Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

দিল্লির দাঙ্গার লক্ষ্য পশ্চিমবঙ্গ নয়তো?

শুভেন্দু দেবনাথ

 



লেখক কবি, গদ্যকার, সাংবাদিক।

 

 

 

ঠিক নির্বাচনের পরপরই দিল্লির এই দাঙ্গা কেন? আর দাঙ্গাই যদি হল তাহলে বেছে বেছে ইস্ট দিল্লিতে কেন? ইস্ট দিল্লির চেয়ে অনেক বেশি মুসলমান দিল্লির অন্যান্য অংশে আছে, সবচেয়ে বড় কথা শাহিনবাগেও হতে পারত দাঙ্গা, কিন্তু না। হল ইস্ট দিল্লিতেই। স্বভাবতই প্রশ্ন ওঠে, ভোট পরপরই দাঙ্গা কেন? দাঙ্গার কারণ আদৌ দিল্লি তো, দাঙ্গার মোড়কে আসল লক্ষ্যটা পশ্চিমবঙ্গ নয়ত? একটু খতিয়ে দেখা যাক না হয়।

দিল্লির যে অংশটায় দাঙ্গা লেগেছে অর্থাৎ, সীলমপুর, শাহদারা বা শাদরা, খেজুরি, ভজনপুরা, মৌজপুর, গান্ধিনগর, এই পুরো অঞ্চলটা হল উত্তরপ্রদেশ সীমান্ত। অর্থাৎ যাতায়াতের সুবিধা খুব সহজ। এক স্টেট থেকে মাত্র ৩০ মিনিটের মধ্যে সহজেই ঢুকে পড়া যাবে ভিন রাজ্যে। এ তো গেল ঢোকা বেরনোর রাস্তা, কিন্তু দাঙ্গার কারণটা কী?

 

হিসেবের কচকচানি

লালকেল্লার শেষ প্রান্ত থেকে আপ টু আনন্দবিহার, গাজিয়াবাদ বর্ডার, সীমাপুরী ওদিকে দিল্লির আইটিও ব্রিজ ক্রস করার পর সীমাপুরী বর্ডার পর্যন্ত এই বিস্তীর্ণ এলাকার নাম ইস্ট দিল্লি বা ট্রান্স যমুনা বা লোকাল ভাষায় যমনা পার। ২০১১র সেনসাস অনুযায়ী এখানকার জনসংখ্যা ১৭.০৯ লাখ। ২০০১ সেনসাসের সময় ছিল জনসংখ্যা ছিল ১৪.৬৪ লক্ষ। যেটা এই ২০১১য় বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৭.০৯ লাখে। ১৯৯১-এর রেকর্ড থেকে ৪৩.০৬ শতাংশ বেড়েছে এবং ২০১৯ পর্যন্ত মোটামুটি দাঁড়িয়েছে ২২ লাখে। ১৯৬৭তে ইস্ট দিল্লি লোকসভা গঠিত হওয়ার পর প্রথম সাংসদ হন হরদয়াল দেবগন ভারতীয় জনসঙ্ঘের প্রার্থী হিসেবে। তারপর থেকে কখনও কংগ্রেস কখনও বিজেপি। তবে বিজেপিই বেশিরভাগ জিতেছে এখান থেকে। মাঝে কংগ্রেসের অরবিন্দর সিং লাভলি এবং প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী শীলা দীক্ষিতের ছেলে সন্দীপ দীক্ষিত এটিকে কংগ্রেসের গড় হিসেবে তৈরি করলেও টেকেনি বেশিদিন। ২০১৪তে হাতছাড়া হয়ে যায়। এখন এখানকার সাংসদ ক্রিকেটার গৌতম গম্ভীর।

দিল্লির সবচেয়ে ঘিঞ্জি এলাকা এবং জনবহুল এলাকা এই পূর্ব দিল্লি। এর মধ্যে প্রায় ২২ শতাংশ বাসিন্দা বাঙালি সরকারিভাবে। বেসরকারিভাবে সংখ্যাটা আরও বেশি। এর মধ্যে ১৬ শতাংশ বাঙালি মুসলমান। একদিকে আইটিওর পর থেকে লক্ষ্মীনগর, পটপড়গঞ্জ, করকডুমা হয়ে ওদিকে শকরপুর, প্রীত বিহার, জগতপুরী, লাল কোয়ার্টার, কৃষ্ণানগর হয়ে গান্ধিনগর পর্যন্ত, অন্যদিকে আইএসবিটি থেকে শুরু করে যমুনাপার, শাস্ত্রী পার্ক, সীলমপুর, খেজুরি খাস, মৌজপুর, শাহদরা, ওয়েলকাম দিলশাদ গার্ডেন হয়ে আনন্দবিহার, সীমাপুরী বর্ডার পর্যন্ত বিস্তৃত এলাকা জুড়ে এই বাঙালিদের বাস। এদের কাজ মুলত এক্সপোর্ট ফ্যাক্টরি অর্থাৎ জামাকাপড়ের ফ্যাক্টরিতে কাজ নয়ত সোনারুপোর গয়না বানানো। আর এই বাঙালিদের পড়ার জন্য দিল্লির সবচেয়ে পুরনো বাঙালি স্কুল কিন্তু আইএসবিটিতেই রয়েছে। একটা কথা এ প্রসঙ্গে বলে রাখা ভালো (দিল্লির বাঙালিদের গায়ে লাগতে পারে), সিআর পার্ক, সফদরজঙ্গ, বসন্ত কুঞ্জ, বসন্ত বিহার, গোবিন্দপুরী, কালকাজি হয়ে বদরপুর বর্ডার পর্যন্ত যে বাঙালির বাস, তারা কিন্তু সরাসরি উদ্বাস্তু হয়ে আসা এবং পুনর্বাসন পাওয়া বাঙালি। বাংলার সঙ্গে এদের যোগাযোগ ক্ষীণ, শুধুমাত্র আত্মীয়দের সঙ্গে। কিন্তু এই পূর্ব দিল্লির ক্ষেত্রে তা নয়। এরা ক্রমাগত পশ্চিমবঙ্গ থেকে কারিগর হিসেবে আসছে, নিয়মিত বাড়িতে যাতায়াত করে, টাকা পাঠায়, বলা ভালো একদম কাজের সূত্রে তারা এখানে, এবং নিয়মিত কারিগর সাপ্লাইয়ের চেনটা চলেই আসছে। ওদিকে করোল বাগ আর চাঁদনি চক ধরছি না, ওখানে শুধুই সোনারুপোর কারিগর আছে।

এ গেল হিসেবনিকেশের কচকচানি। এবার একটা গল্প শোনা যাক, একটা ছোকরা গল্প।

 

ছোকরা গল্প

আমাদের বাংলা ভাষায় যেমন ছেলেছোকরা শব্দটি আছে, এটা কিন্তু সেই ছোকরা নয়। এখানে এক্সপোর্ট লাইন বা জামাকাপড়ের ফ্যাক্টরি বা সোনারুপোর কাজে ছোকরা শব্দটির অর্থ হল বিনি মাইনেতে শুধু খাওয়াপরা হিসেবে নিয়ে যাওয়া খিদমতগার বা হেল্পার। পশ্চিমবঙ্গের হুগলি, মুর্শিদাবাদ, মালদহ, দক্ষিণ ২৪ পরগণা, উত্তর ২৪ পরগণা, বীরভূম, এবং সুন্দরবনের প্রত্যন্ত গ্রামগুলো থেকেই কারিগরেরা দিল্লি যায়। এবার কারিগর হওয়ার প্রথম প্রসেস হল ছোকরা। ধরুন কোনও এক গ্রামের কেউ দিল্লিতে এসে এক্সপোর্ট ফ্যাক্টরির বা সোনারুপোর কারিগর হয়েছে। এবার সে যখন বছরান্তে বাড়ি যায়, তখন গ্রামের বহু মানুষ আসে তার বাড়িতে তদ্বির করতে। যাতে সেই কারিগর তাদের ছেলেদের কাজ শেখাতে নিয়ে যায়। ছোকরার বয়স হতে হবে ১৫র নীচে। মূলত ১০ থেকে ১৩ বছর বয়েসি বাচ্চা ছেলেই আদর্শ ছোকরা হতে পারে। চুক্তি হয় তাকে টিকিট কেটে খরচা করে নিয়ে যাবে বড় কারিগর। ২ বছর পর্যন্ত বাড়ি আসতে পারবে না সেই ছোকরা (বাড়ি গেলে তার কাজে মন লাগবে না, মানিয়ে নিতে পারবে না ওই অস্বাস্থ্যকর কাজের শিডিউল আর পরিবেশে, বাড়ির জন্য মন কেমন করবে তাই), তবে বাড়ির লোক ফোন করতে পারে মালিকের ফোনে। এছাড়া সপ্তাহে ৫০ টাকা করে পাবে, তাতে তার চুল কাটা, সাবান শ্যাম্পু ইত্যাদি এবং সকালের ব্রেকফাস্ট (চলতি ভাষায় নাস্তা)। এছাড়াও দু বেলা খেতে পাবে, বছরে দু বার জামাকাপড় পাবে এবং ছোটখাটো রোগ বিসুখের দায় ওই বড় কারিগরের। ২ বছর পর প্রথমবার বাড়ি যেতে পারবে সে, মালিকের টাকায়, তখন তাকে মালিক জুতো জামা, অ্যাটাচি কেস সব কিনে দেবে, এবং বাড়ির লোকেদের জন্য কিছু উপহার সামগ্রী এবং কিছু টাকা হাতে দেবে। সেই সঙ্গে দেবে যাওয়া আসার টাকা।

এবার ছোকরার কাজ কী? প্রথম এক বছর মালিকের অর্থাৎ যে তাকে নিয়ে গিয়েছিল তার হাত পা টেপা, মালিকের অন্যান্য কারিগরদের খিদমত খাটা, রান্না করা (মালিকের আন্ডারে প্রায় ১০-১২ জন ফুরনের কারিগর বা মাইনের কারিগর আছে তাদের), কারেন্ট চলে গেলে মালিককে হাওয়া করা, সুতো এগিয়ে দেওয়া বা কাজের যন্ত্রপাতি এগিয়ে দেওয়া, জামাকাপড় কাচা ইত্যাদি। ভুল হলেই জুটবে চড়চাপড়, এমনকী বিড়ি সিগারেটের ছ্যাঁকা অব্ধি। যদি ওই যন্ত্রণা সহ্য করেও কেউ টিকে যায় (বেশিরভাগই টিকে যায় কারণে এদের কই মাছের প্রাণ, মরে হাতে গোনা কয়েকজন বা বড়সড় অসুখে পড়ে), তাহলে পরের বছর সে মূল কাজে হাত দিতে পারে। অর্থাৎ বাকি এক বছর প্রথমে সে অল্পস্বল্প সেলাই শিখবে, ববিনে সুতো ভরবে ইত্যাদি। সোনারুপোর কারিগর হলে, প্রথমে চুঙ্গি কাটা, কলেট (বড় চুঙ্গি) পোড়ানো এবং গোল করা, স্লেটে কালো মোম লেপা, ঝালাইয়ের নানা আনুষঙ্গিক কাজ শিখবে। এরপর ৬ মাসে পরে নিজেকেই নানা ডামি ডিজাইন করে ঝালাই করতে হবে, যাতে ঝালাই করতে গেলে পান (ঝালাই করতে লাগে) সূক্ষ্মভাবে লাগে, বোঝা না যায়। অর্থাৎ ঝালাইয়ে হাত পাকাতে শুরু করবে। ২ বছরের মাথায় সে মোটামুটি এই কাজে দক্ষ হয়ে যায়।

এবার আসি এদের খাবার দাবারে। সকালের নাস্তায় বাঙালি দোকান থেকে ওজনে ছেঁড়া পরোটা ১০০ গ্রাম সঙ্গে ঘুগনি, বা মুড়ি ঘুগনি, বা পকোড়া মুড়ি। দুপুর ৩টে নাগাদ ভাত ডাল সবজি। সন্ধেতেও একই টিফিন, আর রাতেও একই ডিনার। সপ্তাহে একদিন ডিম, একদিন মাছ, একদিন মাংস। নইলে বেশিরভাগই সোয়াবিনের তরকারি। দু বছর পর কাজ শিখে গেলে বাড়ি ঘুরে এসে সে হয়ে যাবে ফুরন বা মাস মাইনের কারিগর। এত কাজের উপর এত মাইনে। বাড়ি থেকে ফিরে এসে বছর দেড়েক সে মাস মাইনের কারিগর থাকবে, তারপর সেও কারিগর হয়ে যাবে, তারও ছোকরা আনার অধিকার জন্মে যাবে, সেও হয়ে যাবে একধরনের সেমি মালিক। এইভাবেই চেন সিস্টেম চলে আসছে জামাকাপড়ের ফ্যাক্টরি কি সোনারুপোর কাজের ক্ষেত্রে। জামাকাপড়ের ফ্যাক্টরি বা তামার গয়নার কাজের চেয়েও মারাত্মক হল সোনার কাজ। ছোকরা হোক বা মালিক, হাগতে গেলেও আগে একটা বালতিতে হাত ধুতে হবে। যতবার সিট ছেড়ে উঠবে ততবার হাত ধুতে হবে। মালিক চুল কাটবে সেলুনে, কিন্তু ছোকরাদের চুল মালিক নিজেই কাটবে। সবার কাজের জামা প্যান্ট আলাদা। সেগুলো ধোয়া যাবে না। বছরান্তে ওই চুল, ছোকরা এবং কারিগরদের বিছানাপত্তর, ওই হাগার জল, হাত ধোয়ার জল এবং কাজের জামাকাপড় বিক্রি হবে। প্রত্যেকের জল আলাদা। কারণ সোনার গুড়ো। ওই থেকে যা পাওয়া যাবে তা যার জিনিস তার, শুধু ছোকরার বেলায় তা মালিকের। কোনও কোনও মালিক হয়ত ওই জল বিক্রি করে ২০টা ৫০টা টাকা দয়া করে ছোকরাকে দিয়ে দেয় কখনও কখনও।

আমার বাবা ছিলেন এক সময় পশ্চিমবঙ্গ পুলিশের নামকরা ঠিকাদার। সেই বাবাই যখন ব্যবসায় মার খেয়ে হতাশায় ডুবতে ডুবতে ৫০ বছর বয়েসে দিল্লি চলে যান, তখন এমনই এক তামার জুয়েলারির মালিকের কাছে কাজ নেন ম্যানেজার হিসেবে। পরে তিনি কাজ বুঝে নিয়ে কিছু টাকা দিয়ে নিজেই কারিগর জোগাড় করে ব্যবসায় নামেন। যদিও আজও তিনি নিজে বানাতে পারেন না কোনও গয়না। আমি ১৯৯৯ সালে যখন পাকাপাকিভাবে দিল্লি যাই এই বাবার কাছেই প্রথম ছোকরা দেখি। আমাকেও থাকতে হত সেই ছোকরাদের সঙ্গে। ব্যক্তিগত সেই যন্ত্রণার কাহিনি এখানে বলতে চাই না।

কারিগরের বাসস্থানের একটু পরিচয় দেওয়া যাক। শুয়োরের খোলের মতো একটা ঘর ভাড়া নেওয়া, তাতে দরজা একটা, জানলা নেই। সারাদিন বাল্বের হলুদ আলো জ্বালা, বাকি আলোবাতাস আসে না। বেশ কয়েকজন কারিগর এবং ছোকরা সব মিলিয়ে প্রায় ১৪-১৫ জন ওই রুমে থাকে। গরম লাগলে ছাদে জল ঢেলে ছাদ ঠান্ডা করে তাতে শোয়া, সকাল ৬টায় উঠে পড়া, রাত ৩টেয় শুতে যাওয়া। এই হল জীবন চর্চা।

আপনারা ভাবছেন এই ছোকরা গল্প কেন দিলাম এতক্ষণ? বলি তাহলে।

 

দিল্লির দাঙ্গার লক্ষ্য পশ্চিমবঙ্গ নয়ত?

আগেই বলেছি পূর্ব দিল্লিতে ২২ শতাংশ বাঙালি যার ১৬ শতাংশ মুসলমান। এই হিন্দু মুসলমান দুই সম্প্রদায়েরই ২০ শতাংশ এই এক্সপোর্ট বা সোনারুপোর কারিগর। এরা এমন অঞ্চল থেকে আসে, যারা এক সময় প্রচণ্ড দারিদ্র দেখেছে, এমনকী এদের বাবামায়েরা এদের একবেলা খেতেও দিতে পারত না। এদের সঙ্গে কাটিয়েছি বলেই বলছি প্রমাণও রয়েছে। গ্রামে থাকতে সকাল ৬টায় উঠে এরা যেত জন খাটতে, সেখানেই পেত মুড়ি খেতে, কিংবা দুপুরে চারটি ভাত। ফলে এরা যখন দিল্লিতে আসত শত কষ্টেও ওই চারবেলা ভালোমন্দর (ওগুলোই ওদের কাছে বিরিয়ানির সমান) জন্যই টিকে যেত, নইলে একবেলা না খেয়ে থাকতে হত গ্রামে। এমনকী অনেককে দেখেছি তাদের মাত্র এক জোড়া জামাপ্যান্ট তাও জোড়াতালি দেওয়া। এবার যারা কারিগর হয়ে যায়, তারা বাড়ির মালিকের সাহায্যে, ইলেকট্রিক বিল ইত্যাদি দেখিয়ে ভোটার কার্ড, রেশন কার্ড ইত্যাদি তৈরি করে ফেলে। অর্থাৎ ভ্যালিড ভোটার। এবং এদের পাঠানো টাকায় ওই গ্রামগুলোর আর্থিক কাঠামো অনেকটাই নির্ভরশীল। যাদের বাড়িঘরদোর ছিল না, এই কাজ করে তারা পাকা বাড়ি করেছে, ইলেক্ট্রিক লাইন নিয়েছে, দিল্লি থেকে টিভি কিনে নিয়ে গেছে, এসব আমার স্বচক্ষে দেখা, আপনারাও নিজেরা খোঁজ নিয়ে দেখতে পারেন। পরবর্তীতে তাদের জামাকাপড়, সেন্ট মাখার বহর দেখলে চোখ কপালে ওঠে।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে এসবের সঙ্গে দাঙ্গার কী সম্পর্ক? ভেবে দেখুন পূর্ব দিল্লি বিজেপির কব্জায়। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গ তেমনভাবে নয়। আগেও দেখেছি এবারও দেখেছি, আরএসএসের পূর্ব দিল্লি শাখার লোকজন মাসে অন্তত তিনবার হানা দেয় এই ফ্যাক্টরিগুলোতে। ধমকাতে, যেন ভোট তাদের পক্ষে যায়। এবং এই অ্যাশোআরাম, এবং পরিবারের সারভাইভালের জন্য এরা ভোটও দেয় তাদের। আরএসএসের লক্ষ্য মূলত মুসলিম ভোটার, কারণ হিন্দু ভোটারদের ভোট নিয়ে তারা চিন্তিত নয়। এবার যদি গ্রামবাংলা দখল করতে হয়, তাহলে দাঙ্গা লাগাও, ভয় দেখাও, কান টানলে মাথা আসবেই। অর্থাৎ তোমার দুর্বল জায়গায় আঘাত করো, তুমি মাথা নত করবেই। কলকাতা শহরে বিজেপির চেয়ে গ্রামবাংলায় বিজেপির রমরমা এই কারণেই। অর্থাৎ এখানে ভোট দিলে দিল্লিতে আমার ছেলেপুলেরা শান্তিতে থাকবে, অর্থের জোগান আসবে, সুখে থাকবে পরিবার, আবার ওই অর্থকষ্টের নরকযন্ত্রণা ভোগ করতে হবে না।

একবার ভেবে দেখুন তো এত বড় শাহিনবাগ রইল, ওদিকে ফরিদাবাদ, ওখলা, এদিকে উত্তর প্রদেশের গাজিয়াবাদ, চাঁদনি চক, দরিয়াগঞ্জ, সদর বাজার, ফতেপুরি— মুসলমান কি কম পড়িল দিল্লিতে যে বেছে বেছে পূর্ব দিল্লিতেই করতে হল দাঙ্গা? করতে হল কারণ সারা দেশ এই মুহূর্তে সিএএ, এনআরসি নিয়ে ক্ষুব্ধ, শাহিনবাগ তো প্রতীক হয়ে উঠেছে বিরোধিতার, এদিকে দাঙ্গা করলে তীর ঘুরবে বিজেপির দিকে, সহানুভূতির আবেগটা যাবে বিজেপির বিপক্ষে। তাই শাহিনবাগ যেমন আছে তেমন থাকল, পুলিশ রইল হাতের মুঠোয়, বাকি দিল্লিও থাকল সেফ অ্যান্ড কুল। মাঝখান থেকে কানহাইয়ার পুরোনো কেস রিওপেন হল। সব মিলিয়ে জগাখিচুড়ি, এদিকটা তলিয়ে ভাবার উপায় নেই। এক দীর্ঘদিনের পরিচিত আমার পাশের বাড়িতে থাকা ফ্যাক্টরি মালিকের সঙ্গে দেখা হয়েছিল এবারের দিল্লি সফরে। কথা বলতে বলতে জানাল (নাম নিচ্ছি না সঙ্গত কারণেই), দাদা কী করব জানি না, ওদিকে বাড়িতে বলছে, বিজেপির লোকজন এসে ধমকেছে, তাদের দলে নাম লেখাতে বলেছে, বলো তো এদিকে কাজ করব না ওদিকে দেখব। কতদিন দিল্লি থাকতে পারব জানি না, বাড়ি ফিরলেও তো ছাড়া পাব না। এদিকে আমার প্রায় ৫০ জন কারিগর, তাদের ছোকরা ফুরনের কারিগর সব মিলিয়ে ১৫০ জন আমার দিকে তাকিয়ে আছে, কী করব বলো দেখি। জবাব দিতে পারিনি তাকে। সত্যিই তো কী করবে সে? এখান থেকে যেতে হলে সে একা নয় দেড়শোটা পরিবার গ্রামবাংলার না খেয়ে মরবে, এরকম কত দেড়শো পরিবার সারা পূর্ব দিল্লি জুড়ে। একটা পরিসংখ্যান বলছে শুধু গান্ধিনগরের জনসংখ্যা প্রায় সাড়ে তিন লক্ষ এবং এই জনসংখ্যার ২২ শতাংশই মুসলিম যারা এই জামাকাপড়ের ফ্যাক্টরিতে কাজ করে।

ভেবে দেখুন শাহিনবাগ আন্দোলন চলছে সেই ডিসেম্বরের শেষ দিক থেকে, শুধু শাহিনবাগ কেন কলকাতার পার্ক সার্কাস সহ সারা দেশেই চলছে এই সিএএ, এনপিআর, এনআরসি বিরোধী আন্দোলন, কিন্তু দাঙ্গা একমাত্র কেন হল পূর্ব দিল্লিতে, তাও এমন একটা ব্যবসায়িক জায়গায়, এবং যে জায়গাটা বর্ডার লাগোয়া? লক্ষ্যটা তাহলে কী দিল্লি নয়? কারণ দিল্লিতে সত্যি বলতে কী এই মুহূর্তে দাঙ্গা হওয়ার কোনও ভ্যালিড রিজন নেই। পশ্চিমবঙ্গের যে কটি জায়গায় সম্প্রতি দাঙ্গা হয়েছে, তা দমন করা গেছে ব্যপক ক্ষয়ক্ষতি না করেই। তাই সম্পূর্ণ একটা অন্য মোড়কে দিল্লিতে দাঙ্গা করা হল। যাতে আসল কারণ গুলিয়ে যায়। নিজে গিয়ে, কলকাতা থেকে ফোনে কথা বলে সাংবাদিক হিসেবে নয় একজন মানুষ হিসেবে এই তথ্য ধরা পড়েছে আমার চোখে। হ্যাঁ সাংবাদিক হিসেবে চোখটা ছিল হয়ত, কথা বের করার ক্ষমতাটা ছিল। আমার সঙ্গেই ট্রেনে ফিরেছে কাটোয়ার প্রায় ৫০ জন মুসলিম কারিগর, দিল্লি একটু ঠান্ডা হলে তারা ফিরে যাবে ফের। ২৮ তারিখের বিকানের শিয়ালদহ, ভায়া দিল্লি দুরন্ত এক্সপ্রেসের কামরায় কামরায় এই দৃশ্য দেখেছি, বক্তব্য মোটামুটি এক। আর অর্থের যোগান বন্ধ হলে কিন্তু এই গ্রামগুলো আতান্তরে পড়বে। মনে করে দেখুন কয়েক বছর আগে ঠিক এমনটাই ঘটিয়েছিল শিবসেনা মহারাষ্ট্রে, বাঙালি আর বিহারি খেদাও। কিছুটা সফল হলেও পুরোপুরি পারেনি শিবসেনা। বিজেপি অনেক বড় পরিকল্পনা করে এগিয়েছে। কারণ সহজে এদিকে চোখ যাবে না কোনও মিডিয়া বা বিরোধী পক্ষের নেতার। যদি না কেউ এইসব অঞ্চলে বসবাস করে, এই সব কারিগরদের সঙ্গে ওঠাবসা করে। আমি জানি না, হয়ত আমি ভুলও হতে পারি, কিন্তু তবু তবু এর বাইরে এই মুহূর্তে এটা ছাড়া ভোটের পরপরই দিল্লিতে দাঙ্গা হওয়ার আর কোনও কারণ চোখে পড়ছে না আমার। গান্ধিনগরের চাঁদ মহল্লা, শান্তি মহল্লা, রাজগড়, সুভাষ রোড, রাম নগর, অমর মহল্লা, কৈলাশ নগর, নানক বস্তি, ওল্ড সীলমপুর ভিলেজ, সুভাষ মহল্লা, অজিত নগর, ধর্মপুরা (এখানেই আমার বাড়ি), জৈন মহল্লা, নেহেরু গলি, কৃষ্ণা নগর, লাল কোয়ার্টার, ঝিল, পায়ে হেঁটে ঘুরলে ৩-৪ দিনে কভার করা যায়। লক্ষ লক্ষ বাঙালি এক একটা কামরা ভাড়া করে হয় এক্সপোর্টের ফ্যাক্টরি নয়ত সোনারুপোর কাজ করে চলেছে। এশিয়ার সবচেয়ে বড় কাপড়ের মার্কেটের লাইফ লাইন এই বাঙালিরা, আর এই গান্ধিনগর অনেক বড় লাইফ লাইন পশ্চিমবঙ্গের গ্রাম এবং সীমান্তবর্তী গ্রামগুলির অর্থনীতির। আর এখানেই ঘা দিতে চাইছে বিজেপি। প্রত্যেকটা ঘুঁটি সাজানো, দিল্লির নির্বাচনের ফলাফল প্রকাশ, ট্রাম্পের ভারতে আগমন, শাহিনবাগকে প্রথম পাতা থেকে সরিয়ে মাঝের পাতায় নিয়ে যাওয়া, দাঙ্গার প্রথম পাতায় জায়গা করে নেওয়া, কানহাইয়ার কেস রিওপেন… আর তো কোনও কারণ নেই। ঠিক যেভাবে গুজরাটের দাঙ্গাও হয়েছিল মূলত ব্যবসায়িক এবং বর্ডার এলাকা জুড়ে। এই কারণটাকে আমি অন্তত উড়িয়ে দিতে পারছি না, হয়ত অন্য কারণ আছে কিন্তু মনে হয় না তা খুব একটা ভ্যালিড একটা দাঙ্গা লাগানোর জন্য, কারণ ভোটের ফল প্রকাশের পর এখন আর কোনও কারণ থাকতে পারে না।

ভাবুন বাঙালি, সাবধান হোন, এখনও সময় আছে।