Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

লকডাউনের দিনরাত্রি

ঈশিতা ভাদুড়ী

 





লেখক নেশায় কবি ও গদ্যকার। পেশায় বাস্তুকার।

 

 

‘করোনা’ নামটি কোথা’ থেকে এল? ডেটলের বোতলের গায়ে লেখা আছে তাকিয়েই দেখিনি কখনও। সুমন চট্টোপাধ্যায়ের লেখা থেকে জানলাম ‘করোনা’ একটা জনপ্রিয় মেক্সিকান বিয়ারের নাম। করোনা বা নভেল করোনা নামের ইতিহাস আমার জানা নেই। কিন্তু এই করোনার প্রকোপ এমন এবং তার এই বিশ্বব্যাপী ধ্বংসের যে সাক্ষী হলাম আমরা, এবং শুধু আমি নই, বা আমার স্বজন আমার বন্ধুরা নয়, শুধু স্বদেশ নয়, সারা বিশ্ব যে গভীর সঙ্কটে এবং এই যে আমাদের দুঃখ আমাদের যুদ্ধ মিলে যাচ্ছে একে অন্যের সঙ্গে, এখানেই মনে হয় সভ্যতার বিকশিত দন্তকে একটা সামান্য ভাইরাসের ভয়ংকর চপেটাঘাত। আমরা জেনে গিয়েছি মানুষের থেকে ভাইরাসের ক্ষমতা অনেক বেশি। 

এইসব জানতে না জানতে, বুঝতে না বুঝতেই বদলে গেল দিনরাত্রিগুলো। কান খাড়া করে চোখ তাকিয়ে দেখি বাজারে হ্যান্ড-স্যানিটাইজার নেই, মাস্ক নেই, ডেটল নেই। যদিও অফিসের গেটে স্যানিটাইজার ব্যবহার করা, চেয়ারে তোয়ালে না ব্যবহার করা শুরু হয়ে গেছে ততদিনে। শনিবার ২১ মার্চে সারাদিন ধরে রোস্টার ডিউটি এবং স্ট্যাগার্ড ডিউটি (তিন শিফটে) ঠিক করা হল, ৫০% এর বেশি হাজিরা যেন কিছুতেই না হয়। রবিবার জনতা কার্ফু। রোস্টার ডিউটি অনুযায়ী ২৩শে আর ২৪শে আমার ওয়ার্ক ফ্রম হোম। ২৫ শে আমার অফিস যাওয়ার কথা ছিল। তখনও জানি না অনেক কিছুই, ২৩শে মার্চ থেকে লকডাউন আরম্ভ হয়ে গেল, আমাদের কর্পোরেট অফিসের সার্কুলার এসে গেল, লকডাউন পিরিয়ডে আমাদের ওয়ার্ক ফ্রম হোম। আমাদের ইঞ্জিনিয়ারিং ডিপার্টমেন্টে ওয়ার্ক ফ্রম হোম তত সহজ নয়। 

করোনার খবর কিন্তু আমরা শেষ ডিসেম্বর থেকে পাচ্ছি। চীনে উহান অঞ্চলে মানুষ আক্রান্ত হয়েছে, সংখ্যা বাড়ছে, মৃত্যু হচ্ছে, তারপর ইতালিতে। আমরা অনেক দূরে আছি, তত চিন্তার কিছু নেই। এইরকম ভাবতে ভাবতেই দিল্লি, মহারাষ্ট্র, ধীরে ধীরে সারা ভারত। দিল্লিতে শপিং মল বন্ধ হল। আমাদের দেশের মধ্যে মুম্বাইতেই প্রথম লকডাউন আরম্ভ হল। মুম্বাইয়ে আমার বোনঝিদের ওয়ার্ক ফ্রম হোম শুরু হল। অনলাইনে খাদ্যবস্তু অর্ডার দিয়ে যখন পেল না, তখন অনেক দেরি হয়ে গেল। সারা ভারত রেল, মেট্রোরেল, ফ্লাইট ধীরে ধীরে বন্ধ হয়ে গেল। আমরা সবাই একে অন্যের সঙ্গে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলাম। যে যেখানে দাঁড়িয়ে, রয়ে গেলাম আমরা।

আমাদের কারও কারও বাড়িতে হয়তো খাবার আছে এখনও। আমাদের কারও কারও বাড়ি হয়তো রাস্তার ওপরে, ভ্যানে করে সব্জি হেঁকে যাচ্ছে গেটে। হয়তো আমরা অনেকে এখনও নিরাপদ। হয়তো আমাদের অনেকের মাথার ওপর ছাদ আছে, কিন্তু খাদ্য বা ছাদ নয়, আমরা এই সামান্য জীবানুর এই ভয়ানক বিস্তার থেকে কবে রেহাই পাব আমরা জানি না। আমরা জানি না আমরা কোথায় ভেসে যাচ্ছি।

মাঝেমধ্যে টেলিভিশনের সামনে বসে যখন নিউজ চ্যানেলে দেখি আনন্দবিহারে হাজার হাজার মানুষের বাড়ি ফেরার জন্যে অসহায় আর্তি, যখন দেখি পুরুলিয়া বাঘাযতীন বাঁকুড়া বিভিন্ন জায়গায় লকডাউন অগ্রাহ্য করে মানুষের ভিড়, যখন দেখি কীভাবে বহু মানুষ ভাইরাস গোপন করে তার বীজাণু সমাজে বিস্তার করতে সাহায্য করছে, তখন ভয় গ্রাস করে যায় ভয়ংকর। আমরা অনেকে হয়তো তখনও নেটফ্লিক্সে ‘কারা পারা আস্ক’ অথবা ‘মানি হেইস্ট’ দেখছি…

আমার বোনপোর অপারেশন হয়েছে, ২রা এপ্রিল স্টিচ কাটার কথা। ডাক্তারদের চেম্বার বন্ধ। হাসপাতালে যেতে হবে, এটাও খুব চিন্তার বিষয়, কী ভাইরাস নিয়ে আসব বাড়িতে সেখান থেকে কে জানে! বাড়িতে বয়স্ক মা। ডাক্তারবাবু আমাদের বাড়িতে লোক পাঠিয়ে দিলেন স্টিচ কাটার জন্যে। সে আরেক ঝঞ্জাট। আমরা তো কেউ দরজার বাইরে যাচ্ছি না, তার ওপর মা বয়স্ক মানুষ, রক্তে শর্করা, রক্তচাপ, অ্যাস্থমা সব কিছু নিয়ে কোনও প্রকারে আছেন। সেখানে একটা মানুষ বাইরে থেকে এসে সোফায় বসবে, এখানে ওখানে হাত দেবে। মহাবিপদ! অনেক ভেবেচিন্তে তিনটি প্লাস্টিকের চেয়ার নিয়ে বিল্ডিংয়ের নিচে গিয়ে সেই স্টিচ কাটা হল। তারপর গরম জল ডিটারজেন্ট ডেটলে তাদের শুদ্ধিকরণ। ওদিকে মুম্বাইতে প্রতিদিন আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে, আমার বোনঝি মাহিমের ফ্ল্যাটে একা যুদ্ধ করছে। গ্যাস ফুরিয়ে গেছে, সিলিন্ডার ডেলিভারি হচ্ছে না, বিগ বাস্কেট চাল-ডাল ডেলিভারি করছে না। এমতাবস্থায় কী করে বিশ্বের কথা ভাবব! এদিকে প্রতিদিন ওয়ার্ল্ডোমিটারের ওয়েবসাইটে মৃতের সংখ্যা বাড়ছে। বুকের মধ্যে ধড়ফড় ধড়ফড়…

গতকাল দ্য ওয়াল ব্যুরোতে পড়লাম, কলকাতার ফুটপাতে করোনা-সংক্রমণ! তাও আবার একজন নয়, জানা গেছে, শহরের দু’প্রান্তের দুই ফুটপাতবাসীর ধরা পড়েছে করোনা পজিটিভ! অল্পবয়সে আমরা অনেক গল্পে পড়েছি কলেরা প্লেগ কালাজ্বরের মতন মহামারির কথা। কিন্তু বিশ্বব্যাপী এই অতিমারী অবস্থা আমরা একবিংশ শতকের কেউ কখনও কল্পনা করিনি।

এই যে জীবন থমকে গেল এমন, এর জন্যে দায়ী কে? এই যে আগামী পাঁচ বছরের যে সব কর্মসূচি আমি নিয়েছিলাম, সেগুলো সব বাতিল হল, সেগুলো কোনওদিনও আর হবে কিনা জানি না। আমার মায়ের কিছু ইচ্ছে ছিল, সেগুলোও পূরণ করা আর হয়তো হবে না আমার। আমার মতন সকলেরই জীবন থমকে গেল একেবারে। আমাদের এই ছন্নছাড়া আতঙ্কিত জীবনে, আমাদের এই বিষণ্ণ যাপনে আমরা হয়তো অনেকেই স্তোকবাক্যে একে অন্যের বিচ্ছিন্নতা কাটানোর চেষ্টা করছি। হয়তো অনেকেরেই ভিডিও কলে বিষণ্ণ চোখ গেঁথে যাচ্ছে অন্যপ্রান্তে। আমরা হয়তো অনেকেই এখনও একে অন্যকে বাগান দেখিয়ে, কোকিলের কুহু-ডাক শুনিয়ে একাকীত্ব দূর করার চেষ্টা করছি। আমাদের এই ২১ দিনের লকডাউন হয়তো বাড়বে আরও। আমাদের একাকীত্ব এবং বিচ্ছিন্নতা হয়তো বাড়বে আরও। এই করোনা-ঝড় কবে থামবে জানি না আমরা এখনও, আদৌ থামবে কিনা। এবং এই ঝড় পুরোপুরি থেমে যাওয়ার পরও আমরা কতজন ডুবে যাব বা ভেসে যাব জানি না। কে কোন অন্ধকারে তলিয়ে যাব, কে কোন প্রান্তে ভেসে উঠব তাই-বা কে জানে! তবু আমাদের যুদ্ধ জারি রাখতে হবে। কারণ সামান্য ভাইরাসের কাছে আমরা একবিংশ শতাব্দীর মানুষ কীভাবে পরাজিত হব!