও ধারালো হয়েছে, আরো নাশকতাদীর্ণ, আরও ত্রস্ত হয়ে উঠেছে। যার জ্বলন্ত দলিল ‘না-থাকা-থাকার কিনারে’। পৃথিবীর আকাশবাতাস মেঘরোদ্দুর যত হিংস্র হয়েছে কবিও হয়ে পড়েছেন ততটাই একঘরে, পরিত্যক্ত, একাকী। রেসের মাঠে বাতিল হয়ে যাওয়া ঘোড়ার মতো।

এত অবধি এসে, লেখার প্রায় সন্ধ্যালগ্নের মুখোমুখি পৌঁছে, আমি পাশার দান উল্টে দিতে চাই। প্রশ্ন করতে চাই, নীলাঞ্জন হাজরার কবিতাগুলি কি আদৌ প্রেমের? প্রেমের থেকে আরও অনেক বেশি অভিঘাত নিয়ে কি আসে না অপ্রেম, বিরহ, বিচ্ছেদ? মনে হয় না কি প্রেমিকার সঙ্গে এই দূরত্ব আসলে তাঁর কাঙ্খিত? পূর্ণতায় বিন্দুমাত্র লালসা নেই তাঁর? রবীন্দ্রনাথে পাই— ‘‘আমি বহু বাসনায় প্রাণপণে চাই / বঞ্চিত করে বাঁচালে মোরে।’’ বিচ্ছেদই তো কবিকে বাঁচায়। তাঁকে আবার নতুন করে খুঁজতে সুযোগ দেয়। প্রাপ্তি কবিকে মর্মের মৃত্যু ছাড়া কিচ্ছু দেয় না। বঞ্চনাই তাঁর বাসনা। ‘Satiety has killed more men than hunger’— অন্তত কবির ক্ষেত্রে একথা সত্য। নীলাঞ্জনও তাই প্রেমের ভণিতায় আদতে অপ্রেমই লিখে চলেন। দূরত্বই তাঁর লেখার বিষয়।

চলুন, এই নতুন আলোয় তাঁর কবিতা আবার একবার পড়া শুরু করা যাক।

না-থাকা – থাকার কিনারে । নীলাঞ্জন হাজরা
কলিকাতা লেটারপ্রেস । একশো পঁচিশ টাকা।