Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

পাকিস্তান বা যে কোনও দেশের নামে জিন্দাবাদ বলায় ভুলটা কোথায়?

পাকিস্তান বা অন্য কোনও দেশের নামে জিন্দাবাদ বলায় ভুলটা কোথায়? : শৈলেন সরকার

শৈলেন সরকার

 

‘পাকিস্তান জিন্দাবাদ’। তাঁর এই প্রথম বারের ‘জিন্দাবাদ’ ধ্বনি মঞ্চে উপস্থিত আসাউদ্দিন ওয়াইসি বা তার অনুচর ও পুলিশদের কান এড়িয়ে যায়। কিন্তু দ্বিতীয় বার ‘পাকিস্তান জিন্দাবাদ’ উচ্চারণের সঙ্গে সঙ্গে আসাউদ্দিন ওয়াইসি নিজে তাঁর এক অনুচর সহ ছুটে আসেন। আসে এক পুলিশ অফিসারও। তাঁদের সামনেই মেয়েটি আরও একবার ‘পাকিস্তান জিন্দাবাদ’ বলা-মাত্র ওয়াইসি নিজে হাত বাড়িয়ে মেয়েটির হাত থেকে মাইক কাড়ার চেষ্টা করতে থাকেন। মেয়েটি ওদের হাত ছাড়িয়ে নিজেকে মুক্ত করার চেষ্টা করতে গিয়ে বলতে থাকে ‘এক মিনিট’, অর্থাৎ সে নিজের কথার ব্যাখ্যা দিতে চায়। এবং নিজেকে ওদের হাত ছাড়িয়ে মুক্ত করে ফিরে এসে বলতে থাকে ‘হিন্দুস্থান জিন্দাবাদ, হিন্দুস্থান জিন্দাবাদ, হিন্দুস্থান জিন্দাবাদ’। এ সময় মঞ্চে উপস্থিত কিছু যুবকও তার সঙ্গে ‘হিন্দুস্থান জিন্দাবাদ’ ধ্বনি দেয়। এবার তাকে মঞ্চে উপস্থিত পুরুষ পুলিশ অফিসার ও অন্য রাজনৈতিক কর্মীরা জোর করে মঞ্চ থেকে ঠেলে সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করতে থাকে। এর মধ্যেও মেয়েটি ফের ‘হিন্দুস্থান জিন্দাবাদ, হিন্দুস্থান জিন্দাবাদ’ ধ্বনি তোলে এবং ওই জটলার হাত থেকে নিজেকে মুক্ত করে ফিরে এসে বলতে থাকে, ‘হিন্দুস্থান জিন্দাবাদ— তফাতটা হল— ।’ কিন্তু মেয়েটি কথা শেষ করতে পারে না। ফের মঞ্চের পুরুষ কর্মী ও পুলিশ অফিসার জোর-জবরদস্তি টানা-হ্যাঁচরা করতে থাকে। মেয়েটি এত বাধা সত্ত্বেও আবার ফিরে আসে। বলতে শুরু করে, ‘পাকিস্তান জিন্দাবাদ, হিন্দুস্থান জিন্দাবাদ— তফাতটা হল—।’ এবার আর সে সুযোগ পায় না। তাকে ঘিরে ধরে বিরাট এক জটলা মঞ্চ থেকে নেমে যেতে থাকে। এবার মঞ্চে আসেন আসাউদ্দিন ওয়াইসি। তিনি গোটা ব্যাপারটির জন্য মেয়েটিকে দায়ী করে ওর দায়িত্ব নিজের ঘাড় থেকে ঝেড়ে ফেলে জানান, ‘ওর সঙ্গে তাঁর কোনও কালেই কোনও সম্পর্ক নেই।’ তিনি বলেন, ‘আমাদের শত্রুদেশ পাকিস্তান নিয়ে আমরা ‘পাকিস্তান মুর্দাবাদ’ বলব, আমাদের জন্য সব সময় ‘ভারত জিন্দাবাদ’ থাকবে, সংগঠকরা এই সব লোককে বলার সুযোগ দেওয়ায় বাইরে ভুল বার্তা যাচ্ছে।’ তিনি আরও জানান, ‘এই মহিলার সঙ্গে আমার দূরত্বের কথা জানাচ্ছি, এই মহিলার সঙ্গে কোনও সম্পর্কই নেই আমার। সংগঠকদেরই এই মহিলাকে থামানো উচিত ছিল।’ পরের খবর মেয়েটির বিরুদ্ধে ভারতীয় পেনাল কোডের ১২৪-এ ধারায় রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগ আনা হয়েছে। তাকে জামিন না দিয়ে জুডিশিয়াল কাস্টডিতে রাখা হয়েছে।

মেয়েটির নাম অমূল্য লিওন। কর্নাটকের চিকমাগালোর অঞ্চলের বাসিন্দা। বর্তমানে বেঙ্গালুরুর এক কলেজে সাংবাদিকতার কোর্স করছে। এবং বেঙ্গালুরুতে সিএএ ও এনআরসি বিরোধী সব কটি বিক্ষোভ বা মিছিলে অংশ নিয়েছে। এবার দেখা যাক, ‘এক মিনিট’ বলে বা পরে ফিরে এসে ‘পাকিস্তান জিন্দাবাদ, হিন্দুস্থান জিন্দাবাদ— তফাতটা হল—’ বলতে গিয়ে সে কী বলতে চেয়েছিল। মনে রাখতে হবে তাকে বলার সুযোগ না দিয়ে জবরদস্তি মঞ্চ থেকে সরিয়ে নেওয়া হয়েছিল। আমাদের তবে মেয়েটিকে বোঝার জন্য ওর কোনও লেখা বা অন্য কোথাও দেওয়া বক্তৃতার সাহায্য নিতে হবে। কী বলতে চেয়েছিল অমূল্য? ভারতবর্ষে বাস করে অন্য কোনও দেশের নামে জিন্দাবাদ ধ্বনি দেওয়াটা কি অন্যায়? পাকিস্তান জিন্দাবাদ অর্থে ‘পাকিস্তান দীর্ঘজীবী হোক।’ পাকিস্তান দীর্ঘজীবী হলে বা আমাদের যে কোনও প্রতিবেশী দেশ দীর্ঘজীবী হলে আমাদের অসুবিধে কোথায়? মেয়েটি তো ‘হিন্দুস্থান মুর্দাবাদ’ বলেনি।

২০ ফেব্রুয়ারি ২০২০ তারিখের সিএএ ও এনআরসি বিরোধী এই মিটিং-এর আয়োজক ছিলেন জনৈক ইমরান পাশা। মিটিং-এর আগে প্রচারপত্রে বক্তা হিসেবে অমূল্য লিওনের নাম উল্লেখ থাকলেও ঘটনার পর আসাউদ্দিন ওয়াইসির মতো ইমরান পাশাও নিজেকে সাফসুতরো করে জানান, মেয়েটি কোত্থেকে এল বা কে তাকে ডেকেছে আমরা জানি না। কিন্তু আসাউদ্দিন ওয়াইসির মতো ইমরান পাশাও বলতে পারলেন না, ‘পাকিস্তান দীর্ঘজীবী হোক’ এই কথা বলায় অপরাধটা কোথায়? মেয়েটির বাবা পর্যন্ত কর্নাটক বা কেন্দ্রের বিজেপি-সরকারের কাছে নিজেকে দেশপ্রেমী প্রমানের জন্য নিজের মেয়েকে দোষী সব্যস্ত করে যে কোনও শাস্তি দিতে বলেছেন।

এবার আমরা বরং ১৬ ফেব্রুয়ারি ফেসবুকে মেয়েটির করা একটি পোস্ট দেখি। কন্নড়ে করা সেই পোস্টে মেয়েটি লিখেছে, ‘হিন্দুস্থান জিন্দাবাদ, পাকিস্তান জিন্দাবাদ, বাংলাদেশ জিন্দাবাদ, শ্রীলঙ্কা জিন্দাবাদ, নেপাল জিন্দাবাদ, আফগানিস্তান জিন্দাবাদ, চিন জিন্দাবাদ, ভুটান জিন্দাবাদ— যে দেশই হোক, সব দেশই ‘জিন্দাবাদ’।’ মেয়েটি আরও লিখেছে, ‘তোমরা ছোটদের শেখাও নেশন (মেয়েটি ‘নেশন’ লিখেছে কিন্তু লেখার মধ্যে এটা পরিষ্কার ও আসলে ‘দেশ’ বোঝাতেই চেয়েছে।) হল দেশের মাটিই মাত্র।  কিন্তু আমরা ছোটরা তোমাদের বলছি, নেশন হল তার মানুষেরা। সব মানুষেরই বেঁচে থাকার সাধারণ সুযোগগুলি পাওয়া উচিত। প্রত্যেকেই যেন তার মৌলিক অধিকারের সুযোগ পায়। এই দেশগুলির সরকারের তার নাগরিকদের প্রতি যত্ন নেওয়া উচিত। সব দেশকেই— যারা তার তার নাগরিকদের প্রতি যত্নবান, আমার জিন্দাবাদ। শুধুমাত্র অন্য দেশের নামে জিন্দাবাদ দিয়েছি জন্য আমি সেই ভিন্ন দেশের নাগরিক নয়। আইন অনুসারে আমি ভারতের নাগরিক। আমার দেশকে সম্মান জানানো ও আমার দেশের মানুষের জন্য কাজ করা আমার কর্তব্য। আমি তা করব। দেখতে হবে আরএসএস-এর লোকগুলি কী করে?’

একটি মাত্র উনিশ বছর বয়সী মেয়ের রাষ্ট্র সম্পর্কে কি অসাধারণ উদার ও সাহসী চিন্তা। এই উদারতা, মুক্তমন বা সাহস— মনে হয়, এক সময়ের উদারবাদী ও সাহসী চিন্তার গড় আমাদের বাংলার ছেলেমেয়েদেরও এখন আর নেই। হ্যাঁ, আসাউদ্দিন ওয়াইসি বা ইমরান পাশার মতো মানুষদেরই আমরা পেয়ে যাই সর্বত্র। আমাদের প্রগতিশীল বা প্রতিক্রিয়াশীল ভোট-পিয়াসী সব নেতা বা রাজনৈতিক কর্মীই এক-একজন আসাউদ্দিন ওয়াইসি বা ইমরান পাশা। ভোটের ঝুলিতে টান পড়ামাত্রই আঁতকে উঠে বলে উঠবেন, চিনি না তো! খড়্গপুর আইআইটির ইঞ্জিনিয়ারিং ছাত্র দিল্লির কেজরিওয়ালের মতো শাহিনবাগের প্রতি চোখ বন্ধ করে হনুমানজির ভক্ত হয়ে উঠবেন, বা বাংলার বিজেপি-ওয়ালাদের দেখাদেখি তলোয়ার-হাতে রামনবমীর প্রতিযোগিতায় নামবেন। এই বাংলা বিদ্যাসাগরকে না নিয়ে বিবেকানন্দকে নেওয়া বাংলা। আমি নিশ্চিত আমাদের এই বাংলার কোনও মঞ্চে দাঁড়িয়ে মেয়েটি এ রকম বক্তৃতা করলে সেই মঞ্চের উপস্থিত প্রগতিশীল, প্রতিক্রিয়াশীল সব বুদ্ধিজীবীরাই আসাউদ্দিন ওয়াইসি বা ইমরান পাশার মতো দায় ঝেড়ে বলতেন, ‘কে ডেকেছে ওকে, আমরা চিনি না তো!’ দেশপ্রেমের উদ্দাম বন্যায় ভেসে গিয়ে বলতেন, ‘আমাদের শত্রুদেশ পাকিস্তান নিয়ে আমরা ‘পাকিস্তান মুর্দাবাদ’ বলব, আমাদের জন্য সব সময় ‘ভারত জিন্দাবাদ’ থাকবে।’ এ ভারত সোয়ামি বিবেকানন্দের ভারত বলে কথা।