Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

এ মাসের কবি: সব্যসাচী সান্যাল

এ মাসের কবি: সব্যসাচী সান্যাল । আলোচনা: অমৃতা সরকার

সব্যসাচী সান্যালের কবিতা


সম্পাদককে লেখা চিঠিপত্তর

বইঃ প্রিয় পিয়ক্কড় (২০১৬)

 

হ্যাঁ, সমস্ত কিছুই লেখা হয়ে গেছে। আমার কথা, আমার ছায়ার কথা, তার অভ্যাস, ধর্ম ও শীতের দুপুরে বাগানে দাঁড়িয়ে আলগোছে জল খাওয়ার কথা কেউ না কেউ লিখে রেখেছেন—কোথাও নিশ্চয় ভালো করে খুঁজলে অনন্য রায়ের, শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের কবিতায় ক্যাম্ব্রিয়ান যুগের পাশে ক্লাসে বিবর্তনবাদ পড়ানো আমার আকৃতি দেখতে পাবেন, আপনার নখ খোঁটার ভঙ্গি, মুঠির মধ্যে চোয়াল আটকে রাখার ভঙ্গিও দেখতে পাবেন। বদলানো বাজার অর্থনীতি, অধিকাংশ ইয়োরোপে ইউরো-সংক্রান্ত বিপর্যয় হল, গ্রীসে স্পেনে জমির দাম বাড়ল, খোলা বাজারনীতির পরে ভারতের অভ্যন্তরীন বাজার ও উৎপাদন যে আজ সেন্সেক্সের সাথে উঠছে নামছে- এ’সমস্ত নিয়ে  মার্কেটিং স্ট্র্যাটেজির বিবর্তন নিয়ে রবীন্দ্রনাথ, অনাথবন্ধুতে যদি না পান, মহাভারতে নিশ্চয়ই পাবেন। এমনকী ২০১০-এ ভোর তিনটের সময় গল-পাথরের যন্ত্রণায় অজ্ঞান হয়ে যেতে যেতে আমি দেখতে পাচ্ছিলাম রেডিওলজি’র ঘরে ঝনঝন করে জ্বলে উঠছে আলো, জেলের টিউব আর ইঞ্জেকশান হাতে আবছায়া উঠে দাঁড়াচ্ছেন নার্স—সেও নিশ্চয়ই কোথাও লিপিত আছে, কিছু না হলে “আ পিকচার ইজ ওয়ার্থ আ থাউজ্যান্ড (মানডেন) ওয়ার্ডস”—রবি বর্মা বা সারদা উকিলের ছবিতে খুঁজলে কী আর পাবেন না? আমাকে ভুল বুঝবেন না প্রিয় সম্পাদক, আমি আর কবিতা লিখছি না। আমি শুধু হাতের লেখা অভ্যাস করছি। 

 

প্রিয় সম্পাদক,

প্রবল গ্রীষ্মের মধ্যে শীতের প্রসঙ্গ, বসন্তের কথা এতটুকুই আমাদের, সুখী মানুষেরা বিচ্ছেদের কথা বলে, আলো নিভিয়ে হিজর-এর গান শোনে অন্ধকারের ভেতরে বাদলা পোকা ওড়ে অন্তহীন—আমি এতদিনে জেনে গেছি কমপ্লিকেশান-ই একমাত্র বাস্তব, বাকীটুকু ভাতঘুমের মত জৈবিক—যা বস্তুর চেতন থেকে অজানিতেই দূরে ঢলে পড়ে। প্রিয় সম্পাদক,  বাস্তবের বাইরে নিঃশ্বাস প্রশ্বাসের সঙ্গে বুক ওঠে, নামে আমি তার সাথে অবিচ্ছেদ্য জুড়ে আছি—ফলে এই রিদম থেকে বিচ্যুত হয়ে নিজের হাতের থেকে সরে এসে পেথিডিনের সিরিঞ্জ নিয়ে খেলা করা ঘোলাটে বেড়ালের দিকে চটিও ছুঁড়তে পারি না…

 

প্রিয় সম্পাদক,

আমি বেড়াতে এসেছি, আপনার ও আমার অবস্থানগত পার্থক্যের মধ্যে বেড়াতে এসেছি—এখানে কুড়িয়ে পাচ্ছি রজঃস্বলা ঝিনুকের সারি, মুক্তোর ক্রিস্টালিনিটি থেকে দূরে, আরো দূরে। প্রিয় সম্পাদক, মানুষের ইতিহাস বলে সভ্যতার পূর্বে সে তার গুহাবাসি আঙুল তুলে এনেছিল একাধিক ঊরুসন্ধি থেকে আর গুহার দেয়ালে নানা রসের স্থিরচিত্র এঁকেছিল যা ব্ল্যাকলাইটেই কেবল দৃশ্যমানতা পায়—সে শবর ছিল, জুগাড়ু ছিল—এক চড়ুইভাতির দিনে বন্ধ হল্ট স্টেশানে এসে সে মদের হাঁড়ির খোঁজ পেল—আর নেশার জোগাড়ের জন্য কৃষিকাজের কথা ভেবে উঠল। এর পর সম্পত্তির কথা আসে, উত্তরাধিকারের কথা—এই সূত্রে তার বৃন্দযৌনতার থেকে সরে আসা। আমি যে আমার উত্তরাধিকারের জন্যে মানুষের মন থেকে সমাজ থেকে সরে আসব—এও তো স্বাভাবিক, আর যা স্বাভাবিক তাকে নিয়ে আর যাই হোক যুক্তিগ্রাহ্যতার কথা বলবেন না, প্লীজ।  প্রিয় সম্পাদক, আমাদের অবস্থানগত পার্থক্যের মধ্যে বেড়াতে বেড়াতে আমি কাচের ওপারে দেখতে পাচ্ছি মানুষের স্বভাব কাঁচা পেঁপের মত সবুজ—নক্ষত্রের জন্য উদ্দিষ্ট তাদের গানগুলি একের ওপর এক জমে উঠছে—গণনার জন্য অপেক্ষা করা টাকার বান্ডিলের মত…

 

প্রিয় সম্পাদক,

আচমকা শেষ হয়ে যাওয়া রেখা, তট এই সব আমার প্রক্রিয়া—জানেনই তো আয়ু থেকে সময় বার করে লিখতে হয়—প্রজ্ঞা মাত্রেই কাউন্টার-প্রোডাক্টিভ এটা বোঝার জন্য প্রজ্ঞা অর্জন করার প্রয়োজন হয় না—যখন সর্বনাম সমেত পিঠ ঠেকে যায় দেয়ালে—তখন মেঘ কাটে, মানুষ দেখতে পায় রেসভেরাট্রল নিয়ে ৯০% গবেষণা স্পন্সর করছে ক্যালিফোর্নিয়ার ওয়াইন ইন্ডাস্ট্রি। বাই দ্য ওয়ে দেশী সূলা যথেষ্ঠ ভাল কাবার্নে বানায়—তথাপি আমি কারাকাসের মত খোয়া ওঠা রাস্তার গন্ধ, বৃষ্টিতে পীচফল মেশানো গন্ধের ওয়াইন অন্যত্র খাইনি কখনো—অবশ্য পাসপোর্ট খুলে ভেনিজুয়েলা’র অভিজ্ঞান দেখাতে পারব না—বলে রাখা ভাল ক্যালিফোর্নিয়ার কার্লো রোসি ওয়াইনে আমি কেবল কেরুয়াক, ভ্যাগাবন্ড আর অড্রি হেপবার্নের ফ্লেবার পেয়েছি—থাক সে প্রসঙ্গ, বরং সর্বনামের কথা কেন এল সে নিয়ে বলি— বলি, আমার প্রতিফলন ওয়াইন খেতে ভালোবাসে, আর আমি ওয়াইন খাই না— অ্যাসিডিটি হয়। আয়নায়, বিছানায়, বাথরুমে, রান্নাঘরে নৈমিত্তিক অম্লস্বাদের মধ্যে হাটুরে ক্লান্তি নিয়ে জেগে ওঠা–দৃশ্য থেকে বাইশগজ দূরে হেলমেট ছাড়া, অ্যাবডোমেন গার্ড ছাড়া… এই আমার কবিতার ইম্পেটাসটুকু —আর এও যে কাউন্টার-প্রোডাকটিভ সে নিয়ে আপনার অ্যাটলিস্ট সন্দেহ থাকার কথা নয়…

 

প্রিয় সম্পাদক,

ফ্ল্যাটবাড়ির জানলা থেকে দেখতে পাচ্ছি—কালো পাতার ফাঁক দিয়ে মূর্ত হয়েছে রাস্তা, ট্রাফিক, বৃষ্টি। ব্যালকনিতে দুজন অ্যাডাল্ট কথা বলছে ভুল বোঝাবুঝি নিয়ে, যোগাযোগের ফাঁকফোকর নিয়ে—কেতাবি সিন্ট্যাক্স ক্রমশ ডিসজয়েন্টেড হয়ে উঠছে—ঘোরাফেরা করছে আশার মধ্যে হিস্টিরিয়ার মধ্যে—এই সান্দ্রতার ভেতরে কখন যে একটা দরদালান আকাশে চারিয়ে গেল বুঝতে পারিনি। ক্ষমা করবেন এইখানে ফায়ারপ্লেসের পাশে যদি ভঙ্গুরতার কথা, আবছা হয়ে ওঠার কথা মনে পড়ে…। জানি আপনি বলবেন মীথের ভিতরে ঢুকে গল্প আর ক্লিশে হয়ে উঠে কবিতা পরিণতি পায়। কিন্তু আমি বুঝতে পারি, নিষ্পত্তি কাম্য নয়– কবিতা তো সন্তানের দিকে স্নেহে মুচড়ে ওঠা পুরুষস্তন। ফলে যোগাযোগের কথা, চক্র সম্পূর্ণ হয়ে ওঠার কথা এই সব নিয়ে ভাবি না সম্প্রতি—বরং বিষয় থেকে বিষয়ে ছুঁয়ে যাই আঙুল– যেটুকু চামড়ার গন্ধ উঠে আসে, যেটুকু অসুস্থতা তার্পিনদাহ্যতা নিয়ে ফিল্মরোলের মধ্যে, ধ্বনির মধ্যে, মধু ও ক্ষারের ভেতর ঢুকে যায়…

 

প্রিয় সম্পাদক,

“বাষ্পের খাঁচার ভিতর তুমি এক বাইশে শ্রাবণ”, অথবা “তোমাকে করি না, তাই তুমি কি করিনা?”—এরকম লিখতে পারতাম কিন্তু লিখতে পারছি না। আমাদের নরম সরম মাটি, মনোবেদনায় টইটই করে—বেদনার থেকে গড়িয়ে পড়ে স্নেহ—আর স্নেহের নীচে সব থাকে—শ্যাওলা, পাথর, পোকা মাকড়, মানুষের বিকার—এই চিরন্তনের মধ্যে থ্যাঁতলানো টিকটিকির মত আমায় থেকে যেতে বলবেন না প্লীজ। আমি তো ভাত খাচ্ছি, ডাল খাচ্ছি, মাঝে সাঝে চুমুটা আঁশটা যে খাচ্ছি না তাও নয়—তবে নবনীতে নেই—বরং ভুট্টা ক্ষেতে কশ ছড়ে গেলে বুঝি জিভ এখনো হারায়নি স্পৃহা। ফলে জিভের কথাই লিখি, দাঁতের কথাই লিখি নরম সরম করে মিডলাইফ ক্রাইসিসের কথা লিখি—যা একমাত্র কবিতা লিখতে বসলে টের পাই। আমি বিশ্বাস করি, শিল্প কেবল অভ্যাসের বাইরেই গড়ে ওঠে—প্রাকৃতিক উপাদান নিয়েও সে প্রকৃতির থেকে বিচ্যুত হয়ে বেড়ে ওঠে—ফলে আমি নিজেকে লিখি না, নিজের স্বভাব থেকে দূরে এক অপরিচিতের কথা লিখি…উদ্ধৃতিচিহ্নের থেকে ছাড়িয়ে আনি বস্তুর চিৎকারটুকু—তাকে লিখি…

 

বইঃ গোয়েন্দা গল্প (২০১৭)

গোয়েন্দা গল্প  ১২

পর ও অপর, এরই মাঝে সূত্রগুলো রাখা—আপন বলে কিছু নেই। প্রমাণের কুচি উড়ে বেড়াচ্ছে, ঘটনাস্থলে, মানুষের নৈতিক ও কানুনী প্রক্রিয়াগুলোর ফাঁকে ফাঁকে। মৃত্যুকে মেনে নেওয়া মানে জীবনকে মেনে নেওয়া—এ’রকমই গোয়েন্দা ভাবেন। বাইরে থেকে ভাবেন। ঘটনা মানুষকে ফেলে চলে যায় অন্য একটা পরিণতির দিকে—অথচ মানুষ তাকে আজীবন করে রাখে, ইচ্ছে বা অনিচ্ছেয় প্রাণ করে রাখে। তার গলায় ওয়াটার বটল বেঁধে দিতে ভুলে যায় না কখনো।

 

গোয়েন্দা গল্প  ২৯

ছ্যাঁকার মুহূর্তটুকুই আগুন, বাকীটুকু সম্বিত ও ধারণা। যদিও মানুষ প্রমাণের কথা, তার লুপ্তির কথা বলতেও আগুনের কথা ভেবে ওঠে– গোয়েন্দা জানেন, যা স্পষ্ট যা শিখা, উৎস থেকে রং বদলাতে বদলাতে যা অবলোহিতের দিকে চলে যায়—সে শুধু ধারণার ভিনিয়েট—বস্তু ও তার দাহ্যতা সংজ্ঞার বাইরেই থেকে যায়, এমনকী ক্রিয়ার বাড়বাড়ন্তও তাকে আর ফাঁদে পা দিতে প্রলুব্ধ করে না।  

সাদা ঘাসের মধ্যে দিয়ে ঢালু একটা পথ নেমে গেছে আলোর ভেতরে। সাদা নুড়ি কুড়াতে কুড়াতে খুনী সেই পথে নেমে যান। তার চামড়া স্বচ্ছ হয়ে ওঠে পোষাক পার করে। প্রমাণের ছায়াও তার পদক্ষেপের পাশে জেগে উঠতে ভুলে যায়।

 

গোয়েন্দা গল্প  ৩৫

নিজেকে এড়িয়ে যাওয়া—এতটুকুই বেঁচে থাকার জন্য প্রয়োজন। মানুষ মানুষকে শুইয়ে রাখে ফুলকপির ক্ষেতে। মানুষের পিত্তথলির রঞ্জকে হলুদ হয়ে ওঠে অসময়ের শীত। কাগজের শহরে দীর্ঘশ্বাসের মত গোয়েন্দা ঘুরে বেড়ান। তাঁর কমলা জামার কলারে থক থক করছে দু’চারশো বছরের মাছি ও প্রেরণা। এই আয়না-শহরে খুনীও জেগে থাকেন। পত্রপ্রেরকের মত। নীরব। অধীর।

 

গোয়েন্দা গল্প  ৩৬

শ্রমের বিপরীত একটা আকার মানুষকে টানে, পীচরাস্তার থেকে জঙ্গলের দিকে নিয়ে যায়। ইতিহাসের ভেতর মানুষ চুঁইয়ে পড়ে তার ভুল ভ্রান্তি চুঁইয়ে পড়ে। তবু মানুষ ফিরে তাকাতে চায় আর স্বপ্নের মধ্যে পাশ ফিরে বুঝতে চায়–যেন সে কোথাকার, যেন তার কোথায় কমলা বাগানের শীত পচনের থেকে দূরে  আলগোছে গ্রন্থির ওপর ক্ষুর চালিয়ে দিচ্ছে।

গোয়েন্দা দেখেন, নীবার ধানের মরাই থেকে উঠে দাঁড়াচ্ছে পোড়ো বিকেলের ময়ূর, তার পেখমের ভেতর খুনীর চোখ ঝলসে উঠছে। 

 

গোয়েন্দা গল্প  ৪১

একেকদিন পাহাড়ে বৃষ্টি পড়ে, মানুষ হঠাৎ লক্ষ করে খচ্চরের পিঠে তার ক্রয়ক্ষমতা চলে যাচ্ছে, অথচ সে ফের আনমনে কথার প্যাটার্নে ঢুকে যায়, কোন কথা না বলেই ঢুকে যায়। একেকদিন পাহাড়চুড়ো চকচক করে, মানুষ হঠাৎ দেখে সে অন্য কারো মাথার ভেতর রোদ পোহাচ্ছে, অন্য কারো শ্রাবণ শেষের বেলা বিন্দু বিন্দু তার কাচে লেগে আছে, অনন্যোপায়। এই নির্লিপ্তি আর অসহায়তার মাঝখানে বেড়ে ওঠে সে ও তার প্রতীকসকল। গোয়েন্দা দেখেন, আতস কাচের নীচে কী ভাবে সমাজযোগ্য হয়ে উঠছে প্রতীক, কী ভাবে সে ক্ষুরের পাশে গরমজলের বাটি হয়ে উঠছে…

 

গোয়েন্দা গল্প  ৪২

যেভাবে মানুষ থিতিয়ে পড়ে, সেডিমেন্ট থেকে উঠে আসে, নতুন করে স্নায়ু চারিয়ে দেয় বন্ধ পাল্লায় আর পাল্লা খুলতে না পেরেও বর্ষার দিনে কাঠের মিস্ত্রিকে ক্ষমা করে দেয়, সে ভাবেই খুনী হেঁটে যান, গোয়েন্দার স্বপ্নের ভেতর। টানটান একটা দূরত্ব দুটো পেরেকের মধ্যে, যাকে মানুষ সম্পর্ক ভাবতে ভালবাসে, গলায় ছুঁইয়ে তার শান পরখ করতে চায়—সেই দূরত্বটুকুই বজায় রাখেন খুনী, যেটুকু দূরত্ব শিকারের সাথে হুড়াড়ের, উপমার সাথে কবিতার।

 


ধ্বংসের মধ্য দিয়ে যাত্রা: সব্যসাচী সান্যালের কবিতার স্থানিকতা ও ‘হেটেরোগ্লসিয়া’

অমৃতা সরকার

সব্যসাচী সান্যাল বাংলা ভাষায় কবিতা লেখেন। আরও যথাযথভাবে বললে, সব্যসাচী সান্যাল নিজের খুঁজে পাওয়া, খুঁজে নেওয়া, ক্রমাগত বেড়ে চলা এবং কখনও কখনও ‘ভাষা’কেই অস্বীকার করতে চাওয়া ভাষা-ব্রহ্মাণ্ডকে বাংলা ভাষার আধার দিয়ে কবিতা লেখেন। তাঁর কবিতায় ‘খুঁজে পাওয়া’ ও ‘খুঁজে নেওয়া’ শব্দরা আটখেলি করে চলে নিয়ত। আবার সব্যসাচীর কবিতা দুনিয়ায় ‘লোকেল ডিসপ্লেসমেন্ট ও লোকেল ডিকনস্ট্রাকসন’, ‘পার্সোনা ফ্লুইডিটি’, এবং অপার এক ‘হেটেরোগ্লসিয়া’ এমনভাবে ওলটপালট করতে থাকে যে ‘নির্মাণ’-এর মতো প্রাক-ধারণাযুক্ত প্রক্রিয়া দিয়ে সব্যসাচীর কবিতার গঠন বুঝতে অসুবিধা হয়। সব্যসাচীর কবিতার চলন সরলরৈখিক নয়, আবার তা অহেতুক জটিলও নয়। তার কবিতা আদ্যন্ত ইনট্যুইটিভ কেওসের এক স্পেস। এই স্পেসে কবিতার গঠন এতটাই পরিবর্তনশীল যে কী কী কবিতা আর কী কী কবিতা নয়- এই ডায়ালেক্টিক ফ্রেম করার চেষ্টাও ‘হুজুর মোয়াফি’ বলে কানে হাত। ইনট্যুইটিভ বলেই সব্যসাচীর কবিতার কোথাও পৌঁছানোর দায় নেই। ইনট্যুইটিভ বলেই ‘ডায়াস্পোরা’র ক্লিশে মডেল মেনে শেকড়ে ফেরার তাগিদ নেই। রয়েছে ঘাম, রক্ত, পুঁজ, অপেক্ষা, চিঠির মতো স্মৃতি, স্মৃতির মতো বোঝা —- সমস্ত কিছু থেকে তাদের ‘নিজস্বতা’কে ভাঙচুর করে এক অনির্দিষ্টকে উদযাপন। যে উদযাপনের ভিতর একইসাথে সঙ্কট ও ইউফোরিয়া মিশে থাকে। চামড়ার নিচের উষ্ণ মাংস ও তারও নিচে হাড় অবধি পৌঁছেও দাবিহীন থাকে যা। ভালো থাকার দায় থেকেও মুক্ত করে দেয়। আধুনিক সত্ত্বার চিরায়তভাবে চেনা অথচ আনঅ্যাভয়েডেবেল অস্তিত্ব সঙ্কট কেটে কেটে বসে তাঁর কবিতার চামড়ায়। আর থাকে রেমেডি স্বরূপ খুঁজে নিতে চাওয়া ‘মিথ্যেকথা’: “যার আড়ালে আমাদের ভাষা ঘুমিয়ে রয়েছে”। সকল প্রশ্ন ও স্ববিরোধী শ্বাসের উত্তরে শুয়ে থাকা মিথ্যে কথা, যার আন্তরিকতা ও ওষধিগুণ নিয়ে কবি কোনও সন্দেহ রাখেন না।

সব্যসাচী সান্যাল ‘বাংলার’ কবি নন। তাঁর কবিতাও ‘বাংলার’ কবিতা নয়। ডায়াস্পোরার শর্ত মেনে তাঁর কবিতায় ‘লোকেল ডিসপ্লেসমেন্ট’ রয়েছে যা আবশ্যিক ভাবেই আত্মজৈবনিক। তাই ত্রিপুরার আগরতলায় জন্মানো, ইটানগরে শৈশবের কিছুদিন কাটানো, পুরুলিয়া সৈনিক ইস্কুলে বাংলা মাধ্যমে পড়তে চাওয়া  ইংরেজি মাধ্যমের পড়ুয়া, বোলপুরের পৈতৃক বাড়িতে ফিরে ফিরে আসা ছেলে, বিশ্বভারতীর ছাত্র, কোরিয়া, সুইডেন হয়ে লক্ষ্ণৌতে থিতু হওয়া মানুষটির কবিতা বাংলা ভূখণ্ডের প্রেক্ষিতে ‘স্থানীয়’ হবে না স্বাভাবিকভাবেই। আর এই ‘স্থানীয়’ না হওয়ার উৎকণ্ঠা থেকেই বেশিরভাগ কবির ভিতর শেকড় খোঁজা ও শেকড়ে ফিরতে চেয়েও না ফিরতে পারার এক ফেটিশ পাক খেতে থাকে। ফলে কবিতাগুলি হয়ে ওঠে একটি কালচারাল স্পেসিফিক মোটিফের, একটি স্থানিকতার এবং এগুলির সাথে কবির ব্যাক্তিগত ইতিহাসের যোগসূত্র নামচা। আগা শাহিদ আলির মত প্রতিভাবান কবিও ডায়াস্পোরিক সত্ত্বার ক্লিশে নস্টালজিয়া থেকে মুক্ত হতে পারেননি। সব্যসাচীর কবিতা এই ডায়াস্পোরা ও নস্টালজিক পুনর্নির্মাণ ফ্রেমওয়ার্কেই ঢুকতে অস্বীকার করে। সব্যসাচী স্থানিকতাকে বিনির্মাণ করেছেন এমনভাবেই যে তাঁর কবিতায় কালো মোরগের ধড়ে ধূপকাঠি গুঁজে দেওয়ার বাঙালি লৌকিক টোটেম আর কোনো সার্ব ছোকরার ব্লাগয় টায়ার ফাটার শব্দের অবাঙালিয়ানা পাশাপাশি বয়ে চলে। এই বিনির্মাণকে নিজের কবিতার গভীরে নিয়ে যেতে যেতে সব্যসাচী একটি সব্যসাচীভূম তৈরি করেন যেখানে ‘মাছিদের দেবতা’কেও বাঙালিয়ানার ভিতর দিয়েই বোধ করা যায়। ‘মাছিদের দেবতা’র মত টিপিক্যাল ইউরোপীয় মোটিফ বেগুনি খাওয়ার ভিতর দিয়ে আত্মায় ঢুকে পড়ার সম্ভাবনা দেখাতে পারে এই সব্যসাচীভূম। এই বিনির্মিত স্থানিকতা শরীর ও আত্মার চিরায়ত দ্বন্দ্বকে ভাঙচুর করে। এইখানে গোপনাঙ্গ বলতে মনকে বোঝানো হয় । নিজের লোকেল ডিসপ্লেসমেন্ট নিয়ে কোনও হারানোর ব্যথা না রেখে ‘কবিতার বিষয়আশয়’ দিয়ে সেন্স অফ লসকে মেনে নিয়েই বেফিকরে হয়ে বলা যায়: “ উজি-র নলের মুখে রাতারাত/ ইতিহাস প্রাক হয়ে গেছে/   আমিও বুঝতে পারি, এই ভালো—/ এভাবে ট্যুরিস্ট হয়ে নিজের অতীতে/ ভার ও বিষয়হীন ঘোরাফেরা/ আনমনে গ্যালিলির বেঢপ আকাশে/ নিখাদ উড়িয়ে দেওয়া চিপসের প্যাকেট”।

 

‘মাছিদের দেবতা’

        ৫

তিনি আমার মুখের ভেতর মাটি

তিনি আমার মুখের ভেতর দেওয়াল

শেষ পর্যন্ত আমার সমস্ত কথা, বুনো জন্তুর

মতো জিভের ওপর পায়চারি করে

তিনি আমায় শেখান, তোমার বসার ঘরে

সারাজীবন স্তব্ধতা হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে

বাইরে ছাতাগুলো ভিজছে

 বাইরে গাছের পাতাগুলো ভিজছে

ওই ছাতাগুলো একদিন আমার ভেতরে ছিল

শেকড়সমেত গাছগুলো আমার ভেতরে ছিল

তোমার বসার ঘর আমার ভেতরে ছিল

তোমাকে খুঁজতে যেতেই তুমি নিখোঁজ হয়েছ…

যার কবিতায় স্থানিকতা একটি নির্দিষ্ট কালচারাল মোটিফ থেকে জাত হয় না, তার কবিতা দুনিয়ায় ‘পোয়েটিক পার্সোনা’ ফ্লুইড হবেই। পোয়েটিক পার্সোনাকে হরেক করে তোলার জন্য বেশিরভাগ কবিই নিজের স্বর জোর করে পালটাতে থাকেন যাতে বিবিধ স্বর কানে ঢুকতে বাধ্য হয়। এই জোর করে পাল্টানোটাই দেখায় যে ফ্লুইডিটি আসেনি, রয়েছে একই মানুষ যে হরবোলার মত ডাক দিচ্ছে। সব্যসাচীভূমে এই হরবোলা কেরামতি নেই, রয়েছে স্থানিকতার সঙ্গে পাল্টাতে থাকা একটিই মানুষের স্বর যাকে খানিক পরে গিয়ে অন্য মানুষ বলে মনে হতে থাকে। সেই অন্য মানুষটিকে চেনা চেনা লাগলে  মনে হয় আগের মানুষটির আদল কি ভূত হয়ে আছে কোথাও? এই অস্বস্তি কি পোয়েটিক পার্সোনা নিজেই নিজেকে দিতে চাইছে বলেই তা ছড়িয়ে পড়ছে পাঠকের ভিতরেও? এই অস্বস্তি জন্ম দেয় ‘অপর’ হয়ে ওঠার পথ যেখানে কোনও এক মনোলগে আর্বান কবি সত্ত্বার এক পোয়েটিক পার্সোনার মনে হয়, “ ছাই ও ছায়ার বারবারের জন্ম আমাদের,/ মূল থেকে দূরে,/ এসো একদিন অস্পষ্টতা নিয়ে কথা বলা যাক”।  এই আর্বান অস্বস্তি ‘কাঠের পুতুল’-এর পোয়েটিক পার্সোনাকে এক সাইকাডেলিক সঙ্কটে নিয়ে আসে যেখানে প্রাত্যহিকতার যাবতীয় বিষয় কেবলমাত্র ‘পুতুল’-এর ভিতর দিয়ে জেগে থাকে। দমবন্ধকর এক জায়গায় টেনে নিয়ে আসে ‘পুতুল’ যেখানে “ পুতুল তো ভাষা, যে ভাষা সশব্দে/ দরজা আবজে দেয় মুখের ভেতর”। এই সাফোকেশন শেষতক সব্যসাচীর কবিতার মূল সুর হয়ে থাকে না। ভেসে, ডুবে, ডুবে, ভেসে সেই পার্সোনায় মেশে এই স্বর যা পরম কনফিডেন্সে জগন্ময়ী, তথাগত, দারুব্রহ্ম, য়েশু, ইব্রাহিম , গায়ত্রী স্পিভাক সমস্ত ডিসকোর্সকে অস্বীকার করে  নিজেকে মেটামরফোজড করে ‘অপর’ এক সত্ত্বায়: “তোমা সবে ত্যাগ দেঁহি বিনা পশ্চাত্তাপ/ অমোল ডিমেলো মুই, জনি মেরা বাপ”। এবং অমল ডিমেলোর পৃথিবীতে গুড়াকু মার্কা হাসি নিয়ে পিউ কাটপিস ব্লাউজ কর্নারের হারুন খালিফা, রোস্টেড কাট নিয়ে মুন্না মিটশপের বশির কুরেশি, পেশায় জিগেলো বেণু খোন্দকার, বকিল প্রমোদ বশিষ্ঠরা অমল ডিমেলোর অপরাপর স্বর হয়ে কবিতার জন্ম দেয়।

এই ফ্লুইডিটির জন্যই ‘হেটেরোগ্লসিয়া’  সব্যসাচীর কাব্যভাষার স্বাভাবিক পরিসর। যেকোনও শব্দকেই সব্যসাচী কবিতা করে তুলতে পারেন। ‘কাঠের পুতুল’-এর একটি অংশে ‘লেখালেখি’, ‘শূন্যতা’ শব্দের পাশে কী সাবলীলভাবে বসিয়ে দেন ‘গতরখায়েশ’-এর মত শব্দ আর তাতেই সামনের তিনটি লাইনও একটি ভিন্ন মাত্রা পেয়ে যায়: ‘পুতুলের স্তনের খাঁজটুকুই আলো/ আর সে-ই স্তব্ধতা, যাকে ফুঁপিয়ে ওঠার/ দিন দেখা যায় বড়োজোর দু-এক লহমা/ ওটুকুই লেখালেখি, শূন্যতা, গতরখায়েশ”। ‘কালো পাথরের বাড়ি’র ১৯ নম্বর কবিতায় ‘বাথরুম’ ও ‘মনোবেদনা’কে পাশাপাশি বসানোর পরের লাইনেই ‘খুসট বুড়িয়া’র মত অবাঙালি শব্দ বসাতে মেধার সঙ্গে কলজের জোরও লাগে। পাশাপাশি বসে কী অপার করে তোলে এই আপাত সম্বন্ধহীন শব্দগুলি: “ধোঁয়ায় কালো এই বাথরুম/ এই বাথরুমে মনোবেদনা থাকে/ ভবিষ্যৎ জেনে ফেলা খুসট বুড়িয়া থাকে/ বিয়াল্লিশ বছরের ঘুমের ফাটল থেকে/ কে যেন ডুকরে ওঠে… অবিকল আমার গলায়”। এবং ‘ডিমেলোনগরী’র ভাষা দেখায় যে ভাষার বিশুদ্ধতা নামক বাকোয়াসকে তুড়ি মেরে না ওড়ালে নতুন কাব্যভাষা জন্মাতেই পারে না। ‘লল্লন প্রসাদ ( সবজিবিক্রেতা)’ কবিতাটি দেখলেই এই কাব্যভাষার হেটেরোগ্লসিক বিস্তার বোঝা যায়ঃ

লল্লন প্রসাদ ( সবজিবিক্রেতা)

এবং আকাশে ওঠে অত্রি অঙ্গিরা
পুলহ পুলস্ত্য ক্রতু মরীচি বশিষ্ঠ
জাগে স্বাতী, শতভিষা, মঘা, মৃগশিরা

নিচে প্রত্যুত্তর, মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে
এলইডি লালটেন, কৃশকায় খর্বাকার লল্লন প্রসাদ
লল্লন প্রসাদ। নিকটে আসগর (বেপাক হারামি,
১৫০০ টাকা , বাঁড়া কর্জবিমুখ) — মুখে হাসি, তামাটে দাঁতের
ফাঁকে ঘোর অমানিশি।

লল্লন প্রসাদ— ঘর কাহাঁ বা? নগর চিত্রকূট, জিলা সাতনা
ঘর মে কৌন কৌন — দু বহনে, মা— শাদি হুই?— চোখ ঝুঁকে আসে
গ্রীবা লাল— পিছলে মাহিনা। শাওন মাহিনা, বেটা, পবন কা শোর
জিয়া মে কটার, সালা দিল মাঙ্গে মোর?

লল্লন প্রসাদ, মন্ডি মে উধার। দো টকা ব্যায়াজ।– অওর হাঁ দো
কিলো পেঁয়াজ ।
লল্লন প্রসাদ, সামনে আঞ্জির। টিন্ডা, ভিণ্ডি, লাউ, বেঙ্গন, বশীড়
আমি তো গ্রাহক, যেমন রাষ্ট্র, বিভিন্ন মুখ তবু একই তরকিব
চাই ব্যবহার, দরদাম করি—-

থাকে শুধু অন্ধকার, টিন্ডা, ভিণ্ডি আর লল্লনপ্রসাদ।

এইভাবেই বশির কুরেশির কবিতাকে ধরতে সব্যসাচী ’৭০ কিলো মিট’, ‘ রোস্টেড কাট’, ’৭০ কিলোটাক মিসেজ ডিসুজা’, ‘ পায়ের গোছে টাচ’-এর পরেই লিখে ফেলেন , “ রক্তমাংস থেকে বিচ্যুত পালকের মতো”— পাঠক হতবাক হয়ে ভাবতে থাকে কার কার গলা শুনতে পাচ্ছে সে। বয়স বারোর বালিকা আকাঙ্ক্ষা ত্যাগীর কবিতা খুঁজে পেতে চোদ্দো বছরের বালকবেলার দিকে তাকাতে হয়। সেই চোদ্দ বছরের “ ওগো নিশ্চেতন”, “ সূর্য ঢলিয়া পড়ে মানসসরোবরে” “হাতে আম্রপল্লব”-এর সুশীলপনা ধাক্কা খায় দমকের সাথে বলা, “ইয়ার না বোলোঁ, হম হ্যায় লড়কি, জরা রেস্পেক্ট দো”-এর ঝঙ্কারে । সব্যসাচীর ‘হেটেরোগ্লসিয়া’ তাই শুধু শব্দের নয়, এই ‘হেটেরোগ্লসিয়া’ সংস্কৃতি, সময়, ভূগোল সবকিছুকে তছনছ করে ধ্বংসের মধ্য দিয়ে যাত্রা হয়ে ওঠে।