সুব্রত ঘোষ
সংস্কার বিষয়ক এই অত্যন্ত সুখপাঠ্য প্রবন্ধটি প্রকাশিত হয়েছিল 'সমতট' পত্রিকার জুলাই-সেপ্টেম্বর ২০১৪ সংখ্যায়। লেখকের সহৃদয় অনুমতিক্রমে চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম-এর এই সংখ্যার স্টিম ইঞ্জিন বিভাগে লেখাটি পুনঃপ্রকাশিত হল। - স্টেশন মাস্টার
ব্যুৎপত্তিগত অর্থকে হুবহু অনুসরণ করে শব্দকে যদি সর্বদা সেই অর্থেই ব্যবহার করা হত তবে একদিকে বিতর্ককে যেমন দূরে রাখা যেত তেমনই প্রত্যেককেই এক একজন বৈয়াকরণ বানিয়ে ছাড়ত। ব্যাপারটা হয়ত মোটেই সুখকর হত না।
এরকমই এক শব্দ সংস্কার। ব্যাকরণ খুঁজে পাওয়া গেল যে সংস্কার মানে সম-কৃ (করা) + ঘঞ্চ ভাব। সহজ করে বোঝার চেষ্টা করে একটা মানে দাঁড়ায় যে সম্যকভাবে যা করা হয়। জটিলতার দিকে যাওয়ার ইচ্ছে থাকলে আরও অনেক অর্থ খুঁজে পাওয়া যেতেই পারে। কিন্তু মোটামুটি সব অর্থের অভিমুখ এক। অর্থাৎ ভালোর দিকে – শুদ্ধি, শোধন, নির্মলীকরণ ইত্যাদি। আবার এও আছে যে শাস্ত্রাভ্যাসজনিত বাসনা, বহুকালের অভ্যাসজাত মনের ধারণা বা প্রবৃত্তি। প্রথমদিকের শব্দগুলোর সঙ্গে সঙ্গতি রেখে বলা যেতে পারে যে এই বাসনা, মনের ধারণা, প্রবৃত্তিগুলো সবই সম্যক – অর্থাৎ উত্তমরূপে।
এবার এর ব্যবহারিক দিকে একটু তাকাই।
রবীন্দ্রনাথ দিয়ে শুরু করতে হচ্ছে। মাত্র খান কয়েক পাতার মধ্যে দেখতে পেলাম তিনি সংস্কারকে একাধিক বিশেষণে ভূষিত করে তাকে কী অর্থে ব্যবহার করছেন তা বোঝাবার দরকার বোধ করেছিলেন। রবীন্দ্রনাথের সাহায্য নিলে মস্ত বড় সুবিধে এনাকে ঢাল হিসাবে ব্যবহার করলে একেবারে নিরাপদ থাকা যায়।
রবীন্দ্রনাথ সংস্কার শব্দকে বিশেষণ ভূষিত করছেন এমন কয়েকটা উদাহরণ জড়ো করা যাক – পরিষ্কৃত সংস্কার, মূঢ় সংস্কার, অন্ধ সংস্কার ইত্যাদি। একটি বাক্যে তিনি লিখছেন –
‘….. সকলপ্রকার জড়ত্বের মূলে আত্মার প্রতি অশ্রদ্ধা। জন্তু পায় নি তার স্বরাজ, কেননা সংস্কারের দ্বারা সে চালিত (‘ভারতপথিক রামমোহন রায়’)।
সংস্কারটা যে ভাল সেটা বোঝাতে যেমন ‘পরিষ্কৃত’ শব্দ ব্যবহার করতে হল তেমনই খারাপ বোঝাতে তিনি সাহায্য নিলেন ‘মূঢ়’ বিশেষণের।
হঠাৎ সংস্কৃত ভাষার দিকে চোখ পড়ল। ভাষার নাম সংস্কৃত হল কেন? কোনও একটা ভাষাকে শুদ্ধ করে, শোধন করে, নির্মলীকরণ করে কি এ ভাষার সৃষ্টি হয়েছে?
অনুসন্ধানে নেমে এমন একটা বইয়ে পৌঁছোন গেল যে বইটা অনেক বিতর্কের সৃষ্টি করে প্রকাশককে বাধ্য করেছিল বাজার থেকে তুলে নিতে। ২০০৯ সালে Penguin Press, New York প্রকাশিত “The Hindus -An Alternate History”, লেখিকা Wendy Doniger। হিন্দু ধর্মাবেগকে আহত করার অভিযোগ ওঠায় প্রকাশককে এমন সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছিল। আমাদের প্রয়োজনীয় অংশ অবশ্যই এ সব বিতর্ক বহির্ভূত, নিরীহ। বইয়ের (ইন্টারনেট থেকে প্রাপ্ত) একেবারে গোড়ার দিকে লেখিকা লিখছেন –
…… the privileged men who recorded the text always had access to oral texts as well as to the Sanskrit that was his professional language. Most people who knew Sanskrit must have been bilingual; the etymology of ‘Sanskrit’ (‘perfected’, artificial) is based upon as implicit comparison with ‘Prakrit’ (“primordial’, natural), the language actually spoken.
একটু বিপদে পড়লাম। ‘perfected’ ভাল জিনিস কিন্তু আবার যে ‘artificial’ বললেন। artificial-কে তো আমরা কখনও ভালো চোখে দেখি না। তার মানে সংস্কার ভালও হয় আবার উল্টোটাও হয়? আবার যেটা ‘অসংস্কৃত’ অর্থাৎ প্রাকৃতকে বলছেন – natural – যেটাকে আমরা ভালোভাবে নিই।
চিন্তার পিঠে চিন্তা আসে – মনে পড়ে গেল সবচেয়ে বিতর্কমূলক বিষয়। আর্থিক সংস্কারের ব্যাপারটা। এও তো সংস্কার। এক দল বলছে আর্থিক সংস্কারই সব দেশের মানুষের দারিদ্রমোচনের সর্বরোগহর ওষুধ। আর একদল বইপত্র, পরিসংখ্যান ঘেঁটে দেখাচ্ছেন যে মুক্ত অর্থনীতি ও আর্থিক সংস্কারের ফলে সারা পৃথিবীতে ধনী ও দরিদ্রের মধ্যে বৈষম্য অনেক বেড়ে গেছে। আরও সমস্যা হচ্ছে যে পাশ্চাত্য সংস্কৃতি পৃথিবীর পিছিয়ে পড়া দেশগুলোর নিজস্ব সংস্কৃতিকে প্রকৃত অর্থে গিলে খাচ্ছে। বাজার অর্থনীতির দৌলতে সামাজিক বন্ধনগুলো শিথিল হয়ে যাচ্ছে। মঞ্চে অভিনীত এক বাংলা নাটকের এক বিপণন বিভাগের বড়কর্তা তাঁর অধস্তনকে শিক্ষা দিচ্ছে – বাবাকে বাবা হিসেবে দেখো না, বাবাও একটা মার্কেট। বাবার এক সংসারে যদি পুত্র বাস করে তবে চেষ্টা চালাও যাতে সে সংসারে আগুন ধরে। তবে একটা ভেঙে দুটো সংসার হলে তোমার পণ্য আর একটা বিক্রি হবে। এটাই বাজার অর্থনীতির চেহারা। হয়ত একটু বাড়াবাড়ি হয়ে গেল।
আর্থিক সংস্কারের বিরোধীদের মধ্যে যাঁরা একটু চিন্তাশীল তাঁরা বলছেন – এটা একটা প্রয়োজনীয় আপদ – necessary evil।
তাহলে সংস্কার ভালো না খারাপ সেটা কী ব্যক্তিবিশেষের ধারণা বা perception-এর ওপর নির্ভর করে করবে। এরকমভাবে ব্যাপারটাকে সহজে ছেড়ে দেওয়া যায় না। হাজার হোক আমরা ভারতীয়রা তো তর্কপ্রিয়।
আগেকার দিকে সমাজ সংস্কারক বলে একদল মানুষ ছিলেন বলে আমরা জানি। তাঁদের নাম আমরা এখনও শ্রদ্ধার সঙ্গেই স্মরণ করি। কারণ এখানে এই সংস্কার ভালো। বিদ্যাসাগর সম্বন্ধে রবীন্দ্রনাথ বলছেন –
‘তিনি কেবল দ্বিজ ছিলেন না, তিনি দ্বিগুণ জীবিত ছিলেন’। আরও বলছেন – ‘আমাদের মতো অপমানিত দেশে ঈশ্বরচন্দ্রের মতো অখণ্ড পৌরুষের আদর্শ কেমন করিয়া জন্মগ্রহণ করিল আমরা বলিতে পারি না। কাকের বাসায় কোকিলে ডিল পাড়িয়া যায় মানব-ইতিহাসের বিধাতা সেইরূপ গোপন কৌশলে বঙ্গভূমির প্রতি বিদ্যাসাগরকে মানুষ করিবার ভার দিয়াছিলেন (‘চারিত্রপূজা’)।
আবার রামমোহনের প্রতি শ্রদ্ধা জানাচ্ছেন – ‘আমাদের এখনকার কালে তাঁহার মতো আদর্শের নিতান্ত প্রয়োজন হইয়াছে। আমরা কাতর স্বরে তাঁহাকে বলিতে পারি-
‘রামমোহন রায়, আহা, তুমি যদি আজ বাঁচিয়া থাকিতে! তোমাকে বঙ্গদেশের বড়ই আবশ্যক হইয়াছে। আমরা বাকপটু লোক, আমাদিগকে তুমি কাজ করিতে শিখাও। আমরা আত্মভরি, আমাদিগকে আত্মবিসর্জন দিতে শিখাও। আমরা লঘুপ্রকৃতি, বিপ্লবের স্রোতে চরিত্রগৌরবের প্রভাবে আমাদিগকে অটল থাকিতে শিখাও। আমরা বাহিরের প্রখর আলোকে অন্ধ, হৃদয়ের অভ্যন্তরস্থ চিরোজ্জ্বল আলোকের সাহায্যে ভালোমন্দ নির্বাচন করিতে ও স্বদেশের পক্ষে যাহা স্থায়ী ও যথার্থ মঙ্গল তাহাই অবলম্বন করিতে শিক্ষা দাও’ (‘ভারতপথিক রামমোহন রায়’)।
যে দুই ব্যক্তির বন্দনা আমরা শুনলাম এঁনারা ‘সমাজ সংস্কারক’ এই শিরোপায় উদ্ভাসিত। জানি না কোন সময়ে আমাদের বঙ্গের প্রাত্যহিক অভিধান থেকে এই শব্দদ্বয় অপহৃত। আজকাল এই প্রজাতি বঙ্গদেশ থেকে বিলুপ্ত। কারণ কি এটাই যে বাঙালীর সমাজের আর সংস্কারের প্রয়োজন নেই? ১২৯১ খ্রিস্টাব্দে রামমোহন রায়ের উপস্থিতি সে সব কারণে প্রার্থনা করা হয়েছিল সে সব দোষ থেকে বাঙালী এখন মুক্ত? এখন যাঁরা বুদ্ধিজীবী বা চিন্তাবিদ বলে পরিচিত তাঁরা সংখ্যায় অধিক এবং তাঁদের প্রতি প্রগাঢ় শ্রদ্ধা বজায় রেখেই বলা যেতে পারে এঁদের সরাসরি সমাজ সংস্কারকের শিরোপা দেওয়া হচ্ছে না।
সংস্কার নিয়ে এতগুল শব্দ খরচ করার পরও সংস্কারের আরও গোলমেলে জায়গায় ঢুকে পড়া যাক। এর উৎপত্তি কেবল আমাদের প্রাত্যহিক শব্দ ব্যবহারে নয়, সাহিত্যেও প্রবল উপস্থিতি।
সমস্যার উৎপত্তি সংস্কারকে কু এবং সু নামে ডাকা। সু একটা উপসর্গ হওয়াতে সুসংস্কার কথাটা প্রথম থেকেই ব্যাকরণের অনুমোদন পেয়ে বসল। ‘কু’-টা উপসর্গ না হওয়ায় সরসারি বৈধতা পায় না। তবে বহুল ব্যবহারের পরে ঘুরপথে এটা জাতে ওঠে।
সমস্যার মূলে থেকে গেছে কু এবং সু নিয়ে এক অগোছালো চিন্তা। আরও স্পষ্ট করে বলতে গেলে বলতে হয় ধারণার অস্বচ্ছতা। কোনটাই বা সুসংস্কার। কোনটাই বা কুসংস্কার। আবার বিশেষণবিহীন সংস্কার কাকে বলা হবে। এ সব কটার যথেচ্ছ ব্যবহার সমস্যাকে জটিলতর করেছে।
অভিধানের মধ্যে প্রবেশ করলে এই জটিলতা বহু সময়েই দ্বিগুণিত হয়। আমরা যারা সেকেলে মানুষ তারা সুবল মিত্রের অভিধানকে বেশ পছন্দ করি। সেখানে দেখছি সংস্কার, কুসংস্কার শব্দ দুটো আছে, সুসংস্কার বলে কোনও শব্দ নেই – অথচ সুসংস্কৃত বিদ্যমান। পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি প্রকাশিত ‘আকাদেমি বাংলা অভিধানে’ – সংস্কার, সুসংস্কার, কুসংস্কার, সুসংস্কৃত – সবারই শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান।
যেটাকে ধারণার অস্বচ্ছতা বলা হয়েছে সেটা দূরীকরণে সচেষ্ট হয়ে রবীন্দ্রনাথ বলেছেন – ‘যতক্ষণে তুমি তোমাকে বিশেষ সংস্কারের একটা সন্তোষজনক কারণ দেখাতে না পার ততক্ষণ আমি তাকে কুসংস্কার বলব (‘য়ুরোপ-প্রবাসীর পত্র’)।
কয়েকটা শব্দ আমাদের চিন্তিত করে তুলল। এক – ‘বিশেষ সংস্কার’, দুই – ‘সন্তোষজনক’। বিশেষ সংস্কার বললে বোঝা যায় যে অ-বিশেষ সংস্কারও হয় অর্থাৎ সংস্কার ব্যুৎপত্তিগত অর্থ অনুসরণ করে অর্থাৎ যা সম্যক সেটাই অ-বিশেষ। অ-বিশেষত্ব বর্জন করাতে গেলে অন্য বিশেষণের সাহায্য নিতে হয়। যার উদাহরণ রবীন্দ্রনাথ থেকে প্রবন্ধের প্রথম থেকেই ব্যবহার করা হয়েছে।
এর চেয়ে বড় সংশয় ‘সন্তোষজনক’ কাকে বলব। এই উত্তর কারোর পক্ষেই সন্তোষজনক হওয়া মুশকিল। সুবল মিত্র কুসংস্কার শব্দের অর্থ করেছেন – ‘ভ্রান্ত সংস্কার, ভ্রান্তিমূলক ধারণা বা বোধ’। আবার প্রশ্ন – কোনটা ভ্রান্ত কীভাবে ঠিক হবে, কে ঠিক করবে। অভ্রান্ত হলেই রবীন্দ্রনাথের কাছে সন্তোষজনক।
অভ্রান্ত কাকে বলব, কে সেটা ঠিক করবে এর উত্তরে মিত্র মশাই বলেছেন – ‘বর্তমান প্রণালী ক্রমে’ এবং ‘শিক্ষিত ব্যক্তিরা’। প্রথমটা রীতি অনুযায়ী, অর্থাৎ ইংরাজীতে যাকে বলে – by convention, আর দ্বিতীয়টাতে তর্ক এড়াতে শিক্ষিত বলতে স্কুল/কলেজ/বিশ্ববিদ্যালয়ের তকমাধারীই বুঝিয়েছেন। কেউ বলতে পারেন শিক্ষিত বলতে চিন্তাশীল বুঝিয়েছেন। চিন্তাশীল খুঁজে বেড়ানো বেশ কঠিন কাজ – তার জন্য চিন্তাশীল লোকের দরকার।
যুক্তিবাদী মানুষ বলছেন – কুসংস্কার সেটাকেই বলব যেটা কার্য-কারণ সম্বন্ধ দিয়ে খাড়া করানো যায় না। এটাতো বিজ্ঞানীদের কথা। রবীন্দ্রনাথ বিজ্ঞানী না হয়েও তো একই কথা বলেছেন – ‘যাকে বলি বিজ্ঞান, সায়ান্স, তার প্রধান লক্ষণ হচ্ছে জ্ঞানের মধ্যে অপরাজিত যত্ন। কোথাও আন্দাজ খাটবে না, খেয়ালকে মানবে না, বলবে না ‘ধরে নেওয়া যাক’, বলবে না ‘সর্বজ্ঞ ঋষি এই কথা বলে গেছেন’ (‘জাভা-যাত্রীর পত্র’)’।
এবার ‘সু’ আর ‘কু’-র দ্বন্দ্ব (না ধন্দ?) নিয়ে একটু কূটকচালি করা যাক। তাবিজ, মাদুলি, জ্যোতিষ ইত্যাদি এক বিশাল অংশের কাছে কুসংস্কার বলেই গৃহীত। কারণ আগের দেওয়া যুক্তিতে কার্য-কারণ সম্পর্কের ছাঁচে এদের ফেলা যাচ্ছে না।
অন্য কতকগুলো উদাহরণ টেনে আনা যাক। প্রত্যেক সমাজের কিছু রীতি আছে – আমাদের আছে। দেখা হলে নমস্কার বিনিময়, গুরুজনদের পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করা, কোলাকুলি করা, এমনকী বিদেশি কায়দায় করমর্দন – এগুলোর একটাকেও তো কার্য-কারণের যুক্তিতে ফেলা যাচ্ছে না। এদের তো আমরা কুসংস্কার বলি না। নতুন শব্দ সংযোজন করে এদের ‘সামাজিক রীতি’ বলে অভিহিত করি।
এর যুক্তি হাতড়ালে বোধহয় পাওয়া যায় যে এই সব ‘সামাজিক রীতি’গুলো সার্বিকভাবে সমাজের কোনও ক্ষতি করে না বা পচন ধরায় না, যেটা কুসংস্কারগুলো করে।
বাকি থাকে সুসংস্কার বা অলঙ্কারহীন সংস্কার। সংস্কারের সাথে ‘সু’ উপসর্গ যোগ করার প্রয়োজনই আমরা বোধ করি না। ব্যবহারের ব্যঞ্জনাতেই তার প্রকাশ। বিদ্যাসাগর বা রামমোহনকে যখন সমাজ-সংস্কারক বলা হয় তখন বলার প্রয়োজন পড়ে না যে ওনারা সমাজের সুসংস্কারক। ঠিক একইভাবে যখন ব্যক্তিবিশেষকে সংস্কারগ্রস্ত বলা হয় তখন এটা স্বচ্ছ যে তাঁকে কুসংস্কারগ্রস্তই বলা হচ্ছে।
সুবল মিত্র যাদের শিক্ষিত ব্যক্তি বলেছেন তাঁদের ব্যবহার আমাদের সবচেয়ে ধন্দে ফেলে। এঁদের বিচারে গ্রামের শিক্ষার সুযোগ না পাওয়া দরিদ্র মানুষ যখন মা শীতলার তুষ্টি বিধানে দণ্ডি কাটে তারাই কুসংস্কারগ্রস্ত। তিনি নিজে বিজ্ঞান বিষয়ে শিক্ষিত কেবলই নয়, বিদেশী বিশ্ববিদ্যালয়ের মস্ত বড় তকমাধারী। হাতের আঙুলগুলোতে বিভিন্ন পাথর-খচিত আংটি(নিজের মঙ্গল আশায়), তাঁর একমাত্র ডাক্তারী পাশ পুত্রের অনেক কুষ্ঠি-ঠিকুজি মিলিয়ে বিয়ে দিয়েও সে বিয়ে এক বছরের বেশী টেঁকাতে পারেন না।
এ সমস্ত কর্মধারায় তাঁদের বিজ্ঞানের কোনও তত্ত্ব দিয়েই কার্য-কারণ সম্পর্ককে প্রতিষ্ঠিত করতে পারেন না। বালাই-ষাট, তিনি কুসংস্কারগ্রস্ত হতে যাবেন কোন দুঃখে। তিনি তো বিশ্ববিদ্যালয়ের তকমাধারী।
এঁদের কথাই প্রয়াত অর্থনীতিবিদ অশোক রুদ্র বলেছেন ব্যাখ্যা করে।
অশিক্ষিতদের নিয়ে কোনও সমস্যা নেই। কারণ তাদের যে বিশ্বাস (যেটাকে অন্যেরা কুসংস্কার বলছে) তাতে কোনও খাদ নেই। বিশ্বাস করে এবং মিথ্যা যুক্তির জাল বুনে এমন কোনও চেষ্টা তারা করে না যাতে যুক্তিগ্রাহ্য হয়ে ওঠে। অন্যদিকে এই তথাকথিত শিক্ষিতরা হয়ত মনে এক দংশন অনুভব করেন (সত্যি কি করেন?)। তাই বাস্তু শাস্ত্র মেনে বাড়ি করার যুক্তিটা পৃথিবীর চুম্বক-ক্ষেত্রের সাথে যে একটা ‘বৈজ্ঞানিক’ সূত্রে গাঁথা সেটাকে প্রমাণ করতে গিয়ে বিজ্ঞানের জগাখিচুড়ি বানিয়ে ফেলেন। যদি পৃথিবীর চুম্বক-ক্ষেত্রের সাথে বাড়ির অবস্থানের সম্পর্ক থাকেও তার সাথে সেই ব্যক্তি বা তার পরিবারের শুভ-অশুভের সম্পর্ক বোঝাবার জন্য অনেক অনেক বড় বিজ্ঞানী হওয়া দরকার।
এই মানসিকতার প্রতি রবীন্দ্রনাথের কটাক্ষ আরও তীক্ষ্ণ ও সরাসরি।
…. যখন নিতান্ত নিশ্চয় জানা যায় যে, জগৎকার্য অপরিবর্তনীয় নিয়মে বদ্ধ, তখন কাজেই পেটের দায়ে, প্রাণের দায়ে, তাহার নিকট ঘাড় হেঁট করিতে হয়। তখন বিজ্ঞানের বাহিরে অনিশ্চয়ের হস্তে আত্মসমর্পণ করিতে সাহস হয় না। তখন মাদুলি তাগা জলপড়া প্রভৃতিকে গ্রহণ করিতে হইলে ইলেকট্রিসিটি, ম্যাগ্নেটিজম, হিপ্নটিজম প্রভৃতি বিজ্ঞানের জাল মার্কা দেখিয়া আপনাকে ভুলাইতে হয়। আমরা নিয়ম অপেক্ষা অনিয়মকে যে ভালোবাসি তাহার একটা গোড়ার কারণ আছে। আমাদের নিজের মধ্যে এক জায়গায় আমরা নিয়মের বিচ্ছেদ দেখিতে পাই (‘পঞ্চভূত’)’।
…. তাই আমরা জীববিজ্ঞান বা বস্তুবিজ্ঞানই পড়ি, আর রাষ্ট্রতন্ত্রের ইতিহাসে পরীক্ষাই পাশ করি, ‘কর্তার ইচ্ছায় কর্ম’ এই বীজমন্ত্রটাকে মন হইতে ঝাড়িয়া ফেলিতে পারি না (‘কালান্তর’)’।
বানান অপরিবর্তিত