বেবী সাউ
লেখক কবি ও গদ্যকার।
কারা যেন দপদপ শব্দ করে দ্রুত পেরিয়ে গেল পথ! সমস্ত নির্ভরতা কেঁপে উঠল তারপর যেন কিছু হয়নি ভাব! চারপাশের জানলাগুলো ততক্ষণে খুলে গেছে এবং চৌকো, গোল, লম্বাটে শেপের বিভিন্ন মুখমণ্ডল জানলার রেলিঙে আটকে পড়েছে। একে অপরের প্রতি জিজ্ঞাস্য দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে আছে কিন্তু কেউ কোনও কথা বলছে না। শব্দহীন এই দৃশ্য পরিবেশটিকে আরও নিস্তব্ধ এবং গম্ভীর করে তুলছে। বিচারক শেষ রায় দেওয়ার মুহূর্তে ঠিক যেরকমটা হয়! কিন্তু ততদিনে আমরা পেরিয়ে এসেছি শীতের জবুথুবু রাত এবং বন্ধ দরজা। হালকা হালকা বাতাস, দখিনা বাতাস না এলেও ঘরের মধ্যে সিলিং ফ্যান চলছে। মৃদু। পাশের কোনও বাড়ি থেকে ক্যাঁচার-ক্যাঁচ শব্দ ওই হেঁটে যাওয়ার শব্দগুলোকে আবছা এবং রহস্যপূর্ণ করে তুলল। যেন আরও গম্ভীর হল এই পরিস্থিতি এবং তার ভয়াবহতা।
–কারা ছিল?
–বসন্ত নয় তো? তার সাঙ্গোপাঙ্গ?
সামান্য এই কটি শব্দ রাতের নিস্তব্ধতার মুহূর্তটিকে ফালাফালা করে বানিয়ে দিল এক আশ্চর্যতম কোলাহলমুখর মধ্যরাত! আর অসংখ্য দৃশ্য, দৃষ্টি থেকে হারিয়ে গেল পথ। অসংখ্য ভাবনা এবং কল্পনা একে অপরের হাত ধরে একে একে ছুটে আসতে লাগল…
আসলে সমস্ত পথ অনন্তের। যেখানে সবাই জানা-অজানায় যেতে চায়। কিন্তু নদীর মতো, কাঁটার মতো সে পথের ঠিকানা জেনে শেষ পর্যন্ত কেউ পৌঁছাতে পারে না। শেষ পর্যন্ত শুধুই শূন্য পড়ে থাকে। যে শূন্য নিয়ে শুধু ফুটবল খেলতে শেখে মানুষ! প্রাপ্তিও আসলে সেই শূন্য!
কিন্তু ততক্ষণে শব্দে উঠে এসেছে বসন্ত এলে কী কী বিপ্লব ঘটে যেতে পারে! কীভাবে বদলে যেতে পারে বিরাট ইতিহাসের পৃষ্ঠা আর কাঁপন লাগতে পারে সেইসব বটবৃক্ষের পল্লবে! আলোচনা যেহেতু দীর্ঘ গলার মতো এবং তা ইলাস্টিকের মতো বাড়তে থাকে বাড়তেই থাকে… সেদিকে লক্ষ রেখে সমস্ত পাড়াটি চঞ্চল হয়ে উঠল! মানুষ একে অপরের প্রতি বিশ্বাস অবিশ্বাসের প্রশ্ন নিয়ে উৎসুক হয়ে উঠল আরও। বিষণ্ণ করিডোর ফিসফিস করে আঙুল চাপা দিল ঠোঁটে। দেখা গেল, আঙুলে লেগে আছে সিগারেটের ছ্যাঁকা খাওয়ার দাগ। ততোধিক বিষণ্ণতার সহিত দুটো উজাগর চোখ অপেক্ষায় বলে উঠল…
–এই শীত অসহ্য! অসহায়! বসন্তের আসার সময় হয়েছে!
সমস্ত পাড়াটি মুহূর্তে মোড় নিল সেই বিষণ্ণ করিডরটির দিকে। এই ঘুরে দাঁড়ানো চোখগুলো ছিল রজঃস্বলার রক্তের মতো… ফলে, বিষয়ান্তরে যাওয়ার জন্য করিডরটি একসময় চুপ করে নিজস্ব মোবাইলে লগ ইন করল ফেসবুক। স্মাইলি সহযোগে লিখল, বসন্ত কবে আসবে ভাস্কর… তার সঙ্গে দু পেগ ভদকা খাব!
মৃত মুখগুলো এই পোস্টে দিল অজস্র লাইক, লাভ রিয়্যাক্ট এবং স্যাডের চিহ্ন। বসন্ত যে প্রকৃত স্বভাবে মাতাল এক যুবক, যুবতীটির প্রতি তাদের সহানুভূতিও ঝরল কিছুটা। অন্তর এবং ব্যবধান জুড়ে হিসেবনিকেশও করে ফেলা হল খানিক। সমাজ, আজকালের শিষ্টাচার এবং ‘নিজের ভালো বুঝতে না শেখা/ আখের গুছাতে’ না পারা সেইসব গণ্ডমূর্খদের জন্য হাপিত্যেশও করল কেউ কেউ! একটা জমাটি ব্যাপার হচ্ছে ভেবে, যাদের অ্যানুয়াল পরীক্ষা সমাগত তারাও উৎসুকভাবে চেয়ে রইল তাদের মাতা-পিতাদের মুখের প্রতি। কেউ কেউ অবশ্য কবিতা উৎসবের লিস্ট বানানো নিয়ে এত ব্যস্ত হয়ে পড়ল, যেন পৃথিবীর গুরুত্বপূর্ণ বিপ্লব বলো, বসন্ত বলো লুকিয়ে আছে এই চার মিনিটের কবিতা পাঠের অনুষ্ঠানে!
আর তখনই এরকম একটা পথের হেঁটে যাওয়া, কোলাহলমুখর সামাজিকতা, অভিমানভরা চপ্পলের ঘর্ষণ ভেঙে ডেকে উঠল একটা কুহু…
কুহু…
কুহু…
আমরা একে অপরে মুখ চাওয়া-চাওয়ি করলাম। ভাবলাম সকালেই দোল। হলুদ এবং লাল পলাশের পাপড়ি সংগ্রহ করা প্রয়োজন। প্রয়োজন প্রয়োজনের অতিরিক্ত জল এবং শ্যাম্পুর সংরক্ষণও। অবশ্য কেউ কেউ উপদেশ দিল আবিরের সঙ্গে মিলিয়ে দেওয়া যেতে পারে রক্তজবা এবং অলক্তিকার রঙ। কেউ কেউ সাদা পোশাকে আবির খেলা উচিত নাকি কোনও রাজনৈতিক দলের চিহ্নে নিজেকে মুড়ে, যাতে অনুদান পেতে সহজ হয়! যাইহোক, আমরা সবাই এসব ঘটনার দিকে ততক্ষণে নিজেদের মুড়ে ফেলেছি…
আর তখনই… ঠিক তখনই একটা তীক্ষ্ণ, তীব্র শব্দ আমাদের উৎসবকে কাঁপিয়ে দু ফালা করে দিল… আমাদের মন্দির চত্বরে লুটিয়ে পড়ল রক্তাক্ত লাশ… সরু নদীর মতো রক্তের রেখা, মার্বেলের সিঁড়ি ভেঙে, সাজানো তুলসীমঞ্চ পেরিয়ে কালো পিচ রাস্তার দিকে এগিয়ে চলল! আমরা সমবেতভাবে চিৎকার করে উঠলাম…
চিৎকার করে উঠলাম…
দেখলাম… এবং শিউরে উঠলাম… তারপর ভয়ার্ত মুখগুলো টিমটিমে হলুদ আলোয় ফ্যাকাসে হয়ে উঠল… ওই চৌকো, লম্বাটে, চ্যাপ্টা মুখগুলো…
বসন্তকে দেখলাম। আমাদের নিস্তব্ধ পরিবেশ আরেকবার শিউরে উঠল। বসন্তের লাশ ওটা নয় ভেবে মুখগুলো কিছুটা হলেও উজ্জ্বল হল!
আর উৎসুক হয়ে দেখল, বিদ্রোহের পতাকা হাতে এগিয়ে আসছে বসন্ত…
পতাকাটি রক্তাভ পলাশ নয়…
দুধ সাদা… রংহীন
শান্তির নিঃশ্বাস নিতে চাইছে… বাঁচতে এবং বাঁচার আশ্বাস নিয়ে হাঁটতে চাইছে পথে, পথে…