চার নম্বর নিউজডেস্ক
মনোহরপুর স্টেশনে নেমে গাড়ি নেওয়া হল। গাড়ি চলল সারান্ডার জঙ্গলের রাস্তায়। গন্তব্য, ঝাড়খণ্ডের পশ্চিম সিংভুম জেলার এক বনবসতি। ছোটা নাগড়া। মিনিট কুড়ি পর থেকেই, মোবাইল ফোনে আর নেটওয়ার্ক নেই। ডেভেলপমেন্ট সেক্টরে এত বছর কাটিয়ে দেওয়ার পর অবশ্য এই ব্যাপারটায় বেশ খানিকটা অভ্যস্ত হয়ে উঠেছি। তাই মাথা ঘামালাম না। যদিও, অভ্যাসবশত বারবারই চোখ চলে যাচ্ছে ঘুটঘুটে অন্ধকার হয়ে থাকা মোবাইলের স্ক্রিনের দিকে, যেটার সঙ্গে, এই মুহূর্তে একটা চৌকো কালো ও মসৃণ পাথরের টুকরোর কার্যত কোনও পার্থক্য নেই।
আমরা যাচ্ছি বিশেষ একজনের সঙ্গে দেখা করতে। সরকারি নথি অনুযায়ী তার নাম মুংলি লোহার, বয়স সাতাশের কাছাকাছি। বাড়ি সারান্ডার জঙ্গলের একেবারে মাঝখানে একটা ছোট্ট গ্রামে, যার নাম ছোটা নাগড়া। গ্রামে থাকে মোট ২২৮টি পরিবার, বেশিরভাগই হো প্রজাতির। গ্রামের প্রথা মেনে, বাইরে থেকে ডেকে আনা হয় দুয়েকটি লোহার পরিবারকে, সামান্য জমিজমা দিয়ে বসত করতে দেওয়া হয়। সেই সূত্রেই মুংলির পরিবার কোনও একসময় এসে হাজির হয়েছিল ছোটা নাগড়ায়।
মুংলির মস্ত পরিবার। মরদ গুড়া, গুড়ার চারটি ছোট-ছোট ভাইবোন, বৃদ্ধ শ্বশুর, এবং মুংলির দুই সন্তান। মেয়েটা পাঁচ বছরের। ছেলেটা মোটে ছমাসের– এখনও মাই ছাড়েনি। বিয়ে হয়ে এসেছিল যখন গুড়ার সঙ্গে ঘর করতে, তখন এই অতি দরিদ্র পরিবার অভাব-অনটনে জেরবার। মুংলির সময় কেটে যেত শ্বশুর এবং ছোট্ট দেওর-ননদদের দেখাশোনা করে, আর সংসারের নানাবিধ কাজকর্ম মধ্যে দিয়ে। গুড়া করত দিনমজুরির কাজ– যখন যা পেত। ভাবছেন, এ আর আলাদা কী? ভারতবর্ষের যে কোনও প্রত্যন্ত গ্রামে গরিব বাড়ির বৌয়েদের গল্প তো এমনটাই হয়।
কিন্তু মুংলি লোহারের গল্পটা আলাদা। কারণ, মুংলি নিজেই তাই। আলাদা। কোথায়? সে কথা জানতেই তো এতটা পথ ঠেঙিয়ে আসা।
মুংলিকে জিগ্যেস করলাম, এত্ত বড় একটা পরিবার, চলে কী করে?
উত্তরে প্রথমে খানিকক্ষণ চুপ, তারপর বেশ খানিকটা হাসি, এবং তারও পরে যে কথাগুলো বেরিয়ে আসে, তার মধ্যে অবশ্য কোনও নাটকীয়তা নেই। সোজাসাপটা কথা। স্পষ্ট। এবং, গভীর। “না, সহজ ছিল না কাজটা। আমাদের তো দিন-আনি-দিন-খাই অবস্থা। তার ওপর এতগুলো লোক। বাচ্চাগুলোকে যদি সময় না দিতাম, অন্য কোথাও পাঠিয়ে দিতে পারতাম, তা হলে আমার জীবনটা বরং অনেকটা সহজ হয়ে যেত। তবে তা থেকে আমার সন্তানেরা কী শিখত? ওরাও বড় হয়ে আমাদের আর পাত্তা দিত না। একটু অসুবিধে হলেই মা-বাবাকে তাড়িয়ে দিত বাড়ি থেকে। বড় হয়ে আমার দেওর-ননদ আমার পাশে দাঁড়াবে। আমার বন্ধুত্বপূর্ণ ব্যবহার তারা মনে রাখবে, এটাই আশা করি। যদি ভুলেও যায়, আমি অন্তত জানব যে, আমি নিজের দায়িত্বের মর্যাদা রক্ষা করেছি,” মুংলির উত্তর।
হয়তো বা এই ভালো ব্যবহারেরই ফল পেতে শুরু করে মুংলি, ২০১৬ থেকে। সে বছর থেকে ছোটা নাগড়ায় টাটা কমিউনিকেশনস-এর সিএসআর বিভাগ এবং ট্রিকল আপ নামে এক স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা অতিদরিদ্র পরিবারের মহিলাদের নিয়ে কাজ করা শুরু করে। প্রজেক্টের নাম M-Powered। মুংলিকেও বেছে নেওয়া হয় ওই গ্রামের স্বনির্ভর গোষ্ঠীর সদস্যা হিসেবে। উদ্যমী মনোভাবের মুংলি যেন শুধু এই দিনটারই অপেক্ষায় ছিল। বাড়ির সমস্ত কাজকর্ম সামলে, এইবার শুরু হল মুংলির বাড়ির বাইরের জগৎটাকে জয় করে নেওয়ার যাত্রা।
M-Powered প্রজেক্টে যুক্ত হয়ে, মুংলি হাতে পেয়েছিল নগদ তিন হাজার টাকা, এবং একটি মোবাইল ফোন। প্রশিক্ষকের সঙ্গে আলোচনা করে জীবিকার বিকল্প হিসেবে শুধু পশুপালন নয়, মুংলি সিদ্ধান্ত নেয় একটি ছোট খাবারের দোকান খোলার। প্রতি শনিবার, অর্থাৎ হাটবারে খাবারের দোকান দেয় মুংলি এখন। সৌভাগ্যবশত আমরা এক শনিবারেই দেখা করতে গেছিলাম মুংলির সঙ্গে। গরম গরম শিঙাড়া, আলুর চপ, ডিমের চপ এবং বুলবুলা (ঝাড়খণ্ড-ওড়িশার জনপ্রিয় খাবার) জুটে গেল আমাদের। যাকে বলে, সস্তায় পুষ্টিকর! এক ফোঁটা ফাঁকিবাজি নেই।
নিজে ওই খাবারগুলো খেয়ে বুঝলাম, আমার সহকর্মীরা কেন মুংলি বলতে অজ্ঞান। কারণটা হল, মুংলির জেদ। সংসার সামলানো, সবাইকে আগলে রাখা, মোবাইল ফোন চালাতে শেখা বা ভাতের হোটেল চালানো, সবটাই তার দারুণভাবে করা চাই। এত ভাল করে ফোন ব্যবহার করতে শিখল মুংলি যে, অচিরেই হয়ে উঠল ‘স্মার্ট সখি’– অর্থাৎ, গ্রামের বাকি মহিলাদের প্রশিক্ষক। শুধু শনিবার-শনিবার হাটে খাবার বিক্রি করে মন ভরল না, এখন স্বনির্ভর গোষ্ঠীর মিটিঙের জলখাবারও মুংলির হেঁশেল থেকেই আসে। খাবারের গুণগত মান এত ভাল, যে আশপাশের গ্রামের স্বনির্ভর গোষ্ঠীর মিটিঙেও ডাক পড়ে মাঝেমাঝেই।
আজ মুংলির সাপ্তাহিক হোটেল চলে স্বামী-স্ত্রীর অংশীদারিতে। প্রত্যেক সপ্তাহে প্রায় ১৮০০ টাকা খরচা করে ৩০০০ টাকা মতো আয় হয়। এই টাকাতেই সংসার চলে। উপার্জনের টাকায় বরকে একটা সাইকেল উপহার দিয়েছে মুংলি। এখন, বৌয়ের দেওয়া সেই সাইকেলে চেপে গুড়া যায় অর্ডারের খাবার ঠিক জায়গায় পৌঁছে দিতে। মুখে সাফল্যের চওড়া হাসি নিয়ে জঙ্গলের বাঁকে সাইকেল চালিয়ে বরের মিলিয়ে যাওয়া দেখতে দেখতে খদ্দের সামলায় মুংলি।
“আমার দোকানে এখন একটি কর্মচারী আছে। কিছু কিছু পদ সে রাঁধে, বাকিটা আমি নিজেই করে নিই। আমি ও আমার স্বামী খাবার পরিবেশন এবং নগদ টাকাপয়সার দায়িত্বে থাকি। যা লাভ হয়, সেই থেকে ওই কর্মচারীকে মাইনে দিই। আমার দোকানে সমস্ত খাবার শালপাতার বাসনে পরিবেশন করা হয়। পরিবেশের প্রতি আমারও কিছু দায়িত্ব রয়েছে, সেটা আমি বুঝি। এই ব্যবসাটাকে বাড়ানোর স্বপ্ন দেখি আমি দিনরাত। এবং এই স্বপ্নটা সত্যি হবেই। শুধু শনিবার নয়, রোজ বসবে দোকান, শুধু আমি না, আমার গ্রামের প্রত্যেকটা মেয়ে বাড়ি থেকে বেরোবে, কাজ করবে, আমাদের দুনিয়াটা আরও বড় হবে।” মুংলির সঙ্গে কথা বলার পর খবর নিয়ে জানলাম, সারান্ডা হল এশিয়া মহাদেশের বৃহত্তম শালবন।
আন্তর্জাতিক নারীদিবসকে সামনে রেখে মুংলির গল্প লিখতে বসার কারণ শুধু এই ভাতের হোটেলটা নয়। মুংলির ‘স্মার্ট সখি’ হওয়াটাও নয়, একা হাতে, হাসি মুখে সংসার সামলে নেওয়াও নয়। এর পেছনে, শুধু তিনটিমাত্র কারণ–
এক) আজ গুড়াকে তাঁর গ্রামে সবাই ‘মুংলির বর’ বলে চেনে। তাতে গুড়ার কোনও আপত্তি নেই। এই আদিবাসী মেয়েটির পক্ষে নিজের এই পরিচয় গড়ে তোলা সহজ ছিল না। ব্যবসা দাঁড়িয়ে যাওয়ার আগে অবধি প্রচুর টিপ্পনী, ইয়ার্কি, অপমান সইতে হয়েছে। আজ সেই লোকগুলোই সম্মানের চোখে দেখে মুংলিকে।
দুই) মুংলির মেয়ে নিজের বাড়িতে যে উদাহরণটা দেখে বড় হচ্ছে, তাতে সে শিখছে মেয়েদের জায়গাটা ঠিক কোথায়– সে শিখছে মেয়েরা রান্নাঘরে বন্দি থাকার জন্য জন্মায় না, তাদের সামনে খোলা রয়েছে সারা বিশ্ব, সে শিখছে, শুধু সংসার করা মেয়েদের দায়িত্ব নয়, ব্যবসা করে জীবিকা উপার্জন করতেও মেয়েরা পারে।
তিন) মুংলির ছেলে নিজের পরিবারে লিঙ্গসাম্য দেখে বড় হবে, নিজের মাকে সম্মানিত হতে দেখে বড় হবে, অন্য মেয়েদের সম্মান করতে শিখে বড় হবে।
জঙ্গলের একটি কোনায় একটি ছোট্ট গ্রামের একটি আদিবাসী পরিবারে যদি এই পরিবর্তন এনে দিতে পারে বছর সাতাশের একটি মেয়ে, তা হলে স্বপ্ন দেখতে দ্বিধা নেই, যে বাকিরাও পারবে।