হারুন রশীদ
যেসব পাঠক শব্দ বাক্যের পরতে পরতে রঙ্গ রোমাঞ্চ আর আহ্লাদী সুখের অন্বেষণ করেন কিংবা অলস সময়ে অবসর বিনোদনের জন্য গল্প পড়তে চান, তাদের জন্য নাহার তৃণার ‘স্টুডিও অ্যাপার্টমেন্টে’ কোনও সুসংবাদ নেই। এখানে প্রায় প্রতিটি গল্পে ভিন্ন ভিন্ন প্রেক্ষাপটের নিদারুণ মানবিক যন্ত্রণা লুকোনো আছে। আর আছে মানুষের বহুমুখী চরিত্রের বিচিত্র উদঘাটন। এই সঙ্কলনের প্রতিটি গল্প নিয়ে আলাদা করে আলোচনার সুযোগ আছে। ভবিষ্যতের কোনও সমালোচক সেই কাজটা করবেন। পাঠক হিসেবে আপাতত কয়েকটি গল্পের প্রাথমিক এবং সংক্ষিপ্ত ব্যবচ্ছেদ করা যাক।
‘সেলুন’ গল্পের মধ্যে দুই প্রজন্মের প্রতিদ্বন্দ্বিতার নির্মম বলি হয় এক তরুণী, এটা যেন আমাদের প্রতিদিনের পত্রিকা খুলে পাওয়া একটি ঘটনা। সমাজ বাস্তবতার এই গল্পে অশুভের জয় হয়েছে বলে মন খারাপ হয়। কিন্তু এরকম অপ্রিয় বাস্তবতাই তো আমাদের চারপাশে ছড়ানো। তাদের নিয়ে আমাদের প্রতিদিনের বেঁচে থাকা। হেরে যাওয়া মানুষের সংখ্যাই এই সমাজে বেশি। তাদেরই প্রতিনিধিত্ব করছে গল্পটি।
‘খেলা’ গল্পটি মোটেও খেলাধূলার বিষয় নয়। এখানকার খেলোয়াড় আমাদেরই সমাজপতি। এই গল্প তুলে আনে কৌশলী সংখ্যালঘু নির্যাতনের একটি নিপুণ চিত্র। যে পরিকল্পনা কোথাও না কোথাও বাস্তবায়িত হচ্ছে প্রতিনিয়ত। সুন্দর মুখোশের আড়ালে লুকোনো লোভী মানুষের কুৎসিত লোলুপ চেহারার নগ্ন প্রকাশ ঘটেছে এই গল্পটিতে। খেলা গল্পটিও আমাদের মর্মাহত করে।
‘খেসারত’-এর মার খাওয়া আজমতকে আমরা তো সবাই চিনি। বাসে উঠলেই তাকে দেখা যায় কোনওমতে ঝুলে আছে হাতলের সাথে। যে আজমতকে আমরা পরিহাস করে যাই চিরকাল, তার জন্য লেখকের মমতার ছায়া আমাদেরকেও প্রলুব্ধ করে মায়া ছড়াতে।
এর মধ্যে ‘নিঃসঙ্গ নগরে দ্বিখণ্ডিত চাঁদ’ যেন কিছুটা অচেনা। এই গল্পটি একটু আলাদা। এখানে দুজন অপ্রত্যাশিত চরিত্রের নারী পুরুষের মধ্যে বিচিত্র সম্পর্কের জটিল কিছু সময় পাঠকের মধ্যে উত্তেজনার সৃষ্টি করবে। কিছুক্ষণের জন্য পরিস্থিতির জটিল খেলায় হারিয়ে যাওয়ার সেই উত্তেজনাটি উপভোগ্য। বলাই বাহুল্য এটি একটি থ্রিলার গল্প। তবে এটাই একমাত্র থ্রিলার নয়, ভিন্ন মাত্রার থ্রিলারের স্বাদ নিতে আরও পড়তে পারেন ‘টার্গেট’ কিংবা ‘উলট পুরাণ’।
এই সমাজে ‘কবন্ধ সময়’ আমাদের পিছু ছাড়েনি কোনও সরকারের আমলেই। ভিন্ন ভিন্ন সময়ে ভিন্ন রূপে হাজির হয় তারা। সমাজের নষ্টদের নির্মূল করার অভিযানে কত সুস্থ সুন্দর পরিবার নিঃস্ব হয়ে পড়ে, তার খোঁজ কেবল ভুক্তভোগীরাই জানে। এই গল্পটি আমাদের চেনা সমাজের বলেই হয়তো গল্পটি পাঠের পর এমন কবন্ধ সময় থেকে বেরিয়ে আসার একটা প্রবল আকুতি জেগে ওঠে।
মাঝখানে হঠাৎ করে অন্যরকম একটি গল্প আমাদের সামনে চলে আসে। ‘ফাঁকা ফ্রেম আর অকেজো হাতঘড়ি’ গল্পটি আমাদের মনোযোগ প্রবাহিত করে ভিন্ন এক খাতে। সেখানে এক তরুণী হৃদয়ের হাহাকার যে কোনও পাঠকের হৃদয় স্পর্শ করবে। ভিন্ন আমেজের গল্পটি দীর্ঘ সময় পাঠকের মনকে প্রশ্নবিদ্ধ করবে।
‘তিমির তরঙ্গ’ গল্পটি শুরুতে বুঝতে দেয় না ঘটনা কোনদিকে যাচ্ছে। প্রবাসী ছেলের বিয়ে নিয়ে পিতামাতার স্বপ্ন, পরিকল্পনা সাধারণ কথামালার মধ্যে চলতে চলতে গল্প এগিয়ে যায়। একদম শেষ লাইন আসার আগেও পাঠক সম্পূর্ণ অন্ধকারে। শেষ ধাক্কাটা তাই পাঠকের বুকে একটু গভীরভাবে বাজবে।
সবশেষে ‘স্টুডিও অ্যাপার্টমেন্ট’। একজন শিক্ষিত তরুণ কী বিচিত্র উপায়ে দশ ফুট বাই দশ ফুট একটা ঘরের মধ্যে তার যৌথ পরিবারকে নিয়ে সুখী হবার চেষ্টা করে তার মায়াকাড়া গল্প। গল্পটি পড়তে পড়তে বুকের গভীরে কান্না জমা হয় কোথাও। যে জীবন আমরা অনেকে দেখিনি, সেই জীবন দেখানোর চেষ্টা করেছেন লেখক তাঁর শিল্পসুন্দর লেখনীর মাধ্যমে।
সাহিত্যভূবনে ‘নাহার তৃণা’ একেবারে নবীন না হলেও খুব বেশি গল্প লেখেননি। সামাজিক মাধ্যম এবং সাহিত্য পত্রিকাসমূহে তিনি প্রধানত প্রবন্ধ এবং সমালোচনা সাহিত্যেই বেশি সময় দিয়েছেন। তবু মাঝে মাঝে যে কয়েকটি গল্প লিখেছেন তাতে খুব যত্নের সাথে, আন্তরিক চেষ্টায় সমাজের নানান বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন, মানব চরিত্রের অজানা দিকগুলো চিত্রায়নের চেষ্টা করে গেছেন। এই চেষ্টা থেকে বোঝা যায় লেখক একজন নিবিড় পর্যবেক্ষক। পর্যবেক্ষণের ধারালো প্রকাশ ঘটেছে তাঁর সাহিত্যসম্ভারে। ফলে প্রথম গল্প সঙ্কলন হওয়া সত্ত্বেও পেন্সিল প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত ‘স্টুডিও অ্যাপার্টমেন্টে’ আনাড়ি কোনও গল্প নেই, ভাষার আড়ষ্টতা নেই, যেমনটি হয়ে থাকে অধিকাংশ লেখকের প্রথম সঙ্কলনে।
নাহার তৃণা আরও গল্প লিখবেন ভবিষ্যতে, আরও অনেক ভালো গল্প। কিন্তু এই সঙ্কলনটি অন্য সবগুলোর চেয়ে স্বতন্ত্র। কেননা এই সঙ্কলনের গল্পগুলো লেখকের প্রথম সফলতার বীজপর্ব।