অভীক ভট্টাচার্য
ঠিক কোথা থেকে শুরু করা উচিত লেখাটা? ‘ইকনমিক অ্যান্ড পলিটিক্যাল উইকলি’-র সম্পাদকের পদ থেকে বর্ষীয়ান সাংবাদিক পরঞ্জয় গুহ ঠাকুরতার সরে দাঁড়ানো? কিন্তু সেটা তো একটা এক লাইনের খবর মাত্র। তা কি একটা গোটা লেখার বিষয় হতে পারে? অবশ্যই তা সম্ভব, বিশেষত, কেউ যদি ভাবতে চান পরঞ্জয়বাবুর ১৫ মাসের দায়িত্বকালে ‘ইপিডবলিউ’ যে সম্পাদকীয় নীতি নিয়ে চলছিল এবং আচমকা তিনি সরে যাওয়ার পরে তার কতটা পরিবর্তন হতে পারে, তবে তাঁকে আপাত-নৈর্ব্যক্তিক ওই এক লাইন দিয়েই শুরু করতে হতে পারে। অথবা লেখাটা শুরু করা যেতে পারে সম্পাদকের পদ থেকে তিনি সরে দাঁড়ানোর পরে নোয়ম চমস্কি থেকে শুরু করে বিশ্বের তাবড় চিন্তাবিদরা যেভাবে প্রায় নজিরবিহীন উদ্যোগে তাঁর পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন, এবং সমীক্ষা ট্রাস্ট-কে সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনা করতে বলেছেন, তা দিয়েও। সে ক্ষেত্রে সেটি আদ্যন্ত একটি রাজনৈতিক লেখা হয়ে দাঁড়াতে পারে – যার মূল প্রতিপাদ্য হতে পারে শাসক দলের প্রচ্ছন্ন সমর্থনে কীভাবে প্রভাবশালী বণিকগোষ্ঠীর খেলার পুতুলে পরিণত হতে পারে স্বাধীন সংবাদমাধ্যম – দেশে এবং বিদেশে তার একাধিক উদাহরণ তুলে ধরে শেষপর্যন্ত একটি নির্ণায়ক অভিমুখে পৌঁছতে পারে লেখাটি। কিন্তু, উল্লেখিত দু’টি স্পষ্ট রাস্তার মধ্যে কোনও একটি বেছে না-নিয়ে বরং চেষ্টা করা যাক ‘ইপিডবলিউ’-এর সাম্প্রতিক ঘটনাক্রমের প্রেক্ষাপটে একটি বিশেষ প্রবণতাকে চেনার। সাম্প্রতিক অতীতে ভারতীয় সংবাদমাধ্যমে ঘটে যাওয়া বেশ কিছু ঘটনায় সেই একই প্রবণতাকে বারবার ফিরে আসতে দেখা যাচ্ছে কিনা, সেটা বোঝার।
প্রথম এবং প্রধান কথা, সমীক্ষা ট্রাস্ট-এর সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে পরঞ্জয়বাবুকে যেভাবে সম্পাদকের পদ ছাড়তে হয়েছে, সেটি ‘ইপিডবলিউ’-এর মতো পত্রিকার ঐতিহ্যের সঙ্গে মানানসই না-হলেও আদৌ অপ্রত্যাশিত ছিল না। গোটা ঘটনাক্রমটিকে ফিরে দেখলে বোঝা যাবে, সমস্যার সূত্রপাত হয়েছিল দু’টি প্রবন্ধকে কেন্দ্র করে, যেখানে কর-সংক্রান্ত অভিযোগের মূল তীর ছিল আদানি গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে। লেখাদুটির প্রতিপাদ্যের প্রতি আপত্তি জানিয়ে আদানি গোষ্ঠী একটি আইনি চিঠি (লিগ্যাল নোটিশ) পাঠায় সমীক্ষা ট্রাস্ট-এর কাছে, এবং ট্রাস্টকে না-জানিয়েই ব্যক্তিগত আইনজীবী মারফৎ পরঞ্জয়বাবু তার যথাযথ উত্তর দেন। সে উত্তর আদানিদের কাছে সন্তোষজনক ছিল না নিশ্চয়ই, কারণ তার পরেই ট্রাস্টকে চিঠি পাঠিয়ে ওই লেখাদুটি অবিলম্বে প্রত্যাহার করতে চাপ দেয় আদানি গোষ্ঠী।
এ-পর্যন্ত একরকম ঠিকই ছিল। কারণ যাঁরা সাংবাদিকতা করেন তাঁরা সকলেই জানেন, কর্পোরেট দুর্নীতি নিয়ে অন্তর্তদন্তমূলক প্রবন্ধ লিখতে গেলে ‘লিগ্যাল নোটিশ’ আসবে ধরে নিয়েই লিখতে হয়। এবং পরঞ্জয়বাবু যে মানের সাংবাদিকতা করে এসেছেন দীর্ঘকাল ধরে, তাতে হাতে যথেষ্ট তথ্য ও পাকাপোক্ত প্রমাণ-সাবুদ ছাড়াই তিনি এমন স্পর্শকাতর বিষয়ে লিখতে শুরু করবেন, এমনটা ধরে নেওয়াও কোনও কাজের কথা নয়। আদানির চিঠির প্রেক্ষিতে সমীক্ষা ট্রাস্ট যখন পরঞ্জয়বাবুকে প্রশ্ন করে, তখনও তিনি ঠিক এ-কথাই বলেছিলেন। তিনি জানান, তাঁর কাছে তাঁর প্রতিপাদ্য বিষয়ের সপক্ষে প্রতিটি তথ্য রয়েছে, এবং আদালতে তিনি তা পেশ করতেও প্রস্তুত। এরই পাশাপাশি বোর্ডের মিটিং-এ তিনি জানিয়েছিলেন, ট্রাস্টকে অন্ধকারে রেখে নিজের আইনজীবী মারফৎ আদানির নোটিশ-এর উত্তর দেওয়া তাঁর পক্ষে অনুচিত হয়েছে, এবং এ-বিষয়ে তিনি যথোচিত দুঃখপ্রকাশও করেন। কিন্তু তাতে কান না-দিয়ে ট্রাস্ট তাঁকে জানায়, অবিলম্বে লেখাদুটি প্রত্যাহার করে নিতে।
এখানে একটা কথা উল্লেখ করা দরকার। আদানি গোষ্ঠীর আইনি নোটিশ বিষয়ে ট্রাস্টকে অবহিত না করা ‘টেকনিক্যাল এরর’ হতে পারে, কিন্তু তার জন্য সম্পাদকের চাকরি চলে যাবে, এমন গর্হিত অপরাধ সেটা কোনও মতেই নয়। অতএব, বোঝাই যায়, অন্য কোনও কারণে, অন্য কোনও গুরুতর চাপ কোথাও ছিলই। সে চাপটা কিসের, তা আন্দাজ করার জন্য, বলা বাহুল্য, কোনও পুরস্কার থাকার কথা নয়। ঘটনা হল, সম্পাদক হিসেবে নয়, নিবন্ধকার হিসেবে, খুব বড় কোনও মৌমাছির চাকে ঢিল ছুড়ে বসেছিলেন পরঞ্জয়বাবু। এবং নিবন্ধকার পরঞ্জয়ের পাশে দাঁড়াতে গিয়েই কার্যত ট্রাস্টের ডিরেক্টরদের চটিয়ে ফেলেন সম্পাদক পরঞ্জয়।
এই পর্যন্ত পৌঁছে বেশ কয়েকটা প্রশ্ন তৈরি হয়। প্রথম প্রশ্ন, ট্রাস্টের নির্দেশ মেনে লেখাদুটো সরিয়ে নিতেই পারতেন পরঞ্জয়বাবু। কিন্তু সে-ক্ষেত্রে গত অর্ধশতক ধরে ‘ইপিডবলিউ’-এর যে ভাবমূর্তি তৈরি হয়ে উঠেছে দেশের অন্যতম প্রধান অ্যাকাডেমিক জার্নাল হিসেবে, তার প্রতি ঠিক কতটা সুবিচার হত? এবং দ্বিতীয় প্রশ্ন, কেবল ‘ইপিডবলিউ’ বলে নয়, যে কোনও কাগজ বা পত্রিকার পক্ষেই এ ধরনের হুমকির সামনে মাথা নোওয়ানো, সাংবাদিকতার পেশাগত আদর্শের প্রতি অনুগত থেকে, কতদূর সমর্থনযোগ্য? এ-প্রসঙ্গে আমাদের হয়তো মনে পড়বে, কীভাবে সাম্প্রতিক অতীতে একের পর এক সংবাদপত্র প্রকাশনা সংস্থার বিরুদ্ধে একাধিক কেন্দ্রীয় এজেন্সি লেলিয়ে দেওয়া হয়েছে, কীভাবে কেন্দ্রের তাঁবেদার সংবাদমাধ্যম ও প্রকাশনা সংস্থাগুলিকে দিয়ে বিরোধী সংবাদমাধ্যমগুলির দিকে পরিকল্পিত কাদা ছেটানো হয়ে এসেছে ক্রমান্বয়ে। প্রত্যাশিতভাবেই ছোট কাগজগুলির পক্ষে এই চাপ নেওয়া সম্ভব হয়নি, স্বাধীনতার মোহ বিসর্জন দিয়ে কোনওক্রমে অস্তিত্ব বজায় রাখতে হয়েছে। সর্বভারতীয় প্রেক্ষাপটেও যেমন, তেমনই এ-রাজ্যেও অতি সম্প্রতি একই ঘটনা ঘটতে দেখা গিয়েছে।
অপ্রত্যাশিত বরং এইটা যে, ইপিডবলিউ-এর মতো অ্যাকাডেমিক একটা কাগজ, গত পঞ্চাশ বছর ধরে সৎ ও নির্ভীক সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে যে কাগজ খুব ধারাবাহিকভাবে সুস্পষ্ট একটি অবস্থান নিয়ে এসেছে, তাদের বোর্ড অফ ট্রাস্টি এত তড়িঘড়ি একটা লিগ্যাল নোটিশ-এর সামনে গুটিয়ে গেলেন কেন! বিশেষত যে ট্রাস্টের সদস্যরা হলেন অর্থনীতিবিদ দীপক নায়ার, ইতিহাসবিদ রোমিলা থাপার, সমাজতাত্ত্বিক দীপংকর গুপ্ত প্রমুখ! এমন তো নয় যে, এই প্রথম কর্পোরেট দুর্নীতি ও তার সঙ্গে সরকারের প্রচ্ছন্ন যোগসাজশ নিয়ে কড়া লেখা প্রকাশিত হল এই জার্নালে। এমন তো নয় যে, এই প্রথম কর্পোরেটের কাছ থেকে আইনি চিঠি পেলেন কোনও সাংবাদিক। এমন তো নয় যে, ভুয়ো তথ্য-সংবলিত অভিসন্ধিমূলক সাংবাদিকতার জন্য আদালতে দোষী সাব্যস্ত হয়েছেন পরঞ্জয়বাবু। তা হলে এত তড়িঘড়ি এত কঠোর অবস্থান নিতে হল তাঁদের? কেন আদালতে যাওয়ার পথ খোলা থাকা সত্ত্বেও তা করা হল না? কিসের চাপ ছিল? কত বড় চাপ? কতটা ধারালো দাঁত-নখ সেই চাপের, যার সামনে সম্পাদককে বলি দিয়ে নিজেদের মেরুদণ্ডহীনতা প্রমাণে উঠে-পড়ে লাগতে হল ট্রাস্ট-সদস্যদের? অন্য কোনও বৃহত্তর প্রাপ্তির প্রত্যাশা? কতটা সোনালি তার রং?
ঘটনা হল, একটা নির্দিষ্ট পরিস্থিতির মধ্যে দাঁড়িয়ে নিজেকে তার সঙ্গে মানানসই করে ছেঁটে-কেটে মানিয়ে-গুছিয়ে নেওয়ার সুযোগ পরঞ্জয়বাবুর সামনে অতি অবশ্যই খোলা ছিল। সেটা অবশ্যই একটা অপশন হতে পারত, যেমন আমাদের অনেকেরই হয়। কিন্তু তা না করে তিনি বেছে নিলেন অন্য একটা অপশন, অন্য একটা রাস্তা। হয়তো সে রাস্তায় আলো কম, লোক কম চলে, কিন্তু তা সত্ত্বেও, তা শেষ অবধি একটা রাস্তাই। সব রাস্তার মতোই, এ-রাস্তাও কোথাও একটা পৌঁছয় তো বটেই, পৌঁছতে বাধ্য। তিনি নিশ্চয়ই গন্তব্যটা জানতেন। জেনেই বেছে নিয়েছিলেন।
খুব সম্প্রতি আইএএনএস-কে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে পরঞ্জয়বাবু জানিয়েছেন, ঠিক কী কারণে সরে দাঁড়ানোর সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয়েছেন তিনি। প্রথম উত্তরটা অনুমেয়, ট্রাস্টের নির্দেশে যদি লেখাদুটো তুলে নিতেন, তা হলে সাপও মরত এবং লাঠিও ভাঙত না এ-কথা যেমন ঠিক; তেমনই সৎ ও স্বাধীন সাংবাদিকতার মাপকাঠিতে এক অপরিবর্তনীয় ক্ষতি হয়ে যেতে পারত। ওঁর নিজের ভাষায়, ““I do believe that in India, there is a real and present danger to the freedom of expression, which you and everybody else know is a fundamental right of every citizen guaranteed by the Constitution. If I cannot play the role of an antagonist, if not an adversary, to those in power — be they politicians, bureaucrats or corporate captains — then I am failing to perform my duties and obligations as a journalist. It is not my personal battle, it’s a battle which has wider social and political ramifications…”
তাই পরঞ্জয়বাবুর পদত্যাগের খবর আমাদের কাছে অপ্রত্যাশিত নয়। আমরা নিশ্চিত, ওঁর কাছেও নয় তা। আমরা যারা দুঃখ পেয়েছি, সেটা পরঞ্জয়বাবুর সম্পাদিত কাগজ হাতে না-পাওয়ার দুঃখ – তাঁর নিজস্ব যে মেজাজ, শিক্ষা, রুচি ও পরিশীলন গত পনেরো মাস ধরে ইপিডবলিউ-এর প্রতিটি সংখ্যার প্রতিটি লেখায় প্রচ্ছন্ন থাকত, সেটা ভবিষ্যতে আর না-পাওয়ার দুঃখ। পরঞ্জয়বাবুকে নিয়ে, সে কারণেই আমাদের কোনও দুশ্চিন্তা নেই। কারণ তিনি একটা রাস্তা বেছে নিয়েছেন। সেটা তাঁর চয়েস। সচেতন, স্বচিন্তিত চয়ন। তাঁর নিজের বেছে নেওয়া। এবং সেটা বেছে নেওয়ার পর, সেখান থেকে আর ফিরে দাঁড়াননি।
আমাদের দুশ্চিন্তা বরং পরিবেশটাকে নিয়ে, যেখানে আমাদের অধিকাংশকে প্রতিনিয়ত নিজেদের সঙ্গে আপস করতে হয়, সচেতনভাবে, অথবা বাধ্যত। পরঞ্জয়বাবু আমাদের সামনে একটা দৃষ্টান্ত খাড়া করে দিলেন।
লেখা প্রায় শেষ হয়ে আসার মুখে, ঈষৎ কৌতুকজনক আরও একটা তথ্য মনে পড়ল। নিছকই সমাপতন, কিন্তু তবুও উল্লেখ থাক যে, হয়তো বা অসচেতনেই এ-যাত্রা তাঁর এমন এক পূর্বসুরিকে ‘রিপিট’ করে ফেললেন পরঞ্জয়বাবু, এ বছর যাঁর শতবর্ষ উদ্যাপন করছি আমরা। হ্যাঁ, আমরা সমর সেনের কথাই বলছি। বিবাহের পূর্বে হবু শ্বশুরমশাইকে বিদেশযাত্রার প্রস্তাবিত যৌতুক প্রসঙ্গে যিনি বলতে পারেন পুরুষাঙ্গ বন্ধক রেখে বিলেতগমন তাঁর পছন্দ নয়, তিনি যে সম্পাদকীয় কর্মজীবনে বারেবারেই কর্তৃপক্ষের বিরাগভাজন হবেন এবং ফলশ্রুতিতে প্রথমে ‘নাও’ ও পরে ‘ফ্রন্টিয়ার’ যে তৎকালীন রাজন্যবর্গের চক্ষুশূল হয়ে উঠবে, তাতে আর সন্দেহ কী?
পরঞ্জয়বাবুকে ধন্যবাদ, তিনি শ্বশুর বা অসুর, কারও কাছেই নিজের কলমটি বন্ধক রাখতে চাননি।
ছবিঋণ – ইন্টারনেট