রাণা রায়চৌধুরী
লেখক কবি, গদ্যকার ও গল্পকার।
এই বসন্তকালকে তোমার ভালো লাগে?
আমার ভালো লাগে কিনা বুঝতে পারি না।
ছোটবেলায় ফাগুন মাসে ধানখেত থেকে হাওয়া আসত। সেই হাওয়ায় আমার বইয়ের পাতা উল্টে যেত।
দখিনা বাতাসে বইয়ের পাতা উল্টে যাওয়ার ভিতর দিয়ে উল্টে যেত– হারিয়ে যেত আমার অনেক পাওয়া, না-পাওয়াও।
দখিনা বাতাস আমার অনেক স্বপ্নকে নিয়ে যেত উত্তরের দিকে। উত্তর দিকে ঝুমাদের ভয়াবহ বাড়ি। ঝুমা ফ্রক পরা অপূর্ব বালিকা। কিন্তু ঝুমার বাবা এক ভয়ঙ্কর বাঘ। বাঘের ভয়ে আমি ঝুমাদের বাড়ির দিকে তাকাতাম না। অথচ ঝুমাকেই আমার বসন্তের ঠান্ডা বাতাস মনে হত।
আমাদের বাড়ির পাশ দিয়ে দূরপাল্লার যে ট্রেন যায় আমার ধারণা তারা সকলেই ফেরার সময় বসন্তকালকে নিয়ে আসে।
সেটা বোঝা যায় তাদের প্রসন্নতা দেখে, তাদের রঙিন মুখাবয়ব দেখে বোঝা যায় যে, বসন্তের সঙ্গে অনেক আত্মীয় অনেক ভালোবাসার মানুষকে তারা পৌঁছে দিয়েছে আমাদের কাছে। যাঁরা আন্তরিক যাঁরা সরল, ঠিক এই বসন্তকালের মতোই।
বসন্তকাল খুব সহজ ও আন্তরিক। এবং রহস্যময়। তাকালে মুখ ফিরিয়ে নেয়, কিন্তু সেও আমাকে আড়ে আড়ে লাজুক দেখে। ওই তাকানোতেই মনে হত, আমার জীবনের সব দক্ষিণদিকের জানলাই চিরকালের জন্য সে খুলে দিয়ে গেল। সে যেন এক আশ্বাস, সে যেন শুশ্রূষা, সে যেন নির্ভরতা দিয়ে চলে গেল অন্য বাতাসদের সঙ্গে গল্প করবে বলে।
আমি দেখি বসন্তের বাতাস, বসন্তের রোদ, বসন্তের আকাশ, তার সময়ের গাছ, লতাগুল্মের দল, তার ধুলো এইসবই বয়ে চলেছে আমার ভিতর। আমার আমাদের সবাইকে সে সহিষ্ণু হতে বলছে, কোকিলের কালো ডানায় তার পথভোলা আলপনা এঁকেবেঁকে চলছে আমাদের এপথ সেপথ ওপথের বিশ্বাস ও আশ্রয়ের নির্মাণে।
আমি ভাবি নীলনদের তীরের বসন্তকাল কেমন, বা সিন্ধু সভ্যতা যুগের বসন্তকাল কেমন ছিল, বা আদিম মানুষের বসন্তকাল কেমন ছিল– আমি পৌঁছে যাই সেইসব বসন্তের দিনে। দেখি, এখনকার মতোই বসন্ত হারমোনিয়াম নিয়ে বসেছে আগামীর সুর তৈরিতে, যে সুর আজ এখন আমার মনে আমাদের আচ্ছন্ন হয়ে বাজছে।
বসন্তকাল পুরুষ না নারী তা আমি বুঝতে পারি না, কিন্তু সে এক তরুণ কবি সেটা বুঝতে আমার অসুবিধা হয় না। তার সঙ্গে আমার আলাপ করতে ইচ্ছে জাগে, সাধ জাগে– কিন্তু সে ধরা দিয়েও দেয় না ধরা।
দেখি দূরে কাছে নিকটে আবার অতি দূরে নিজেকে মেলে ধরেছে সে কবিতায় গানে– হাতে তার একতারা দোতারা গিটার এবং আরও বিবিধ বাদ্যযন্ত্রে সে ধীরে বয়, মৃদু বয়, যেন শান্ত বিপ্লবের প্রতিবাদের প্রদীপ সে– জ্বলছে কিন্তু ধ্বংসের কোনো আভাস নেই তার মধ্যে– বরং যেন এক দৃঢ় প্রতিজ্ঞার শপথের ভঙ্গি ও ইশারা তাহার ভিতর।
তুমি ভোর না দুপুর, তুমি গভীর রাত না অমায়িক বিকেল– আমি বুঝি না তোমাকে– তুমি শোক না বিরহ, তুমি কি কান্না? আমার ভিতরে তুমি এক আলোময় কষ্ট এঁকে দিয়ে চলে যাও ধু ধু ধানখেতের ওই পারে, সবুজ পুকুরের ওই পারে, তালবনের আড়ালে– সূর্যাস্তের ফিকে আলোর চলে যাওয়া পথে– ‘তোমার উতলা উত্তরীয়’ আমাকে আশ্বস্ত করে যে একদিন আমাদের সব অসুবিধে আমাদের মনের সব দেয়াল আমাদের সব সঙ্কীর্ণতা তুমি আবার এসে মুছে দেবে …
আমরা সবাই বড্ড একা। নিঃসঙ্গ। আমরা সবাই আজ এই নক্ষত্রলোকের নিচে এই গ্রহমণ্ডলীর নিচে এসে দাঁড়িয়েছি নিজেদের চিনব বলে, একে অপরকে চিনব বুঝব বলে।
আমরা একত্রিত হব হবই আজ। আমাদের রাস্তাপালিত সারমেয় ভুলু এসে লেজ নেড়ে বলল, ‘বসন্ত আসছে, বসন্ত আবার এসেছে!’
আমরা এই দেশের মাটিতে দাঁড়িয়ে ‘বসন্তের বজ্রনির্ঘোষে’র সত্যিটাকে আরও অনেক মানুষের মধ্যে পৌঁছে দেব বলে ‘পুরো দেশটা একটা পরিবার’ এই সঙ্কল্পে আমরা বেরিয়ে পড়ি সবাইকে একত্রিত করতে। সঙ্গে তুমি আছ আমাদের নব প্রেরণা– আমাদের চিরকালীন প্রেরণা– এ-কথা জানাল জামরুল ডালের শত-শতাব্দীব্যাপী এক নিমগ্ন কোকিল …
আমার বাবা তোমাকে দেখে দেখে ছবি আঁকত। অথচ হে বসন্ত, হে বসন্তকাল তোমাকে দেখা যায় না। তুমি শ্রুত নও, তুমি স্পর্শের অতীত– তবু আমার বাবা তোমাকে অনুভবে কল্পনায় এক বিরাট উৎসবের উৎসাহের মতো আঁকত।
আমরা একদা বালকাবস্থায় তোমার বাতাস– তোমার বাতাসের মায়াকে নিয়ে আমাদের গোবর নিকোনো উঠোনে খেলতাম ‘বসন্ত বসন্ত’ খেলা।
তুমি আছ।
তুমি আমাদের অনেক নেইয়ের মাঝে আছ, ‘আছ’ হয়ে আছ… সম্পূর্ণ হয়ে আছ তুমি…