Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

এজেন্ট অরেঞ্জ

প্রজ্ঞাদীপা হালদার






লেখক গদ্যকার ও অনুবাদক





আমাদের গৌহাটিতে এই ফাল্গুন-চৈত্র মাসে যে হাওয়াটা দেয়, ঝরঝর পাতা উড়িয়ে সে আসলে গাইতে থাকে, জরা পঙখ ঝটক গ্যয়ি, ধুল অটক, অওর লচক মচক কে দূর ভটক, উড়ি ডগর ডগর, কসবে কুছে, নুক্কড় বস্তি। অবিকল এই সুরে আর ছন্দে শিস দিতে দিতে বয়ে যায় হাওয়া।

আমাদের গৃহকর্ত্রী আসলে আম্মা, ঘরের বয়োজ্যেষ্ঠা যেমন হন, তেমনই। ছোট শোবার ঘরটায় বসে বই পড়তে পড়তে ওই তিন বাড়ি কাজ সেরে মৃদুপায়ে আসতে দেখি তাঁকে, করঞ্জগাছের পাশ থেকে এই এ ব্লকে আসবার রাস্তা। ছোট ছোট চার ফ্ল্যাটের কমপ্লেক্স। সামনে সবুজের বিথার, বাঁদিকে তাকালে আবছা নীল পাহাড়। এই অদ্ভুত সৌন্দর্যের মাঝেও নিরাসক্ত থেকে আম্মা যে কী করে বাড়ি বাড়ি কাজ করেন, কে জানে। অবধারিত এসে আমায় জিজ্ঞেস করবেন, “আইজ কী রানবেন?”

আম্মার সঙ্গে কথা বলতে গেলেই আমি ধন্ধে পড়ে যাই, কোন ভাষায় কথা বলবো। তিন বাড়িতে কাজ করবার সময় বলা হিন্দি নাকি আমি যাতে স্বচ্ছন্দ, সেই বাংলা? আম্মা দিব্যি বোঝেন সিলেটি বাংলা, বলেনও, তাতে সামান্য অহমিয়া টান। একাত্তরের যুদ্ধের সময় চলে এসেছিলেন। খেটে খান, বর নেই, ছেলে মারা গ্যাছে। ছেলের বউ, নাতি নাতনি নিয়ে আম্মার সংসার। আম্মার সঙ্গে দুপুর মানেই আম্মার এনআরসির গল্প। এনআরসির লিস্টে আম্মার নাম নেই, কিন্তু ছেলের বউ-এর নাম আছে। কী হবে ছেলের বউকে যদি ক্যাম্পে নিয়ে যায়? আম্মার কপালে চিন্তার ভ্রুকুটি শান্ত করতে বলি, ভেবো না আম্মা, সব ঠিক হয়ে যাবে। কেউ কোত্থাও যাবে না। মিথ্যেই বলি, আম্মাও কী সান্ত্বনা পান? না মনে হয়। তবু তড়িঘড়ি গরম কড়াই হাত দিয়ে ধরে ছ্যাঁকা খেলে আলতো বকা দেন। বেশ হইসে, কে ধরতে কইসিলো, আমি নাই?

রান্নাঘরের সঙ্গেই একটা টিনের ছাউনি আছে, দুপুরবেলায় সব বাঁদরছানারা সেখানে খেলতে নামে। তারজাল দেওয়া দরজার ওপারে এসে বসে। এই সব দুপুরেই আমি টের পাই যে হাওয়া একদিন সর্বগ্রাসী নির্জনতায় হু হু করে বয়ে যেত, সে গাইছে, জরা পঙখ ঝটক গ্যয়ি, ধুল অটক, অওর লচক মচককে দূর ভটক।

বাঁদিকের পাহাড়টার নাম দিয়েছি হাতিপাহাড়, যে মস্তি হাতিটা সেই পাহাড় থেকে নামে রোজ সন্ধেয়, তার নাম বাজবাহাদুর। ওই পাহাড় থেকে দুটো পাহাড়ি ময়না রোজ এসে আমাদের কৃষ্ণচূড়া গাছে বসে শিস দেয়, তাদের নাম ছোটকু আর ফুলিয়া। ওদের যে এ সব নাম আছে তা ওরা জানে না। এমন নাম দেওয়ার বাতিক আমার ছোটবেলার। সেই ছোটবেলায়,যখন আমাদের ভাড়াটে বাড়ির বাগানে ঝেঁপে আসতো বাতাবিলেবুর ফুল। এখানেও কোথাও একটা অদৃশ্য বাতাবিগাছ ফুল ফোটায়, দেখতে পাই না, গন্ধ পাই।

এই বসন্ত পাখিদের বাসা বাঁধবার কাল। ঠোঁটে করে খড়কুটো নিয়ে তারা ওড়ে এ দিক, সে দিক। জানলায় বাসা বাঁধে শালিখ। চাঁদমারির মাঠে বাদামগাছে হর্ণবিলের বাসা, সেটা দুবেলা দেখতে যাওয়াই বড় কাজ। সেগুনের জঙ্গলে হাতির কানের মতো মতো বড় বড় পাতা খসে যায়, সারা জঙ্গল এমন বাউল হয়ে থাকে, শুকনো পাতার গন্ধে ম ম আলোও পাণ্ডুর। আমরা শুঁড়িপথ বেয়ে উঠে যাই। এখানে ঘাইহরিণীর ডাক, এখানে অবাধ জঙ্গল, খুব দূরে হুইসলিং থ্রাশ ডাকে।

যেদিন রান্না সকাল সকাল শেষ হয়, এসে বারান্দায় বসি। যেমন, জীবনানন্দ বলেছিলেন, এইখানে আমার নকটার্ন, তেমনই এখানে বসে আমি পাখির ডাকের সঙ্গে হিসেব মেলাতে চেষ্টা করি। এই যে জীবনটি যাপন করি, তা যথার্থ আমার নয়। আমাকে মানাতো একটেরে ভিড় শহরে, বাজারের পচা সব্জি এড়িয়ে কর্মস্থলের অটোয় সওয়ার৷ হুতোম যেমনটি লিখেছেন টুনোয়ার টপ্পা, সহর সিখাওয়ে কোতোয়ালি, তেমনই এই নাগরিক মারী এড়িয়ে আমি পালিয়ে গেছি, একটা জীবন থেকে আর একটা জীবনে। যতদূর যাওয়া সম্ভব।

আজকাল ভাবি বসন্তের বনের পুরুষালি এই গন্ধ যে পায়নি, তার জীবনের অর্থ কী। কী অর্থ যদি পালাবার সাহস না করলে? এ ভাবেই আমার শিরার মধ্যে ফাগুন খানিকটা বিদ্রোহ ও বসন্ত ইঞ্জেক্ট করে দেয় নতুন পাতার, আনন্দসঙ্গমে। তা বাদে বসন্ত এখানে পলাশে, শিমুলে, পাখিদের ভোজে। কাল ভোরে পাশের গন্ধরাজে একটি মৃদু দোয়েল দীর্ঘস্বরে টি দেবে, আমার ঘুমের গান, তার জন্যে কান পেতে আছি, নয়তো কতক্ষণ আর বিভাবরী এই জাগরণে?