প্রতিভা সরকার
লেখক প্রাবন্ধিক, গল্পকার, অধ্যাপিকা ও সমাজকর্মী
করোনা-কাল বা অন্য সময়, ব্যক্তিগত এবং রাজনৈতিকের জন্য কোনও ছিদ্রহীন আলাদা প্রকোষ্ঠ নেই, কোনওকালে ছিলও না। এ প্রকোষ্ঠে জল ঢুকলে চুইয়ে তা ওপাশে যাবেই। ব্যক্তিগত গদ্যের মধ্যে চিরকালই ঢুকে থাকবে রাজনীতির বিষ।
এই যে স্বাধীনতার বহু আগে তৎকালীন পূর্ববঙ্গের এক রেলস্টেশনে দেখতে পাচ্ছি ব্যবসার কাজে ঘরছাড়া এক কৃষ্ণকায় দীর্ঘ যুবাপুরুষকে, অসুস্থ গর্ভবতী স্ত্রীকে নিয়ে তিনি শঙ্কিত এবং বিব্রত। ঘরে দ্বিতীয় স্বজন আর কেউ নেই যার কাছে পত্নীকে রেখে আসা যায়। খুবই দুর্ভাগ্য, কারণ পথিমধ্যে ওলাউঠা আক্রান্ত তরুণী ভার্যা এখন নিজের স্ফীতোদর বাহুতে বেষ্টন করে মুহুর্মুহু আর্তনাদ করছে— ওগো, বেদনাবিষে জ্বলে মইলাম গো। আমারে এট্টু জল খাইতে দাও। মাত্র এক ঢোঁক!
কথার ফাঁকে ফাঁকে অনবরত বমন চলছে, আর পাতলা বার্লির মতো দাস্ত। লৌহশকটের জন্য অপেক্ষমান সবাই এই যুগলকে এড়িয়ে চলে যাচ্ছে দূরে। স্বামীটি সাহায্যের জন্য কারও নিকটবর্তী হওয়া মাত্র সে উঠে দূরে গাছের ছায়া অভিমুখে হাঁটা লাগাচ্ছে বা তাড়াতাড়ি প্ল্যাটফর্মের একেবারে ধারে দাঁড়িয়ে ডানহাত তুলে দিচ্ছে কপালে, যেন জরিপ করছে গাড়ি নিকটবর্তী হল কিনা। কোনও স্ত্রীলোক করুণায় নম্র হয়ে সন্তানসম্ভবার নিকটে দাঁড়িয়ে পড়লে অথবা তার মুখে সমবেদনার ছায়া পরিলক্ষিত হওয়া মাত্র পুরুষসঙ্গীটি জোরপূর্বক তার বাহু আকর্ষণ করে দূরে আরও দূরে নিয়ে যাচ্ছে। সঙ্গে তীব্র ভর্ৎসনা— তোর কি মরণের ইচ্ছা হইছে?
মেয়েটি এশিয়াটিক কলেরায় আক্রান্ত। নুন চিনির জল দূরস্থান, তখন লোকে মুমূর্ষুর মুখে এক গণ্ডুষ পানীয় জল দিতেও ভয় পেত। তাতে ওলাউঠা আরও বৃদ্ধি পাবে এই ছিল জনমানসে ধারণা। শুধু ভয় এবং ঘৃণা ছাড়া সেই অভিজ্ঞতাহীন নবীন দম্পতি আর কিছু পাবে না, এ তো ভবিতব্য।
আমার মাতামহ ও তাঁর প্রথমা স্ত্রীর কথাই লিখলাম এতক্ষণ। কিম্বা আমার সেই অদেখা মাতামহী, যিনি প্রথম সন্তান সম্ভাবনাকালে এইভাবে অপমৃত্যুর শিকার হন, শ্রুতির ওপর ভিত্তি করে তাঁর মর্মান্তিক মৃত্যুদৃশ্যের পুনর্নির্মাণ করলাম।
এ আমার ব্যক্তিগত কথামালা। দাদুর মুখ থেকে শোনা কাহিনি যা ছবির মতো থেকে গেছিল মনের কোনও স্তরে, করোনাগ্রস্ত মানুষের হেনস্থার কথা শুনে উঠে এল স্মৃতিজলের একেবারে উপরিতলে। একশো বছরেরও আগে ঘটে যাওয়া সেই ঘৃণার চাষ এখনও আধুনিক রাজধানীর স্নায়ুতে স্নায়ুতে, এই বোধ আমাকে লকডাউনের সময়ে আরও বিষণ্ণতা দেয়। লিভারের অসুখে আক্রান্ত বৃদ্ধকে গাছে বেঁধে পেটানোর কাহিনিতে আমি শিউরে উঠি।
আমি কি আমার অদেখা মাতামহীর মুখের আদল দেখি গঙ্গাম্মার মুখে? ২৯ বছরের গঙ্গাম্মা এক পরিযায়ী শ্রমিক, যে লকডাউন ঘোষণার পর স্বামীর সঙ্গে বাধ্য হয়ে পায়ে হেঁটে রওনা দিয়েছিল ব্যাঙ্গালোর থেকে রায়চূড়। কাজের জায়গায় কাজ নেই, ফলে খাবার নেই, সরকার পরিবহনের কোনও ব্যবস্থা করেনি, আর কী করতে পারত এই শ্রমিক দম্পতি?
কিন্তু গনগনে রোদ, রাত্রিছায়ায় পাক্কা ৩০০ কিলোমিটার পথ ক্ষতবিক্ষত পায়ে পাড়ি দেবার পর যখন সবে অর্ধেক রাস্তা আসা হয়েছে, তার শরীর জবাব দিয়ে বসল। চূড়ান্ত অসুস্থ গঙ্গাম্মার ঠাঁই হল বেল্লারি শিবিরে। মুখের সামনে ভাতের থালা, কিন্তু কয়েকদিনের অভুক্ত মানুষটি চৈতন্যহীন।
যেমন হয়, হাসপাতালে নেওয়া হল। সেখানে গঙ্গাম্মা মারা গেলে নানা তরজা হল— মৃত্যু কি অনাহারে? না, না তা তো নয়। খুবই অদ্ভুত কথা যে এই প্রথম জানা গেল তার পুরনো কিডনির অসুখ ছিল। উপরন্তু হেপাটাইটিস বি-ও। শেষ অব্দি কী দাঁড়াবে গঙ্গাম্মার কেসটা, তার স্বামী ক্ষতিপূরণের টাকা পাবে কি না পাবে, এসব প্রশ্ন পার হয়ে আমার মনে পড়ে যায় মাতামহের প্রথমপক্ষের অকালমৃত স্ত্রীকে, যাঁর নাম ছিল মনোরমা। পথে যেখানে যত অনাসৃষ্টি, যত দুর্ঘটনা, নিষ্ঠুরতা, হত্যার গন্ধ, সবার পেছনে এসে চিরম্লানমুখে দাঁড়িয়ে থাকেন তিনি। চোখের পাতা ভেজা, কিন্তু কণ্ঠনালীতে মরুভূমির উত্তপ্ত বালুরাশি বোঝাই। চিরতৃষ্ণার পুত্তলিকা, আমার মনোরমা। আমার ব্যক্তিগত আর রাজনৈতিককে মিলিয়ে মিশিয়ে দেবার প্রথম কারিগর।
করোনার কাল কি তবে আমাকে খুব বিমর্ষ করে রেখেছে? গেরস্থালির কাজ বেড়েছে ঢের বেশি, রান্নাঘরের জানালা খোলা থাকলে আজকাল খাবারের আশায় এক কাক-পরিবার ঘোরাফেরা করে। কিছু না দিলে হেড অফ দা ফ্যামিলি গম্ভীর হয়ে আমায় বকে দেয় “ক্ক”। জানি ওদেরও প্রবল খাদ্যাভাব চলছে। রাস্তার ধারের যত খাবারের দোকান, হোটেল, সবই তো বন্ধ। পাড়া পাহারা দেওয়া কুকুরগুলো পেটপিঠ এক করে অনাথের মতো ঘুরে বেড়াচ্ছে। নয়ডার নীলগাই, অজানা সমুদ্রতটে ঢেউয়ের সঙ্গে ক্রীড়ারত হরিণ, গন্ডোলাহীন ভেনিসে ডলফিনের প্রত্যাবর্তন আমাকে যত প্রফুল্ল করে, এই হতচ্ছাড়া মানুষের সঙ্গচাটা প্রাণীগুলির দুর্দশা তার চেয়ে কিছু কম বিষণ্ণ করে না।
আমি নিজেকে সান্ত্বনা দেবার মতো করে আওড়াই, মন্বন্তরে মরিনি আমরা, মারি নিয়ে ঘর করি। কিন্তু মারি-মন্বন্তরের ইতিহাস মনে পড়তেই আবার দেখি ফিচেল হেসে দাঁড়িয়ে আছে সেই আদি অকৃত্রিম রাজনীতি। এক্কেবারে কমলি নেই ছোড়েগা ভঙ্গিতে!
তবু নিজেকে ভরসা জুগিয়ে বলি, কবেই বা সুদিন ছিল, গত সত্তর আশি বছরের কলকাতা এবং অবিভক্ত বাংলার ইতিহাস মারি, মড়ক, দাঙ্গাকে বাদ দিয়ে কিছুই নয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ কলকাতায় সোজাসুজি আছড়ে পড়েনি ঠিকই, কিন্তু ১৯৪৮ সালের আগেই তার আঁচ পুড়িয়ে দেয় কলকাতা এবং বাংলাকে। ৪২-এর গ্রীষ্মে ক্রমাগত আছড়ে পড়তে লাগল বার্মা থেকে আসা রেফিউজিদের ঢেউ। সাম্রাজ্যবাদী জাপানের আক্রমণ থেকে বাঁচবার দলবদ্ধ প্রয়াস। আজকের পরিযায়ী শ্রমিকদের মতো অবিশ্বাস্য দীর্ঘ পথ পাড়ি দেওয়া। পথশ্রমে, অনাহারে, বন্য জন্তু এবং মানুষের নিষ্ঠুর আক্রমণে অনেক মৃত্যু।
এর পরই যে ঘটনা ঘটল তার প্রভাব পড়বে গোটা ভারত জুড়ে— মহাত্মা গান্ধির ভারত ছাড়ো আন্দোলন। নেতাদের গ্রেপ্তারের প্রতিবাদে ফেটে পড়া, তার উত্তরে অকল্পনীয় পুলিশি অত্যাচার, আগস্ট থেকে অক্টোবর অব্দি বেলাগাম লুঠতরাজ, দাঙ্গা।
সেই অক্টোবরেই উড়িষ্যার তটরেখা বরাবর ছুটে এল এক বিধ্বংসী সাইক্লোন। গবাদিপশু উজাড় করে, মানুষ ও শস্য ধ্বংস করে সেই রাক্ষুসী ঝড় সব তছনছ করে দিয়ে গেল। সে ধাক্কা সামলানোর আগেই তলে তলে শুরু হয়ে গেল আর এক ঝোড়ো ষড়যন্ত্র। যুদ্ধের প্রস্তুতি হিসেবে সরকার বাহাদুর ফড়েদের মাধ্যমে চাল কিনতে শুরু করলেন বাংলার কৃষকদের কাছ থেকে। এমন অসম্ভব দাম হাঁকা হয়েছিল সরকারের তরফে, যে সরল চাষা তার বীজধান, এমন কি নিজের খোরাকির ধানও বিক্রি করে দিয়েছিল। তার ধারণা ছিল পরের মরশুমে ভালো চাষবাস আবার উদ্বৃত্ত শস্যে ভরে দেবে তার গোলা।
আর এক কাণ্ডও কৃষকের বিপক্ষে গিয়েছিল। ভারতে জাপানি ভয়ে ভীত ব্রিটিশ সরকার নদীনালাময় বাংলায় কৃষকের প্রাণরেখা সচল রাখতে জুড়িহীন ডিঙি নৌকোগুলিকে প্রথমে বাজেয়াপ্ত করতে শুরু করে। তারপর ছোট বড়, বজরা ডিঙি, কোনও নৌকাই তার কৃপাদৃষ্টি এড়াতে পারেনি। অনেক জায়গায় চাষের খেতে পৌঁছবার, স্থানান্তরে যাবার একমাত্র অবলম্বন ছিল এই নৌকাগুলি। কিন্তু সরকারের ভয়ের কারণ হচ্ছে মালয় অন্তরীপে স্থানীয়দের নৌকা ও বাইসাইকেলের সাহায্য নিয়ে জাপানি সৈন্যবাহিনীর দুর্বার গতি। এছাড়া পোড়ামাটি নীতি, যা শত্রুর ব্যবহার করতে পারে পেছনে পড়ে থাকা এইরকম সমস্ত কিছুই ধ্বংস করে দিয়ে যায়, সেটাও এই সিদ্ধান্তের পেছনে কার্যকরী ছিল। কিন্তু এই নৌকাহরণ বাংলার শ্রমজীবী, বিশেষ করে জেলে সম্প্রদায়ের জীবন একেবারে তছনছ করে ফেলে।
এইভাবেই শুরু হয়ে গেল মন্বন্তর, দা গ্রেট বেঙ্গল ফেমিন। ফ্যান দে মা আর্তনাদে রাজপথ ভরে গেল। ডাকিনী যোগিনীর মতো পিছে পিছে এল টাইফয়েড আর কলেরা। পঞ্চাশ হাজার মানুষের লাশ কাটা কলাগাছের মতো পড়তে লাগল।
ব্যাপারটা হচ্ছে বাটারফ্লাই এফেক্ট। কোথায় এক ক্ষীণজীবী প্রজাপতি তার দুখানা রঙিন ডানা নাড়াল, বায়ুস্তরে সেই তরঙ্গ অনেক দূর যেতে যেতে রূপান্তরিত হল বিধ্বংসী সাইক্লোনে। ছোট ছোট ঘটনা পর পর ঘটে যেতে যেতে এক বিশাল গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার গতিপথ নির্ধারিত করে দেয়। মাথার ওপর স্বৈরাচারী শাসক থাকলে ক্রাইসিস পূর্বাপর ঘটনার দ্বারা গভীরতর হয় কেবল।
করোনায় প্রকাশিত আমাদের নিষ্ঠুর মানসিকতা, জিনিসপত্র জমিয়ে রাখার জন্য দোকান বাজারে দৌড়োদৌড়ি ও প্যানিক বাইয়িং, মিথ্যে করোনা জেহাদ নাম দিয়ে, ফেকের পর ফেক ভিডিও শেয়ার করে, বিশেষ সম্প্রদায়কে খাদের শেষ কিনারায় নিয়ে যাওয়া, ঘণ্টা মোমবাতি বাজি নিয়ে এই হুল্লোড়, পরিযায়ী শ্রমিক ও দিন আনি দিন খাই মানুষের প্রতি চূড়ান্ত ক্যালাসনেস, অর্থনীতির মুখ থুবড়ে পড়া, অনিশ্চয়তার কালো মেঘ, এইসবের পেছনে যে সারিবদ্ধ ঘটনাবলি সেগুলো কোনওটাই প্রজাপতির পাখা নাড়াবার মতো মৃদু নয়। তার মধ্যে আছে দিল্লি ও অন্যত্র অমানুষিক দাঙ্গা, নির্দোষ ছাত্র পেটানো, উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে এনআরসি, সিএএ প্রণয়ন, দেশজোড়া আন্দোলনকে বানচাল করবার মরিয়া প্রয়াস, ডিমোনেটাইজেশনের মার, কাশ্মিরের কণ্ঠরোধ, কর্পোরেটকে তেল দেবার জন্য নির্বিচার পরিবেশ হত্যা। আরও অনেক কুকীর্তি।
ফলে বেঁচে গেলেও, করোনাকালে আরও বেড়ে যাওয়া এই অমানবিকতা, সম্পূর্ণ বিশৃঙখলা, পারস্পরিক অবিশ্বাস ও মানসিক দীনতা রোগ সেরে গেলেও আমাদের ছাড়বে না। এই হীন ইতর জীবন যাপনের জন্য মানসিক প্রস্তুতি অসুখের থেকেও বেশি জীর্ণ করে।
অথচ আমার আজ একটি ব্যক্তিগত গদ্য লিখবার কথা ছিল।