Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

টেকনিক্যাল জ্ঞান, ম্যান ম্যানেজমেন্ট, স্নেহপরায়ণতা— কোচ পিকে ব্যানার্জির সাফল্যের তিন চাবিকাঠি

সুরজিৎ সেনগুপ্ত

 

 

 

 

 

 

 

 

পিকে ব্যানার্জির সঙ্গে আমার প্রথম দেখা ১৯৭৪ সালের জানুয়ারি মাসে। বোম্বেতে ইস্টবেঙ্গল ক্লাব রোভার্স খেলতে গেছিল। আমি ইস্টবেঙ্গলে সই করে কলকাতা থেকে বোম্বে গিয়ে পৌঁছই। তখন ইস্টবেঙ্গলের কোচ পিকে ব্যানার্জি। সেখানেই আমাদের প্রথম দেখা হয়। প্রথম যেদিন প্র্যাকটিসে নামলাম সেদিন থেকেই উনি যে আমার প্রতি মনোযোগ দিচ্ছেন সেটা টের পেয়েছিলাম। এবং তারপর থেকে বহুদিন ক্লাব ফুটবলে ওনার কোচিংয়ে খেলেছি। ইন্ডিয়ান টিমের হয়ে, দেশের হয়ে যখন খেলতে গেছি তখনও প্রদীপদার কোচিংয়ে নারিশড হয়েছি। সবমিলিয়ে দীর্ঘদিন প্রদীপদার পরামর্শের আওতায় ছিলাম। এবং টেকনিক্যালি অনেক ইকুইপড হতে পেরেছিলাম প্রদীপদার সান্নিধ্যে। প্রদীপদা যে মাপের ফুটবল খেলতেন তাতে টেকনিক্যালি প্রদীপ ব্যানার্জি যে অনেকটাই এগিয়ে থাকবেন অন্যান্যদের চেয়ে, সে ব্যাপারে কোনও সন্দেহ থাকে না। কিন্তু শুধু তো ফুটবলারই নয়, উনি কোচ হিসাবেও যে কতটা এগিয়ে সেটা আমরা প্রতি পদে পদে বুঝতে পারতাম। কিন্তু টেকনিক্যালি এগিয়ে থাকলেই সফল কোচ হওয়া যায় না। সফল কোচ হতে গেলে আরও কিছু কিছু গুণ থাকা দরকার যেগুলো প্রদীপ ব্যানার্জির মধ্যে ছিল। যার মধ্যে এক নম্বর ছিল ম্যান ম্যানেজমেন্ট। প্লেয়ারদের কাকে কীভাবে কখন কতটা কাজে লাগাতে হবে সেটা প্রদীপদার মতো আর কেউই জানতেন না, আর কোনও কোচই জানতেন না। আর একটা সবচেয়ে বড় ব্যাপার আর একটা গুণ প্রদীপদার ছিল যেটা আর কারও মধ্যেই ছিল না। সেটা হচ্ছে প্রদীপদা প্লেয়ারদের অত্যন্ত স্নেহ করতেন। প্রদীপদা মানুষটাই স্নেহপরায়ণ ছিলেন। নিজের প্লেয়ারদের সঙ্গে একদমই বড় ভাইয়ের মতন ব্যবহার করতেন। সব মিলিয়ে প্রদীপদার সাফল্যের পেছনে এই তিনটে কারণ। তিনি টেকনিক্যালি অত্যন্ত দক্ষ ছিলেন। ম্যান ম্যানেজমেন্টে দক্ষ ছিলেন। এবং প্লেয়ারদের প্রতি অত্যন্ত স্নেহপরায়ণতা করতেন। এই তিনটে গুণই প্রদীপদাকে অন্যান্য কোচেদের থেকে এগিয়ে রেখেছিল এবং সাফল্যও এনে দিয়েছিল অনেক বেশি।

কোচ পিকে ব্যানার্জির কথা বলতে গেলে অমল দত্তের সঙ্গে একটা তুলনা এসেই যায়। আমি পিকে ব্যানার্জি এবং অমল দত্ত দুজনকেই কোচ হিসাবে পেয়েছি। এটুকু বলতে পারি প্রদীপদা অমলদার থেকে ম্যান ম্যানেজমেন্টে তো এগিয়ে ছিলেনই, টেকনিক্যালিও অমলদার থেকে অনেক এগিয়ে ছিলেন। অমলদার থেকেও আমরা অনেক কিছু পেয়েছি। অমলদার থিওরিটিক্যাল নলেজ যা ছিল, তাঁর থেকেও অনেক কিছু পরামর্শ আমরা পেয়েছি। কিন্তু যেটা অমলদা বলতেন সেই একই জিনিস যখন প্রদীপদার কাছ থেকে শুনেছি তখন সেটা অনেক গভীর পর্যন্ত যেত। তাই বলছি শুধু ম্যান ম্যানেজমেন্টই নয়, টেকনিক্যালিও প্রদীপদা অমলদার থেকে অনেকটাই এগিয়ে ছিলেন।

আর প্রদীপদার স্নেহপরায়ণতা নিয়েও আলাদা করে একটু বলা দরকার। যেমন ধরুন, আমরা তো প্রসূনকে সহখেলোয়াড় হিসেবে পেয়েছি। প্রদীপদা নিজের ভাইকে স্নেহ করবেন, ভালোবাসবেন এতে তো অস্বাভাবিকত্ব কিছু নেই। কিন্তু কখনওই মনে হয়নি প্রদীপদার প্রসূনের প্রতি কোনও পক্ষপাতিত্ব আছে। প্রদীপদার কাছে প্রসূন যেমন, আমরা সবাই সেরকমই ছোট ভাইয়ের মতই ছিলাম।

আরও একটা জিনিস বলি এই প্রসঙ্গে। প্রসূন ওনার নিজের ভাই ছিল বলে যেমন বিশেষ কোনও ব্যাপার ওনার মধ্যে দেখিনি, তেমনই ওনার সাফল্য ইস্টবেঙ্গলের হয়ে অনেক বেশি মোহনবাগানের তুলনায়, সেখানেও আমার মনে হয় না যে কোনও বিশেষ ব্যাপার ছিল বলে। একটা জিনিস মানতে হবে, যত বড় কোচই হোন না কেন তার জীবনে ব্যর্থতা কিছু থাকেই। বিশ্বের সমস্ত বড় কোচেদেরই কিছু না কিছু ব্যর্থতা আছে। ব্যর্থতার তুলনায় সাফল্য অনেক বেশি থাকে বলেই তাঁরা সফল কোচ উপাধি পান। প্রদীপদার জীবনেও ব্যর্থতা ছিল। ঘটনাচক্রে সেই ব্যর্থতার সময়গুলো মোহনবাগানে থাকাকালীন বেশি হয়েছে। দুটো ক্লাবের পরিবেশগত তারতম্য বলতে সাপোর্টারদের কিছু তারতম্য ছিল এটা বলা যায় কিন্তু সেটা খুব বড় কারণ বলে আমার মনে হয় না।

পিকে ব্যানার্জির সঙ্গে ব্যক্তিগত মনে রাখার মুহূর্ত অনেক। একটা ঘটনা মনে পড়ছে, ১৯৭৮ সাল হবে। জানুয়ারি মাস-টাস হবে। কলকাতাতে সন্তোষ ট্রফি হচ্ছে। প্রদীপদা ছিলেন রেলওয়ের কোচ। আর আমাদের কোচ ছিলেন অরুণ ঘোষ। তা আমরা যখন ফাইনাল খেলতে যাব, তার আগে পর্যন্ত আমাদের খেলা নিয়ে যথেষ্ট সমালোচনা হয়েছিল কাগজে। আমরা খেলছিলামও খুব মামুলি। বেঙ্গল টিম যতটা স্ট্রং ছিল, বেঙ্গল টিমের প্লেয়াররা ফাইনালের আগে পর্যন্ত নিজেদের নামের প্রতি সেই সুবিচার করতে পারছিল না। তারপরে প্রদীপদা আমাকে টেলিফোন করতে বলেছিলেন আমাকে কিছু পরামর্শ দেবেন বলে। আমাকে পরামর্শ দিয়েওছিলেন। সে পরামর্শ কাজেও লেগেছিল। কিন্তু আমাকে যেটা মুগ্ধ করেছিল সেটা হল উনি তো আমাদের কোচ নন, তৎসত্ত্বেও উনি চাইছিলেন যে বেঙ্গল টিম জিতুক। আর বেঙ্গল টিম জিততে গেলে প্লেয়ারদের কী করতে হবে সেটা প্রদীপদার চেয়ে ভালো আর কেই বা বলতে পারবেন! সেই একটা ঘটনা আমার মনে আছে, আমাকে প্রায় দশ মিনিট ধরে উনি ফোনে কথা বলেছিলেন। আর একটাই অ্যাডভাইস দিয়েছিলেন “তুমি দৌড়াও! তোমার দৌড়কে পাঞ্জাব ভয় পাবে।”

পিকে ব্যানার্জির কাছে আমাদের প্রাপ্তির শেষ নেই।

 


সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে অনুলিখিত