অচিন্ত্য প্রান্তর
লেখক রূপান্তরকামী সমাজকর্মী।
২৪ শে জানুয়ারি।
কোলকাতা থেকে সংগঠনের কাজে দিল্লি যাচ্ছি। সকাল ৯টা ৫৫ মিনিটের ফ্লাইট। আগের রাতে মেসেজ এল, প্রজাতন্ত্র দিবস নিকটবর্তী হওয়ার কারণে সুরক্ষা ব্যবস্থা জোরদার করা হয়েছে। যাত্রীরা যেন বিমান ছাড়ার অন্তত তিন ঘণ্টা আগে উপস্থিত হন। আমার সঙ্গীর এমনিতেই উদ্বেগ প্রবল। তাই রাত না পোহাতেই দরজায় হাজির।
পৌঁছনোর পর দরজায় দাঁড়ানো সিআইএসএফ সচিত্র পরিচয়পত্রের সঙ্গে আমার মুখ বার পাঁচেক মেলালেন। পেছনে দাঁড়িয়ে থাকা যাত্রীদের মধ্যে ততক্ষণে ফিসফাস, ইশারা, খোঁচা শুরু হয়ে গেছে। পৌঁছলাম বোর্ডিং কাউন্টারে। এক তরুণী সুহাসিনী স্মিত হাসি এবং অস্বস্তিপূর্ণ দৃষ্টিতে বোর্ডিং পাশ হাতে দিলেন। ততক্ষণে আমার বুক দুরুদুরু শুরু হয়ে গেছে।
দুটিই লাইন। পুরুষদের ও মহিলাদের। দেখতে পাচ্ছি পুরুষ যাত্রীদের খোলা যায়গায় শরীরে হাত বুলিয়ে পরীক্ষা চলছে। মহিলাদের লাইনে দাঁড়ালে সহযাত্রী বা মহিলা নিরাপত্তা রক্ষীদের অস্বস্তি হতে পারে, ভাবতে ভাবতেই এগিয়ে গেলাম নিরাপত্তারক্ষীদের ঘেরাটোপের কাছে। পরের কথাবার্তা এইরকম—
আমি— আমি একজন ট্রান্সজেন্ডার। পুরুষদের লাইনে দাঁড়িয়ে খোলা জায়গায় দেহ তল্লাশিতে আমি স্বচ্ছন্দ নই। মহিলাদের বেষ্টনীতে দাঁড়াতে পারি?
রক্ষী— প্রমাণপত্র আছে?
আমি— নতুন আইন অনুযায়ী আবেদনের প্রক্রিয়া শুরু এখনও শুরু হয়নি।
রক্ষী— কাগজ দেখাতে হবে। নাহলে কী করে…।
আমি— আমায় দেখছেন, তাও কাগজ চাই…!
পিছনে তখন গুঞ্জন; এই দেখো, “দাড়িওয়ালা হিজড়ে”, “আজকাল প্লেনেও…!”
আমি ভয়, উৎকণ্ঠা চেপে বলে উঠলাম— “দেশে ট্রান্সজেন্ডার আইন হয়েছে, সেই অনুযায়ী আমার মুখের কথাই তো যথেষ্ট…! আর কাগজও তো আমার কথাতেই দেবে।”
রক্ষী— বুঝলাম। কিন্তু কোনও অর্ডার নেই। দাঁড়ান দেখছি।
হাজার চোখের এক্স-রে শরীরের ওপর খেলা করছে তখন। মাথা ঠান্ডা রেখে এগোলাম রক্ষীর সঙ্গে। না, কোনও লাভ হল না।
–শুনুন পুরুষদের লাইনেই দাঁড়াতে হবে। বুকের ওড়নাটা খুলে এগিয়ে আসুন।
উঁচু কাঠের পাটাতনের ওপর দাঁড়ালাম, দুহাত তোলা, পরনে সালোয়ার। সারা শরীর জুরে রঞ্জন-রশ্মির খেলা চলছে। আর মাথার ভেতরে হাতুড়ি পিটছে। মেটাল ডিটেক্টরটি পুরো দেহ ঘুরে নেমে এল দুপায়ের ফাঁকে। সালোয়ার সমেত উপরে উঠতে থাকল। আচ্ছা, আজকাল আর মাটি ফাঁক হয় না? সম্বিত ফিরল বোর্ডিং পাশের উপর স্ট্যাম্প মারার শব্দে। কান, মাথা ঝাঁ ঝাঁ করছে। চোখে অন্ধকার। আলতো হাতে আমাকে ধরে জলের বোতল এগিয়ে দিলেন আমার সঙ্গী।
২০১৪ সালে সুপ্রিম কোর্ট আমাদের নাগরিক স্বীকৃতি দিয়েছে। তাতে পরিষ্কার করে ট্রান্স নাগরিকদের মর্যাদা রক্ষার নির্দেশও দেওয়া আছে। তারপর পাঁচ-পাঁচটি বছর ধরে বিস্তর দরকষাকষির পর পার্লামেন্ট এবং কেন্দ্রীয় সরকার ট্রান্সজেন্ডার আইন চালু করেছেন। সেটাতেও (অন্যান্য অনেক বির্তক থাকা সত্ত্বেও) CHAPTER II-এর “Prohibition against discrimination” section-এর পাঁচ নম্বর পয়েন্টে স্পষ্টভাবে বলা আছে:
No person or establishment shall discriminate against a transgender person on any of the following grounds, namely:-
The denial or discontinuation of, or unfair treatment with regard to, access to, or provision or enjoyment or use of any goods, accommodation, service, facility, benefit, privilege or opportunity dedicated to the use of the general public or customarily available to the public;
এটির বয়সও প্রায় একমাস গড়াতে চলল, অথচ কেন্দ্রীয় সরকারের গুরুত্বপূর্ণ বিমানমন্ত্রক এবং সিআইএসএফ জানেন না আমাদের নিয়ে কী করবেন। এমনকি বিমানবন্দরে নেই পৃথক শৌচাগারও। বুঝে দেখুন, গ্ৰামে-গঞ্জে, শহরতলিতে আমাদের জীবন কোন ধারায় বইছে…!
ছোটবেলা থেকে শুনে আসছি ‘মেয়েলি’, ‘ছক্কা’, ‘লেডিস’, ‘ফিফটি-ফিফটি’, ‘ভগবান মেয়ে বানাতে বানাতে ছেলে বানিয়ে ফেলেছেন’ এই শব্দ বা বাক্যবন্ধগুলি। সেই বয়সে নিজের সহজাত প্রকাশভঙ্গি নিয়েই শরমে, কুণ্ঠায় মরে থাকতে হত। প্রয়োজনের বাইরে কারও সঙ্গে একটা কথাও বলতাম না পাছে অসাবধানে আমার অন্তরের সত্য প্রকাশ হয়ে পড়ে। একটা মিথ্যে আবরণে নিজেকে ঢেকে-ঢুকে রেখেছিলাম জন্ম ইস্তক। প্রকাশ্যে “নারীসুলভ” বেশ তো অকল্পনীয় বিষয় ছিল। তবু শেষ রক্ষা হয়নি। সেইসময় থেকে শুরু করে আজ অবধি কারও তো বুঝে নিতে অসুবিধে হয়নি যে আমি “অন্যরকম”। আকারে-ইঙ্গিতে, শ্লেষে, বিদ্রুপে, কৌতুকে নানাভাবে নিগৃহীত ও ব্যবহৃত হয়ে এসেছি। প্রতিটি ক্ষেত্রে সোচ্চারে বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে আমি ‘বেমানান’ (পড়ুন অস্বাভাবিক)। তখন তো কেউ কোনও ‘প্রমাণপত্রে’র ধার ধারেনি। আর আজ যখন স্ব-পরিচয়ে সম্মান দাবি করছি, তখন রাষ্ট্র “কাগজ” চাইছে…! এই দুটি ক্ষেত্রেই কিন্তু একটি বিষয় তার গনগনে উপস্থিতি নিয়ে বর্তমান। সেটি হল অপমান। পিতৃতন্ত্রের ভীড়ে পা না মেলানোর শাস্তি।
দেশের সর্বোচ্চ আদালত যখন আমাদের ক্ষেত্রে দৈহিক লিঙ্গ ও জেন্ডারের ভিন্নতাকে সসম্মানে স্বীকৃতি দিয়েছেন। তখন উল্টোদিকে পিতৃতন্ত্র অন্য এক ফাঁদ পেতেছে। সে বলছে— বেশ মেনে নেওয়া গেল মানসিক লিঙ্গের অস্তিত্ব। অন্তরের সত্তাই যখন আসল তখন দেহের এই “ত্রুটি”-কে সারিয়ে নেওয়াই কি জরুরি নয়? আর এই ভাবনা থেকেই শুরু হচ্ছে নিজের “ভুল” শরীরকে কেটে ছেঁটে দৈহিক পূর্ণতা প্রাপ্তির “মহিমান্বিত” যাত্রা। লক্ষ লক্ষ টাকা খরচ করে দেহরোম গ্ৰন্থিকোষ পুড়িয়ে, হাজারো সার্জারির কষ্ট সহ্য করে চলছে পুরোদস্তুর “নারী” বা “পুরুষ” হয়ে ওঠার প্রক্রিয়া। তাতে টাকা যায় যাক, মৃত্যু হয় হোক, তথাকথিত “পূর্ণতাপ্রাপ্তি”-র এই লড়াইয়ে সব আহুতিই তুচ্ছ।
মজার কথা, ঠিক যেমনভাবে পিতৃতন্ত্র মূলধারার নারী বা পুরুষদের সামাজিক নিয়মের কঠোর ধারাপাতের মাধ্যমে আঁটোসাঁটো করে খোপে বেঁধে রাখতে চায়, আমাদের ক্ষেত্রেও তার ব্যাতিক্রম হয় না। বরং এই দৈহিক ত্রুটির মাসুল দিতে হয় বহুগুনে।
তবু আশার কথা যে মূলধারার নারী, পুরুষ উভয় ক্ষেত্র থেকে পিতৃতন্ত্রের বিরুদ্ধে আওয়াজ উঠছে। নারীবাদীদের হাত ধরে মহিলাদের আন্দোলনের সঙ্গে সঙ্গে পুরুষরাও যোগ দিচ্ছেন পিতৃতান্ত্রিক চর্চার বিরুদ্ধে। তৈরি হয়েছে এই আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে প্রচুর সময়োপযোগী ক্যাম্পেন।
তাই ট্রান্স নাগরিকদের কাছে এটাই প্রশ্ন— আমরা কি এই প্রচলিত খোপের যন্ত্রণা মেখে এই আপাত স্বস্তির জীবন বেছে নেব? নাকি চোখে চোখ রেখে বলব “আমি যা, আমি তাইই”…।