অভিজিৎ সুকুল
লেখক পেশায় তথ্যপ্রযুক্তি কর্মী ও প্রবন্ধকার।
আপনাদের অনেকের মতই নিমাই ঘোষকে আমি প্রথমবার দেখেছিলাম পর্দায়। খবরের কাগজের সাংবাদিক গিয়েছেন জাতিস্মর মুকুলের সাক্ষাৎকার নিতে। তিনি প্রশ্ন করছেন আর পেছনে ব্যাকগ্রাউন্ডে আমরা দেখতে পাচ্ছি হালকা টিন্টেড কাঁচওয়ালা চশমা পরা সাংবাদিক-সঙ্গী ফোটোগ্রাফারটি তাঁর ক্যামেরা প্রস্তুত করছেন। তারপর ছবি তুলতে শুরু করলেন ভদ্রলোক। তার আগে চশমাটা খুলে নিয়েছেন। হাঁটু মুড়ে বসে মুকুলকে বললেন, “একটু হাসো তো খোকা।” তখন বালক বয়স। কে নিমাই ঘোষ কোনও ধারণাই ছিল না। তারপরে একে একে ফেলুদা, শঙ্কু পড়ছি, এক এক করে সত্যজিতের ছবি দেখছি আর আম বাঙালির মত প্রেমে পড়ে যাচ্ছি সেই ‘ওরিয়েন্ট লংম্যান’এর। খবরের কাগজ, ম্যাগাজিন যেখানেই সত্যজিতের ছবি, সেখানেই তলায় একটা নাম। নিমাই ঘোষ। তদ্দিনে জেনে গেছি উনি সত্যজিৎ রায়ের ‘বসওয়েল’। জেমস বসওয়েল যেমন বন্ধু স্যামুয়েল জনসনের জীবনকে কলমে তুলে ধরেছিলেন, তেমনই সত্যজিৎ রায়কে জানতে হলে নিমাই ঘোষের ক্যামেরা অপরিহার্য। ওঁর জীবনের বিভিন্ন অন্তরঙ্গ মুহূর্তগুলোর হদিশ পেতে গেলে আর একটা নামের আশ্রয় নিতেই হবে। নিমাই ঘোষ।
অথচ ফোটোগ্রাফার হতে চাননি নিমাই ঘোষ। হতে চেয়েছিলেন অভিনেতা। উৎপল দত্তের লিটল থিয়েটারে ডাক পেয়েছিলেন কলেজের নাটক থেকে। সেখানেই চুটিয়ে অভিনয় চলছিল। সেই সব নাটকের মধ্যে আছে ‘অঙ্গার’, ‘ফেরারি ফৌজ’, ‘ওথেলো’ এবং ‘নীচের মহল’। তারপর দলে মনোমালিন্য। রবি ঘোষ, যাঁর হাত ধরে থিয়েটারে আসা নিমাই ঘোষের, শ্যামল সেন, ভোলা দত্ত প্রমুখেরা বেরিয়ে এলেন। নতুন দল হল। নাম ‘চলাচল’। রিহার্সাল হত সন্ধেবেলায়। রবি ঘোষের বাড়িতে। রিহার্সালে যাওয়ার আগে বাড়িতে আড্ডা বসত। সঙ্গে তাস খেলা। সেই আড্ডায় বন্ধু গোপাল ঘোষ একদিন নিয়ে এলেন এক ক্যামেরা। ক্যানন কিউএল ১৭। গোপালবাবুর শাশুড়ির ট্যাক্সিতে ভুল করে ফেলে গেছিলেন কেউ। সেটি নিমাইবাবুর হস্তগত হল। এর আগে ক্যামেরা নিয়ে ধারণা ছিল না তাঁর। বন্ধু ক্যামেরাম্যান জয়প্রতাপ মিত্র, যিনি মৃণাল সেন, পরে সত্যজিৎ প্রমুখের সঙ্গে কাজ করেছেন, তাঁকে দেখিয়ে দিলেন খুঁটিনাটি। এমনকি কাটপিস ফিল্ম অর্থাৎ রোলের ক্যানের শেষ দিকের অংশ জোগাড় করে দেবেনও বললেন। এদিকে রবি ঘোষ, নিমাই ঘোষের ‘রবিদা’, নির্বাচিত হয়েছেন গুগাবাবায়। রামপুরহাটের কাছে শুটিং। তাই নাটকের রিহার্সাল বন্ধ। বাড়ি বসে থেকে কী লাভ? ব্যাগে ক্যামেরা ভরে নিমাই ঘোষ রওয়ানা দিলেন রামপুরহাট। রবিদার শুটিং দেখতে। প্রথমদিন রিহার্সাল চলছে। বাঘার ঢোলে গাছ থেকে টুপ্ টুপ্ জল পড়বে। গুপী-বাঘাকে বুঝিয়ে দিচ্ছেন পরিচালক। হাত-পা নেড়ে। অঙ্গভঙ্গি করে। সেই সঙ্গে সেটে দাপুটে পদচারণা। নাটকের লোক নিমাই ঘোষের মনে ধরে গেল পরিচালকের এই নাটকীয় ভঙ্গি। শাটার টিপতে লাগলেন। দুই গাছের মধ্যে দাঁড়িয়ে আছেন শালপ্রাংশু ব্যক্তিত্ব। প্রথম শট। কলকাতায় ফিরে গড়িয়াহাট রোডের স্টুডিও রেনেসাঁসে ভূপেন্দ্রনাথ সান্যালের (মেজদা নামে পরিচিত ছিলেন) কাছে। ছবি ডেভেলপ হল। দেখে মেজদা চুমু খেলেন। বললেন, তোলো। তোমার কম্পোজিশন সেন্স দারুণ। হবে, তোমার হবে। রামপুরহাটের শুটিং শেষে সত্যজিৎও ফিরেছেন কলকাতায়। পরের পর্বের শুটিং নিউ থিয়েটার্স। বংশী চন্দ্রগুপ্ত একদিন বললেন, ছবি যে তুললেন, মাণিকদাকে দেখাবেন না? লাঞ্চের পর আসতে বললেন স্টুডিওয় একদিন। নিমাই ঘোষ গেলেন। হাল্লা রাজার রাজসভার সেট পড়েছে। একটা বিরতিতে বংশীবাবু সত্যজিতের হাতে তুলে দিলেন ছবিগুলো। দেখেশুনে রায়সাহেব বললেন, আপনি তো মশাই আমার অ্যাঙ্গেল মেরে দিয়েছেন। বলে এক ধাক্কায় নিমাইবাবুকে ঢুকিয়ে দিলেন সেটের ভেতর। সেই যে ঢুকলেন সত্যজিৎ রায়ের অন্দরে, বেরোনো আর হল না নিমাই ঘোষের।
তবে শুধু সত্যজিৎই তো নন। সমসাময়িক ভারতবর্ষে খুব কম সেলিব্রিটিই ছিলেন, যাঁরা ওঁর ক্যামেরায় ধরা পড়েননি। উত্তমকুমার ওঁর ছবিকে বলতেন ‘ম্যাজিক’। শুধু নিজের নয়, নিমাই ঘোষের তোলা অন্য ছবিতেও আগ্রহ ছিল ম্যাটিনি আইডলের। ভারতীয় চিত্রশিল্পীদের নিয়ে করেছিলেন ‘ফেসেস অব ইন্ডিয়ান আর্ট’ সিরিজ। সাদা-কালোর বাইরে বেরোলেন। ছবিতে ব্যবহার করলেন রং। মিকেলেঞ্জেলো আন্তনিওনি তাঁকে ডেকে পাঠিয়েছিলেন রোমে— তাঁর ৯৪তম জন্মদিন উপলক্ষ্যে আয়োজিত ছবির প্রদর্শনীতে উপস্থিত থাকার জন্য। হ্যাঁ, বিশ্বখ্যাত এই পরিচালক ছবিও আঁকতেন। মৃণাল সেন তাঁর ‘ইন্টারভিউ’ ছবির জন্য স্টিল ফোটোগ্রাফার হিসেবে চেয়েছিলেন ওঁকে। সে সময়েই শুটিং চলছিল ‘প্রতিদ্বন্দ্বী’র। ওঁকে ইউনিটে পেতে আপস করেছিলেন মৃণালও। বাংলা থিয়েটারের ডকুমেন্টেশন করেছেন অনবদ্যভাবে। থিয়েটার করার সময় খেয়াল করতেন তাপস সেনের আলো-ছায়া সৃষ্টির কৌশল। নিজের ছবিতে পরে প্রয়োগ করেছিলেন সেই শিক্ষা। কচ্ছের রণ-এ কাজ করেছেন। বস্তারে কাজ করেছেন। উড়িষ্যার বোন্দা উপজাতিদেরও বানিয়েছেন তাঁর সাবজেক্ট। অরুণাচলে আপাতানি উপজাতিদের ছবি তুলেছেন। আদিবাসীদের নিয়ে ছবি তুলতে গিয়ে তো প্রাণটাই খুইয়েছিলেন প্রায়। ভুলবোঝাবুঝিতে জনতা ক্ষিপ্ত হয়ে আক্রমণ করেছিল। গাড়ির তলায় ঢুকে সে যাত্রা রক্ষা পান। আবার বোম্বেতে পাকাপাকিভাবে ডেকেছিলেন দেব আনন্দ। যাননি। শর্মিলা ঠাকুর ভক্ত ছিলেন নিমাইদার কাজের। ওঁকে উপহার দিয়েছিলেন একটি ক্যামেরা। ওঁর না দেখা ছবির সংখ্যাও অসংখ্য। হুইলচেয়ারে বসে অমৃতসরের স্বর্ণমন্দির নিয়ে কাজ করতে চেয়েছিলেন। কিছুটা করেওছিলেন। সম্পূর্ণ হয়নি সে কাজ। আরও কয়েকবার যেতে হত। শরীর সায় দেয়নি। নিজের শহর তাঁকে অনুমতি দেয়নি ভিকটোরিয়া মেমোরিয়াল নিয়ে কাজ করতে। এ নিয়ে আক্ষেপও ছিল।
‘মাণিকদা’কে কোনও রকম জ্বালাতন না করে নিজের কাজ করে যেতেন নিমাই ঘোষ। বিশিষ্ট সত্যজিৎ গবেষক দেবাশিস মুখোপাধ্যায় বললেন, এমনও হয়েছে, চলে যাওয়ার সময় নিমাইদা যখন ‘আসছি মাণিকদা’ বলছেন, তখন উনি খেয়াল করেছেন ওঁর উপস্থিতি— আরে, তুমি এলেই বা কখন? নিঃশব্দে নিজের কাজ করে যেতেন। এ কারণেই বোধহয় মাণিকবাবু প্রশ্রয়ও দিতেন তাঁকে। ‘ঘরে বাইরে’র সেটে ক্যামেরায় লুক-থ্রু করবার সময় কেউ একজন ক্যামেরার সামনে চলে এলে সত্যজিৎ বলেছিলেন, নিমাইয়ের ভুঁড়ি ছাড়া আর কোনও কিছু যেন সামনে না আসে। অর্থাৎ, একমাত্র নিমাই ঘোষেরই এক্তিয়ার ছিল এরকম গুরুত্বপূর্ণ সময়েও ওঁর অসুবিধা ঘটানোর। পুত্র সাত্যকি ঘোষ, যিনি নিজেও খ্যাতনামা ছবি-তুলিয়ে, বলেছেন বাবার প্যাশনের কথা। হয়ত সেদিন যা ছবি তুলেছেন ঘুমোতে যাওয়ার আগে ডেভেলপ হয়নি। মাঝ রাত্তিরে ঘুম ভাঙলে বিছানা ছেড়ে উঠে বসে যেতেন হাতে সেই ছবির প্রিন্ট নিয়ে। পরীক্ষা করে দেখতেন শট বা কম্পোজিশনে কোনও গোলমাল আছে কিনা। এই প্যাশনই তাঁকে নিমাই ঘোষ বানিয়েছিল। পরিবহন দফতরে চাকরি করেছেন। আরও ভালো করে ছবি তুলবেন বলে একসময় ছেড়েও দিয়েছেন সে চাকরি। বইসহ নিমাই ঘোষের একাধিক প্রজেক্টের ডিজাইন করেছেন অধ্যাপক এবং নামকরা গ্রাফিক ডিজাইনার পিনাকী দে। বললেন, নিমাইদা মিষ্টি খেতে দারুণ ভালোবাসতেন। চন্দননগর থেকে জলভরা সন্দেশ নিয়ে যেতাম প্রায়ই। আর উনি আমাকে মিষ্টি খাওয়াতে নিয়ে যেতেন বিবেকানন্দ রোডের নেপাল সুইটসে। তারপর ডায়াবিটিস ধরা পড়ল। এই সময়টায় খুব রোগা হয়ে গেলেন। অ্যান্ডারসন ক্লাবে সাঁতার কাটা শুরু করলেন নিমাইদা। বলতেন, থেরাপি শুরু করেছি। তুমি কিন্তু মিষ্টি আনা থামিও না।
নিমাই ঘোষের জীবনের শেষ পর্বে একটি কাজের সূত্রে ওঁর সঙ্গে যোগাযোগ হয়েছিল এই অধমের। প্রথমদিন থেকে ‘জেঠু’ সম্বোধন করতাম। আপত্তি করেননি। তবে বলতেন ‘আপনি’ করে। বলেছিলেন, চট করে ‘তুমি’ বলতে পারি না আমি। হয়ে যাবে আস্তে আস্তে। এই বয়সেও যে কোনও কাজ নিয়ে প্রচণ্ড উৎসাহী ছিলেন। নিয়মিত ফোন করে কতটা কী এগিয়েছে খোঁজ নিতেন। একদিন জিজ্ঞাসা করেছিলেন, কত ছবি তুলেছি বলুন তো। আমার আন্দাজ ধারেকাছেও পৌঁছয়নি। লক্ষাধিক সেই সব ছবির ডকুমেন্টেশনও হয়নি ঠিকভাবে। মাথায় টোকা দিয়ে বলেছিলেন, সব এখানে আছে। এটা যেদিন যাবে, সব মুছে যাবে। সরকারি তরফে এই বিপুল ভাণ্ডার সংরক্ষণের ব্যবস্থা হয়নি বলে মনে একটা ক্ষোভও ছিল। অভিমানে বলেছিলেন, গঙ্গায় সব ভাসিয়ে দেবেন। দীর্ঘ শরীরকে বেঁকিয়ে-চুরিয়ে ছবি তোলার অভ্যাস থাবা বসিয়েছিল শরীরে। ক্যামেরা সামলাতে গিয়ে আছাড়ও খেয়েছেন বেশ কয়েকবার। শেষ দিকে শয্যাশায়ী ছিলেন। করোনা ভাইরাস নিয়ে হৈচৈ শুরু হওয়ার ঠিক আগে মার্চের মাঝামাঝি শেষ গেছিলাম জেঠুর কাছে। ধমকেছিলেন আসা কমিয়ে দিয়েছি বলে। বলেছিলেন, এলে, কথা বললে ওঁর ভালো লাগে। বলেছিলাম, এইসব ঝামেলা কেটে যাক। আসব। তারপর একদিন হঠাৎ করে ২৫শে মার্চ এসে গেল। আর দেখা হল না। ভালো থাকবেন নিমাই ঘোষ। আমার নিমাই জেঠু। প্রণাম।