কস্তুরী সেন
লেখক কবি ও গদ্যকার
এই মধ্যরাত্রে বসন্ত শেষ হয়ে যাচ্ছে৷ ধৈবত ঋষভের কোমলতা খসে গেল গা থেকে, সে শুনতে পাচ্ছে ইউ ডাইস ফর্ম। সে শুনতে পাচ্ছে মেসেজের টুংটাং, গাড়িতে সে সারারাস্তা ফিরেছে যুক্তি সাজাতে সাজাতে… আর এই রাত্রি, দ্বিতীয় প্রহরের পর ঝরে যাচ্ছে সেসব তীব্রতার মধ্যম। সে পরের লাইন ভাবছে, ‘নীহারপাতবিগমাৎ সুভগো বসন্তে…’, একটি পর্দাওড়া একতলা বাড়ি, উনআশি সাল। সে একটি বসন্তরচনার দায়ে সে বাড়িতে টেবিল পাতে, দর্শন অনার্সের বইয়ের পাশে ঋতুসংহার সাজায়, এইবার তার মনে পড়বেই ‘চুল এলো করে কাঁদতে হয়… বসুধালিঙ্গনধূসরস্তনীবিললাপবিকীর্ণমূর্ধজা…’ লাল মলাট, সোনালি ছোটগল্প। অথচ সে দুবিনুনি মেয়েটিকে পায় না। তার দুইপাশে মধ্যরাতে বসন্ত ঝরে যাচ্ছে। বহুদিন সে ভোরের উনত্রিশ নম্বর ট্রামের শব্দ শোনেনি। হেস্টিংস হাউস, অ্যাসফল্টে বিছিয়ে থাকা রাধাচূড়াময় ভোর। এসময় সজনেফুল খেতে হয়, তাকে কদাচিৎ সদয় হয়ে স্টাফরুম বলে। স্টাফরুম, ইশরাত পারভিন ক্লাশে চলে গেলে সহজ হয়। ফলে সে স্টাফরুমে এনে রাখে এইট বি’র মোড়, সেন্ট্রাল লাইব্রেরির গেট দিয়ে সে ঢুকছে দৌড়তে দৌড়তে দশটা কুড়ি, সে দুপুরবেলা মিলনদায় গিয়ে ভাবছে তপোব্রতবাবু নেই, অথচ সে বিনোদিনী পড়ছে, এইরকম একটি মার্চমাস এলে সে নিশ্চিত ঝিলে ঝাঁপ দিত। অথচ ইউ জি আর্টসের ঝিলে কত শালুক ফুটেছে সেইবার!… তার মাস গুলিয়ে যায়, তার ‘আমার জীবন’ ‘আমার কথা’ গুলিয়ে যায়, সজ্জিত সালঙ্কারা মহিলারা তাকে ঘিরে ধরে দাঁড়ান, মণিবন্ধ টিপে বলেন, ‘বড্ড রোগা, বড্ড যেন রোগা না?’। সে দুবিনুনি মেয়েটিকে খোঁজে, সে চোখ বুজে গ্রহণ করে প্রিয় কবির উপন্যাস, ছাদ জানলা ছাদ জানলা মেথড।
আর পূরবী থেকে বিলাবল, তার ঠাট বদলায়। এর বহুদিন পর সে বন্ধুকে বলবে ‘সত্যই সে ভুলে নাই! উত্তরজীবনে এই নীলকুন্তলা সাগরমেখলা ধরণীর সঙ্গে তাহার খুব ঘনিষ্ঠ পরিচয় ঘটিয়াছিল… ‘এই পঙক্তিগুলো মাথায় কেমন টুকে রাখতে ইচ্ছে করে না? সে ফের একটি ক্যান স্প্রিং বি ফার বিহাইন্ড খেলায় মাতে, রান্নার মেয়ে তাকে একটি জাগ্রত থানের হদিশ দ্যায়, পুকুরেরও। তলদেশ থেকে একডুবে শিকড় তুলে আনলে কত লোকের কত অসুখ সারে। তার কী অসুখ, তার কী অসুখ ভাবতে ভাবতে দুপুরবেলায় সে বলে বেশি করে খাবে লক্ষ্মী, একদিন চলো তোমার সেই পুকুরে যাই। সে আরোহ অবরোহ মেলায়, চলন মেলায়, নজরুল খুঁজে খুঁজে বার করে, ‘এল ওই বনান্তে পাগল বসন্ত’…খাতায় লাল কালির দাগের পাশে লেখে নম্বর কেন কাটা হল।
সে বসন্ত রচনা করে আর ফোন আসে, হোয়াটস্যাপ। গত সংখ্যার গল্পের গল্প শোনে সে, এটা কি তুই? ফোন আসে, হোয়াটস্যাপ। জীবনানন্দ সভাঘর পরশু সন্ধে, অবনীন্দ্র, তরশু। তার মাথা জুড়ে কাঁটা হয়ে থাকা এক বসন্ত, ধরে ফেলে কেউ কেউ। সে অস্বীকার করে, বলে পুরনো লেখা, সে অস্বীকার করে, বলে ক্যানসেলড চেক নেই। বহুদিন সে পেজমার্ক দিয়ে আচমকা উঠে যায়নি না পেরে। বিশ্বনাথ দাস, দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা, তাকে বুঝিয়ে দিয়েছে জীবন সরল জীবন শ্রী। দিদি ধান্যকুড়িয়া, খোলাপোতা, স্বরূপনগরের উপর দিয়ে গেলেন জানাবেন তো একবার! কী খাওয়াতে বিশ্বনাথদা বলো, ওদিকে আর না গেলে নেমন্তন্ন করবে না এ কী কথা… সে বিশ্বনাথ দাসকে প্রশ্ন করে হাইওয়ের দুপাশে এত পলাশ ফোটে কী করে তোমাদের ওদিকে! স্বরূপনগরে লোকনাথ হোটেলের নির্জন রবিবারের মাথায় কী দৃপ্ত পলাশ ঝরল সারা রাস্তা। দুবিনুনি মেয়েটি তাকে বলে প্রেশারের ওষুধ ফুরিয়েছে দেখিস একবার, টুকুর ড্রইংখাতা… কেন তোমারই কেবল সব ফুরিয়ে যায়, ভাবতে ভাবতে তার ঈর্ষা মরে আসে। ‘মনাংসি ভেত্তু সুরতপ্রসঙ্গিনাং বসন্তযোদ্ধা সমুপাগতঃ প্রিয়ে…’ পড়ানোর দিন কী শাড়ি পরেছিলে তুমি, এই প্রশ্ন নিয়ে ঊনআশি মার্চের রাস্তায় সে হাঁটে। কালো শেল চশমার ছবিকে ডেকে জানতে চায় হাওয়া দিচ্ছিল খুব সেসব বছরে? স্যর বলত? জানতে ইচ্ছে করে না এখন কেমন আছে? সিরিয়াল দেখে কি না সন্ধেবেলা, হাঁটুর ব্যথা কেমন?
আর এই মধ্যরাত্রে তার চারপাশ থেকে বসন্ত ঝরে যায়। ধৈবত ঋষভ কোমল, মধ্যম তীব্র। সে সমগ্র জীবন জড়ো করে বসন্ত লেখে মেসেজে, ফিরেছ? নাকি দেরি আরও…