ব্রতীন্দ্র ভট্টাচার্য
লেখক প্রাবন্ধিক, গদ্যকার।
চতুর্দিকে এতশত মরার ভয়ের মধ্যে আরও একটা ভয়বলয়ের কেন্দ্রে দাঁড়িয়ে আছি সকলে। কেউ উৎকণ্ঠিত, কেউ আবার গোমাতার ন্যায় পরম উদাসীনতায় অনিত্য জীবনের জাবর কাটছেন। কেউ মুখোশের খোঁজে হন্যে, তো কারও মতে এ-সবই পশ্চিমী দুনিয়ার ওষুধবানিয়াদের ষড়যন্ত্র। আতঙ্কের আবাদ হলেই বাজারে ওষুধ ছেড়ে সোনা তুলবে ঘরে। কেন না ওদের নৌকায় জায়গার অভাব হয় না! ওদিকে এক শক্তিমান বাবা নাকি অত্যধিক গোমূত্রপানপূর্বক অসুস্থতাহেতু হাসপাতালস্থ হয়েছেন, তবু তাঁর চেলারা পরম নিষ্ঠায় এখনও ঘটি-ঘটি চোনা গিলে চলেছেন। চিনে ভাইরাস আর সনাতন হিন্দুত্বের লড়াইয়ের জয় হয় কার, সেটাই দেখার!
আমার কাজটা তুলনায় সহজ। পক্ষ না-নিয়ে কেবল ক্ষয়ক্ষতির একটা হিসেব দাখিল করা। সব ক্ষয়ের, বা ক্ষতির, হিসাব তো সম্ভব না। হিসাবটাই তাই আর্থিক ক্ষয়ক্ষতিরই থাক।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ওয়েবসাইটে প্রদত্ত তথ্য অনুযায়ী সারা পৃথিবীতে কোভিড-১৯ আক্রান্তের সংখ্যা এখন পর্যন্ত এক লক্ষ বিয়াল্লিশ হাজার ছশো ঊনপঞ্চাশ। আক্রান্ত দেশের সংখ্যা ১৩৫, এবং মৃতের সংখ্যা পাঁচ হাজার তিনশো তিরানব্বই। চিন ছাড়াও অন্য যে-সব দেশের মানুষ এই ভাইরাসের কবলে পড়েছেন– ইতালি, ইরান, দক্ষিণ কোরিয়া, স্পেন, ফ্রান্স, জার্মানি, অ্যামেরিকা এবং সুইৎজারল্যান্ড তাদের মধ্যে প্রধান। এই কটি দেশে আক্রান্তের সংখ্যা মোট সংখ্যার বিরানব্বই শতাংশেরও বেশি।
আমাদের দেশে সংক্রমিত মানুষের সংখ্যা আপাতত বিরাশি, যা মোট সংখ্যার বিচারে কমের দিকেই। তবে আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা যেভাবে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে, তাতে কোন সংখ্যা কোথায় গিয়ে দাঁড়ায় বলা শক্ত। কথায় বলে, মারের সাবধান নেই!
জ্ঞানচক্ষু মেলা-ইস্তক খেতে-পরতে-পাওয়া মানুষের যে চাহিদার কথা জেনেছি, তা হল মুক্ত চলাফেরা। এই করোনাভাইরাস বা কোভিড-১৯ ঠিক এই জায়গাতেই ঘা বসিয়েছে। নব্বইয়ের দশকে মুক্ত অর্থনীতির রবরবা বিশ্বের প্রায় সব দেশকেই বাধ্য করেছিল মনুষ্যচলাচলের ক্ষেত্রে বাধাকে– অন্তত ব্যবসায়িক কারণে চলাচলের ক্ষেত্রে– ন্যূনতম মাত্রায় নামিয়ে আনতে। এই মুক্তবাণিজ্যের পথে এই বিবিধ বাধার হ্রাসপ্রাপ্তির ফলে বিশ্ববাণিজ্য– ১৯৯৫ সালের বিশ্ব বাণিজ্যসংস্থার পত্তনের কালে যা ছিল পাঁচ ট্রিলিয়ন ডলার মতন, ২০১৮-র মধ্যে বাড়ল চতুর্গুণের বেশি। পর্যটকের সংখ্যা, ১৯৯৫ সালে যা ছিল ৫২৫ মিলিয়নের মতন, ২০১৬-তে বেড়ে দাঁড়াল ১.২ বিলিয়ন– দ্বিগুণের বেশি। গতায়াতের ওপর বিশ্বব্যাপী নিষেধাজ্ঞায় ব্যবসার এই এতসব বাড়বাড়ন্ত একেবারে মুখ থুবড়ে পড়েছে।
অর্গানাইজেশন ফর ইকোনমিক কো-অপারেশন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট বা ওইসিডি– যা কিনা ছত্রিশটা অবস্থাপন্ন দেশের জমায়েত– করোনাসৃষ্ট এই অবস্থাকে ২০০৮-এর বিশ্বব্যাপী মন্দার সঙ্গে তুলনা করেছে। আঙ্কট্যাড– বা ইউনাইটেড নেশনস কনফারেন্স অন ট্রেড অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট-এর মতে এই সঙ্কটের ফলে বিশ্ববাণিজ্যে ভাঁটার অর্থমূল্য হতে পারে এক ট্রিলিয়ন ডলার, আর বিশ্ব-জিডিপি পড়তে পারে দুই শতাংশ। তেলের সবথেকে বড় খরিদ্দার চিন তেলের আমদানি কমিয়ে দেওয়াতে বিশ্ববাজারে তেলের দাম নিম্নগামী। ১৯৯১-এর উপসাগরীয় যুদ্ধের পর সবথেকে তলানিতে ঠেকা তেলের দাম কমেছে এক তৃতীয়াংশ। দাম আরও পড়ে যাবার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে রাশিয়া আর সৌদি আরবের তেলচুক্তি শেষ হয়ে যাওয়ায়– দুই দেশই বাজারে আরও তেল ছাড়ার পরিকল্পনা গ্রহণ করার পর।
আঙ্কট্যাড-এর রিপোর্টে বলা হয়েছে, ভারতের বহির্বাণিজ্যে যে আঘাত আসতে চলেছে তার অর্থমূল্য তিনশো আটচল্লিশ মিলিয়ন ডলারের মতন। এর কারণ হিসাবে দেখানো হয়েছে মূলত রাসায়নিক পদার্থ ও বস্ত্রশিল্পে চৈনিক উপাদানের আমদানির ওপর ভারতের নির্ভরতা।
তবে আঙ্কট্যাড-এর এই রিপোর্ট থেকে বহির্বাণিজ্যের ওপর প্রভাব ঠিক পুরোটা বুঝতে পারা মুশকিল। এখানে যে সমস্যার কথা বলা হল, তার সবটুকুই চিন-সংক্রান্ত। কিন্তু ভাইরাসের আক্রমণ যেহেতু চিনেই সীমাবদ্ধ নেই, সেহেতু তার ফলও কেবল চিনে সীমাবদ্ধ থাকবে, এমন ভাবনা ঠিক নয়। বস্তুত, ওপরে যে কটি দেশের নাম বলা হয়েছে (যেসব দেশে বিরানব্বই শতাংশ আক্রান্তের বসবাস), তারা প্রত্যেকেই বিশ্ববাণিজ্যের আসরে বড় খেলোয়াড়, এবং ভারতের রপ্তানির প্রধান কয়েকটি গন্তব্য। যেহেতু বিশ্ববাণিজ্যে ভারতের ভাগ মাত্র দুই শতাংশের মত, সে হেতু ক্ষতির পরিমাণের আর্থিক মূল্য হয়তো দেখতে অল্পই হবে, তবে এই ক্ষতির প্রকৃত ফল ভুগবে দেশের অগণিত ক্ষুদ্র ও মাঝারি সংস্থা, যারা দেশীয় বহির্বাণিজ্যের, বিশেষত রপ্তানির, প্রধান চালিকাশক্তি। মনে রাখতে হবে, এই ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প দেশের চল্লিশ শতাংশ মানুষের রুজিরুটি উপার্জনের ক্ষেত্র, এবং এদের ব্যবসায় আঘাত এলে তার প্রথম ধাক্কাটি খাবে আমাদের এই সব সহনাগরিক।
স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রক-প্রদত্ত সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী আমাদের দেশে কোভিড-আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা আপাতত নব্বই, যদিও সংবাদমাধ্যমের সূত্রে জানা যাচ্ছে সংখ্যাটা একশো পার করেছে। এঁরা সকলেই ভারতীয়। এর বাইরে আছেন সতেরোজন বিদেশি। মহারাষ্ট্র, কেরল, উত্তর প্রদেশ ও হরিয়ানায় এই রোগের বাড়বাড়ন্ত। পূর্বভারতের কোনও রাজ্যের নাম মন্ত্রকের তালিকায় এখনও ওঠেনি।
আক্রান্ত দেশের তালিকায় বেশ নিচের দিকে থাকা সত্ত্বেও (এবং অর্থনীতিকে গোমূত্র খাওয়ানোর বিধি না-থাকার কারণে, সম্ভবত) ধ্বসা রোগের হাত থেকে মুক্তি পায়নি ভারতের অর্থনীতি। মুখ থুবড়ে পড়েছে সেনসেক্স। রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্য পূরণ হবে না কোনওমতেই, এ-কথা প্রকারান্তরে স্বীকার করে নিচ্ছেন অর্থমন্ত্রকের আধিকারিকেরা। অবস্থা এতটাই সঙ্গিন, যে আগামী বছরের লক্ষ্যমাত্রাও হয়ত কমিয়ে আনতে হতে পারে, ভাবনাটা এমন। যদিচ জাতীয় আয়ের আনুমানিক বৃদ্ধির হার ছয় থেকে সাড়ে ছয় শতাংশ হবে বলেই সরকার মনে করছেন। যে সমস্ত ক্ষেত্র সবথেকে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে বলে মনে করা হচ্ছে, তাদের মধ্যে আছে বেসামরিক বিমান চলাচল, হোটেল, বস্ত্রশিল্প, ইলেকট্রনিক্স ও গৃহস্থালির অন্যান্য সরঞ্জাম– যেমন মোবাইল ফোন, পোল্ট্রি এবং মৎস্যব্যবসা।
দেশের অর্থনীতি যে খুব সুবিধার জায়গায় নেই সে-কথা নিতান্ত ভক্ত ছাড়া সকলেই মানেন। বিগত ছয় বছরের মধ্যে দেশের আয়বৃদ্ধির হার এখন সবথেকে কম। বেকারত্বের হার প্রায় আট শতাংশ। মূল্যবৃদ্ধি প্রায় সাত শতাংশ ছুঁয়েছে। উৎপাদনক্ষেত্রের ছবিও খুব একটা আশাব্যঞ্জক নয়। এতসব নেতির মধ্যে ভাইরাসের উপদ্রব ভারতের অর্থনীতিকে যে মন্দার গভীরতর অন্ধকারের দিকে ঠেলে দেবে– এই ভাবনার মধ্যে অনিশ্চয়তা খুব একটা নেই বলেই মনে হয়। কৃষ্ণগহ্বরে পূর্ণ নিমজ্জন কতদিনে হবে, আর তার থেকে বেরিয়ে আসা কবে বা কীভাবে সম্ভবপর হবে, তা নিয়ে আমাদের শঙ্কার শেষ নেই। নেই কোথাও আশার রূপালি মেঘরেখা।