সত্যব্রত ঘোষ
লেখক প্রাবন্ধিক, চলচ্চিত্রনির্মাতা
কোভিড-১৯ সঙ্কট যখন দেশের শাসক দলের অহং, কর্তৃত্ববাদ এবং তাদের ঘৃণ্য সাম্প্রদায়িক রাজনীতি প্রকাশেরও মুখবন্ধ হয়ে দাঁড়ায় তখন তা দেশের জন্য চরম দুঃসময় বৈকি। সম্প্রতি উত্তর প্রদেশ সরকার সিদ্ধার্থ বরদারাজনের বিরুদ্ধে একটি মানহানির এফআইআর দায়ের করেছে, এই লকডাউনের মধ্যেই অযোধ্যা পুলিশ দিল্লি গিয়ে তাঁর হাতে শমন ধরিয়েছে এবং তাঁকে সস্ত্রীক ১৪ই এপ্রিল অযোধ্যা থানায় হাজির হতে নির্দেশ দিয়েছে।
স্বাভাবিকভাবেই এই লকডাউনের মধ্যে বরদারাজনের পক্ষে ওই তারিখে আসা সম্ভব ছিল না। অযোধ্যা থানার স্টেশন হাউস অফিসার তাঁকে বলেন যে তিনি যেন তাঁর বক্তব্য একটি ইমেইল করে পাঠিয়ে দেন।
পুলিশের এই যে নাছোড়বান্দা মনোভাব, এর থেকে স্পষ্টই বোঝা যায় যে তাদের ওপর উপরমহল থেকে চাপ দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু প্রশ্নটা হল, বরদারাজন এমন কী করলেন যার জন্য যোগী আদিত্যনাথ সরকার এই উন্মত্ততায় প্রশাসনকে একটি নিউজ পোর্টালের সম্পাদকের বিরুদ্ধে লেলিয়ে দিলেন? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গেলেই আমরা দেখতে পাব যে আমাদের দেশের নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠ সরকারের এখনও পর্যন্ত ধর্ম নিয়ে রাজনীতি করাটাই একমাত্র অ্যাজেন্ডা হিসেবে রয়ে গেছে।
দিল্লিতে তাবলিগি জামাতের সমাবেশ ঘিরে যখন বিতর্ক জমে উঠছে সেই সময় গত ৩১শে মার্চ দি ওয়ার পত্রিকায় একটি নিবন্ধ[1] প্রকাশিত হয়। তার একটি স্তবক উদ্ধৃত করে বরদারাজন টুইট করেন। স্তবকটিতে বলা হয়েছিল উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ ২৫শে মার্চ থেকে ২রা এপ্রিল পর্যন্ত অযোধ্যাতে বিশাল রামনবমী মেলা যেমন হয় তেমনই হবে বলে জানিয়েছেন এবং আরও বলেছেন যে দেবতা রাম তার ভক্তদের করোনা ভাইরাস থেকে রক্ষা করবেন। সেখানে আচার্য পরমহংসকে সরকারি রাম মন্দির ট্রাস্টের প্রধান হিসেবেও উল্লেখ করা হয়[2]।
বরদারাজনের একটা ভুল হয়েছিল। রাম রক্ষা করবেন মন্তব্যটি যোগী আদিত্যনাথ করেননি। ওটি করেছিলেন আচার্য পরমহংস। ওই রিপোর্টে আচার্য পরমহংসকে যে সরকারি রাম মন্দির ট্রাস্টের প্রধান বলা হয়েছিল সেই তথ্যটিও ঠিক ছিল না। বরদারাজন এবং দি ওয়ার সুসাংবাদিকতার পাঠ অনুসরণ করে সেই ত্রুটি সংশোধন করে নেন[3]।
এখানে বলে রাখা দরকার অযোধ্যাতে পূর্বঘোষিত রামনবমী মেলাটি শেষ পর্যন্ত না হলেও প্রধানমন্ত্রী যেদিন দেশজুড়ে লকডাউন ঘোষণা করেন তার পরের দিনই যোগী আদিত্যনাথ অযোধ্যাতে একটি ধর্মীয় সমাবেশে যোগ দেন।
কিন্তু একজন পাঠকের এটা অবমাননাকর বলে মনে হল, এবং আরেকজন এটি পড়ে খুব ‘আহত’ হলেন। অতএব তাঁরা যথারীতি কর্তৃপক্ষের কাছে নালিশ ঠুকলেন। তারাও বরদারাজনের বিরুদ্ধে দাঙ্গা বা আতঙ্ক ছড়ানোর জন্য গুজব ছড়ানোর [ধারা ৫০৫(২), আইপিসি]; কম্পিউটার ব্যবহার করে কারও চরিত্রহনন এবং আন্তর্জালে অশ্লীল জিনিসপত্র ছড়ানোর [৬৬(ডি), আইটি অ্যাক্ট]; এবং একটি মহামারির সময় সরকারি কর্তৃপক্ষকে অমান্য করার [ধারা ১৮৮, আইপিসি] অভিযোগ আনলেন।
কেউ কেউ বলবেন আইন আইনের পথে চলুক। কিন্তু আমাদের দেশে বিচারপ্রক্রিয়াটাই শাস্তিস্বরূপ। এই মামলা বছরের পর বছর ধরে চলবে। এমনকি বরদারাজন যদি জামিনও পান তা সত্ত্বেও তিনি বাঁধা থাকবেন। তাঁকে বারবার কোর্টে হাজিরা দিতে হবে। বিচার মাঝেমাঝেই মুলতুবি হয়ে যাবে। এবং প্রতিটি রায়ের বিরুদ্ধে উচ্চতর আদালতে আবেদন করা চলতে থাকবে। একে যদি কেউ রাষ্ট্রীয় সম্পদের সুব্যবহার বলেন তবে তাঁকে মহান বলা ছাড়া আর উপায় কি!
এই ঘটনার সঙ্গে সঙ্গে আরও দুজনের কথা উল্লেখ করা জরুরি। আনন্দ তেলতুম্বড়ে এবং গৌতম নওলখা। এঁদের দুজনেরই আইনি আবেদন খারিজ হয়েছে এবং এঁদের গ্রেপ্তারিও সময়ের অপেক্ষা। এঁরা দুজনেই সেই ২০১৭ সালের মহারাষ্ট্রের এলগার পরিষদ বা ভীমা কোরেগাঁও মামলায় অভিযুক্ত। আনন্দ দলিতদের অবস্থা নিয়ে লেখালেখি করতেন এবং তাতে তিনি অতিডান এবং অতিবাম দুই পক্ষকেই সমালোচনা করতেন। অন্যদিকে গৌতম কাশ্মির নিয়ে লাগাতার লেখালেখি করে সমস্ত সরকারেরই শিরঃপীড়ার কারণ হয়েছিলেন। আরও বেশকিছু মানবাধিকারকর্মী যেমন— সুধা ভরদ্বাজ, অরুণ ফেরেইরা, ভার্নন গঞ্জালভেজ, ভারভারা রাও, সুধীর ধাওয়ালে, সুরেন্দ্র গ্যাডলিং, মহেশ রাউত, সোমা সেন এবং রোনা উইলসন— এক বছরেরও বেশি সময় ধরে জেলে বন্দি। এঁদের সবার মধ্যে একটাই মিল। এঁরা সবাই দলিত আদিবাসী সহ বিভিন্ন প্রান্তিক মানুষজন— উন্নয়নের ঢক্কানিনাদ যাঁদের কাছে পৌঁছয় তো না-ই, বরং যাঁরা এই তথাকথিত উন্নয়নের বলি হন— তাঁদের কথা বলতেন।
গোঁড়া মধ্যযুগীয় চিন্তাভাবনা যখন একটা স্থিতাবস্থা বজায় রাখতে চায় তখন সে তার আশেপাশের ঝোপঝাড়ের মধ্যে থেকে যে ডালগুলো মাথা ছাপিয়ে বেড়ে উঠেছে তাদেরকে ছেঁটে দেওয়ার চেষ্টা করে। তারা কেবল স্তাবকতা পছন্দ করে, প্রশ্ন নয়। এবং ভাবে এইভাবেই তাদের কল্পিত সাম্য বজায় থাকবে। আমাদের সৌভাগ্য যে আমরা এমন কিছু মানুষকে পেয়েছি যাদের আসলে সেই স্থিতাবস্থা বজায় রাখার পক্ষেই কাজ করার কথা ছিল, কিন্তু তাঁরা সেটাকেই চ্যালেঞ্জ করে বসেছেন। তাঁদেরকে দমন করা দেশকে আক্ষরিক এবং রূপক কোনও অর্থেই শক্তিশালী করে না।
১৯৩৯ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন রবার্ট ফ্রস্ট ‘একটি বিলক্ষণ আঁচড়’ (A Considerable Speck) কবিতায় লিখেছিলেন:
নিজের মাথা আছে বলেই চিনতে পারি
আসল মাথা মাঝে হরেক রকমারির
কেউ জানে না প্রলব্ধ হয় কী সন্তোষ
দেখতে পেলে লেখার খাতায় মাথার জোশ
ফ্রস্ট কালেক্টিভিজমের বিরোধিতা করেছিলেন। কারণ তার জন্য আনুগত্য প্রয়োজন হয়। আমাদের এই মুক্তচিন্তক সাংবাদিকরাও সেটাই করছেন। এডিটরস গিল্ড অফ ইন্ডিয়া বরদারাজন এবং তার স্ত্রীর বিরুদ্ধে এই পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য উত্তর প্রদেশ সরকারের সমালোচনা করেছে। বরদারাজন সম্পর্কে যতদূর জানা যাচ্ছে তিনিও আদৌ ভয় পাননি। বরং তিনি মনে করিয়ে দিয়েছেন “এই শমন হল গোটা ভারতের মিডিয়ার জন্য একটা ওয়েক আপ কল বিশেষ। যে সময় খোদ প্রধানমন্ত্রীও প্রকাশ্যে বলছেন যে সরকারের এখন একমাত্র একটাই কাজ– মানুষকে এই মারণ ভাইরাসের হাত থেকে রক্ষা করা, সেই সময়ে রাজ্য সরকারগুলি মিডিয়াকে টার্গেট করাটাকেই প্রধান কাজ হিসেবে নিয়েছে। এর থেকেই মিডিয়া তো বটেই, সাধারণ মানুষেরও বোঝা উচিত যে আমাদের গণতান্ত্রিক স্বাধীনতা আসলে কতটা ঠুনকো।”
[1] https://thewire.in/health/as-covid-19-cases-spike-nehru-stadium-in-delhi-to-be-converted-to-quarantine-centre
[2] On the day TablighiJamaat event was held, Acharya Paramhans, head of the official Ram temple trust, Adityanath insisted a large Ram Navami fair for Ayodhya from March 25 to April 2 would proceed as usual and that Lord Ram would protect devotees from the coronavirus.
[3] Note: In an earlier version of the story, the quote about Ram saving devotees from the coronavirus was wrongly attributed to Yogi Adityanath. It was in fact said by Acharya Paramhans. This clarification initially described him as head of the Ayodhya temple trust; he is in fact an Ayodhya based sadhu active in the Ram temple movement. Another sadhu, Ramchandra Paramhans was earlier head of the Ramjanmabhoomi Nyas. The head of the official Ayodhya Temple Trust is Mahant Nritya Gopal Das, and he too had said the coronavirus would not affect those who would come to Ayodhya for Ram Navami with love and devotion, as quoted by Aajtak:
“महंत नृत्य गोपाल दास ने रामनवमी पर लोगों को अयोध्या आने का न्योता दिया है. महंत नृत्य गोपाल दास ने कहा कि रामनवमी की भीड़ जैसे हर साल होती है उसी तरह इस साल भी होगी. उन्होंने कहा कि रामनवमी की भीड़ से इस बीमारी का कोई संबंध नहीं है. ये बीमारी अलग है और रामनवमी में आने वाले भक्तों की भीड़ अलग है.
महंत नृत्य गोपाल दास का कहना है कि जिस प्रकार प्रेम और श्रद्धा से रामनवमी में भक्त आते थे उसी तरह से आएं, घबराने की कोई बात नहीं है. श्रीराम जन्मभूमि ट्रस्ट के अध्यक्ष महंत नृत्य गोपाल दास ने कहा कि ये बीमारी दूसरों के लिए है, आपके लिए नहीं है.