বৈদূর্য্য সরকার
দেখতে কিছু শহরপানা এই আমাদের গাঁ
গুটির বাড়ি সুতার বাসা সুতানুটির ছা
খাই দাই গান গাই বাগবাজারের ঘাটে
তাইরে নাইরে না… আমার সকল বেলা কাটে
টালা ব্রিজ বন্ধ হয়ে যাবার পর কাশীপুর যাওয়ার ব্রিজের মুখটায় আজকাল মারাত্মক ভিড়। খালের বিভাজিকা মানলে সাবেক কলকাতার সীমা হিসেবে এখান থেকে যাত্রা শুরু করতে হয়। কলকাতার শৈশবে আক্রমণ রুখতে কাটা মারাঠা ডিচ দৌড়েছিল যানবাজার হয়ে সেই বেকবাগান। সে স্মৃতি এখনও ধরা আছে খালের পাশের একটা গলিতে, যার নাম ‘মারাঠা ডিচ লেন’। ‘বলো মনোময়… জীবন থেকে এত দুন্দুভি উঠছে কেন… আর/ নেতিয়ে পড়েছে লিভার… জেলেপাড়া… পুরো মারহাট্টা ডিচ লেন’। জেলেপাড়া থেকে গলিপথে কিছু এগিয়ে বড় রাস্তা পেরিয়ে দুর্গাচরণ মুখার্জি স্ট্রিট। গলির প্রথমেই সগর্বে দাঁড়িয়ে আছে হ্যারি চ্যারিটেবল ট্রাস্টের হোর্ডিং দেওয়া সাহা পরিবারের অট্টালিকা। সে বাড়িতেই একতলায় ‘শ্রী শ্রী রাধাশ্যাম সুন্দর জীউর মন্দির’ ও দালান । ১৩৪৪-এর ফাল্গুন পূর্ণিমায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল এটি। ১৯৩৮ খ্রিস্টান্দ থেকে এখনও চকমেলানো শ্বেত ও কৃষ্ণপাথরের মন্দির অম্লান, রাধাশ্যামের মহিমা অপার। উল্টোদিকে হরি সাহা পরিবারের বাসভবন। হরি সাহা নামের বাঙালি যুবকটি হ্যারি নামের কোনও সাহেবের ব্যবসায় কাজ করত। মূলত চুন ও সুরকির ব্যবসা। তখন কলকাতায় বসতবাড়ি তৈরির জোয়ার। সেই ব্যবসা অধ্যাবসায় এবং সততায় বাড়তে সময় লাগেনি বিশেষ। কিংবদন্তির মতো ছিল হরি সাহার সততা। সাইকেল চেপে গিয়ে জল ঝড় বজ্রপাত সত্ত্বেও প্রতিদিনের হিসেব সাহেবকে মিটিয়ে আসতেন।
সম্ভবত ১৯২০ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ অসহযোগ আন্দোলনের সময় সাহেবের গণেশ ওল্টায়। সাহেব খানিকটা স্নেহবশত হরি সাহার হাতে সামান্য মূল্যে যাবতীয় ব্যবসা তুলে দিয়ে যায়। হরি সাহা কিন্তু সেই হ্যারি সাহেবের নামের অমর্যাদা করেননি। বরং সর্বত্র নিজের নামের ছলে তার নামই প্রচার করেছেন।
হরি সাহা সেই দামাল সময়ে, গ্রামবাংলা থেকে কলকাতায় পড়তে আসা ছাত্রদের জন্যে চালু করেছিলেন মেস (খান্না মোড়ে)। সেই মেসের সামনে চালু হয় কাঁচা বাজার। পরে তার সুযোগ্য পুত্র বঙ্কুবিহারি সাহার উদ্যোগে ১৯৪৭ থেকে সেখানে চালু হয় জামাকাপড়ের হাট। হ্যারি চ্যারিটেবল ট্রাস্টের উদ্যোগও নেওয়া হয়েছিল বঙ্কুবাবুর আমল থেকে। সামান্য মূল্যে মানুষ স্বাস্থ্য পরিষেবাও পায় এখান থেকে, আছে ডায়াগনোস্টিক সেন্টারও। সে আমলে কালুবাথানে এনাদের উদ্যোগে ফায়ার ব্রিক তৈরি হত, এখন যদিও তা বন্ধ।
৩০, দুর্গাচরণ মুখার্জি স্ট্রিট
হরি সাহার হাট আজও প্রবল প্রতাপের সঙ্গে বুধবার সকালে অফিসযাত্রীদের গতিরোধ করে। শনি আর মঙ্গলবার হাট বসে। রাত দশটা থেকে পরের দিন সকাল নটা পর্যন্ত। খান্নার মোড়ে গাড়িবারান্দাওলা বাড়ি থেকে হরি সাহার তত্ত্বাবধানে হাট শুরু হলেও এখন সে আড়েবহরে বেড়ে ছড়িয়েছে অনেকটাই। ফড়িয়াপুকুর যাওয়ার রাস্তায় (প্রায় অচল) ট্রামলাইনের ওপর থেকে ভেতরে দীনেন্দ্র স্ট্রিট এবং এগোলে সাহিত্য পরিষদের দিকে কিছুটা জুড়ে সারারাত ধরে চলে বেচাকেনা। খিদিরপুর বড়বাজারের পাশাপাশি ফুলিয়া শান্তিপুরের তাঁতঘর থেকে আসে বিক্রেতারা। কলকাতা সংলগ্ন পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন অঞ্চলের সঙ্গে বিহার ওড়িশা অসমের ক্রেতাও মেলে খোঁজ করলে।
হরি সাহার বিপুল ব্যবসায়িক সাফল্য পরবর্তীতে শতাধিক বাড়ি ও অন্যান্য সম্পত্তিতে বিনিয়োগ হয়েছিল। অঞ্চলের জনশ্রুতিতে শোনা যায়, সেইসব বাড়িতে এখনও সামান্য মূল্যে বহু লোকে থাকে। এটাও শোনা যায়, ছেচল্লিশের দাঙ্গায় বিতাড়িত মুসলমানদের অনেকেই এদের হাতে তাদের বসত তুলে দিয়েছিল। সেই ‘কালোয়ারপট্টির মাঠে/ ছাই ওড়ে ছেচল্লিশের’।
হরি সাহার মন্দির থেকে নাক বরাবর এগোলে সাবেক চিৎপুর রোড (রবীন্দ্র সরণি)। রাস্তা পেরিয়ে সারদামণির নামাঙ্কিত ঘাট। পাশেই সাবেক চক্ররেলের প্ল্যাটফর্ম। গঙ্গার ধার দিয়ে এগোলে প্রমদাসুন্দরীর ঘাট ও লঞ্চঘাট। তার পরে বাঁ হাতে একটা অপরিসর চলন পথ। যে সরু গলিটা সটান গিয়ে পড়েছে রবীন্দ্র সরণিতে।
বিষ্ণুরাম চক্রবর্তীর বাড়ি। সদর দরজার বর্তমান অবস্থা
এখানে খুব সঙ্কুচিতভাবে একটেরে পড়ে আছে উত্তরমুখী অন্নপূর্ণার দালান মন্দির এবং সেই সংলগ্ন পশ্চিমমুখী চারটি আটচালা রীতিতে গড়া শিবমন্দির। জানা যায়, মন্দিরগুলোর দ্বিতীয়টির প্রবেশপথে সংস্কৃত ভাষায় লেখা একটি লিপি পাওয়া গেছিল। সেকালের প্রহেলিকায় লেখা শকাব্দটি উদ্ধার করে পূর্ণচন্দ্র দে উদ্ভটসাগর জানাচ্ছেন, প্রতিষ্ঠাকাল ১৬৯৮ শকাব্দ (১৭৭৬ খ্রিঃ)। দুশো বছরের এই মন্দিরগুলির প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন বিষ্ণুরাম চক্রবর্তী। যিনি ওয়ারেন হেস্টিংসের আমলে কলকাতার আমিন পদে ছিলেন।
তবে এখন জায়গাটা মালিকহীন ভাড়াবাড়ির মতো চেহারা নিয়েছে। কেউ খুঁজে পাবে না দুশো বছরের প্রাচীন ঐতিহ্য কিংবা বিস্মৃত ইতিহাসকে।
বিষ্ণুরাম চক্রবর্তী স্থাপিত মন্দিরের বর্তমান ভগ্নদশা
মনকেমন নিয়ে বন্ধ ট্রাম রাস্তা চিৎপুর রোড ধরে হাঁটতে শুরু করলে আশপাশের অলিগলি থেকে যেন মুখ বের করে উঁকি মারে প্রাচীনতা, বাতাসের ফিসফিসে ভেসে আসে কবেকার কতসব গল্প, হতশ্রী বাড়ির উঠোন থেকে বেরোয় কাহিনির ধরতাই। মনে পড়ে ‘কুকুরের ডাকে জেগে আছে/ রাত্রিঘোর রবীন্দ্র সরণি…/ যাদুঘর… এ বাবুহীন ঘরে/ আমি শুধু তোমার ঘরণী’।
কিছুটা এগিয়ে কুমোরটুলির রাস্তায় এক মেহের আলি শুনিয়ে দিয়ে গেল প্রাচীন কলকাতার একটা প্রবাদ— ‘গোবিন্দরামের ছড়ি/ উমিচাঁদের দাড়ি/ হুজুরিমলের কড়ি/ বনমালী সরকারের বাড়ি… কে না জানে’।
গোবিন্দরাম কোম্পানির আমলে ব্ল্যাক জমিনদার হিসেবে কুমোরটুলিতে বাস করতেন। সাহেব কর্তাদের এদেশ সম্বন্ধে ধারণা দেবার মহান কাজটি করে থাকতেন গোবিন্দরাম। ব্ল্যাক জমিনদার গোবিন্দরাম কলকাতার দণ্ডমুণ্ডের কর্তা হিসেবে তখন প্রতিষ্ঠিত ছিলেন। ‘গোবিন্দরামের ছড়ি’ কথাটা যে ডেপুটি কালেক্টর হিসেবে তার দাপট বোঝাতে ব্যবহৃত হয়েছিল, সে ব্যাপারে সংশয় নেই।
ইংরেজ চিত্রকরের ছবিতে চিৎপুর রোডের পশ্চিম পাড়ে ১৭৩০-এ গোবিন্দরামের তৈরি পঞ্চরত্ন মন্দিরের স্থাপত্য, তাকে ঘিরে তিনটে দোচালা ও দুটি নবরত্ন মন্দিরের হদিস মেলে (views of Calcutta and its environs)। ১৭৩৭-এ ১৬৫ ফুট উঁচু মন্দিরটির চূড়া এক সাইক্লোন ঝড়ে ভেঙে পড়েছিল। একে সাহেবরা ব্ল্যাক প্যাগোডা বলে চিহ্নিত করত। মনুমেন্টের থেকেও উঁচু এই মন্দিরটি যে কলকাতার কিংবদন্তিতে মিশে আছে তাতে সন্দেহ নেই।
গোবিন্দরামের ব্ল্যাক প্যাগোডা। আগেকার এবং বর্তমান চেহারা
এর সামনেই চিৎপুর রোডের উল্টোদিকে ওনার প্রতিষ্ঠিত (সম্ভবত ১৭৩০এ) সিদ্ধেশ্বরী কালীর মন্দির (৫১২ রবীন্দ্র সরণি)। জানা যায় গোবিন্দরামের বংশধর অভয়চরণ মিত্র যিনি দক্ষিণ ২৪ পরগনার কালেক্টরের দেওয়ান ছিলেন, তিনিই পাকা মন্দির ও দালান গড়ে দেন।
কিংবদন্তি অনুযায়ী, সুতানুটির গ্রামে বেত আর হোগলাপাতার ঘন জঙ্গলে দৈবাদেশে হিমালয় থেকে এসে উপস্থিত হলেন এক সন্ন্যাসী, নাম উদয়নারায়ণ। তার তপস্যায় প্রীত হয়ে দেবী তাকে এখানেই বিগ্রহ প্রতিষ্ঠার আদেশ দিয়েছিলেন (১৭০৩ খ্রিস্টাব্দ)। প্রতিষ্ঠিত দেবীর পুজোর ভার এক কাপালিকের হাতে দিয়ে ফিরে গেলেন সন্ন্যাসী। এই মন্দিরের কিংবদন্তিতে যেমন নরবলির গল্প আছে, তেমন আছে ইতিহাসের আলোআঁধারি। ত্রিশ টাকার মাইনের কোম্পানির কর্মচারি গোবিন্দরাম নাকি নানা উপায়ে বিপুল অর্থ উপার্জনের পর, প্রাথমিকভাবে দেবীর মন্দিরটি তৈরি করে দিয়েছিলেন। তবে তার জমিদারিসুলভ আচরণের গল্প এমনই ছড়িয়েছিল, কোম্পানির পক্ষ থেকে হলওয়েল এসে তার জমাখরচের হিসেব চেয়ে বসে। বিপুল কারচুপির অভিযোগে গোবিন্দরাম বরখাস্ত হলেও মুছে যাননি পুরনো কলকাতার ইতিহাস থেকে।
এই মন্দিরের দুয়ারে শ্রীরামকৃষ্ণদেব এসেছিলেন, কেশব চন্দ্র সেনের অসুখে চিনি ডাব দিয়ে বাগবাজারের সিদ্ধেশ্বরী কালীর কাছে মানত করেন। তার শিষ্য নাট্যসম্রাট গিরিশচন্দ্র ঘোষ নিয়মিত আসতেন। প্রতিটি রচনা করা নাটক দেবীর চরণে উৎসর্গ করতেন। তিনি দেবীকে বলতেন ‘উত্তর কলকাতার গিন্নি’।
চিৎপুরের এই মায়াময় পথে আরেকটু এগিয়ে গেলেই পড়বে মদনমোহন তলা। জড়িয়ে আছে মদনমোহনের বিখ্যাত মূর্তি বদলের গল্প।
রবীন্দ্র সরণি আর মদনমোহন তলা স্ট্রিটের সংযোগে দুর্গসদৃশ এই অট্টালিকা ১৭৩০-এ তৈরি করেছিলেন গোকুল চন্দ্র মিত্র। শোনা যায় নুনের ব্যবসা থেকে তার বিপুল অর্থাগম। ১৭৪৮-এর লটারিতে তিনি চাঁদনি চক বাজারের স্বত্ব লাভ করেছিলেন। এক বিঘেরও বেশি জায়গা নিয়ে তৈরি বাড়ির দোতলায় মন্দির, বারান্দার একপাশে বিরাট ভাঁড়ার। একতলায় সুরম্য ঠাকুরদালান, একদিকে বিরাট রান্নাঘর, একটু দূরে রাসমঞ্চ। অনুষ্ঠানের দিন বিগ্রহকে বসানো হয় এই রাসমঞ্চটিতে।
গোকুল চন্দ্র মিত্রের আদি বাড়ি বালিতে। সম্ভবত বর্গি হামলার সময় বাগবাজার অঞ্চলে এসে ইনি বসতি স্থাপন করেছিলেন। সেই বর্গি হামলাতেই ক্ষতিগ্রস্ত বিষ্ণুপুরের মল্লরাজ চৈতন্য সিংহ জমিদারি রক্ষা করতে বিপুল অঙ্কের টাকা ধার করেন গোকুল মিত্রের থেকে। সেটাও নাকি স্বপ্নাদেশে। বন্ধক রেখেছিলেন কুলদেবতা মদনমোহনের বিগ্রহ।
পরে সৌভাগ্যের প্রতীক বিগ্রহটি টাকা শোধ করে ফিরিয়ে নিতে চান চৈতন্য সিং। কিন্তু ততদিনে গোকুল মিত্রের বিশ্বাস জন্মে গেছে, এই বিগ্রহ আসার পরেই তার শ্রীবৃদ্ধি হয়েছে উত্তরোত্তর। তাছাড়া তার বালবিধবা কন্যা মদনমোহনের পুজো ও প্রেমে বিমোহিত। মদনমোহনের সঙ্গে তার হৃদয় বিনিময় হয়েছে। ফলে স্বামী মদনমোহন বিহনে তার প্রাণত্যাগও সম্ভব। তাই এখানকার বিগ্রহে রাধাকৃষ্ণের পাশে গোকুল কন্যাও আছেন।
ফলে সহজে বিগ্রহ ফেরত দেওয়া হল না। বদলে করা হল কারসাজি। মূল বিগ্রহের অনুরূপ বিগ্রহ দিয়ে বিদেয় করা হল রাজাকে। ফেরার সময় স্বপ্নাদেশে তিনি জানতে পারলেন ঘটনা। ফলে মতবিরোধ, বিশ্বাসভঙ্গের জন্যে মকদ্দমা শুরু হল। শেষপর্যন্ত নাকি ভগবানই একটা মাছি হয়ে বসে, রাজাকে চিনিয়ে দিয়েছিল আসল বিগ্রহ আর গোকুল মিত্রকে দিয়েছিলেন আশ্বাস— প্রতি অন্নকূটের দিন আসার।
সেই থেকে অন্নকূটের দিন মহা ধুমধাম। অন্নকূটে আয়োজন থাকে অগুন্তি পদের। ভাত, ছয় সাত রকমের ডাল, নানারকম তরকারি, চাটনি নিয়ে একত্রিশ পদ। একতলায় সেই প্রসাদী অন্ন পেতে বহু লোকের ভিড় জমে। শোনা যায়, প্রতিদিনের ছানা দুধ ও মিষ্টান্ন সরবরাহের জন্যে নবীন ময়রা আর দ্বারিক ঘোষকে বসানো হয়েছিল এ অঞ্চলে।
তবে এখন বাঙালির ব্যবসার মতোই এই মন্দিরের জৌলুসও কমতির দিকে। চাঁদনি আর দালানে চলছে কুমোরটুলির প্রতিমা গড়ার কাজ।
এবার একটানা কিছুটা পথ চলে, পতিতাপল্লি ও যাত্রাপাড়ার রং ঢং বাঁচিয়ে এসে পড়া গেল বিখ্যাত কোম্পানিবাগান (রবীন্দ্র কাননে)। সেখান থেকে বাঁ হাতে কিছুটা পথ পেরিয়ে এসে থামতে হল লালরঙের একটা বড় বাড়ির সামনে। এই হচ্ছে বিখ্যাত রামদুলাল দে-র অট্টালিকা। যদিও তার দুই ছেলে ছাতুবাবু ও লাটুবাবুর নামেই বেশি পরিচিত।
রামদুলাল হারানো দিনের বাঙালির ব্যবসাবুদ্ধির উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত ছিলেন, বলা যায়। হাটখোলার দত্তবাড়ির মদনমোহন দত্তের কর্মচারী রামদুলাল এক নিলামে ডুবন্ত জাহাজ কিনে তা থেকে লক্ষ টাকা উপার্জন করেন। তার সঙ্গে থাকা দত্তবাড়ির চোদ্দ হাজার টাকা কাজে লাগিয়েই এ কাণ্ডটি ঘটান তিনি। তাই পুরো টাকাটা মালিককে দিতে চাইলে খুশি হয়ে মদনমোহন দত্ত তাকে লাভের সব টাকাটাই ফিরিয়ে দেন। ভালোবাসার সেই বন্ধন থেকেই রামদুলাল যতদিন মদনমোহন জীবিত ছিলেন, নগ্ন পদে তার কাছ থেকে দশ টাকা মাস মাইনে নিতে আসতে দ্বিধা করতেন না। যদিও ততদিনে তার ব্যবসাবুদ্ধি প্রবাদে পরিণত হয়েছে। সস্তায় পুঁতি কিনে মাদ্রাজে বিক্রি করে প্রচুর উপার্জন করেছেন। গোলমরিচ বিক্রি করেও তাই। মার্কিন জাহাজ কলকাতায় তার সঙ্গে দীর্ঘদিন ব্যবসা করেছে। চা, চিনি, রেশম বস্ত্র, নীল, চটের জিনিস, আদা, লঙ্কা, মসলিন, পাথরের অলঙ্কার পাঠিয়েছেন জাহাজ বোঝাই করে।
বিডন স্ট্রিটে রামদুলাল দের বাড়ি
তার নিজেরও চারটি জাহাজ ছিল। তার ছিল আধুনিক নিয়মে হিসাবরক্ষার জ্ঞান ও পারদর্শিতা। ইংরেজদের টেক্কা দিয়ে ১৭৮৫ থেকে ১৮০০ আমেরিকানদের হয়ে রামদুলাল বেনিয়ার কাজ করলেও তার পর থেকে শুরু করেন নিজস্ব ক্লিয়ারিং ও ফরওয়ার্ডিং এজেন্সি।
রামদুলালের বসতবাড়ি চোদ্দ বিঘার ওপর। পঁচাশি বিঘার ওপর ছিল তার অতিথিশালা। সেখানে হাজার অতিথিকে চাল ডাল আলু ঘি কাঠ ও মাটির পাত্র দিয়ে সেবা করা হত। বন্যাদুর্গতদের জন্যে কিংবা প্রার্থনালয় অথবা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সাহায্যের ব্যাপারে তার নাম সবার আগে বসত। চারশো প্রতিবেশীকে নিয়মিত সাহায্য করে গেছেন তিনি। যদিও তার ব্যক্তিগত জীবনযাত্রার মান ছিল অতি সাধারণ। পরনে ধুতি বেনিয়ান, কাঁধে চাদর। সেই সাধারণ চেহারার বণিকের স্মরণে মার্কিন দেশের একটা জাহাজের নামকরণ হয়েছিল। ১৮২৫-এ তার মৃত্যুর পর সালেম-এর ইস্ট ইন্ডিয়া মেরিন সোসাইটির সদস্যরা শোকপ্রকাশ করেন। তার তৈলচিত্র এখনও মার্কিন মুলুকে স্মিথসেনিয়াম জাদুঘরে রক্ষিত আছে।
১৭৭০-এ রামদুলাল দে দুর্গাপুজো শুরু করেন। পরবর্তীকালে ছাতুবাবু লাটুবাবুর নামে যা প্রসিদ্ধ। এই দুই ভাই, আশুতোষ ও প্রমথনাথ রামদুলালের রেখে যাওয়া বিপুল সম্পত্তির বলে পুরনো কলকাতার আইকন হয়ে ওঠেন। শখ শৌখিনতা, কুস্তির আখড়া থেকে বুলবুলির লড়াই সবেতেই খরচ করেন অঢেল। পাখিকে দানাপানি দিয়ে বড় করে যুদ্ধকৌশল শেখানোর এ শখ যদিও এখন আর বড় একটা শোনা যায় না।
রামদুলাল দুই ছেলে ছাতুবাবু ও লাটুবাবুকে দিয়ে প্রতিজ্ঞা করিয়ে নিয়েছিলেন, তারা যেন ব্যবসা ছেড়ে জমিদারির সুখের দিকে না যায়। যদিও চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের পর রামদুলালের সে আশা আর বজায় থাকেনি।
ছাতু ও লাটুবাবুরা বাড়িটাকে ঢেলে সাজায়। যদিও বিরাট ঠাকুরদালান আর চোখ ঝলসানো ঝাড়বাতিটা ছাড়া সবই হারিয়ে গেছে কালের প্রবাহে।
ছাতুবাবু লাটুবাবুর বাড়ির পুজো
- তথ্য ও ছবি ঋণ: গুগল, পত্রপত্রিকা ও স্মরজিৎ ভট্টাচার্য।
- ব্যবহৃত কবিতার লাইন: উত্তর কোলকাতার কবিতা, প্রসূন বন্দ্যোপাধ্যায়।