Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

রবীন্দ্রনাথ ও আঁদ্রে জিদ

সৈয়দ কওসর-জামাল

 

১৯১২ সালের অক্টোবর মাসে রবীন্দ্রনাথ ইংল্যান্ডে। ইংরেজিতে অনূদিত তাঁর গীতাঞ্জলির কবিতা ও দেশের সাহিত্যমহলে আলোড়ন তুলেছে। সবাই প্রশংসা করছেন তাঁর কবিতার। সংবাদপত্রেও তাঁকে নিয়ে লেখা হচ্ছে। এই সময় এক ফরাসি তরুণ কবি স্যাঁ-লেজে লেজে লন্ডনে থাকার সময় পড়লেন রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে ডব্লিউ-বি-ইয়েটসের প্রবন্ধে, যেখানে গীতাঞ্জলির চারটি কবিতাও ছিল। মুগ্ধতাবোধ থেকে লেজে চিঠি লিখে দেখা করলেন রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে। এই ঘটনাটিকে রবীন্দ্রনাথ বলেছেন এইভাবে :

কাল সকালে একজন ফরাসি গ্রন্থকার আমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলেন। তিনি প্রুফে আমার তর্জমাগুলো পড়ে খুব উত্তেজিত হয়ে আমার কাছে এসেছেন। তিনি বল্লেন, তোমার মতো কবির জন্য আমরা অপেক্ষা করে আছি। আমাদের lyrics-এ আমরা কেবল accidental-কে নিয়ে বদ্ধ হয়ে আছি– তোমার লেখা দেশকালের অতীত, চল তুমি আমাদের ফ্রান্সে চল, সেখানে তোমাকে আমাদের প্রয়োজন আছে। (জগদানন্দ রায়কে লেখা চিঠি)

ফ্রান্সের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের এটিই প্রথম কাব্যিক যোগসূত্র। আর এই যোগসূত্রটি ঘটালেন স্যাঁ-লেজে লেজে, যিনি পরে স্যাঁ-জন পের্স ছদ্মনামে বিখ্যাত হয়েছেন এবং নোবেল পুরস্কারেও ভূষিত হয়েছেন ১৯৬০ সালে। তরুণ স্যাঁ-লেজে শুধু রবীন্দ্রনাথের কবিতার প্রশংসাই করেননি, অপেক্ষা করেছেন গীতাঞ্জলির কবিতাগুলি কবে গ্রন্থরূপে প্রকাশিত হবে। আর প্রথম কপিটি ফ্রান্সে তিনিই নিয়ে গেছেন। ইতিমধ্যেই লেখক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত, আঁদ্রে জিদকে অনুরোধ করছেন গীতাঞ্জলির ফরাসি অনুবাদের জন্য। রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে দেখা করার সময় কথাপ্রসঙ্গে স্যাঁ-লেজে যে চারজন ফরাসি লেখকের নাম উল্লেখ করেছিলেন, তাঁদের মধ্যেও একজন আঁদ্রে জিদ।

স্যাঁ-জন পের্সের কাছ থেকেই আঁদ্রে জিদ রবীন্দ্রনাথের পরিচয় পান। পের্স তাঁকে ইংরেজি গীতাঞ্জলির ব্যক্তিগত কপিটিই তুলে দিয়েছেন। এই কপিটি গীতাঞ্জলির ইন্ডিয়া সোসাইটি সংস্করণ, যা ১৯১২ সালের ডিসেম্বরে লন্ডনে প্রকাশিত হয়েছে। আর এই মাসেই জিদকে চিঠিতে পের্স লিখেছেন— ‘এই বইটা যতদিন খুশি আপনি রাখুন, কিন্তু আমার জন্যই ওটা রেখে দেবেন, কারণ কপিটা ব্যক্তিগত।’ (৭ ডিসেম্বর, ১৯১২)

আঁদ্রে জিদকে গীতাঞ্জলি-র নিজের কপিটি দেওয়ার একটাই উদ্দেশ্য– আঁদ্রে জিদ যাতে রবীন্দ্রনাথ অনুবাদে উৎসাহিত হন। ২৮ ফেব্রুয়ারি, ১৯১৩ জিদকে পুনরায় চিঠি :

রবীন্দ্রনাথের কাব্য অপরূপ। আজকের এই মুহূর্তে ফ্রান্সে ছোট এই বইটার সঙ্গে আপনিই একমাত্র পরিচিত। আপনার তরফ থেকে আমি রবীন্দ্রনাথকে চিঠি দিচ্ছি। লন্ডনে যখন আমি তাঁর কাছ থেকে বিদায় নিই, তখন পর্যন্ত কোনও প্রকাশককে তিনি তাঁর স্বত্ব তুলে দেননি।

স্পষ্টতই ফরাসিতে গীতাঞ্জলি অনুবাদের স্বত্ব-ই বুঝিয়েছেন পের্স। ইংল্যান্ডে রবীন্দ্রনাথের অনুবাদ-স্বত্বের দিকটি তখন দেখছিলেন ফক্স স্ট্রাংওয়েজ। তাঁর কাছে ইতিমধ্যে আরও তিনটি জায়গা থেকে ফরাসি অনুবাদ-স্বত্বের জন্য আবেদন আসে। শোনামাত্র পের্স চিঠি লিখলেন রবীন্দ্রনাথকে। চিঠিতে তিনি অনুবাদকের ব্যক্তিত্বটি যে অতি গুরুত্বপূর্ণ, তা জানিয়ে লিখছেন :

….কারণ আঁদ্রে জিদের মতো একজন লেখক যখন নিজের মৌলিক রচনা ফেলে কোনও কারণে যে বিষয়ান্তরে যেতে পারেন, এমন কথা কেউ প্রথমে বিশ্বাস করবে না। সেই আঁদ্রে জিদই স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে আপনার কবিতাগুলির অনুবাদ করতে গভীর আগ্রহ প্রকাশ করেছেন। অনুবাদের কাজটি এইরকম যোগ্য হাতে ন্যস্ত থাকার মূল্য যে কী, সম্ভবত শ্রীযুক্ত ফক্স স্ট্রাংওয়েজ বা আপনি নিজেও ঠিক উপলব্ধি করতে পারছেন না।

আঁদ্রে জিদ ‘স্বতঃপ্রবৃত্ত’ হয়ে গীতাঞ্জলির অনুবাদে হাত দিয়েছেন, এ কথায় যতটা না সত্যি আছে, তার চেয়ে বেশি সত্যি হল পের্স-এর নিরন্তর তাগিদ। একই চিঠিতে পের্স রবীন্দ্রনাথকে জানাচ্ছেন, অনুবাদে হাত দেওয়ার পর থেকেই তিনি চাইছেন গীতাঞ্জলির ফরাসি অনুবাদের সর্বস্বত্ব তাঁকে দেওয়া হল এই মর্মে আপনার মুখের কথা।

রবীন্দ্রনাথের সিদ্ধান্ত আঁদ্রে জিদের পক্ষেই যায় এবং অনুবাদ সম্পর্কে তৈরি হওয়া অনিশ্চয়তা দূর হয়। তবে অনুবাদের ব্যাপারে পের্স যতই উদ্যোগী হন, গীতাঞ্জলির ইংরেজি অনুবাদ জিদের পছন্দ না হলে তিনি নিশ্চয় অনুবাদের কাজে হাত দিতেন না। এই কবিতাগুলি যে তাঁরও ভালো লেগেছিল, তা বলার অপেক্ষা রাখে না।

তবু পের্সের প্রস্তাবমতো জিদের অনুবাদ প্রথমেই পুস্তকাকারে প্রকাশিত হয়নি। প্রথমে নিজের পত্রিকা ‘নুভেল র‍্যভু ফ্রসেজ’-এ পঁচিশটি কবিতার অনুবাদ প্রকাশ করেন জিদ। এর পর ২৬ নভেম্বর, ১৯১৩ জিদ অনূদিত L’Offrande Lyrique (Gitanjali) পুস্তকাকারে প্রকাশিত হল পত্রিকাটির নিজস্ব প্রকাশনী থেকে। অনুবাদকর্মটি জিদ উৎসর্গ করেন স্যাঁ-লেজেকেই। প্রথম সংস্করণ মুদ্রিত হয়েছিল পাঁচশো কপি। আঁদ্রে জিদ-লিখিত বিখ্যাত ভূমিকাটি কিন্তু প্রথম সংস্করণে ছিল না, এটি যুক্ত হয় পরের সংস্করণে, ১৯১৪ সালের প্রথম দিকে। স্যাঁ-লেজে লেজে বা স্যাঁ-জন পের্স এই অনুবাদের জন্য যে ভূমিকা নিয়েছিলেন, তা পরোক্ষে থেকে গেল, কিন্তু আঁদ্রে জিদের অনুবাদের মধ্যে দিয়েই ফরাসিভাষী মানুষের কাছে পরিচিত হলেন রবীন্দ্রনাথ। এই দেশের সাহিত্যমহলের সঙ্গে তাঁর একটি স্থায়ী সম্পর্ক তৈরি হল। ১৯৬১ সালে রবীন্দ্রজন্মশতবার্ষিকীর সময় পর্যন্ত এক হিসেব অনু্যায়ী জানা যাচ্ছে, L’Offrande Lyrique (Gitanjali)-এর ১৩৬টি সংস্করণ প্রকাশিত হয়েছে।

জিদ জন্মেছিলেন ১৮৬৯ সালে, অর্থাৎ রবীন্দ্রনাথের চেয়ে তিনি আট বছরের ছোট। মানবতাবাদী ও নীতিবাদী লেখক আঁদ্রে সাহিত্যজীবনের প্রথমে প্রভাবিত হয়েছিলেন প্রতীকবাদী আন্দোলনের নন্দনতত্ত্বে। গীতাঞ্জলির কবিতা অনুবাদের সময় তাঁর বয়স তেতাল্লিশ বছর। কিন্তু এই বয়সেই ফরাসি সাহিত্যে ঔপন্যাসিক, নাট্যকার ও সমালোচক হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছেন। এছাড়াও বিশ্লেষণাত্মক নানা রচনার মধ্যে দিয়ে জিদ ইউরোপের প্রচলিত সামাজিক ও ধর্মীয় মূল্যবোধের বিচার করেছেন– কখনও তীব্র ভাষায় আক্রমণ করেছেন প্রোটেস্টান্টদের নৈতিক ও যৌনতার ধারণাগুলিকে। এর ফলে ফরাসি সাহিত্য ও সমাজে আঁদ্রে জিদ একজন বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব হয়ে উঠেছিলেন।

এমত লেখক জিদ যখন গীতাঞ্জলির ফরাসি অনুবাদ করেন, তখন তা ফরাসি মননে গৃহীত হতে দেরি হয় না। ফরাসি অনুবাদ যখন প্রকাশিত হয়েছে, তখন রবীন্দ্রনাথ ইতিমধ্যেই নোবেল পুরস্কারে সম্মানিত। অনুবাদের দ্বিতীয় সংস্করণের ভূমিকায় জিদ জানাচ্ছেন, তাঁর হাতে অনন্ত সময় থাকলেও প্রাচীন ভারতের বিপুল গ্রন্থসম্ভারের সামনে দাঁড়িয়ে তার বুক দুরু দুরু করতই। পোল দ্য স্যাঁ-ভিক্তরকে উদ্ধৃত করেছেন জিদ— ‘ইউরোপীয় ও ভারতীয় চিন্তার মধ্যেখানে ভয়ঙ্কর নিষেধের মতো মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে হাজার দেবতা।’ তাই তাঁর বিস্ময়– অথচ গীতাঞ্জলি, একটা ছোট কাব্যগ্রন্থ, তা ভয়ের উদ্রেক করেনি। এই সংক্ষিপ্ততা পছন্দ হয়েছিল জিদের। তিনি এই ভালো লাগার কথা দিয়েই শুরু করেছিলেন তাঁর ভূমিকা। তাঁর ভালো লেগেছে, রবীন্দ্রনাথের এই কবিতায় পুরাণের কোনও রেফারেন্স নেই, ফলে এই কবিতাগুলি পাঠ করার জন্য কোনও পূর্বপ্রস্তুতির দরকার হয় না। তিনি এই কবিতায় পেয়েছেন ‘পরিমাণের বদলে উৎকর্ষ এবং কলেবরের বদলে ঋদ্ধি।’ তিনি বলেছেন :

কী সেই সত্য, যা আত্মাকে পুষ্ট করে, আবার মাতাল করেও তোলে? এ কি ব্রাহ্মণ্য দর্শনের ফসল? এ কি বৈষ্ণবীয় ধর্ম? না, এ হল প্রেমের দর্শন– এ হল এই ধর্মের মধ্যে প্রেমের স্থান।

এইসব বিমূর্ত ও মনননির্ভর বিষয়কে রবীন্দ্রনাথ স্পর্শের উচ্চতা দিয়ে জীবন্ত করে তুলেছেন, এই ছিল আঁদ্রের ধারণা। রবীন্দ্রনাথের ‘সামনে নিজেকে নত করে আমি সেই আনন্দ পেয়েছি, যা তিনি পেয়েছেন তাঁর দেবতার সামনে গান গাইবার সময় নিজেকে অবনত করে।’

৪ ডিসেম্বর, ১৯১৩ জিদ প্যারিসের তিয়েআত্-এর দ্যুভ্য কলোম্বিয়ের-এ রবীন্দ্রনাথের ওপর ভাষণ দেন। ১৯১৬ সালে অনুবাদ করেন রবীন্দ্রনাথের ডাকঘর নাটক। এটি ছাপা হয়েছিল Amal et la lettre du Roi বা অমল ও রাজার চিঠি নামে। লন্ডনের ম্যাকমিলান কোম্পানি থেকে জিদের কাছে রবীন্দ্রনাথের Nationalism গ্রন্থটি পাঠানো হয়েছিল। জিদ জানান, তিনি আগেই এর কিছু অংশ পড়েছেন এবং তাঁর কাছে ইন্টারেস্টিং মনে হয়েছে। তবু গ্রন্থটির অনুবাদে জিদ আর আগ্রহ দেখাননি।

১৯২০ সালের জুন মাসে রবীন্দ্রনাথ প্যারিসে পৌঁছে দু’জন মানুষের সঙ্গে দেখা করতে চেয়েছিলেন– একজন রোঁম্যা রঁলা, অন্যজন আঁদ্রে জিদ। রথীন্দ্রনাথ আমাদের জানাচ্ছেন– আঁদ্রে জিদ যদিও কয়েক বছর আগেই গীতাঞ্জলির অনুবাদ করেছিলেন, বাবার সঙ্গে তখনও তাঁর দেখা হয়নি।’ এবার রথীন্দ্রনাথের অভিজ্ঞতা এইরকম :

একদিন আমার স্ত্রী ও আঁদ্রে কার্পেলেসের সঙ্গে ওতিলের পেছনে রোয়া দ্য বুলোয়াঁর ধারে সকালে হাঁটার সময় আমাদের বন্ধু আধুনিক স্থাপত্যের একটি বাড়ির দিকে তাকিয়ে বললেন, জিদ এই বাড়িতে থাকেন। তিনি একথাও জানালেন যে জিদ ভারি অদ্ভুত মানুষ, কখনও কারও সঙ্গে দেখা করতে চান না। তবু আমরা ঠিক করলাম যে দেখা করার চেষ্টা করব এবং সেইমতো দরজায় কড়া নাড়লাম। কয়েক মিনিট অপেক্ষার পর পুনরায়। এতে অবশ্য বাড়ির নীরবতা ভেঙেছে বলে মনে হল না। আমরা ফিরে আসার মুহূর্তে হঠাৎ-ই দরজা খুললেন ড্রেসিং গাউনে সজ্জিত এক ব্যক্তি। কয়েক মুহূর্ত আমাদের দেখলেন এবং দরজা খোলা রেখেই দ্রুত ওপরে চলে গেলেন। আমরা শুধু দেখলাম একসঙ্গে দুটো করে সিঁড়ি ডিঙ্গিয়ে একটা মানুষের শরীর রহস্যময় অন্দরমহলের দিকে মিলিয়ে গেল। (অন দ্য এজেস অফ টাইম)

১৯২০ থেকে ১৯২১ রবীন্দ্রনাথ ইউরোপের অনেক দেশে ভ্রমণ করেছেন। ১৯২১-এ পুনরায় প্যারিসে তিনি উঠেছেন শ্রীযুক্ত অলিবের কানের অতিথিশালায়। এই সময় রোম্যাঁ রলাঁর সঙ্গে তাঁর কয়েকবার দেখা হওয়ার বিবরণ পাই, কিন্তু আঁদ্রে জিদের সঙ্গে তাঁর দেখা হয়েছে, এমন তথ্য মেলেনি। তবু রবীন্দ্রনাথের একটি চিঠির টীকায় কৃষ্ণা দত্ত ও অ্যান্ড্রু রবিনসন জানাচ্ছেন যে ২৪ এপ্রিল ১৯২১ জিদের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের দেখা হয়েছে। অথচ যে চিঠির টীকায় এই তথ্য তাঁরা দিচ্ছেন, ২৪ মে, ১৯২১-এর সেই চিঠিটি রবীন্দ্রনাথ লিখছেন স্টার্জ মুর-কে। এই চিঠির বিষয় নুভেল র‍্যভু-র উপদেষ্টা হিসেবে আঁদ্রে জিদ শ্রীমতী মুরের করা ম্যাকমিলার-কৃত Cresent Moon-এর ফরাসি অনুবাদ ছাপতে বাধা দিয়েছেন অনুবাদ মধ্যমানের হয়েছে, এই যুক্তিতে। রবীন্দ্রনাথ এই সমস্যায় কিন্তু আঁদ্রে জিদকে লিখছেন না, লিখছেন স্টার্জ মুরকে। তিনি লিখছেন :

…..I have been told that Andre’ Gide is their advisor and my works are in his hands either for translation or for revision when translated by some other authors. I suppose he is too proud to submit his alterations for final approval of translators. Do you know Gide personally? In that case it would greatly simplify the matter if you write to him direct and come to some understanding with him. I have no freedom whatever about this. My part in the whole affair is the most insignificant one of merely being the author of the original book. (Selected Letters of Rabindranath Tagore)

রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে আঁদ্রে জিদের প্রথম সাক্ষাৎ আমরা ঘটতে দেখছি ১৯৩০-এ, যখন রবীন্দ্রনাথ তাঁর ছবির প্রদর্শনীর জন্য প্যারিসে। এই সাক্ষাতের সময় সেখানে ছিলেন ভিক্তোরিয়া ওকাম্পো। তাঁর ভাষায় :

পারীতে থাকবার সময়ে এই প্রথম রবীন্দ্রনাথ তাঁর অনুবাদক আঁদ্রে জীদের সঙ্গে আলাপ করতে গেলেন। আমিও ছিলাম এই দেখাশোনার সময়ে, তবে কিনা বুদ্ধি করে ওঁদের ছেড়ে দিয়েছিলাম একা, তাকিয়ে ছিলাম জানলার ঠিক নিচেই এক ফুলফলন্ত বাদামগাছের দিকে। আমার অবশ্য মনে হয় না যে ওই দু’জন মানুষের মধ্যে যথার্থ কোনও মতবিনিময় হতে পেরেছিল। এটা একটু আশ্চর্য, কেন না জীদের গীতাঞ্জলি অনুবাদের মতো যোগ্য অনুবাদ আমি অন্তত কমই দেখেছি। (ওকাম্পোর রবীন্দ্রনাথ : শঙ্খ ঘোষ)

ভিক্তোরিয়া ওকাম্পোর কথায় আমাদের এই ধারণা বদ্ধমূল হচ্ছে যে ১৯২১ সালে জিদের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের দেখা হয়নি। কিন্তু এখানেও কিছু প্রশ্ন ওঠে। ভিক্তোরিয়ার কথানুযায়ী রবীন্দ্রনাথই জিদের সঙ্গে আলাপ করতে গেছিলেন। কিন্তু চিঠিপত্রে একটি তথ্য আমরা পাচ্ছি যে যেখানে রবীন্দ্রনাথের আঁকা ছবি দেখে জিদ উৎসাহিত হয়ে নিজেই প্রস্তাব দেন যে রবীন্দ্রনাথ কিছু ছবি এঁকে দিলে গীতাঞ্জলির নতুন সংস্করণে সেগুলি যুক্ত করে দেবেন। আমরা জানি জিদের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের দেখা হয়েছিল ২৩ এপ্রিল, ১৯৩০-এ অর্থাৎ প্যারিসে রবীন্দ্রনাথের ছবির প্রদর্শনী শুরু হওয়ার আগে। রবীন্দ্রনাথ যদি জিদের বাড়ি গিয়ে থাকেন, তবে জিদ রবীন্দ্রনাথের ছবিগুলো কোথায় দেখলেন, এ প্রশ্ন স্বাভাবিক। আসলে জিদ-ই রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে দেখা করেন তাঁর হোটেলে এবং ভিক্তোরিয়া সেখানে ছিলেন প্রদর্শনীর ব্যবস্থাপনায়। রবীন্দ্রনাথ তখনই জিদকে তাঁর ছবিগুলো দেখান এবং জিদ তাঁর মুগ্ধতা প্রকাশ করেন। এইসময় জিদকে অনুরোধ করা হয় ছবিগুলোর ক্যাটালগের ভূমিকা লিখে দেওয়ার জন্য। জার্মানি চলে যেতে হবে জানিয়ে জিদ অবশ্য সে দায়িত্ব গ্রহণ করেননি। এই দায়িত্ব পালন করেছিলেন আনা দ্য নোয়াই।

রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে তাঁর মতবিনিময় হয়নি, একথাও তবে আংশিক সত্য। রথীন্দ্রনাথের লেখায় আমরা আগেই জেনেছি, জিদ আলাপচারিতায় খুবই অস্বাচ্ছন্দ্য বোধ করতেন। কথাবার্তায় তিনি ছিলেন খুবই আড়ষ্ট। দুজনের মধ্যে বিশেষ কোনও আলোচনার সূত্রপাত যে হয়নি তা স্পষ্ট হয় যখন দেখি দুজনের কেউ-ই এই সাক্ষাতের সম্পর্কে কিছুই লিখে যাননি।

এই দেখা হওয়ার দিন বা তার পরপরই জিদ তার উপন্যাস La Porte etroite এর ইংরেজি অনুবাদ Straight is the gate (১৯২৪) রবীন্দ্রনাথকে উপহার দেন। রবীন্দ্রনাথ এই উপন্যাসের প্রাপ্তিস্বীকার করে জিদকে লেখেন– It has produced a strong impression upon my mind– its transparent simplicity reveals a depth of a subtle truth which is the most difficult of all manners of dealing in this story– চিঠির শেষে তিনি আশা প্রকাশ করেছেন যে ইউরোপ ছাড়ার আগে আর একবার তাদের দেখা হবে। (মে, ১৯৩০)

জিদের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের আর দেখা হয়নি। যতদূর মনে হয় ভারতীয় সভ্যতা ও সংস্কৃতি সম্পর্কে জিদের খুব একটা আগ্রহ ছিল না। তাছাড়া এমনও হওয়া অস্বাভাবিক নয় যে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কেও তিনি আর তত আগ্রহী ছিলেন না। ১৯১৮-তে প্রকাশিত রবীন্দ্রনাথের Reminiscence পড়ে তিনি তাঁর ডায়রিতে লিখেছেন— ‘রবীন্দ্রনাথের Reminiscences পড়লাম। কিন্তু, এই Orient des Indes আমার মনোমত নয়।’ হয়তো এমন সব কারণেই রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে তাঁর স্থায়ী যোগাযোগ তৈরি হতে পারেনি। রবীন্দ্রনাথের শেষ ইউরোপ ভ্রমণের সময় শুধু তাঁদের দেখা হল মাত্র। কিন্তু এই ব্যক্তিগত যোগাযোগ বড় কথা নয়, জিদের অনুবাদ করা ফরাসি গীতাঞ্জলি রবীন্দ্রনাথকে রাতারাতি ফরাসিভাষী ইউরোপের মানুষের কাছে জনপ্রিয় করেছে, শুধু ইংরেজির মধ্যে দিয়ে তা সম্ভব ছিল না। এ কম কৃতিত্বের কথা নয়, আর এভাবেই রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে আঁদ্রে জিদের নাম যুক্ত হয়ে থাকল। জিদের অনুবাদ পাঠ করেই রবীন্দ্রনাথকে আন্তরিকভাবে গ্রহণ করেছেন ফরাসি ভাবুক রোম্যাঁ রল্যাঁ, কবি আনা দ্য নোয়াই, কবি পল ভালেরি এবং ভিক্তোরিয়া ওকাম্পো।

 

ছবিঋণ – ইন্টারনেট