ইন্দ্রাণী দত্ত
১
এবারে বর্ষার পরে পরিতোষের বাড়ির দরজা সহজে খুলছিল না— কসরতের প্রয়োজন হচ্ছিল রীতিমত। মালিনীর তুলনায় পরিতোষ আগে ফেরে— ফলে ভুগতে হচ্ছিল তাকেই; এই পরের রবিবারেই পুলককে ডেকে চাবি বদলাবে, নতুন লক বসাবে ঠিক— ভেবে নিলেও হয়ে ওঠেনি।
সেদিন জ্বর এসেছিল পরিতোষের— ভরদুপুরে বাড়ি ফিরে চাবি ঘোরাচ্ছিল; অফিসে প্রায় দেড় বোতল জল খেয়েছে— তলপেট ফেটে যাচ্ছে, মাথা ছিঁড়ে পড়ছে যন্ত্রণায়— এদিকে দরজা খুলছে না। চাবিই ঢুকছিল না প্রথমে— পরিতোষের মনে হল তবে কি জ্বরের ঘোরে ভুল চাবি ঢোকাল সে— ব্যাগ হাতড়ে নিশ্চিন্ত হয়েছিল তারপর। ছ ছ বারের চেষ্টায় যাও বা চাবি লকে ঢুকল, তাকে বাঁ দিক ডান দিক কোনওদিকেই ঘোরানো যাচ্ছে না— পরিতোষের মনে হল এইবার ওর প্যান্ট ভিজে যাবে কিংবা দোরগোড়াতেই ধড়াস করে পড়ে অজ্ঞান হয়ে যাবে। পাশের বাড়িতে গিয়ে দরজা ধাক্কা দেবে নাকি মালিনীকে মেসেজ করে পুলকের মোবাইল নম্বর চাইবে অথবা ফোন করবে প্রাণের বন্ধু সমরেশকে— অসম্ভব দ্রুততায় ভাবছিল পরিতোষ— প্রবাসী জামাই মেয়েকে ওয়াটসঅ্যাপ করে কোনও লাভ হবে কি না এ চিন্তাও সম্ভবত ঝলক দিয়েছিল ওর মনে, তারপর হেসে ফেলেছিল। এইসময় চাবি ঘুরল, পরিতোষ ঠেলা দিল দরজায়— খুলল না; যেন উল্টোদিক থেকেও কেউ সমপরিমাণ বলপ্রয়োগ করছে, বানচাল করে দিচ্ছে পরিতোষের চেষ্টা। এবার শরীরের সমস্ত জোর দিয়ে ধাক্কা দিল সে— ভেঙে গেলে যাবে— কাতরে উঠে খুলে গেল দরজা। দৌড়ে ঢুকল পরিতোষ আর ঝুলন্ত উইন্ড চাইম ওর মাথায় ঠুকে গিয়ে টুং টাং বেজে উঠল। সোফায় ব্যাগ ছুঁড়ে বাথরুমের দিকে স্প্রিন্ট নিতে নিতে বারান্দা ভরা রোদ আর হাওয়া টের পেল সে— রুপোলী গ্রিল তেতে উঠে রোদ আর মরচের গন্ধ আসছিল, গেরস্থালির বিবিধ ঘ্রাণ মিশছিল তাতে— রান্নাঘর থেকে গতরাতের ডালের ফোড়নের বাস, বাথরুম থেকে সাবান শ্যাম্পু আফটার শেভের গন্ধ যেন হই হই করে পরিতোষকে ঘিরে ধরেছিল। পরিতোষের মনে হল, রোদ খাচ্ছিল বাড়িটা— একলা আর এলোথেলো— পরিতোষকে ঢুকতে দিতে যেন দেরি করছিল তাই; আর এই যে সে ঢুকল, ঘণ্টা বেজে উঠল— রোদ, হাওয়া, বিবিধ ঘ্রাণের এই যে ঘিরে ধরা— অসময়ে পরিতোষের বাড়ি ফেরায় এ যেন এক উৎসবের সূচনা— সে যেন এক পুরাকালের রাজপুত্র, বহু দিন অনুপস্থিতির পরে প্রাসাদে ফিরেছে আর ওর উষ্ণীষ ঠেকে গেছে মন্দিরের ঘণ্টায়, সাজ সাজ রব উঠেছে রাজ্যে। চাদর মুড়ি দিয়ে শুয়ে শুয়ে আরও ভাবছিল পরিতোষ— এই যে সে অপেক্ষা করছিল বাইরে, ঘামছিল, ভয় পাচ্ছিল, অথচ চাবিটা খুলে যেতেই সব অন্যরকম। চকিতে মৃত্যুর কথা মনে হয়েছিল পরিতোষের তারপর রিটায়ারমেন্টের। সামনেই পরিতোষের রিটায়ারমেন্ট, এতদিন যেন ভয়ে ভয়ে ছিল সে— কী করবে, কীভাবে বাঁচবে অফিস না গিয়ে। অথচ সেই দুপুরে আধো তন্দ্রায় হাল্লার রাজা হয়ে গেল পরিতোষ— রোদভরা বারান্দায় ছুটি ছুটি বলে দৌড়ে বেড়াতে লাগল হাততালি দিয়ে।
অবসরের দিন অবশ্য মেঘ ছিল আকাশে। পরিতোষ চুপচাপ। ফুল টুল, উপহার হাতে করে বাড়ির সামনে দাঁড়িয়েছিল— দুপাশে মালিনী আর সমরেশ। ঘন সাদা রেখা তৈরি হচ্ছিল আকাশে— একটেরে আর উজ্জ্বল।
–কোদালে কোপানো মেঘের গা— মালিনী কথা শুরু করতে চাইছিল।
–রথের চাকার দাগের মত, না কি সাইকেল চলে গেছে?— সমরেশ সিগ্রেট ধরাল।
সাইকেল শব্দটা অথবা সিগ্রেটের ধোঁয়া যেন একটা কথোপকথনের পরিসর তৈরি করল আচমকা।
দরজা খুলতে খুলতে পরিতোষ বলে উঠল— আমাদের ক্লাস সেভেনের সেই প্ল্যান, মনে পড়ে তোর?
–আবার কী প্ল্যান? এবারে পায়ের ওপর পা তুলে আরামই আরাম— সিগ্রেটের ধোঁয়া ছেড়ে সমরেশ বলেছিল।
–সেই যে অপেক্ষার প্ল্যান! মৃত্যুর জন্য। মনে নেই?
–যত্ত বুড়োটেপনা! লোকে যেন আর রিটায়ার করে না! বোঝান তো আপনার বন্ধুকে। আমি কবে থেকে বলে চলেছি— আর কোথাও জয়েন করো। কন্সালটেন্সিও খুলতে পারো। পাপিয়ার বর তো— এখন আবার কী সব প্ল্যানের কথা বলছে দেখুন…
মালিনী গম্ভীর হল।
–ঐ কন্সালটেন্সি ফেন্সি আমার দ্বারা হবে না। অনেক কাজ করেছি। দুর দুর— আর না।’
–কেউ কি তোমাকে জোর করছে? কিন্তু এই তো রিটায়ার করলে, আজই মরে যাওয়ার কথা শুরু করতে হবে? বাড়িতে বসে এইভাবে ব্রুড করলে তো আরওই বুড়ো হয়ে যাবে…
–ব্রুড করব কেন? অপেক্ষা করব। খুব সুন্দর অপেক্ষা। ছোটবেলা থেকে ভেবে রেখেছি।
–উফ আবার সেই মৃত্যুবিলাস! এই তো ব্রুড করা!
–সেই পাগলামি তোর এখনও যায়নি রে?
–নতুন কিছু পাগলামি, সমরেশদা? আমি জানি না? বসুন আগে। চা আনি।
–আজ আর বসব না, একটু ডাক্তারের কাছে যাব। জাস্ট রুটিন চেক আপ। আরে, পাগলামি মানে, স্কুলে থাকতে আরোগ্য নিকেতন পড়ে বেজায় আফশোস হয়েছিল আর কি— আহা শেষ অবধি দেখতে পেলেন না! আমরা দুজনেই ভেবেছিলাম জীবনমশাই শেষ অবধি যা পারেননি আমরা সেটা পারব। হা হা— তখন আমাদের বছর বারো বয়স— কী করিতে হইবে গোছের প্ল্যান করেছিলাম বঙ্গলিপির পাতায়— এক দুই তিন করে পাঁচ নম্বরে বোধহয় ছিল, ঝাঁটার শলা দিয়া চোখের পাতায় ঠেকা দিতে হইবে যাহাতে বুজিয়া না যায়।
–ভ্যাট! সত্যি! ‘কালিদা’র কথা জানি তবে এই গল্পটা জানতাম না তো! আপনারা যে কী ছিলেন! উফ! এখনও অবশ্য ইনি এইরকমই। বুড়োবয়সে উল্টোপাল্টা কিছু না করলেই হল!’
পরিতোষ হেসে বলল— এই দ্যাখো, তুমিই বুড়ো বললে আমাকে! কী আবার করব!
–কী করবে আগেভাগে জানলে গৃহস্থ নিশ্চিন্ত হয় এই আর কী— নয়তো…
–এখনও ভাবিনি— বলেছিল পরিতোষ। ফুলদানিতে হাতের ফুল রাখল নিজেই। তারপর মিষ্টির বাক্স ফ্রিজে ঢুকিয়ে উপহারের মোড়ক খুলতে শুরু করল। পরিতোষের দিকে এক পলক তাকাল মালিনী। চোখ নামাল। তারপর রান্নাঘরে গিয়ে চা বসিয়ে দিল।
২
কিছুই না করে সপ্তাহ দুই কাটল। এই যে নিয়ম করে সকালে ওঠা, চা, স্নান, দাড়ি কাটা এতবছর তাকে চালনা করেছে, তার থেকে নিস্তার পেয়ে খোঁচা খোঁচা দাড়ি, ঈষৎ উস্কো খুস্কো, গেঞ্জি পাজামার আর এক পরিতোষকে সে নির্মাণ করল কিছুদিন। তারপর আয়নায় নিজেকে দেখল বারেবারে, চোখ বন্ধ, মুখ হাঁ সেল্ফি তুলল কয়েকটা— টাচস্ক্রিনে আঙুল চালিয়ে ছবিগুলো দেখল আর ডিলিট করল, দাড়ি কামিয়ে চুল আঁচড়ে আবার ফিটফাট হল।
এরপর একটা রুটিনে ঢুকে গেল সটান। বইয়ের আলমারিতে বহুদিন পরে আবার তার হাত পড়ল। মহাভারত টেনে নামাল, তারপর আরোগ্য নিকেতন, মিসেস ড্যালাওয়ে, কোল্ড মাউনটেন, এমপারার অফ অল ম্যালাডিজ, এমনকি অভেদানন্দও— কলেজ স্ট্রিট হানা দিল বার দশেক, অন লাইন অর্ডার করল কিছু—
মালিনী কলেজে বেরিয়ে যায় সকালে, তারপর পড়ার টেবিলে পরিতোষ, তার ল্যাপটপ, প্রেশারের ওষুধের ফয়েল, জলের বোতল আর বই। সামনে বারান্দা ভরা রোদ, হাওয়া, বারান্দার ওপারে এক চিলতে ঘাসজমি— বাঁদিকের জানলা দিয়ে রাস্তা দেখা যায়— মানুষজন, সাইকেল, রিক্সা, অটো অথবা গাড়ি। ক্রমশ রোদ কমে, ছায়া দীর্ঘ হয়; রাস্তার বাতি জ্বলে উঠলে মালিনী ফেরে। ‘কী পড়ছ… কী পড়লে… আজ কলেজে এই হল, সেই হল… আর ভালো লাগে না’— মালিনীর কথায়, দৃষ্টিতে সতত উদ্বেগ আর জিজ্ঞাসা— টের পায় পরিতোষ। কথা বলতে বলতে রাতের খাবার গরম করে মালিনী, গা ধোয়। খাওয়ার পাট মিটলে কলেজের খাতা, নিজের পড়াশোনা, টুকটাক ফোন, স্কাইপে মেয়েজামাই— পরিতোষও ফিরে যায় পড়ার টেবিলে। তারপর ঘুম।
অজস্র বই পড়ছিল পরিতোষ বাংলায় ইংরিজিতে— গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ; সে পড়ছে, নিজের মত করে মৃত্যুর একটা ছবি এঁকে নিতে চাইছে মনে মনে, ওদিকে তার পায়ের কাছে রোদ সরছে, সকাল গড়িয়ে দুপুর, দুপুর গড়িয়ে বিকেল, জানলার বাইরে জীবনের স্রোত বয়ে চলেছে— বস্তুত পড়ার টেবিলেই যেন তার বসবাস। এইভাবে পড়তে পড়তেই মৃত্যুর সামনাসামনি হওয়ার আকাঙ্খা করছিল পরিতোষ— মৃত্যু যেন তার উল্টোদিকের চেয়ারে এসে বসবে আর পরিতোষ জিজ্ঞেস করবে— ‘আরে কালিদা, কেমন আছেন? চা খাবেন? চিনি ক চামচ?’ তারপর বারান্দার রোদে পা দোলাতে দোলাতে চা খাবে মৃত্যু, ওর বই উল্টে পাল্টে দেখবে, পরিতোষও দেখে নেবে তাকে, মিলিয়ে নেবে বইয়ের সঙ্গে, তারপর বাথরুম ঘুরে চুলটুল আঁচড়ে নিয়ে বলবে— ‘চলুন কালিদা, ওঠা যাক…’
মাস কয়েক এইভাবেই কাটল। বাড়ি থেকে খুব একটা বেরোতে চাইত না পরিতোষ— নিমন্ত্রণ, মল টল, সিনেমা যেতে বেজায় বিরক্তি। মালিনী ঘন ঘন পাপিয়ার বরের প্রসঙ্গ তুলছিল আর হেসে উড়িয়ে দিচ্ছিল পরিতোষ। বস্তুত এই বাড়ি, এতকালের সংসার, দৈনন্দিন এমনকি মালিনীর থেকেও নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে নিতে চাইছিল সে, যেন ওর বারো বছর বয়সে ফিরতে চাইছে; সমরেশকে সঙ্গে করে মৃত্যু মোলাকাতের আবার একটা প্ল্যান করা যাক— এরকম ভাবছিল। সমরেশ যথারীতি ওর নাটক, গানবাজনা নিয়ে মহাব্যস্ত। একলা একলা ক্লান্তিকর লাগছিল ক্রমশ— পরিতোষের মনে হচ্ছিল ওর এই অপেক্ষার সাক্ষী থাকুক কেউ— যে ওর এই প্রতিটি মুহূর্তর হিসেব রাখবে, অনেকটা রিয়ালিটি শোয়ের ক্যামেরার মত। সমাধান হিসেবে ওর মনে হয়েছিল এই যে ওর পড়ার টেবিল— এখানে পিঁপড়ে, মশা, মাছি এই সব বাদ দিয়ে জীবন্ত একটা কিছু দরকার— পার্মানেন্ট কিছু— যে পরিতোষের মতই টেবিলেই খাবে, টেবিলেই ঝিমোবে। গাছ আর মাছ ছাড়া মাথায় কিছু এল না। মাছ রাখার হ্যাপা অনেক— জল বদলাও, মেপে মেপে খাবার দাও, হ্যানা ত্যানা কত কী— মাছ তো মরে টরেও যায় তাড়াতাড়ি। ছোট একটা ফিসবোল রাখা যেতে পারে অবশ্য তবে জল বদলানোর সময় হাত ফস্কে গেলে সর্বনাশ— একবার বাঁ আরেকবার ডানহাত ওপর নিচ করে মাথা নাড়ল পরিতোষ। গাছই ভালো। মালিনীও তাই বলেছিল।
বইয়ের দোকানের বদলে নার্সারি গেল সে। সারি সারি ফুলগাছ, টব, বীজের প্যাকেট, চারা ও সারের বস্তা— বাগান করার হাজার সরঞ্জাম সেখানে। পরিতোষ খুরপি দিয়ে মাটি খুঁড়ছে, জল দিচ্ছে, ওকে ঘিরে গোলাপ, গাঁদা, জুঁই, টমেটো, শিম, বরবটি; পরিতোষ হয়ত সবে আগাছা তুলে কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়িয়েছে, কপালে ঘাম, সাদা গেঞ্জিতে মাটি— হঠাৎ দেখল সূর্যমুখীর আর ডালিয়ার মাঝখানে দাঁড়িয়ে মৃত্যু মুখ টিপে হাসছে— শুক্রবার বিকেলে শিয়ালদা নার্সারিতে এইরকম একটা অপেক্ষার কল্পনা করতে লাগল পরিতোষ— বাগানপর্বের সেই শুরু।
বাগান বলতে বারান্দা, ছাদের টব আর সামনের একচিলতে ঘাসজমি। পড়ার টেবিল ছেড়ে এখন প্রায় সব সময়েই ঘরের বাইরে পরিতোষ— মাটিমাখা হাতে খুরপি, সার, জল।
সেদিন তুমুল বৃষ্টি হয়ে গিয়েছিল। ভারি বর্ষণ শেষ হয়ে হাল্কা এক পশলা— তারপর পশ্চিমে আকাশ পরিষ্কার হয়ে আসছে, মেঘ ছেঁড়া আলো পড়েছে পরিতোষের বারান্দায়, কোণের টবে ঝুমকোলতা; বাদুলে বাতাসে কেঁপে কেঁপে উঠছে বেগনে পাপড়ি ও পাতা, ভিজে লাল বারান্দায় তার অস্পষ্ট লাইলাক প্রতিফলন, শিকর গড়িয়ে পড়ছে— পরিতোষ চৌকাঠে দাঁড়িয়ে দেখছিল; এই মুহূর্তকে ওর বড় ভঙ্গুর মনে হচ্ছিল— বারান্দা সামান্য শুকোলেই অথবা আলোটুকু ঈষৎ সরে গেলেই চুরচুর হয়ে ভেঙে যাবে সব। পরিতোষ ভয় পেল— দু হাতের দশ আঙুল চোখের কাছে আনল— ওর কুঁচকোনো চামড়ায় সবজে শিরার পাশে মৌমাছির চাকের ডিজাইন— তার ওপর কনে দেখা আলো। পড়ার টেবিল থেকে দৌড়ে নিয়ে এল ওর মোবাইল— গুঁড়িয়ে যাওয়ার ঠিক আগে লুফে নিল মুহূর্তটা— ক্লিক।
এ যেন আন্দালুশিয়ান ডগের ওপেনিং সিন— চোখ খুলে গেল পরিতোষের। পরদিন ঘুম যখন ভাঙল, খালি পায়ে সটান বাইরে এসেছিল সে— মেঘ কেটে গিয়েছে, লাইলাক ছোপ উধাও, তার বদলে লম্বা লম্বা কমলা সুতোয় ভরে গিয়েছে মেঝে— ক্লিক। রবির মা সিঙ্কে ভাতের ফ্যান গেলে গেছে— ঝাঁঝরিতে ফ্যানের সঙ্গে ভাতের দানা— ফ্যানে ভাতে মিশে পায়েসের মত লাগছে— ক্লিক ক্লিক। স্কুটারে ছেলেটির কোমর জড়িয়ে মেয়েটি যাচ্ছিল টেল লাইট জ্বালিয়ে— পরিতোষের বাড়ির সামনে স্কুটার বাঁক নেওয়ার মুহূর্তে পরিতোষের নতুন চোখ, টেল লাইট, মেয়েটির ডান পা এক লাইনে এল যেন শাদা শালোয়ারের নিচে তিন নম্বর চোখ— ক্লিক ক্লিক ক্লিক।
একটা ভালো ক্যামেরার কথা তুলেছিল মালিনী। পরিতোষ বলেছিল— না, মোবাইলই ভালো।
অপেক্ষার পল অনুপল বিপল এখন পরিতোষের আঙুলে— মেগাবাইট গিগাবাইটে ভরে উঠতে লাগল ওর মোবাইল— তারপর উপচে উপচে ক্লাউডে— মুহূর্তর পরে মুহূর্ত সাজিয়ে এইভাবে সে যেন পৌঁছে যাবে গন্তব্যে, তারপর ক্যামেরার ফ্রেমে দেখতে পাবে তাকে—
–কেমন আছ পরিতোষ?
–আসুন কালিদা, চা খান।
৩
সমরেশের ক্যান্সার ধরা পড়ল। দুই মেয়ে মুম্বাই নিয়ে গিয়েছিল সঙ্গে সঙ্গেই। ফিরিয়ে এনেছিল মাস তিনেক পরে।
–ফাঁসির হুকুম হয়ে গেছে, বুঝলি! দিনক্ষণ ঠিক হয়নি এখনও। তবে আর মাস ছয় বড়জোর— নিজের ঘরেই শুয়ে শুয়ে বলছিল সমরেশ। দপদপ করছিল টিউবলাইট— চোকটা গেছে।
–শেষের দিকে খুব কষ্ট পাব— পরমানন্দ মাধব তো— হা হা হা; ডাক্তার বলছিল, বোধহয় ঘুমটুম পাড়িয়ে রাখবে ঐ সময়টা। কালিদার চেহারাটা আর দেখা হবে না— ঝাঁটার শলা টলা কি আর কাজ করবে?— হাসছিল সমরেশ, ওর সেই উচ্চকিত হাসি। নিঃশব্দে কাঁদছিল মালিনী।
পরিতোষের চোখ চলে যাচ্ছিল বন্ধুর মুখে, সমস্ত শরীরে— ফর্সা হাতের সবজে শিরা বেয়ে নিকষ কালি নখের ডগা অবধি চলে এসেছে, কপাল কালচে, ক্লান্ত চোখ; নাক আর ঠোঁট বাঁকা লাগছিল। পরিতোষের বুক কাঁপতে লাগল। কালিদা যদি তার কাছে এইভাবেই আসে!
একটা ছবি তুলল পরিতোষ— খাটে হেলান দিয়ে সমরেশ, পিছনে খোলা জানলা দিয়ে যতটা দেখা যায়— বাগান আর একটা বেড়াল।
ফেরার পথে দুজনেই চুপ। মালিনী বার বার তাকাচ্ছিল পরিতোষের মুখে, একবার যেন আঙুল রাখল পরিতোষের হাতের শিরায়। চমকে উঠে হাত সরিয়ে নিল পরিতোষ।
পরিতোষের মেয়ে জামাই এসেছিল ক্রিসমাসের ছুটিতে।
–তোর বাবার একটা চেঞ্জ দরকার। কতদিন ধরে স্রেফ বাড়ির মধ্যে বসে— চল বেরিয়ে আসি কোথাও একসঙ্গে…
–বাবা যাবে তো? সমরেশকাকুর এই অবস্থা— এখানে তো তাও যাই হোক বাগান টাগান ছবি তোলা নিয়ে আছে একরকম— এর পরে কী যে করবে!
–দেখি বলে। কটা দিন তো মোটে। তুইও বল।
প্রবল বাধা আসবে, ভেবেছিল ওরা। অথচ এক কথায় রাজি হয়ে গিয়েছিল পরিতোষ।
৪
সূর্য ওঠার আগেই পরিতোষরা বেরিয়ে পড়েছিল— এই সময় নাকি বাঘ দেখার সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি, সামান্য বেলা হয়ে গেলেই স্রেফ চারটে হরিণ, দুটো ময়ূর, আর গুচ্ছের বাঁদর দেখে ফিরে আসতে হবে। মালিনী তাড়াহুড়ো করছিল— নিজে তিনটেয় অ্যালার্ম দিয়ে উঠে পরিতোষকে জাগাল, তারপর মেয়েজামাইয়ের ঘরের দরজায় টোকা দিল। আলো ফোটেনি, ঘোলাটে আকাশ। শুকনো ডালের ডগায় বুড়ির চুলের মত কুয়াশা জড়ানো ছিল। মালিনী পরিতোষকে বাঁদুরে টুপি আর মাফলার পরে নিতে বলছিল বারবার। নিজে সোয়েটারের ওপর শাল মুড়ি দিল।
খোলা জীপে মালিনী, নন্দিনী, সম্রাট আর পরিতোষ। গাইড কথা বলে যাচ্ছিল— এই পাহাড়, এই জঙ্গল, জঙ্গলের হালচাল। বলছিল, প্রায় দশটা জোনে ভাগ করা আছে গোটা পার্ক। প্রতিটি জোনেই বাঘ দেখতে পাওয়ার কথা— গতকাল আর পরশু টুরিস্টরা তিন নম্বর জোনে বেশ কয়েকবার বাঘ দেখেছে; লোকালয় ছাড়িয়ে ওদের জিপ তিন নম্বরে ঢুকে গেল।
–আচ্ছা, বাঘ ঝাঁপিয়ে পড়ে না জিপের ওপর?— মালিনী শালের থেকে মাথা বের করে জিজ্ঞেস করল।
–ভয় পাওয়ার কিছু নেই ম্যাডাম। এ ধরনের কেস হয়নি এখানে।
–ভয় পাচ্ছি কে বলল! এমনিই জিজ্ঞেস করলাম।
অপ্রশস্ত পথের দুধারে জঙ্গল, মাথার ওপর দিয়ে এগাছ আর ওগাছের জড়াজড়ি। আরাবল্লির রেঞ্জ আধো অন্ধকারে মেঘের মত দেখাচ্ছে। জিপ ধীরে এগোচ্ছিল। সম্রাট আর নন্দিনী তাদের ঢাউস ক্যামেরায় ছবি তুলছে। পরিতোষের হাতে মোবাইল। মালিনী ওর শালের তলায় দুহাত ঘষে চলেছে। ড্রাইভার আর গাইড দুদিকে নজর রাখছিল।
একসময় আঙুল তুলে এক পাল হরিণ দেখাল ড্রাইভার— দুলকি চালে তারা রাস্তা পেরোল ওদের দিকে ভ্রূক্ষেপ না করেই। আকাশ ক্রমশ পরিষ্কার হয়ে আসছিল।
–কে জানে কপালে বাঘ দেখা আছে কি না— সকাল হয়ে আসছে— তোরা আর একটু আগে উঠতে পারলি না?
–আরে আরও দুদিন তো আছি মা। আজ বিকেলের সাফারিটা বুক করে নেব। গাইডসাব, বিকেলে চারটে স্পট পাওয়া যাবে?
তক্ষুণি ক্যাঁ ক্যাঁ শব্দ করে একটা ময়ূর উড়ে গেল। গাইড জিপ থামাতে বলল ইশারায়। মুখে আঙুল দিয়ে চুপ করতে বলল।
জিপ যেখানে দাঁড়িয়ে সেখান থেকে ধাপে ধাপে পাহাড় নেমে গেছে। একদম নিচে মসৃণ গোল গোল ছোট পাথর। তার ওপর দিয়ে একফালি স্রোত, শান্ত জল, ওপারে আবার পাহাড়, আরও জঙ্গল। গাইড আঙুল তুলল— ঐ যে ঐ যে…। মোবাইলের ক্যামেরায় চোখ রাখল পরিতোষ— দেখল, পর্বতের ওপর ভাসমান মেঘ, শুকনো ডালের ডগায় কুয়াশা গলে ফোঁটা ফোঁটা জল ঝরছে, ঘাসজমি থেকে হাল্কা বাষ্প ওপরে উঠছে ধীরে; আর ফ্রেমের এক কোণে প্রাচীন আগ্নেয়শিলা, গ্রানাইটের চাঙড় পেরিয়ে শান্ত জল আর রাজকীয় সে— কমলা কালো ডোরাকাটা মুখ নামিয়ে জল খাচ্ছে। ওদের জিপের পিছনে ততক্ষণে আরও দুটি জিপ দাঁড়িয়ে গেছে নিঃশব্দে। চরাচরে তখন একটি দুটি ভোরের পাখির ডাক, জল বয়ে যাওয়ার মৃদু ধ্বনি আর ক্যামেরার খচাৎ খচাৎ। সম্রাট আর নন্দিনী পেল্লাই লেন্স বাগাল, শালের ঘোমটা খুলে জিপের রড ধরে উঠে দাঁড়াল মালিনী, তারপর আচমকা লাফ দিল— দৌড়ে নেমে যেতে লাগল জলের দিকে।
ভাঙা পাথুরে পথ এবড়োখেবড়ো এবং ঢালু— হুমড়ি খেয়ে পড়ে গেল মালিনী, তারপর দুপাক গড়িয়ে একদম জলের কাছে— মুখ তুলে তাকাল আরাবল্লির বাঘ। পরিতোষ চীৎকার করে উঠে ঝাঁপ দিতে গিয়েছিল জিপ থেকে— তাকে জড়িয়ে ধরে টেনে নিল গাইড। কাঁপছিল পরিতোষ, হাত পা ছুঁড়ছিল উন্মাদের মত। মোবাইল খসে পড়েছিল ওর হাত থেকে— পাথরে পাথরে ঠোক্কর খেয়ে অদৃশ্য হয়ে গেল এক সময়।
শুয়ে পড়ল মালিনী— পিঠের তলায় কনকনে জল আর মসৃণ নুড়িপাথর টের পাচ্ছিল সে। আকাশের দিকে তাকাল তারপর— ভোর হয়ে আসছে।
হই হই করে উঠেছিল মানুষজন— বোকা, পাগল নাকি মাতাল মেয়েমানুষ!
কেউ বলল— কী করছ তুমি?! কী করছ!
–ফিরে এসো— চিরে যাওয়া গলায় বলেছিল কেউ। আরাবল্লির পাথরে ঠোক্কর খেয়ে ফিরে এল— ফিরে এসো, ফিরে এসো।
একজন চিৎকার করে কেঁদে উঠল।
মাথার ওপর আইসক্রিমের গলে যাওয়া দেখছিল মালিনী— গাঢ় রং ক্রমে ধূসর হয়ে কমলা হচ্ছিল তারপর নীলচে— অথচ ক্যানভাস নয়— থ্রি ডাইমেনশনাল পাহাড় যেন; প্রথমে মনে হচ্ছিল বিশাল এক পর্বত থেকে একটা ছোট পাহাড় চাকলা করে কেটে নেওয়া— তারপর বুঝল আদতে আইসক্রিম। বিশাল এক আইসক্রিম ছ্যাঁত ছ্যাঁত করে পাথরে গলে গলে পড়ে ছোট ছোট মুকুট ফর্ম করছে— প্রথমে কাচের মুকুট তারপর অবয়বহীন— পাথরের লালচে রঙের সঙ্গে বেবাক মিশে যাচ্ছে। আইসক্রিমটা গলে যেতে যেতে ফেটে গেল এবারে— কমলা রঙের আগুন ছিটকে বেরোলো।
মালিনী চিনতে পারল— কালিদা!
পরিতোষের মোবাইল গড়িয়ে পড়েছিল অনেকক্ষণ। টুকরো টুকরো হয়ে অপেক্ষার মুহূর্তরা ছড়িয়ে পড়ছিল বনময়।