রোমেল রহমান
কুকুর ভুবনে বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চাকারী বা বুদ্ধিজীবী কুকুরদের আলাপ…!
–দেখুন, পরিস্থিতি যা দাঁড়িয়েছে তাতে মুখ বুজে থাকাটা কি সমীচীন?
–মুখ বুজে আছি কে বলল? খাচ্ছি-দাচ্ছি, হই-হল্লা করছি, সভা-সমিতিতে যাচ্ছি, বক্তৃতাবাজি করছি! মুখ তো থেমে নেই! আপনার হঠাৎ কেন মনে হল আমরা চুপ মেরে আছি?
–কী বললেন? দেশে যা চলছে তা নিয়ে আমরা একটাও কথা বলছি না! অথচ আপনি বলছেন আমাদের মুখ চলছে?
–হ্যাঁ বলছি! কারণ রাজার ভালো ভালো কাজগুলো মানে উন্নয়নের স্তুতি করছি আমরা!
–সেটা তো লেহন ছাড়া আর কিছু না!
–লেহন ব্যতীত কী করব আমরা? যে খাতায় নাম লিখিয়েছি সেটা তো লেহনের! আর লেহনজনিত কারণেই বিবিধ সুযোগসুবিধা পাচ্ছি!
–হ্যাঁ! এটা অবশ্য ঠিক বলেছেন। ওরা মানে আমাদের ইয়াং বুদ্ধিজীবীরা বিশেষ করে এই টাইপ প্রশ্নকারী যারা এরা আসলে মূল লাইনটা বুঝবে না! কোথা থেকে, কেন যে এরা আসে আর কীভাবে যে বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চা করে ভাবা যায় না, এদের সঙ্গে এক টেবিলে বসতে হচ্ছে!
–দেখুন স্যর! আপনি বয়সে আমার থেকে অনেক সিনিয়র! আমার কাছাকাছি বয়সি কুকুর হলে বা বন্ধু কুকুরজীবী হলে বলতাম আপনি একটা জ্যান্ত বাইঞ্চোদ! কিন্তু যেহেতু আপনি আমার অগ্রজ সেহেতু সভ্য ভাষায় আমি বলতে চাই, অতিমাত্রায় পদলেহী আচরণ স্বাস্থ্যের জন্য হানিকর!
–[ক্ষেপে গিয়ে] তুমি কিন্তু মাত্রা ছাড়িয়ে যাচ্ছ!
–স্যর ব্যাপারটা হচ্ছে যে আমাদের সবাই চাটুকার। মূলত আমাদের এই বুদ্ধিবৃত্তিক কুকুর সঙ্ঘটা টিকেই আছে রাজার খুদকুড়ো বা ছুঁড়ে দেওয়া হাড়গোড়ে! আমরা মানে ইয়াং চাটুকারেরা শুধু বলতে চেয়েছিলাম যে, একটু গঠনমূলক সমালোচনা করা প্রয়োজন রাজতন্ত্রের, নৈলে আম কুকুরগণ আমাদেরকে যাচ্ছেনাতাইভাবে হেয় তাচ্ছিল্য করছে! ওরা ছড়া বেঁধে বলছে—
‘যাদের পেটে রাজার চাল, সবাই তারা বালস্য বাল!’
–কিহ?
–হ্যাঁ হ্যাঁ! ঠিক! আমি সাক্ষী স্যর! সেদিন বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস নেবার সময় শুনলাম পেছন থেকে কে যেন বলে উঠল, ‘রাজার বাল হাজির!’ তাছাড়া ভার্সিটির বাথরুমে লেখা, ‘ তোষামুদে চুতিয়া, তোর মুখে দিবো মুতিয়া!’ করিডোরে লেখা, ‘লেজ নেড়ে যায় রাজার সিপাই, সব ফিটফাট বিচি দুটো নাই!’
–বলো কি! পেয়াদাদের দেখাওনি? কমপ্লেইন করোনি?
–অভিযোগ অনুযোগ করে লাভ নেই স্যর! ক্যাম্পাসে তো যেতেই হবে! তাছাড়া আমি যদি রেগে যাই তাহলে রাজার পতাকা ওড়াবে কে?
–তা ঠিক… তা ঠিক! তা বলে ছেলেপুলে ‘রাজার বাল’ বলে গাল দেবে আর হাসিমুখে সেটা শুনতে হবে?
–উপায় নেই স্যর! ভিসি হবার লাইনে দাঁড়ালে টয়লেট পেপার খোঁজাখুঁজি করলে চলে না!
–হে হে! রসিক আছেন আপনি!
–তো কী বিষয় নিয়ে যেন কথা হচ্ছিল?
–আপনি ছিলেন কোথায় এতক্ষণ?
–ঐ ইয়ে মানে! মহারাজা একটা ভাষণ দেবেন বইমেলায় সেটা লিখে দিচ্ছিলাম!
–অ! আপনি ভাগ্যবান! আপনার জবানই রাজার জবান!
–হে হে! তা ঠিক… তা ঠিক!
–তো যেটা আলোচনা হচ্ছিল সেটা হচ্ছে যে আমাদের তরুণ বন্ধুটি একটু বিদ্রোহ করতে উশখুশ করছে! মানে চলমান অস্থিরতা বিষয়ক একটা প্রতিবাদ বা স্মারকলিপি বা বালছাল আর কি দিতে ইচ্ছে তার!
–বুঝেছি! কেচকি কলে পড়োনি বোধহয় এখনও তাই না? তোমার সমস্যা কি?
–জি সমস্যা তো আমার না! বলছিলাম যে, দেশের প্রতিটা ক্ষেত্রে যেই চরম অনিয়ম, দুর্নীতি, অপশাসন, লুটপাট আর খাকি পোশাকের ঝৈ ঝৈ, এর বিরুদ্ধে অন্তত আমাদের কিঞ্চিৎ উষ্মা জানান দেয়া জরুরি! নৈলে সমাজে আমরা সুবিধাবাদী হিসেবে চিহ্নিত হয়ে যাচ্ছি!
–অ! চিহ্নিত হয়ে যাচ্ছি?
–জি! চিহ্নিত হয়ে যাচ্ছি!
[বুড়োগুলো সব হেসে ওঠে]
–ইয়াং ম্যান, তোমার রক্ত গরম তাই লাফাচ্ছ! তুমি কি জানো না আমরা যেই চেয়ারে বসে আছি এবং আমাদের এখন অব্দি যা কর্মকাণ্ড সেটা স্পষ্টতই সুবিধাবাদীদের কর্মকাণ্ড! একফোঁটা ফাঁকি নেই। যা প্রমাণ করে আমরা ভালো কুকুর, নিপীড়িত নিম্নবর্গের কুকুরদের ভাষ্যকার! ‘আমরা রাজার উচ্ছিষ্ট খাই এবং রাজার গুণগান গাই!’ এখানে নতুন করে চিহ্নিত হবার কোনও লাইন নেই! আর দ্বিতীয় কথা হচ্ছে বিদ্রোহ করার কোনও সুযোগ তোমার নেই! সেটা তোমার মধ্যে থাকলে তুমি এখানে এই ভাঁড়ের আখড়ায় জুটতে না!
–ও কিন্তু একেবারে মিথ্যা বলেনি, মিনিমাম একটা যায়গা থাকা উচিৎ সমালোচনার! রাজাকুকুর দেশে যেই পদ্ধতি জারি রেখেছেন সেখানে তো কারও একটা শব্দ উচ্চারণের সুযোগ নেই রাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে! এমনকি শাস্ত্র নিয়েও বাহাসের সুযোগ নেই! কথা বল্লেই কেস খেয়ে হাজতে ঝিমোতে হয়!
–ঐ এসেছে আরেকজন! কুকুর না হয়ে গাধা হলে মানাত!
–আস্তে! এই যে শোনো, তুমি কি এখনও দুধ খাও?
–মানে?
–মানে হচ্ছে মানুষের ভেতর অনেকের মাতৃদুগ্ধ ছাড়ার পরেও দুধ খাবার অভ্যাস থেকে যায় বলে ফিডার সেবন করে থাকে বা চায়ের দোকানে গিয়ে তারা মিকচার নামক এক তরল পান করে থাকে! তুমি কি সেই দলের?
–বুঝলাম না স্যর!
–এই দ্যাখো! এত সস্তা বাক্য যে বোঝে না সে রাজতন্ত্রের কারবার বুঝবে কী করে আর কেনইবা প্রশ্ন তুলবে?
–স্যর ওকে খুলে বলুন, শিশু তো এখনও! দুধের ঘ্রাণ মুখে মেখে আছে!
–রাজতন্ত্র জিনিসটা কী?
–আপনি বলুন।
–রাজতন্ত্র জিনিসটাই হচ্ছে জবাবদিহিতাবিহীন একটা পদ্ধতি যেখানে রাজার হুকুমই শুরু এবং শেষ সিদ্ধান্ত!
–হুমম!
–আরও বাকি আছে! এবার বলো, রাজা জিনিসটা কী?
–বলুন আপনি!
–রাজা হচ্ছে, যার যা কিছু আছে তার সব কিছু জমা দিয়ে একজন যাচ্ছেনাতাইর অধীনে চলে যাওয়া! অর্থাৎ চেপে যাওয়া! এখানে রাজার বিরুদ্ধে যাবার কোনও সুযোগ নেই!
–বুঝলাম না!
–তাইলে বাড়ি যাও! রাজার নাড় হয়ে রাজার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করলে উধাও হয়ে যাবে নৈলে উন্মাদ হবে!
–তা বলে চুপ থাকব? তাকিয়ে তাকিয়ে দেখব?
–সে তোমার ব্যাপার! আমরা সুবিধা পাই, তাই আমাদের মুখে কোনও কথা নাই।
–কিন্তু আমি কথা বলতে চাই!
–বলো! তবে এখানে এসে হাউকাউ করার সুযোগ তোমার শেষ আজ থেকে! বিরুদ্ধমনোভাবজনিত ব্যাধির কারণে তোমার লাইসেন্স বাতিল!
–বিচি জমা দিয়ে দিলে ঘেউ করা সাজে না বৎস!
–কী হয়?
–ঘেউ করিলেই পরোয়ানা!
–হ্যাঁ!
–একটা গান গাওয়া যাবে?
–হ্যাঁ! রাজ কীর্তন কিংবা কুকুরীয় প্রেম ভালোবাসার গান গাওয়া যেতে পারে! রাজার বিরুদ্ধে বা রাজধর্মের বিরুদ্ধে গান গাওয়া গর্হিত অপরাধ!
–প্রশ্ন তো করাই যাবে না, কী বলেন?
–অবশ্যই না! প্রশ্ন করলেই সাঁড়াশি দিয়ে ঘেটি এবং মাজা চেপে ধরা হবে! রাজতন্ত্র প্রশ্ন পছন্দ করে না!
–যুক্তি?
–তুমি খুব বেশি পেঁচাও। তুমি এক্ষুনি বিদেয় হও। যুক্তি-তর্ক নামক কোনও শব্দ আমাদের অভিধানে নেই!
২৪ জানুয়ারি ২০২০