Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

ধর্মসঙ্কটে করোনা

অরিন্দম

 

 

লেখক সমাজকর্মী, রাজনৈতিক ভাষ্যকার।

সতেরো রাজ্যে এক হাজার পঁয়ত্রিশ জন নিজামুদ্দিন করোনা সংক্রামিত। বুঝে গেছেন নিশ্চয়ই। আপনি এই যে বুঝে গেলেন এটাই জরুরি ছিল। ‘এরা’ এইভাবেই দেশটার বারোটা বাজাচ্ছে। ‘এরা’ই আবার চিৎকার করছে সিএএ, এনআরসি, এনপিআর হতে দেব না! শাহিনবাগ তুলে দিয়ে ঠিক করেছে। কি এই লাইনগুলো পরপর মনে এল কি না! ঠিক এবার আর থালি বা দিয়া জ্বালাতে গিয়ে মনের মধ্যে যে দ্বিধাদ্বন্দ্বগুলো বা প্রশ্ন উঠে আসছে সেগুলো দূরে সরিয়ে রাখবেন। বাজারে গিয়ে প্রদীপ কিনে আনবেন। মনে রাখবেন এই লকডাউনের মধ্যে হিন্দুদের কোনও জমায়েতের থেকে করোনা ছড়ায়নি। লকডাউনের মধ্যে ২৫শে মার্চ যোগীর অযোধ্যা জমায়েত, বা কলকাতার ঠনঠনিয়া কালীবাড়িতে সন্ধ্যারতির ভিড়, রামনবমীর জমায়েত কোথাও থেকে ছড়িয়েছে? দেখান দিকি! বা আদতে লকডাউনের মধ্যে আদৌ হিন্দুরা যে কোনও জমায়েত করেছিল এটাই মনে রাখবেন না। কারণ মন বড় বিশ্বাসঘাতক। খালি প্রশ্ন তুলতে চায় ‘অসতো মা সদগময়ো। আস্তে আস্তে আপনি বিশ্বাস করতে শুরু করবেন ৩ ঘণ্টার মধ্যে ১৩০ কোটি মানুষের বিশাল দেশে এরকম কঠিন লকডাউনের সিদ্ধান্ত নিতে গেলে ৫৬ ইঞ্চি বুকের পাটাই দরকার।  এগুলোই হচ্ছে সেই কঠিন কঠোর সিদ্ধান্ত যা বিগত সত্তর বছরে কেউ নিতে পারেনি। আর ওই যে লোকগুলো মুম্বাই থেকে দিল্লির আনন্দবিহারে জমায়েত হয়েছিল সব অশিক্ষিত মজুরের দল। লকডাউন ভেঙে এবার করোনা ছড়াবে নিজামুদ্দিনের মতন। এবার আপনি লকডাউনের মধ্যে সকালের চা খেয়ে কাজে বেরোবেন কারণ আপনি একজন স্বাস্থ্যকর্মী। কর্মস্থলে গিয়ে দেখবেন দিল্লি থেকে কয়েকশো মজুর বউ বাচ্চা নিয়ে হাজির। কেউ হেঁটে, ভ্যানে করে এসেছে। কয়েকটা মরেওছে। নোংরা উকুনের দল বলে মনে মনে গালি দিয়ে সবকটাকে রাস্তায় বসিয়ে এরপর কীটনাশক ঢেলে শুদ্ধ করবেন।

কী ভাবছেন এই লেখাটা একটু বাড়াবাড়ি হয়ে গেল। কিন্তু মশাই যুক্তিগুলো তো এভাবেই তৈরি হয়। ভেবে দেখুন গরুর মাংসের জন্য জুনেইদকে পিটিয়ে মারবার পর লোকগুলো সন্ধ্যাবেলাতে বাড়ি নিজের বৌ মেয়েকে আদর করেনি? করেছে তো। বা জার্মানিতে দুপুরবেলা পঞ্চাশটা শিশু-কিশোরকে গ্যাসচেম্বারে ঢুকিয়ে মেরে, তারপর বডিগুলোকে ডাস্টবিনে ফেলে দিয়ে আমরা কি বৌকে নিয়ে নাইট শোতে ‘ফলস্টাফ ইন ভিয়েনা’ দেখতে যাইনি! গা গুলিয়ে উঠল। কিন্তু উপায় নেই! ফ্যাসিস্টদের যুক্তিসূত্রগুলো যখন আমরা গ্রহণ করতে শুরু করব তখন কিন্তু আর থামতে পারব না। নিজেরা ন্যায্যতা তৈরি করে নেব। এ এক ভয়ঙ্কর সময়। আসলে কোনও ঘটনাই বিছিন্ন নয়। করোনা সংক্রমণ কম হবে না বেশি হবে সেটা জানা নেই। কিন্তু এটা জানা আছে লকডাউন পরবর্তী দিনগুলি ভয়ঙ্কর হবে। সাধারণ মানুষের উপর তীব্র আক্রমণের ন্যায্যতা তৈরি করবে একেকটা ‘নিজামুদ্দিন’। হাতের তাস সাজানো হচ্ছে মাত্র। তাই আসুন একটু দেখে নেওয়া যাক আসলে নিজামুদ্দিনে কী ঘটেছিল।

দিল্লির নিজামুদ্দিনে দরগাতে মুসলিম ধর্মপ্রচারের সংগঠন ‘তবলিগ ই জামাত’-এর বিশ্বকেন্দ্র। এখানে দেশবিদেশ থেকে মুসলিম মিশনারিরা আসাযাওয়া করে থাকে। তবলিগ ই জামাত এখানে গত ১৩-১৫ মার্চ ধর্মীয় জমায়েত ডেকেছিল এবং এই জমায়েত হতে শুরু করে ৮ই মার্চ থেকে। দেশবিদেশ থেকে প্রায় ৪০০০ লোক জমায়েত হয়েছিল। ব্যাপারটি সেখানেই শেষ হয়ে গেলে ঠিক ছিল। কিন্তু না, ৩১শে মার্চ আমরা জানতে পারলাম যে এই লকডাউনের মধ্যেও ওই দরগাতে ৬ তলা ডর্‌মিটারিতে প্রায় ২০০০ লোক ছিল। তার ভিতর করোনা আক্রান্ত সন্দেহে ৪৪১ জনকে ৩১শে মার্চ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। আর এই জমায়েতে মালয়েশিয়া, জিবুতি, ইন্দোনেশিয়া সহ বিদেশ থেকে বহু প্রতিনিধি (বেশ কয়েকশো প্রায় ২৮০) আসে এবং অংশ নেয়। সন্দেহ এই বিদেশি প্রতিনিধিদের থেকেই করোনা ছড়িয়েছে ওই ‘তবলিগ ই মারকাজ’-এর বিশ্বকেন্দ্রে। এবং এই জমায়েতের পর কয়েকজন ধর্মপ্রচারক সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে যার ভিতর ৬ জন তেলেঙ্গানাতে এবং ১ জন কাশ্মিরে মারা যায়। এর ভিতরেই ‘মারকাজ’-এ আবার ২৩ তারিখ এক জমায়েত হয়। এই করোনা পরিস্থিতিতে যে কোনও জমায়েতে ১৩ তারিখ সরকারের যে নিষেধাজ্ঞা তাকে উপেক্ষা করেই। এই জমায়েতেও প্রায় ৩৫০০ জন আসে এবং ইতিমধ্যে ২৩ তারিখ প্রধানমন্ত্রী সারা দেশে লকডাউন ঘোষণা করায় তাদের মধ্যে প্রায় অনেকেই আর কোথাও যেতে পারেনি। তাদের ভাষায় ‘প্রধানমন্ত্রীর উপদেশমতন যেখানে ছিলেন সেখানেই থেকে যান’ (প্রসঙ্গত মনে রাখতে হবে বৈষ্ণো দেবীর মন্দিরে একইরকমভাবে ৫০০ জন আটকে পরেছেন, সুপ্রিম কোর্ট আদেশ দিয়েছেন তাদের সাহায্য করতে)।

এবার এই ঘটনা সামনে আসার সঙ্গে সঙ্গে এটিকে ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে ব্যাখ্যা করা শুরু হয়েছে। মুসলমানদের করোনা সন্ত্রাসবাদী বলা হচ্ছে। করোনা সংক্রমণ থেকেও ফ্যাসিস্টরা ফায়দা তুলতে চাইছে। আমাদের সতর্ক থাকতে হবে। কিন্তু করোনা তো কোনও ধর্ম দেখে আসে না। কিন্তু আবার এটুকু বলাই যথেষ্ট নয়। গোঁড়া ধর্মীয় লোকেদের বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গির প্রতি অবজ্ঞা থাকে। তারা মানতে চান না। এখানে যেমন মারকাজে করোনা সংক্রমণের আশঙ্কা সত্ত্বেও ২৩ তারিখ জমায়েত হয়েছিল। আবার অখিল ভারতীয় হিন্দু মহাসভা সমস্ত বড় শহরে গোমূত্র পানের জন্য জমায়েত ডেকেছিল সরকারি নিষেধ উড়িয়ে দিয়ে। পাঞ্জাবে এই সংক্রমণ বেড়েছে এক ধর্মীয় গুরুর মাধ্যমে ধর্মীয় জমায়েত থেকেই। সুতরাং এখানেও এই অবৈজ্ঞানিক বেপরোয়া দৃষ্টিভঙ্গি ছাড়া আর কিছু খোঁজা অনুচিত।

বরং উল্টোদিকে দেখব সরকার কী করল? ২৫ তারিখ স্বাস্থ্য দপ্তর থেকে লোক এসে করোনা সন্দেহ করে কয়েকজনকে আলাদা করেন এবং ওই দরগাতেই হলে কোয়ারেন্টাইন করেন। ইতিমধ্যে মারকাজের থেকে প্রশাসনের কাছে দরগা খালি করে দেওয়ার জন্য গাড়ির পাশের আবেদন করা হয়। যদিও পাশ দেওয়া হয়নি। অথচ ওই একই সময়ে ২৮শে মার্চ অমিত শাহ, গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রী বিজয় রুপানিদের উদ্যোগে ১৮০০ গুজরাতি তীর্থযাত্রীকে উত্তরাখণ্ড থেকে ফিরিয়ে আনা হয়। না প্রশ্ন করবেন না ১৩ তারিখের পর এরা তীর্থ করতে গিয়েছিল কেন? মারকাজ থেকে ২৭শে মার্চ ৬ জন এবং ২৮শে মার্চ ৩৩জনকে আইসোলেশনে পাঠানো হয়। ২৮শে মার্চ ডবলুএইচও-র প্রতিনিধিদল মারকাজ পরিদর্শন করে যান। সবচেয়ে বড় কথা এনএসএ প্রধান দাভোল পরিদর্শন করেন। ইতিমধ্যেই দিল্লি পুলিশ একটি ভিডিও প্রকাশ করেন যে ২৩ তারিখ ওনারা তবলিগের সংগঠকদের মারকাজ খালি করতে বলেন। সুতরাং পুরো বিষয়টি সরকারের কাছে পরিষ্কার ছিল। প্রশ্ন উঠবে লকডাউনের মধ্যে মারকাজ কী করে খালি করবে? কী করে ফিরবে যদি সরকার গাড়ির পাশ না দেয়। এবং করোনা সংক্রমণের আশঙ্কা নিয়ে এদের ফেরা কি উচিত ছিল? সংক্রমণ হচ্ছে জানা সত্ত্বেও সরকার টেস্ট করেনি। সুতরাং সরকার তার দায়িত্ব এড়িয়ে যেতে পারে না। বরং এই সংক্রমণের দায় দিল্লি আর কেন্দ্রীয় সরকারকেই নিতে হবে। আর সুস্থদের আলাদা কোয়ারেন্টাইন করে সরকার ৩১ তারিখের আগে খালিও করেনি। উল্টে সরকারের এই অবহেলাতেই মারকাজে সংক্রমণ ছড়িয়েছে। এখন প্রশ্ন, কেন করেনি? এরপরেও সংক্রমণের দায় শুধু তবলিগের ঘাড়ে চাপানো যায়?

সরকারের কাছে বিদেশিদের সম্পর্কে বিপুল তথ্য থাকে, তা সত্ত্বেও ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়ার মতন করোনা আক্রান্ত দেশের থেকে প্লেনে করে এসে কীভাবে তারা নিজামুদ্দিন মারকাজে ঢুকে গেল? এয়ারপোর্টেই কেন তাদের কোয়ারেন্টাইন করা হল না? তাহলে তো পরিষ্কার এয়ারপোর্টগুলিতে পরীক্ষাব্যবস্থার গাফিলতি ছিল। এবং স্বাস্থ্যমন্ত্রী দাবি করেছিলেন বিদেশ থেকে আসা সবাইকে নজরে রাখা হচ্ছে। ৫ই মার্চ কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্যমন্ত্রী রাজ্যসভাকে জানাচ্ছেন করোনা আক্রান্ত দেশের থেকে আসা সবাই সরকারের নজরে আছে (Press Information Bureau,Government of India, Ministry of Health and Family Welfare, 05-March-2020 12:07 IST, Suo-Moto statement by Dr. Harsh Vardhan, Minister for Health and F.W. ON 5th March, 2020 in Rajya Sabha in view of large number of reported cases across the world and reported cases in India of Novel Coronavirus (COVID-19) and the steps taken by the Government of India  …Regular surveillance has been initiated across the country for all cases having travel history from all major COVID-19 affected countries and for people having contact with such persons and having fever, cough or breathlessness. Through Integrated Disease Surveillance network all such persons are tracked and as on 4th March, a total of 28529 persons were brought under community surveillance and monitored. The state surveillance officers, district surveillance officers and rapid response teams of health professionals under the leadership of state Health Secretaries are monitoring all such people on a daily basis. Sufficient isolation beds have been made available in the tertiary facilities across the country to manage any outbreak.)। এটা ৫ই মার্চের অনেক পরের ঘটনা হওয়া সত্ত্বেও এক্ষেত্রে তা হল না কেন?  অথচ এই ঘটনা প্রকাশ্যে আসার সঙ্গে সঙ্গে স্বাস্থ্যদপ্তর জানিয়েছে এখন দোষারোপের সময় নয়। কিন্তু প্রশ্ন তো উঠবেই। সারা দেশে লকডাউন পরিস্থিতিতে পুলিস থানা থেকে কয়েক মিনিটের দূরত্বের মধ্যে কয়েক হাজার মানুষের জমায়েত এবং তাতে বিপুল সংখ্যক করোনা আক্রান্ত বলে সন্দেহ করা হচ্ছে, এই পরিস্থিতিতে সরকার ৭দিন হাত গুটিয়ে বসেছিল! টেস্ট পর্যন্ত করা হয়নি। করোনা আক্রান্ত বিদেশিরা এসে সারা দেশে ঘুরে বেড়াল! সুতরাং সরকার খালি লকডাউন করে, পুলিস-মিলিটারি নামিয়ে মারকাজের ঘাড়ে দোষ চাপিয়ে নিজের দায়িত্ব এড়াতে চাইছে। সেখানে খোদ রাজধানীতে সরকার কতটা বিভ্রান্ত তার প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে। পাশাপাশি তবলিগ জামাতের কর্তারা বিচ্ছিন্ন থাকার গুরুত্ব উপলব্ধিই করতে পারেনি। তারা ধর্মীয় আচার পালন করে গেছেন। সাধারণ মুসলিম ধর্মের মানুষদেরও এই গোঁড়া ধর্মপ্রচারক সংগঠন সম্পর্কে সাবধান হতে হবে। এরপরে ৩০শে মার্চ সংবাদমাধ্যমের কাছে পুরো বিষয়টি সামনে আসে। আরও একটা সন্দেহ দানা বাঁধছে, যেহেতু এই কেন্দ্রীয় সরকারের বেশিরভাগ কাজেই ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থাকে, তাহলে কি এই ঘটনাকে সরকার বাড়তে দিয়েছে এমন করে যাতে শাসকদল করোনা সংক্রমণকেও ধর্মীয় উন্মাদনা তৈরিতে কাজে লাগাতে পারে? এর উত্তরটা এবার আপনাদের উপর ছেড়ে দেওয়াই ভাল।

এবং আরও একটা ঘটনা উল্লেখ করতে হয়। হার্ভার্ড চান গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের মহামারি বিশেষজ্ঞ ডাঃ এরিক এফ ডিং এনডি টিভিকে দেওয়া সাক্ষাতকারে বলেছেন লকডাউন এই মহামারি বৃদ্ধিকে ধীর করতে পারে, অনেকটা দাবানলের সময় প্লেনে করে জল ছেটানোর মতন। কিন্তু আসল হচ্ছে টেস্ট করা। প্রয়োজন গণহারে টেস্ট। যা আমাদের দেশের সরকার কিছুতেই করতে রাজি নয়। নিজামুদ্দিনের ঘটনা চোখে আঙুল দিয়ে দেখাল, একটা জায়গাতে আবদ্ধ থাকলেই সংক্রমণ আটকায় না। আমরা শিক্ষা গ্রহণ করব কি? না কি আমরাও কুযুক্তি সংক্রমণে আক্রান্ত হব?

 

তথ্যসূত্র:

  1. https://www.ndtv.com/india-news/coronavirus-india-delhi-markaz-nizamuddin-mosque-sealed-after-7-covid-19-deaths-850-moved-out-for-qu-2203336
  2. https://www.indiatoday.in/india/story/timeline-of-nizamuddin-markaz-event-of-tablighi-jamaat-in-delhi-1661726-2020-03-31https://www.indiatoday.in/india/story/1-800-people-stranded-in-uttarakhand-to-return-to-gujarat-in-28-buses-1660760-2020-03-28