Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

নিষ্কর্মা সময় হলে যা হয়…

সৌমিত্র দস্তিদার

 




লেখক তথ্যচিত্রনির্মাতা, গদ্যকার

 

 

 

সরকারি ঘোষণা যেমন হয় তেমনি আচমকাই হল। তবে এবারের সময়টা নিয়ে কমবেশি সকলেরই বুকের ধুকপুকানি বেড়ে গেল প্রবলভাবে। এমনিতেই লকডাউনের শহরে সবার রক্তচাপ এখন ওপরের দিকে, তারপর যদি ঘোষণা হয় মাননীয় প্রধানমন্ত্রী রাত বারোটায় জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণ দেবেন তখন দুশ্চিন্তায় মাথা খারাপ হবে তো বটেই।

অদ্ভুত একটা ব্যাপার লক্ষ করেছি— ভারতীয় রাজনীতিবিদেরা কেন জানি না একটু নাটকীয়তা পছন্দ করেন। আমাদের স্বাধীনতা এল মধ্যরাতে। লাল কেল্লা থেকে দেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরুর সেই বিখ্যাত ভাষণটি তো ইতিমধ্যেই ইতিহাসের মহাফেজখানায় পাকাপাকি জায়গা করে নিয়েছে। শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধির জরুরি অবস্থা জারি তাও মাঝরাতে। আর এখন পৃথিবীর কঠিনতম সময়ে এদেশের প্রধানমন্ত্রীর মধ্যরাতের ভাষণ লোকের রাতের ঘুম কাড়বে সে তো বলাই বাহুল্য। তার ওপর আবার নিন্দুকেরা বলেন যে এই সামান্য ‘চা-ওলা’ আবার অভিনেতা হিসেবে এক নম্বর। প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নিতে প্রথমবার সংসদে ঢুকতে ঢুকতে সিঁড়িতে পা দিয়েই কেঁদে ফেলেছিলেন এ এক পবিত্র মন্দির আর তিনি তার সামান্য সেবকমাত্র বলে।

গুজব বাড়ছে বাতাসের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে। কেউ বলছেন যে আর্থিক জরুরি অবস্থা জারি হতে চলেছে। কারও ধারণা দেশে বোধহয় মিলিটারি শাসন ঘোষণা হবে। উচ্চবিত্ত, মধ্যবিত্তের স্পষ্ট বক্তব্য— উপায় নেই দাদা, আর কোনও পথ নেই এছাড়া। মিলিটারি ছাড়া কেউ এখন দেশ চালাতে পারবে না। দেখলেন না দিল্লি নিজামুদ্দিনের ঘটনা। দুনিয়া কোথায় পৌঁছে গেছে আর মোল্লাগুলো তা জানেও না। অশিক্ষিত বর্বরের দল…, বলে গজগজ করতে করতে চ্যাটুর্জে ও মুখুজ্যেবৌদি রওনা হলেন পুজোটা সেরে ফেলতে। নাহ, রাত বারোটায় বা এই দশটা-সাড়ে দশটায় কেউ পুজো করেন না। আজ বিশেষ প্রার্থনা। হিন্দু হৃদয় সম্রাটের জন্য। বাইরে কারা যেন আওয়াজ তুলেছে, হর হর মোদি ঘর ঘর মোদি। আর সামান্য সময় বাকি। কী হবে, কী হতে চলেছে কেউ তা জানে না। কিন্তু গুজব লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে। মোবাইলে মোবাইলে ছড়িয়ে পড়ছে হোয়াটসঅ্যাপ ইউনিভার্সিটির বার্তা— কোনও এক বাবা নাকি স্বপ্নাদেশ পেয়ে মাননীয়কে পরামর্শ দিয়েছেন যে দেশ থেকে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে বের করে দিলে, যবনমুক্ত ভারতে সকলে মিলে টাটকা ও গরম গোমূত্র পান করলে তবেই করোনা থেকে মুক্তি সম্ভব। প্রবল আশঙ্কায় গভীর অন্ধকার নেমে এসেছে সংখ্যালঘু মহল্লায়।

ঠিক রাত বারোটায় মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ভাষণ শুরু করলেন। মুখে সেই ট্রেডমার্ক মৃদু হাসি। হাতজোড়। মিত্রোঁ….. কিন্তু!

শুরুতেই যেন মনে হল ওঁর চোখ জলে ভেজা। যা দেখামাত্র আড়ালে নিন্দুক বিরোধীরা বলে বসলেন— নোটঙ্কি অব শুরু হো গয়া। প্রধানমন্ত্রী প্রথমেই বলে বসলেন, বিশ্বাস করুন, কদিন ধরে আমি ঘুমোতে পারছি না। এই লকডাউন আমার চোখ খুলে দিয়েছে। সহ্য করতে পারছি না। আমার দেশবাসীর একটা বড় অংশ মাইলের পর মাইল হাঁটছে। তাদের না আছে জল, না আছে খাবার। আমি জানি, মাত্র কয়েকটি পরিবার দেশের বেশিরভাগ সম্পদ কুক্ষিগত করে রেখেছে। আমি জানি আমার দেশের প্রাকৃতিক সম্পদ লুঠ করে নিয়ে যাচ্ছে মুৎসুদ্দি পুঁজি। এ হতে দেওয়া যায় না। এই দেশ আমার আপনার সবার। বিরোধীদের চোখমুখ লাল হতে শুরু করেছে। প্রধানমন্ত্রী এক গ্লাস জল খেলেন। জল খেয়ে আবার বলতে লাগলেন— লকডাউন একদিন উঠে যাবে। করোনাও নির্মূল হবে। তারপর আমি প্রথমেই অসভ্য ইতর আমেরিকার সঙ্গে যাবতীয় কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করব। পাকিস্তান নেপাল বাংলাদেশ মিলে এক কনফেডারেশন গড়ে তুলব। বিদেশি পুঁজির আধিপত্য খর্ব করব। সব বেসরকারি হসপিটাল স্কুল কলেজ ইউনিভার্সিটি জাতীয়করণ করব। ধর্মীয় সংগঠনের নামে-বেনামে থাকা ভূসম্পত্তি অধিগ্রহণ করে তা ভূমিহীনদের মধ্যে বিলিয়ে দেব। মিলিটারি খাতে ব্যয়বরাদ্দ কমিয়ে স্বাস্থ্য শিক্ষা খাতে পুরো টাকা খরচ করব। সর্বোচ্চ স্তর পর্যন্ত সকলের জন্য শিক্ষা হবে সম্পূর্ণ অবৈতনিক। দেশকে গড়ে তুলব সত্যিকারের ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র হিসেবে।

দূরদর্শনের ক্যামেরাম্যানরা অবাক হয়ে শুনছেন প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য। এই প্রধানমন্ত্রীকে তারা কেউ আগে দেখেনি। হৈচৈ পড়ে গেছে দিল্লিতে বিজেপির সদর দপ্তরে। দূরদর্শনের অপারেটারদের ওপর ‘উচ্চপর্যায়’ থেকে অনেকক্ষণ ধরে নির্দেশ আসছে অবিলম্বে সম্প্রচার বন্ধ করার জন্য। কিন্তু স্টুডিওতে যাঁরা আছেন তাঁরা বেঁকে বসেছেন। কোনও অবস্থাতেই তারা প্রধানমন্ত্রীর এই ঐতিহাসিক বক্তৃতা বন্ধ করবেন না।

মোবাইল ঝনঝন করে বেজে যাচ্ছে মাননীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শা-র ঘরে। উনি ফিরেও তাকাচ্ছেন না। ঘরের মধ্যে আহত সিংহের মত পায়চারি করছেন। দিল্লি সদর দপ্তরে জেপি নাড্ডা অসুস্থ হয়ে পড়ায় তাঁকে নিয়ে অ্যামবুলেন্স রওনা হয়ে গেছে এইমসের দিকে। ১০ নম্বর জনপথ রোডের দিকে গাড়ি চলেছে প্রায় দুশো কিমি গতিতে। গাড়ির ভেতরে বসে কুলকুল করে ঘামছেন প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ মনমোহন সিংহ। রাহুল গান্ধি টুইট করে দিয়েছেন, আমরা মোদিজির পাশে আছি। আপৎকালীন পরিস্থিতিতে প্রয়োজনে জাতীয় সরকার যদি গড়ে ওঠে তাতে কংগ্রেস যোগ দেবে। একে গোপালন ভবনে তার আগেই রাহুল গান্ধির দূত গিয়ে জাতীয় সরকারের প্রশ্নে সীতারাম ইয়েচুরির মত নিয়ে এসেছেন।

মোদিজি বলে চলেছেন, সীমান্তে কড়াকড়ি উঠিয়ে দিয়ে উপমহাদেশে মুক্ত বাণিজ্যের পথ উন্মুক্ত করে দেব। তিন দেশের জনগণের মধ্যে যাতায়াতের জটিলতা দূর করব। প্রয়োজনে ভিসা তুলে দেব। বাংলাদেশের জনগণের স্বার্থে হাসিনাজির সঙ্গে তিস্তার পানি বণ্টন নিয়ে আর কোনওরকম টালবাহানা না করে যত শীঘ্র সম্ভব পর্যাপ্ত জল দেওয়ার ব্যবস্থা করব লকডাউন উঠে যাবার পরেই। পাকিস্তানের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক অনেক সুদৃঢ় করতে হবে, ভুলবোঝাবুঝি দূর করতে হবে। শত্রুতা উন্নতির পথ নয়, এ কথা বোঝাতে হবে— তার জন্য যা যা করার দরকার তা করবই।

নাগপুরে সঙ্ঘের সদর দপ্তরে বিপুল চিৎকার চেঁচামেচি শুরু হয়ে গেছে। মোহন ভাগবত টিভি দেখতে দেখতে হঠাৎ বুকে ব্যথা অনুভব করছেন। ভক্তরা হতভম্ব হয়ে বোঝার চেষ্টা করছে এ কোন মোদিজি!

দিল্লির ঝুগ্গিবস্তি থেকে রাস্তায় নামা অটো ড্রাইভার সবাইকে জনে জনে প্রশ্ন করছেন এনডিটিভি-র রভিশকুমার। আপ কেয়া মোদিজিকে সাথ রহেঙ্গে? হাজার হাজার লোক পাগলের মতো বলে উঠছেন— নরেন্দ্রভাই সংঘর্ষ করো/ হাম তুমারে সাথ হায়। মোদিজি তখনও বলে চলেছেন— আমার ভারত আর ভুখা নাঙ্গা থাকবে না। বিজলি পানি মকান ফ্রি হয়ে যাবে গরিব জনতার। ওদিকে আমেরিকার হোয়াইট হাউসে জোর করে ঘুম ভাঙানো হয়েছে ট্রাম্পের। অবাক তিনিও। ভারতের প্রধানমন্ত্রী এ কী বলছেন— আমরা আমেরিকার ঔদ্ধত্য মেনে নেব না। দরকার হলে পাকিস্তান আর বাংলাদেশকে পাশে নিয়ে আমেরিকার বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক অবরোধের নেতৃত্ব দেব। শ্লোগান তুলব, আমেরিকা তুমি ইরান থেকে হাত ওঠাও। ইজরায়েলকেও ধমক দিতে ভোলেননি নরেন্দ্রভাই। সাফ জানিয়ে দিয়েছেন, করোনা-মুক্ত পৃথিবীতে ভারত সর্বশক্তি দিয়ে প্যালেস্টাইনের পাশে থাকবে।

বক্তৃতা শেষ হয়নি, তার আগেই লকডাউনের মধ্যে গরিব কৃষক, পরিযায়ী শ্রমিক, নিম্নমধ্যবিত্ত লোকজন মোদি মোদি ধ্বনিতে আকাশ বাতাস কাঁপিয়ে রাস্তায় নেমে পড়েছেন। তখনও মোদিজি বলে চলেছেন যে কখনও কখনও সদর দপ্তরেও কামান দাগতে হয়। জনতার ওপর আমার অগাধ আস্থা। আমি জানি একদিন না একদিন স্বৈরতন্ত্রীদের হাত থেকে সব ক্ষমতা তারা কেড়ে নেবে। জন্ম নেবে এক নতুন বৈষম্যহীন উদার ঝলমলে ভারতবর্ষ।

রাজ্যে রাজ্যে অভূতপুর্ব পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। দিলীপবাবুকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। সঙ্ঘপরিবারের কর্মীবাহিনীর সঙ্গে হাতাহাতি যুদ্ধ শুরু হয়েছে জনতার। শোনা যাচ্ছে এর পিছনে নাকি মাওবাদীদেরও বড় ভূমিকা আছে। কোনও এক শীর্ষ মাওবাদী নেতা ইতিমধ্যেই বিবৃতি দিয়ে জানিয়ে দিয়েছেন যে মোদিজির বিরুদ্ধে কোনওরকম ষড়যন্ত্র হলে পিপলস লিবারেশন আর্মি সর্বশক্তি দিয়ে তা রুখবে।

ওবি ভ্যান আর প্রিন্ট মিডিয়া এর মধ্যেই পৌঁছে গেছে রাষ্ট্রপতি ভবনে। শিল্পপতিরা বলছেন এরপরে রাষ্ট্রপতির মোদিজিকে বরখাস্ত করা ছাড়া আর উপায় নেই। নাহলে পুঁজিতন্ত্রের গণতান্ত্রিক মুখোশটা আর ধরে রাখা যাবে না। এ তো একেবারে সমাজতান্ত্রিক পথে চলার ডাক দিচ্ছেন নরেন্দ্র মোদি। অর্ণব গোস্বামী অনেক কষ্টে লাইভ ধরতে পেরেছেন অমিত শাহ-কে। অবশ্য অস্থির ক্রুদ্ধ অমিত শাহ কোনও কথাই বলতে চাইছেন না। তবু অর্ণব চেঁচিয়ে চলেছেন— আপনি বলুন স্যার, নেশন ওয়ান্টস টু নো, ওয়ান্টস টু নো….

 

ধড়মড়িয়ে উঠে বসলাম বিছানায়। বাইরে তখনও আলো ফোটেনি। তবে পাখি ডাকছে। লকডাউনের নিষ্কর্মা সময়ে কতরকম স্বপ্নই যে মনের মধ্যে জন্ম নেয়।