সোনালী মুখার্জি
লেখক পেশায় শিক্ষক। হন্সলো, লন্ডন।
আমাদের পাড়াটা এমনিতেই চুপচাপ। সারি সারি বাড়ি। যে যার কাজ নিয়ে ব্যস্ত। শনি-রবিবার আর ছুটির দিনে পাড়ার রাস্তায় বাচ্চারা খেলতে নামে। কেউ আবার সাইকেল নিয়ে বেরোয়। হান্সলো হিথরোর কাছেই তাই প্লেন উড়ে যাওয়ার আওয়াজ আমাদের গা সওয়া।
প্রায় তিন সপ্তাহ ধরে আমাদের পাড়াটা যেন এক নিঝুমপুরী। বসন্তের হাল্কা রোদ পিঠে নিয়ে বয়স্ক দম্পতিদের হাত ধরে হাঁটা নেই। এখন ইস্টারের ছুটি তাও বাচ্চারা সব উধাও। প্লেনের আনাগোনাও প্রায় হাতে গোনা। এই অনন্ত নৈঃশব্দ্যই যেন আর্তনাদের মতো বুকে বেঁধে।
বৃহষ্পতিবার করে ঠিক রাত আটটার সময় আমাদের পাড়ার সবকটা জানালার পর্দা সরে যায়। জানালায় দাঁড়িয়ে ঠিক পাঁচ মিনিট আমরা সবাই হাততালি দিই। বয়স্করা দরজায়। হাততালি শেষে বয়স্কদের অনেকেই সম্মিলিত চিৎকারে গলা মিলিয়ে বলে ওঠেন “together we will make it”। কারও গলার আওয়াজ সামান্য কেঁপে ওঠে। চোখের জল আর গলার কাছে দলাপাকানো আবেগে আমরা মনে করি আমাদের চিকিৎসক-স্বাস্থ্যকর্মীদের। আমাদের দোকানিদের, আমাদের সাফাইকর্মীদের। যারা সুপারমার্কেটে ঝুঁকির মুখে দাঁড়িয়েও হাসিমুখে সাহায্য করে চলেছেন।
আজ সকালে পোস্টম্যান চিঠি দিতে এলেন। ওর কাছে জানতে চাইলাম “কেমন আছেন?” কথা নেই। শুধু মুখে সেই চেনা হাসি। ওরা এমনই হন। আমার পাড়ার দোকানের পাঞ্জাবি ছেলেটি বা ওষুধের দোকানের গুজরাতি ফার্মাসিস্ট সকলেই এমন। মুখ বুজে কাজ করে চলেছেন। কোনও অভিযোগ নেই। একবারের জন্য বলা নেই, “উফ্। আর পারছি না।” হাসিমুখে যেন একটাই প্রার্থনা, “ভালো থাকুন। সুস্থ থাকুন। নিরাপদে থাকুন।”
সামাজিক দূরত্ব আর সঙ্গরোধ— আমার শব্দকোষে নতুন সংযোজন। এই দুটি শব্দ এখন লোকের মুখে মুখে। সেদিন চাক্ষুষ করলাম যেদিন দু ঘণ্টা লাইন দিয়ে সুপারমার্কেটে ঢুকতে হল। প্রত্যেকের মধ্যে যাতে অন্তত দু মিটার করে দূরত্ব থাকে সেজন্য নতুন সাদা দাগ দেওয়া হয়েছে। দোকানের ভেতরেও সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিত করতে ব্যবস্থা নানা কুচকাওয়াজের।
গত তিন সপ্তাহ ধরে অত্যাবশ্যকীয় পরিষেবা ছাড়া সবই প্রায় বন্ধ। জীবনের ছন্দটাই যেন বদলে দিয়েছে এই অনন্ত নৈঃশব্দ্য। এখন সকাল হয়েছে কিনা তা বুঝতেই ভুল হয়ে যাচ্ছে। রোজই উঠতে বেলা হয়ে যাচ্ছে। তারপরে মেয়েকে স্কুলে পাঠানোর তাড়া নেই। নিজে কাজে যাওয়ার তাড়া নেই। জীবনের সব কুচকাওয়াজই যেন করোনা ভাইরাসের ভয়ে গুটিয়ে গেছে।
এই শহরের বাসিন্দা আমি প্রায় দু দশক ধরে। এখন লন্ডনই আমার নিজের শহর। একটা প্রাণবন্ত শহর যেন মরমে মরে আছে। অথচ মাত্র কয়েক সপ্তাহ আগেই চিত্রটা ছিলো অন্যরকম। আমরা সারা বছর বসে থাকি গরমকালের দিকে চেয়ে। গরমকাল আসছে কিন্তু কোথাও যেন মানুষের মন বিষণ্ণ। এত সুন্দর রোদে ঝলমল করছে চারিদিক, অথচ সেটা দেখতে হচ্ছে বাড়ির জানালায় দাঁড়িয়ে। আমার বাড়ির ছোট্ট বাগানে বেশ কিছু সুন্দর ফুল ফুটেছে। মাঝে মাঝে যাই বাগানে। কোনও কাজ ছাড়া রোদে বসে থাকার যে আনন্দ সেটা হয়ত এই পরিস্থিতিতে না পড়লে কোনওদিনই অনুভব করতে পারতাম না।
সঙ্গরোধ-এর মানে যে এত গভীর সেটা হয়ত নিজেরা এই অবস্থায় না পড়লে কোনওদিনই বুঝতে পারতাম না। বন্ধ দরজা জানালা, ফাঁকা রাস্তা, ঝাঁপ টানা দোকানপাট, স্কুলকলেজ– কেমন যেন ঝিমিয়ে থাকা এক মৃত্যুপুরীতে ঘর করছি আমরা। আবার অন্য দিকে মনটা ঘুরলে দেখি কত পাখি। এরা বাড়ির সামনের ম্যাগনোলিয়া গাছটায় বাসা বেঁধে ছিল? কৈ কোনওদিনও খেয়াল করিনি। হয় তো করার অবকাশও হয়নি।
হঠাৎ মনে হচ্ছে সময় যেন থমকে দাঁড়িয়ে। এখন ঘড়ি দেখতে হচ্ছে সময় বোঝার জন্য। রোজ সকালে, ঘুম থেকে উঠে ভাবছি, আজকে কী বার? আমাদের পাড়ায় ছোট-বড় অনেক বাচ্চা আছে। ছুটির দিনে রাস্তা আটকে ক্রিকেট খেলা হয় খুব। আজকাল সেই বাচ্চাদের আওয়াজ আর পাই না। মাঝে মাঝে মনে হয় ঘুমিয়ে আছি বোধহয়। জেগে উঠলেই আবার সব আগের মতন হয়ে যাবে। সেই ঘড়ির কাঁটার সঙ্গে তাল মিলিয়ে শুরু হয়ে যাবে আমার কাজ। মনে মনে আবার ভাবব কবে ছুটি পাব?
ছুটি ঠিক কী? এখনও বুঝে উঠতে পারলাম না। সরকার বলছে বাড়ি থেকে যথাসম্ভব কাজ করো। সত্যিই কি একজন শিক্ষক বা শিক্ষিকার পক্ষে তা সম্ভব? আমি আমার সেই ছোট্ট মুখগুলোকে প্রতিদিন মনে করি। কত চিন্তা হয়! কত বাচ্চা সারাদিনের খাবারের অনেকটাই স্কুলেই পায়। হয়ত বাড়িতে রাতে অল্প খাবারই পাবে তারা। স্কুল না থাকায় ওরা সকালের সেই “টোস্ট” পাচ্ছে তো? কী করে চলছে ওদের বাড়ির সংসার! কেমন আছে ওরা। ভাবলেই মনটা ভারী হয়ে ওঠে।
এইসব ভাবতে ভাবতেই দিন শেষ। আবার একটা নতুন দিন চলে আসে। আবার সেই একইরকমভাবে চলে পরের দিনটাও। প্রথম দিকে খুব রাগ হত। আসতে আসতে সয়ে যাচ্ছে। কয়েক সপ্তাহ হয়ে গেল যে।
এখানে বেশিরভাগ মানুষ দেখলাম আইন মেনে চলতে উৎসাহী। হয়ত সব দেশেই। গত তিন সপ্তাহে মাত্র দুবার বের হয়েছি। বাড়ি ফেরার পর একটা নতুন অধ্যায় যেন। জামাজুতো থেকে শুরু করে, সমস্ত কেনা জিনিসপত্র ধোয়া-মোছা করতে দেখলাম বেশ সময় লাগল। কোথাও একটা ভয় যেন পেয়ে বসছে। যত দিন যাচ্ছে ততই যেন বেশি সাবধানী হয়ে পড়ছি।
জানুয়ারিতে বড়দিনের ছুটির পর যখন স্কুল খুলল তখনই প্রথম এই ভাইরাসটার কথা বিবিসি-র ওয়েবসাইটে পড়ি। সুদূর সেই ইউহান শহর থেকে এত দূরে এই ক সপ্তাহের মধ্যে চলে আসতে পারে? এখনও কেমন যেন অবাক লাগে। এ এক অদেখা শত্রুর সঙ্গে মানবজাতির লড়াই। ঘরে বন্দি হয়ে কত কিছু ভাবি! রোজ নতুন কিছু চিন্তা মাথায় আসে। দিনের শেষে এসে দেখি ঠিক যেখানে দাঁড়িয়ে ছিলাম সেখানেই আছি।
টেলিভিশন দেখতে কোনও দিনই আমার খুব ভালো লাগত না। এখন খবর দেখলে মনে খারাপ হয়। উৎকণ্ঠা বাড়ে। তাও জোর করে বসে সন্ধের খবরটা দেখি। মৃত্যুর খতিয়ান শুনতে শুনতে যাদের গেল তারাও তো আমার মতোই কেউ। কারও বাবা, মা, ভাই, বোন। আমাদের বাড়ির কাছেই কয়েকজন মারা গেছেন। তাঁদের মধ্যে একজন আমাদের বিশেষ পরিচিত। আঠারো বছর ধরে চিনি। কী দাপট ছিল ওঁর। কাজেকম্মে শাড়ির আঁচল কোমড়ে গুঁজে সাত-পাঁচ না ভেবেই ঝাঁপিয়ে পড়তেন। কেমন একা একাই চলে গেলেন। প্রিয়জনরা শেষবেলায় একবার চোখের দেখাও দেখতে পেল না।
এখন কী করে দিন কাটছে? এখানে, দেশে অনেকেই এই প্রশ্নটা করেন। উত্তরটা আমি কোনওসময়ই ঠিক দিতে পারি না। ওই বাড়িতেই আছি বলেই যেন কাটিয়ে দিই। কী করব, কী করা উচিত, কী করলে ঠিক হবে কিছুই বুঝতে পারি না। থমকে যাওয়া মুহূর্তগুলো গড়িয়ে গড়িয়ে চলতেই থাকে। নতুন সূর্য ওঠে, নতুন দিন হয়। ভাবতে থাকি কবে কাটবে এই বন্দিদশা।