হিন্দোল ভট্টাচার্য
কবি, গল্পকার, গদ্যকার, ঔপন্যাসিক।
বলতে পারেন, আমরা রোজ কেন এভাবে বিলাপ করছি? আমরা কি জানি না যে দেশে আমরা আছি, সেটা একটা হিন্দুরাষ্ট্র? হিন্দু ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্র। আর কতবার কত মানুষ বারংবার তুলনা, প্রতিতুলনায় দেখাবে জার্মানিতে এই হয়েছিল, ইতালিতে ওই হয়েছিল, এরা কিন্তু ফ্যাসিস্ট, এরা ক্ষমতায় থাকলে কিন্তু পুলিশ মিলিটারির সহযোগিতায় সংগঠিতভাবে সন্ত্রাস চালাবে। আমরা কি জানতাম না এমন একটা সময় আসতে চলেছে? আমরা কি এও জানি না, আমাদের মধ্যে অধিকাংশ মানুষের মনের মধ্যে সাম্প্রদায়িক হিংসা এবং প্রতিহিংসা তৈরি করে দিয়েছে এই হিন্দু ফ্যাসিস্টদের দল। জার্মান গেস্টাপো বাহিনীর মতো কাজ করছে আমাদের প্রশাসন। হিন্দু ফ্যাসিস্টদের দল এই দেশের সেনাবাহিনী এবং পুলিশের সহযোগিতায় এখন প্রত্যক্ষভাবে দাঙ্গা করছে। মুসলিম নিধন করছে। জোর করে, অস্ত্রের মুখে জাতীয় সঙ্গীত গাওয়ানোটা তো কোনও গণতান্ত্রিক দেশের কাজ হতে পারে না। কিন্তু এ কথা এখন কাউকেই বলে কি কোনও লাভ আছে? আপনি কীসের জন্য আপনার প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করার জন্য একটা সংখ্যা করতে চলেছেন? কী মনে হয় লোকে পড়বে? আমার তো এখন মনে হয় হিটলারের ইহুদিনিধন, আউসউইতজ— এইসব লোকে পছন্দ করে। তারা চায় এমনটা আসুক। কয়েকদিন আগে আমার এক বান্ধবী বললেন, তাঁর কলেজের সহকর্মী তাঁকে বলেছেন কতদিন আর লুঙ্গিড্যান্স চলবে! আপনি ভাবতে পারছেন? দেখেছেন কীভাবে দিল্লিতে আগুন জ্বালিয়েছে? একে আপনি সংগঠিত সন্ত্রাস বলবেন না তো কাকে বলবেন? সারা দেশে মুসলিমরা বিপন্ন। তাদের নৃশংসভাবে হত্যা করবে এই দেশের সরকার। আমরা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখব। দেখতেই হবে। কারণ আপনি বেশি কথা বললে আপনাকে ওরা দেশদ্রোহী আখ্যা দিয়ে জেলে ঢুকিয়ে রাখবে। হয়তো এই দেশে আউসউইতজ হবে না, কিন্তু প্রত্যক্ষভাবে দিল্লির রাজপথে চালু হতেই পারে হাড়িকাঠ। বিরোধীদের টেনে নিয়ে গেল আর হাড়িকাঠে বসিয়ে শেষ। গিলোটিনে আলপনার আর সম্ভাবনা নেই। বরং আসতে চলেছে হিন্দু ফ্যাসিস্টদের নরমেধ যজ্ঞ। এই যজ্ঞ শুরু হয়ে গেছে। মুসলিম নিধন, বিরোধী নিধন, কণ্ঠরোধ, দেশদ্রোহিতার অপরাধে গ্রেফতার, রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস চলছেই। শুধু এ দেশকে স্বীকার করতে হবে যে এই দেশ এখন আর গণতান্ত্রিক কোনও দেশ নয়। গণতান্ত্রিক কোনও দেশে গতকালের মতো কোনও ঘটনা ঘটতে পারে না। রামের নামে বা দেশের নামে বা জাতীয়তাবাদের নামে মানুষের উপরে এত সন্ত্রাস নেমে আসতে পারে একমাত্র ঘোষিত এক ফ্যাসিস্ট দেশে। আপ-এর মতো মৃদু হিন্দুত্বের পার্টিগুলি যতই ভারসাম্য বজায় রাখার আইওয়াশ দেওয়ার চেষ্টা করুক না কেন, মানতেই হবে, মৃদু হিন্দুত্ব আর এই উগ্র হিন্দুত্বের বিরুদ্ধে কিছুই করতে সক্ষম নয়। আপনার ঘেন্না লাগছে না নিজেকে এই দেশের বাসিন্দা বা নাগরিক হিসেবে ভাবতে? আপনার ভয় লাগছে না? আত্মপ্রসাদের জন্য এই লেখা আমিও লিখছি আর আপনাকে পাঠাচ্ছি। কিন্তু কী হবে? এই লেখার কোনও ক্ষমতা নেই। কোনও লেখাই আর কোনও মানুষের মধ্যে কোনও অনুভূতিমালা তৈরি করতে পারছে না। তাহলে তারা সকলে মিলে আজকেই সব কিছু ফেলে গর্জে উঠত। গৃহযুদ্ধ বেঁধে যেত। তা বাঁধছে না। আমরা অদ্ভুতভাবে সহিষ্ণু হয়ে পড়েছি। ওরা যত আক্রমণের, ফ্যাসিস্ট অত্যাচারের মাত্রা বাড়াচ্ছে, আমরা ততই সহিষ্ণু হয়ে পড়ছি। আমাদের চোখের সামনে মুসলিম ভাই বন্ধু আত্মীয়দের হত্যা করছে, তাদের মানবিকতাকে হত্যা করছে, তাদের অন্তরাত্মাকে ধর্ষণ করছে। কাল তাদের হয়তো পুঁতে ফেলবে হিন্দুরাষ্ট্রের শ্মশানভূমিতে। আমরা কী করতে পারি বলবেন? এতকাল ধরে এত লোকে তো বললেন, বিজেপিকে ভোট দেবেন না ভোট দেবেন না, কিন্তু মানুষ বিজেপিকে ভোট দিলেন। এই রাজ্যেও দিলেন। এই রাজ্যেও সকলের সামনে দিলীপ ঘোষ বিরোধীমাত্রেই গুলি করে মারার নিদান দেন। সকলের সামনে বলেন সিএএ-র যারা বিরোধিতা করবে, তাদের গুলি করে মারা হবে। আমরা সহ্য করে নিচ্ছি। আজ দিল্লিতে বিভিন্ন জায়গায় মোদির মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালীন যেভাবে আমেদাবাদে পুলিশ প্রশাসনের সহায়তায় হিন্দু ফ্যাসিস্টদের দল সংগঠিত হত্যাকাণ্ড, অগ্নিকাণ্ড চালিয়েছিল, তেমন-ই হয়েছে, হচ্ছে। আগামীকাল তা কলকাতাতেও হবে। আমরা তখনও বসে বসে ভাবব এমন কেন হয়ে গেল! এমনটা তো ছিল না আমাদের দেশ। আর তার পর হয়তো আমরা আবার অক্ষরে অক্ষরে আমাদের বিষণ্ণতা ব্যক্ত করব, আর ওদিকে আবার কোনও জায়গায় আগুন জ্বলবে। বিরোধী কণ্ঠ তুললেই, তাকে হাড়িকাঠে বসিয়ে জাতীয়সঙ্গীত গাইতে, জয় শ্রীরাম বলতে বাধ্য করবে এই ফ্যাসিস্টদের দল। আপনি কী করবেন? আমরা কী করব? জানি না। অসহায় লাগছে খুব? সকলের লাগছে কি? না কি তারা তাদের মনের ভিতরে থাকা হিন্দু সাম্প্রদায়িক সত্তাকে ভালো করে বিরিয়ানি খাইয়ে চাঙ্গা করে তুলছেন? ভালো লাগছে না। অনেক ইতিহাসের অ্যানালজি দেওয়া হয়েছে। এখন ফ্যাসিস্টরাই স্বীকার করছে তাদের সঙ্গে নাজিদের তুলনা টানা যায়। তাই এই কথাগুলি আর বলার মতো কোনও কথা নয়। মোদ্দা কথা হল, আমাদের এখন কিছুই বলার নেই। সকলেই সবকিছু জানেন। দেখতেই পাচ্ছেন। আমি, হিন্দুধর্মের কোনওকিছুই না মেনে, তবু আমার পিতৃ-মাতৃপ্রদত্ত নামের জন্য আমার মুসলিম ভাই বন্ধু আত্মীয়দের কাছে ক্ষমা চাইছি। কারণ যে গ্যাসচেম্বারের মধ্যে আপনাদের দিন কাটাতে হচ্ছে, তার মধ্যে অন্তত আমাদের কাটাতে হবে না। কিন্তু জানি, একদিন কাটাতে হবে। কারণ আমরা তো জন্মসূত্রে হিন্দু হলেও হিন্দু নই, যেভাবে জন্মসূত্রে জার্মান হলেও নাজি ছিলেন না এমন অনেক জার্মানকে আউসউইতজে হত্যা করা হয়েছিল, দেশ থেকে বের করে দেওয়া হয়েছিল। আমাদের তেমন অবস্থা হবে। অথবা হয়তো আরও খারাপ অবস্থা আমাদেরও হবে। হয়তো বাড়ির সামনেই কুপিয়ে মারা হবে। জানি না কী হবে। শুধু এইটুকু জানি, আমি একটা হিন্দু ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্রের বাসিন্দা। এখন যা খুশি হতে পারে। যখন যা খুশি। প্রস্তুত থাকতে হবে। এক তীব্র অন্ধকার সময়ের মধ্যে আমরা সকলেই আছি। এখন ইতিহাসের কাছে নিজেদের ভূমিকাটুকু পালন করে যাওয়া ছাড়া আর কিছুই হয়তো করার নেই।