অমিয় ঘোষ
লেখক সিউড়ি বিদ্যাসাগর কলেজের ইতিহাসের অধ্যাপক।
গত ২০ মার্চ বিশ্ব যখন করোনা ভাইরাসের ভয়ে আতঙ্কিত, তখন হাজার মৃত্যুসংবাদের মধ্যে একটি মৃত্যুসংবাদ স্মৃতিকে উস্কে দিল। ভারতীয় ফুটবল দলের স্ট্রাইকার ‘অর্জুন পুরস্কার’, ‘পদ্মশ্রী পুরস্কার’ ও ফিফার দ্বারা পুরস্কৃত আমাদের কলেজের (সিউড়ি বিদ্যাসাগর কলেজের) প্রাক্তন ছাত্র প্রদীপ কুমার ব্যানার্জির মৃত্যুতে কলেজের ছাত্রছাত্রী ও শিক্ষক-শিক্ষাকর্মীকুল মর্মাহত হল। ১৯৩৬ খ্রীস্টাব্দে জলপাইগুড়িতে জন্ম হলেও প্রদীপ কুমার ব্যানার্জির বিদ্যালয়ে পড়াশুনা জলপাইগুড়ি ও জামশেদপুরে। জামশেদপুরে পড়ার সময় সন্তোষ ট্রফি খেলার সুযোগ পান স্বল্প (১৫ বছর) বয়সে। স্কুল শিক্ষা শেষ করে পড়তে আসেন সিউড়ি বিদ্যাসাগর কলেজে। এই কলেজটি বেছে নেওয়ার পক্ষে দুটি কারণ ছিল। প্রথমত, সিউড়ী থেকে অনতিদূরে বিহার সীমান্তে ছিল তাঁর পিতৃভূমি, বাবা আগে থেকেই বিদ্যাসাগর কলেজে সম্পর্কে জানতেন। কলেজে পড়াশুনার সঙ্গে সঙ্গে খেলাধুলার চর্চা হত। ভালো খেলোয়াড় পেলে তাকে ভর্তির জন্য কলেজে গুরুত্ব দিত। স্বভাবতই প্রদীপবাবু কলেজের সঙ্গে মাঠ ও হোস্টেল থাকায় খেলার সুযোগকে কাজে লাগান। তাঁর খেলায় মুগ্ধ হয়ে তৎকালীন অধ্যক্ষ অরুণ সেন তাকে বার্ষিক এক টাকা ফি-র বিনিময়ে তাঁকে পড়াশুনো ও খেলার সুযোগ করে দেন।
১৯৫২-৫৪ খিস্টাব্দে প্রদীপবাবুর কলেজ জীবনে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটে যা তাঁর জীবনের গতিপথ নির্ধারণ করে দেয়। বিদ্যাসাগর কলেজে প্রতি বছর বড় করে ফুটবল ম্যাচের আয়োজন করা হত। নানা জায়গা থেকে মানুষ আসত খেলাগুলি দেখতে। খেলা নিয়ে বছরের একটা সময় কলেজের মাঠে উৎসব হত, যা প্রদীপবাবুর মত খেলাপাগল মানুষকে বিশেষভাবে উৎসাহিত করে। ১৯৫৪ খ্রিস্টাব্দে সিউরি বিদ্যাসাগর একাদশ ও মোহনবাগান একাদশের মধ্যে প্রীতি ম্যাচের আয়োজন করা হয়। প্রথমে কিশোর বলে নামানো না হলেও পরে নেমে তিনি তিন গোল দেন। মোহনবাগান দুই গোলে পরাজিত হয়। তাঁর খেলায় মুগ্ধ হয়ে মোহনবাগানের কয়েকজন কর্মকর্তা তাঁকে উপদেশ দেন, কলকাতায় চলে এসো, খেলাকে যদি আরও উন্নত করতে চাও। এই ঘটনা প্ৰদীপবাবুর জীবনে পরিবর্তন আনে, ১৯৫৪ খ্রিস্টাব্দে শেষবার কলেজ ত্যাগ করে কলকাতায় উপস্থিত হন এবং এরিয়ান ক্লাবে যোগ দেন। পরের বছর শান্তিনিকেতন নিবাসী পূর্ব রেলের পদস্থ কর্মকর্তা কল্যাণ কুমার দাস প্রদীপবাবুকে নিয়ে আসেন ইস্টার্ন রেলওয়ে দলে (১৯৫৫-১৯৬৭)। কল্যাণবাবু অবশ্য বিদ্যাসাগর কলেজের ছাত্র হিসেবে তাঁর খেলার কথা আগে থেকেই জানতেন। পরবর্তীকালে টেলিভিশনে নানা সাক্ষাৎকারে প্রদীপবাবু খেলোয়াড় জীবনে তাঁর কলেজের অবদান বহুবার স্বীকার করেছেন।
কলকাতায় খেলার হাত ধরে ১৯৫৮ খ্রিস্টাব্দে টোকিও এশিয়ান গেমস, ১৯৬০ এর রোমে গ্রীষ্মকালীন অলিম্পিক গেমস, ১৯৬৬র ব্যাংকক এশিয়ান গেমসে প্রদীপ ব্যানার্জির যোগদান বারবার চর্চিত হয়ে এসেছে কলেজের খেলাধুলার ইতিবৃত্তে। ১৯৯২ খ্রিস্টাব্দে কলেজের ৫০ বছর পূর্তি উপলক্ষ্যে ডাক পড়লো প্রাক্তন এই ছাত্রের। দিনটা ছিল ৭ মার্চ ১৯৯২। প্রদীপবাবু কলেজে আসার জন্য সব রকমের কাজ ছেড়ে কলেজের উদ্দেশ্যে রওনা দিলেন। সেদিন তাকে আনতে যে গাড়ি পাঠানো হয়েছিল সেটি দেরিতে পৌঁছেছিল বোলপুর স্টেশনে। তখন মোবাইলের যুগ ছিল না। প্রদীপবাবু গাড়ির অপেক্ষা না করে বাসে করেই সিউড়ি পৌঁছন। অধ্যাপক কিশোর মুখোপাধ্যায় স্মৃতিচারণা করতে গিয়ে জানালেন, “আমি তখন কলেজ গেটে দাঁড়িয়ে, হতচকিত হয়ে দেখলাম ভারত বিখ্যাত ফুটবলার হাতে ব্যাগ দোলাতে দোলাতে কলেজে আসছেন। আমতা আমতা করে বললাম, লোক পাঠিয়েছিলাম আনতে। প্রদীপ বাবু বলেন, “কাউকে না দেখতে পেয়ে চলে এলাম”। কলেজের স্থান তাঁর মনে কতখানি ছিল এই ঘটনা তার প্রমাণ। সেইদিন কলেজে একাদশের সঙ্গে বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয় একাদশের প্রীতি ম্যাচে কলেজের দল জয়লাভ করলে তাঁর উল্লাস ছিল দেখার মত।
বিশ্ববন্দিত এই ফুটবলার কলেজে শেষবার এসেছিলেন ২০০৫ খ্রিস্টাব্দে প্রাক্তন অধ্যক্ষ অরুণ সেন স্মৃতি পুরস্কার বিতরণ সভায়। আয়োজক হিসেবে প্রস্তাব নিয়ে ফোন করতেই তিনি বলেন, “আমন্ত্রণ নয়, আমি যাব আমার কলেজে।” সেবার কলেজে এসে খেলায় আগ্রহী ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে এক ঘণ্টার ক্লাসের আয়োজন করতে বলেন। হলভর্তি আগামীদিনের খেলোয়াড়দের সঙ্গে প্রায় দুঘন্টার ক্লাস নেন। স্মৃতিচারণায় বারবার অরুণ সেনের কথা বলেন। অনুষ্ঠানের শেষ পর্যন্ত প্রায় ৭ ঘণ্টা কলেজে কাটিয়ে যান। উপদেশ দেন খেলা বিষয়ে পড়ার ব্যবস্থা চালু করতে। কয়েকবছর পর অবশ্য তাঁর উপদেশ মত এই বিষয়ে পড়ার ব্যবস্থা চালু করা হয় কলেজে।
কলেজের মুকুটে যেমন রয়েছে প্রণব মুখার্জির মত ভারতরত্ন ও রাষ্ট্রপতির পদাধিকারী ছাত্র তেমনই রয়েছে আন্তর্জাতিক মানের ফুটবলার পদ্মশ্রী প্রদীপ কুমার ব্যানার্জির মত ছাত্র। মৃত্যু দৈহিক পরিণতি, কিন্তু কর্মের জন্য চিরকাল বেঁচে থাকবেন আমার কলেজের প্রাক্তনী প্রদীপ কুমার ব্যানার্জি।