রেজাউল করীম
লেখক চিকিৎসক ও প্রাবন্ধিক
আজ আমরা ইতিহাসের সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে আছি। অনাদিকাল ধরে মানুষের ইতিহাসে লেখা থাকে বিজয়ের ইতিহাস। মানুষ সেখানে গৌণ, মানুষের তিল তিল করে গড়ে তোলা সভ্যতার কোনও ছাপ সেখানে থাকে না। এই নতুন ইতিহাস এমন রচনা যাতে মানুষের সভ্যতা, সংস্কৃতি, দৈনন্দিন টানাপোড়েন, শ্রম, নান্দনিকতা ও মূল্যবোধের দলিল তৈরি হচ্ছে। এ কোনও বিজয়ীর ইতিহাস নয়, এ ইতিহাসে লেখা থাকছে অজানা দস্যুর বিরুদ্ধে মানবতার যুদ্ধের ইতিহাস। এই যুদ্ধের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হল— অদৃশ্য এই শত্রুর সাম্যবাদী আক্রমণ পদ্ধতি। অতীতে এইরকম অনেক আক্রমণ মানবজাতিকে বিপদের মুখে ফেলেছে— সেই আক্রমণে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে দরিদ্র মানুষ, সভ্যতার চাকায় পিষ্ট মানুষ অজানা শত্রুর কাছে আত্মসমর্পণ করেছে।
করোনা নানা দিক থেকে তাই আলাদা, এর মারণ ক্ষমতা যত কমই হোক, চরিত্রগত দিক থেকে পুরোপুরি স্বতন্ত্র। তাই, বিশ্বব্যাপী মানবজাতি ঐক্যবদ্ধভাবে তাকে প্রতিহত করার চেষ্টা করছে, কোনও রাজনৈতিক গণ্ডি এখন পর্যন্ত তাকে বিপথগামী করতে পারেনি।
প্রমিথিউস যখন জিউসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন, তখন তাঁর মনোগত ইচ্ছা ছিল “I wish no living thing to suffer pain”। জিউস ছিলেন অভিশপ্ত কারণ সর্বংসহা পৃথিবীর কান্নার কারণ ছিলেন তিনি “I curse thee! let a sufferer’s curse Clasp thee, his torturer, like remorse”। শেলী বা এসকাইলাসের কাব্যে প্রমিথিউসের যে কাহিনি সে কল্পকথা হলেও পৃথিবীতে বারবার তার দেখা মেলে। সমগ্র মানবজাতি যখন যেকোনও ব্যাথা, জরা, মৃত্যুর ভারে থরথর তখন ডেমোগর্গন হাজির হয়ে নতুন রূপে, নতুনভাবে। সব হিসেব সে এলোমেলো করে দিতে চায়। প্রাচীন ধর্মীয় সাহিত্যে তাকে লোভ, মোহিনী মায়া, desire যে নাম দিক না কেন, সব যুদ্ধে সে ভিলেন হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে।
করোনা যুদ্ধেও সে এসেছে নতুনভাবে— এক অর্থে ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি। সহজ হিসেব জটিল করে লোভের আর ক্ষমতার নতুন ইতিহাস রচনা করার প্রয়াস। নতুন যুগে তার বহিঃপ্রকাশ যা আলাদা, না হলে ফলাফলে সে আদি ও অকৃত্রিম। করোনার থাবা যখন প্রথম এসে পড়ল তখন পেশাদার মানবতাবিরোধী সভ্যতার পুরীষপ্রেমী কলমচির দল তার নাম দিল চায়না ভাইরাস— উহানে তার দেখা মিলেছে বলে। কিম্বা হতে পারে চিনের নাম শুনলেই পুঁজিবাদী ব্যবস্থার মনে পড়ে মাও সে তুঙের কথা! অথচ, ইতিহাসের ছাত্রের জানার কথা, ৫০০০ বছর আগের মহামারির চিহ্নবাহী যে গণকবর পাওয়া গেছে তাও ওই উহানের। তারপরও একের পর এক বৈজ্ঞানিক প্রবন্ধে উল্লেখ করা হয়েছে, করোনা ভাইরাসের সাম্প্রতিক স্ট্রেন ল্যাবরেটরিতে সৃষ্ট নয়। সে নিজেকে বারবার বদল ঘটিয়ে তার সংক্রমণ ক্ষমতা বাড়িয়ে নিয়েছে মাত্র। ইতিহাসের ছাত্রদের এটাও জানার কথা যে মানুষ ও পশু যখনই তাদের স্বাভাবিক বাসস্থানচ্যুত হয়েছে, যখন সেই চ্যুতি বহু মানুষকে একসঙ্গে আক্রান্ত করেছে, যখন প্রকৃতি মানুষের বিরামহীন অত্যাচারে ক্ষতবিক্ষত হয়েছে তখনই মহামারি এসেছে। গত কয়েক হাজার বছরের লিখিত সভ্যতার ইতিহাসে এরকম অন্তত কুড়িটি মহামারি এসেছে যা মানবসভ্যতার এক তৃতীয়াংশ ধূলিসাৎ করেছে। তার সঙ্গে লেখা আছে মানুষের জিঘাংসার ইতিহাস। এই মহামারি তাই নতুন কিছু নয়, এ হল মানুষের লোভ, জিঘাংসা আর সম্মিলিত নির্বুদ্ধিতা আর তার উৎকট মুষলপ্রসব।
আক্রমণের সাময়িক ধাক্কা সামালের জন্য প্রথমদিকে মানবজাতির ঐক্যের যে ডাক শোনা গেছিল ধীরে ধীরে তার স্বর যেন ক্ষীণ হতে চলেছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা সারা বিশ্বে রোগব্যাধি মোকাবিলার নিয়ামক সংস্থা। অতীতে যখন এবোলা, সার্স ও মার্স, বিশেষত এবোলার আক্রমণে তৃতীয় বিশ্ব পর্যুদস্ত তখন এই সর্বোচ্চ নিয়ামক সংস্থা সংক্রমণ-শৃঙ্খল ভাঙার যে ডাক দিয়েছিল তা নিয়ে প্রথম বিশ্ব নিশ্চুপ ছিল। সিয়েরা লিওন বা লাইবেরিয়ার নিপীড়িত জনগণের হয়ে কেউ মুখ খোলেননি। ইওরোপ ও উত্তর আমেরিকার বিরুদ্ধে কেউ তোপ দাগেননি। কেউ বলেননি যে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা যথেষ্ট কর্মক্ষম নয়, কেউ বলেননি যে এই সংস্থা বিশ্বকে বিপথে চালিত করেছে। করোনা দমনে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সক্রিয়তা নিয়ে আমেরিকা প্রশ্ন তোলার পর ভারত সহ অনেক তৃতীয় বিশ্বের দেশ তার খুঁত খুঁজতে শুরু করেছে। অথচ, আমেরিকার উদ্দেশ্যে এই সংস্থার সর্বপ্রথম সতর্কবাণী ঘোষিত হয়েছে ১২ই জানুয়ারি। ৮৯ দিন পরে আমেরিকার রাষ্ট্রপতির মনে হল যে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা চিন-ঘেঁষা। তাঁর এদেশি সৈন্যসামন্ত অতঃপর হোয়াটস্যাপ বিশ্ববিদ্যালয় জুড়ে প্রচারের ঢল নামাল— টেডরোস চিনের দালাল। টেডরোসের জীবনপঞ্জিতে লিপিবদ্ধ আছে তিনি পিপলস লিবারেশন ফ্রন্টের নেতা। সেই সংগঠন গোপন বিপ্লবী সংগঠন নয়। একজন মানুষ যিনি একটি দরিদ্র দেশে স্বাস্থ্যক্ষেত্রে বিপ্লবের সূচনা করেছেন। তাঁর কার্যকালে তিনি সারা বিশ্বের প্রশংসা কুড়িয়েছেন। আমেরিকার মৃত্যু মিছিলের দায় কাঁধ থেকে ঝেড়ে ফেলার জন্য ট্রাম্পের দরকার ছিল একজন আসামি। তাই, টেডরোসের বিরুদ্ধে লড়াই, তাই বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাকে অর্থ না দেওয়ার প্রতিজ্ঞা। যদিও, আমেরিকার দেয় অর্থের প্রায় অর্ধেক আফ্রিকার দেশগুলি ইতিমধ্যে জোগাড় করে ফেলেছে। তাই, বলছিলাম প্রমিথিউস যুগে যুগে ফিরে আসে, জিউসরাও ফিরে আসে নব নব রূপে।
এদেশের অবস্থার অবশ্য কোনও হেরফের নেই। বিশ্ব্যব্যাপী মিথ্যা খবরের যে কারবার চলে, ভারত তার রাজধানী বললে অত্যুক্তি হয় না। প্রথমে হোয়াটস্যাপ বিশ্ববিদ্যালয় খবর দিল এই চায়না ভাইরাস এসেছে চাইনিজদের হাত ধরে। রাজধানী দিল্লি, বাঙ্গালোর, এমনকি সম্প্রীতির রাজধানী কলকাতাতেও দু একজন চিনা অভিবাসীর উপর চোরাগোপ্তা আক্রমণ হল। বিশেষ সুবিধা হবে না দেখে শুরু হল তবলিগ ও মুসলমান সম্প্রদায়ের উপর দোষারোপের খেলা। কেন্দ্রীয় সরকারের প্রত্যক্ষ মদতে শুরু হল করোনার সাম্প্রদায়িকীকরণ। অথচ, সবাই জানেন এই ভাইরাস আক্রমণ শুরু হয়েছে বিদেশিদের হাত ধরে। ধর্ম, সম্প্রদায়, ধনী, নির্ধন নির্বিশেষে সবাই তার ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলেছে এইভাবে সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিকোণ থেকে এই সমস্যা নিয়ে আলোচনা করা উচিত নয়। তা সত্ত্বেও, এই প্রোফাইলিং চলছে। কারণ ভোটার বাজারে এর দাম আছে। প্রশ্ন অনেক। মার্চ মাসের দু তারিখ থেকে ১৪ এপ্রিল পর্যন্ত মন্দির, মসজিদে যত জমায়েত হয়েছে তাদের প্রোফাইলিং না করে শুধু একটা সুনির্দিষ্ট ক্লাস্টার নিয়ে সরকার আলাদা করে ভাবছে কেন? সারা দেশ জুড়ে সব উপসর্গযুক্ত মানুষের টেস্ট হচ্ছে না কেন? ইওরোপ বা এমনকি সিঙ্গাপুরে যত টেস্ট হয়েছে আমাদের দেশে তার ২৪১ ভাগের এক ভাগ হচ্ছে। সেই অত্যল্প টেস্ট করে কি দেশে সংক্রমণের প্রকৃত সংখ্যা জানা সম্ভব? কেন্দ্রীয় সরকার একদিকে একটি সম্প্রদায়ের যেকোনও এক বা একাধিক মানুষের জমায়েতের জন্য নানারকম বিবৃতি দিয়ে আকারে ইঙ্গিতে তাকে একটি সাম্প্রদায়িক রূপ দেওয়ার চেষ্টা করে চলেছেন এমন সময়ে যখন লক্ষ লক্ষ শ্রমিক রাস্তায় সংঘবদ্ধ ভাবে হেঁটে বাড়ি ফিরে আসার চেষ্টা করছেন। সেই চেষ্টা করতে গিয়ে প্রায় ২০০ জন ইতিমধ্যে মারা গেছেন। তাদের করোনা পরীক্ষা হয়েছে কি?
ভারতবর্ষের লকডাউন ঘোষণা হয়েছে। তারপরও অবাধে মানুষ বাজারে, মন্দিরে, মসজিদে জমায়েত করছেন। একজন মুখ্যমন্ত্রী স্বয়ং দলবল নিয়ে পুজো করেছেন। একজন প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রীর বাড়ির বিয়ের অনুষ্ঠানে একজন বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী উপস্থিত থেকেছেন। কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য সচিব সে সবের ব্যাপারে মুখ খোলার প্রয়োজন বোধ করছেন না।
তবলিগ জামাতের ঘটনাটি অত্যন্ত নিন্দনীয় ও ক্ষমার অযোগ্য অপরাধ। কিন্তু সেই অপরাধ সংঘটিত হয়েছে পুলিশের নাকের ডগায় ও তাদের সম্মতিতে। তাই, ঘটনার কথা জানা থাকলেও ডিএমসি বা সরকার কেউ কোনও ব্যবস্থা নেননি। কেন? এমনকি জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অভিযুক্ত ব্যক্তিদের সঙ্গে উপস্থিত হয়ে আলোচনা করেছেন। এই ঘটনার বিচার বিভাগীয় তদন্ত হওয়া উচিত ও নিরাপত্তা উপদেষ্টার ভূমিকারও মূল্যায়ন হওয়া দরকার।
গতকাল পর্যন্ত করোনা মোকাবিলায় সরকারের ভূমিকা সন্তোষজনক নয়। সরকার লকডাউনে আস্থাশীল। অথচ, লকডাউন যদি সাফল্যমণ্ডিত করতে হয় তাহলে যেসব কাজ করতে হবে সেগুলি নিয়ে তাদের কোনও আগ্রহ নেই।
১) লকডাউন প্রকৃতপক্ষে, মহামারি বিলম্বিত করে। সেই বিলম্ব ব্যবহার করে সরকারের উচিত সব ক্লাস্টার চিহ্নিত করা। চিহ্নিত করার জন্য প্রতি লাখে অন্তত ১৫০০ বা তার বেশি জনের পরীক্ষা করা দরকার। এখন পর্যন্ত প্রতি লাখে মাত্র ১১ জনের পরীক্ষা হয়েছে।
২) লকডাউনের একক সাফল্য নির্ভর করছে মানুষের দৈনন্দিন চাহিদা পূরণের জন্য সরকারি কার্যক্রমের ওপর। বাড়িতে বাড়িতে খাদ্যশস্য পৌঁছে দেওয়া তার একটি অন্যতম পদক্ষেপ। সরকারি গুদামে উপচে পড়া খাদ্য সম্ভার আর বাড়িতে বাড়িতে অভুক্ত মানুষের সারি, না, এ কোনও গ্রহণযোগ্য পন্থা হতে পারে না।
৩) সব অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বন্ধ হয়ে দিন-আনা দিন-খাওয়া মানুষের জন্য যে সমস্যা তৈরি হয়েছে কেবল খাদ্যশস্য দিলেই তার অবসান হবে না। সরকারের উচিত পাশাপাশি তাদের হাতে অর্থ পৌঁছে দেওয়া। PM Cares-এ ইতিমধ্যে কয়েক হাজার কোটি টাকা জমা পড়েছে। মানুষের হাতে এক টাকাও পৌঁছয়নি।
করোনা সংক্রমণের আগে এনআরসি-র জন্য সরকার হাজার হাজার কোটি টাকা যোজনা করার ঘোষণা করেছিলেন। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ঘোষনা করেছিলেন, খুঁজে খুঁজে সব বিদেশিদের বার করে ডিটেনশন ক্যাম্পে বন্দি করবেন। তার জন্য যে পরিকাঠামো দরকার তার অভাব নেই বলেছিলেন। সেই পরিকাঠামো ব্যবহার করে খুঁজে খুঁজে ভাইরাস মারতে অসুবিধা কোথায়? দৃশ্যত একটাই অসুবিধা। সেটি হল— ঘোষককেই বিগত মাসখানেক হল খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।
সারা দেশে যত রোগী এখন পর্যন্ত পাওয়া গেছে তার সঙ্গে প্রতিদিন আরও প্রায় হাজার খানেক করে যোগ হচ্ছে। নতুন কেস খুঁজে বের করার জন্য যে টেস্ট দরকার তা অপ্রতুল। তবু, এ থেকে কয়েকটি সাধারণ সিদ্ধান্ত করা যায়:
১) সারা দেশে যত টেস্ট হয়েছে তার কেস পজিটিভিটি ৩-৫ শতাংশ। নতুন কেস পজিটিভিটি প্রায় ৪ শতাংশ।
২) মৃত্যুহার প্রায় ৩ শতাংশ।
৩) ব্যাপক হারে টেস্ট করলে যে বিপুল সংখ্যক নতুন রোগী পাওয়া যেতে পারে তার জন্য প্রয়োজনীয় পরিকাঠামোর অভাব আছে। সরকার ইতিমধ্যে ৫০,০০০ নতুন ভেন্টিলেটার কিনবে ঠিক করেছে। অনেক হাসপাতালে নতুন করোনা ওয়ার্ড তৈরি হয়েছে।
৪) সংক্রমণ ও মৃত্যুহারের যে আন্তর্জাতিক রূপ দেখা গেছে তা এখন পর্যন্ত তার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ।
৫) কেন্দ্রের তরফে সরাসরি সব ডেটা পাবলিক ডোমেনে রাখা আছে। কোনও রকম লুকোচুরি করা হচ্ছে না।
পাশাপাশি এই রাজ্যের চিত্রটি পুরোপুরি আলাদা।
১) এই রাজ্যে মোট সক্রিয় পজিটিভ কেস+নিষ্ক্রিয় পজিটিভ কেস ও মৃতের যে তালিকা দেওয়া আছে তার বাইরে অনেক রোগী আছে যাদের অবস্থা নিয়ে কারও কাছে স্পষ্ট ধারণা নেই। এরকম কেসের সংখ্যা মোট মৃত্যুর অন্তত চারগুণ।
২) এই রাজ্যে (ও আরও কয়েকটি রাজ্য বা শহরে) কোভিড মৃত্যুর সার্টিফাইং কমিটি তৈরি হয়েছে। এই কমিটি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ঘোষিত নিয়মের পরিপন্থী ও বেআইনি।
৩) এই রাজ্যে সবচেয়ে কম সংখ্যক মানুষের পরীক্ষা হয়েছে। প্রতি লাখে মাত্র ৫ জনের পরীক্ষা হয়েছে এই রাজ্যে। যদিও এই রাজ্যের কেস পজিটিভিটি প্রায় ৬.৯ শতাংশ ও নতুন কেস পজিটিভিটি প্রায় ৭.৫ শতাংশ।
৪) এই রাজ্যের অনেক এলাকায় লকডাউন সফল করার ব্যাপারে সরকারের সদিচ্ছার অভাব আছে। কোনও কোনও সংখ্যালঘু ও অবাঙালি এলাকায় লকডাউন আদৌ হচ্ছে না বলে অনেকে অভিযোগ করেছেন।
৫) লকডাউনের সময় রেশনে খাদ্য সরবরাহ ও তার বণ্টন ব্যবস্থা দুর্নীতিমুক্ত নয় বলে অভিযোগ।
করোনা মোকাবিলায় সরকারের ভূমিকা তাই আতসকাচের তলায়। এরকম একটি মহামারি মোকাবিলায় সরকারের উচিত হাজার হাজার পরীক্ষা করা। দুঃখের বিষয় সরকারের পরামর্শদাতা কমিটির মধ্যে উপযুক্ত জনস্বাস্থ্য বিশারদ নেই। যাদের মাধ্যমে কাজ করানো হচ্ছে তারা সরকারের তল্পিবাহকের কাজ করছেন বলে অনেকের মত। আরেকটি অত্যন্ত গুরুতর বিষয় হল— মৃত্যুর সংখ্যা কম করে দেখানো। করোনায় মৃত্যু হয় কো-মরবিডিটির জন্য। তাই, বয়স্ক, প্রতিরোধ অক্ষম, ক্যানসারের রোগী এর সহজ শিকার। কো-মরবিডিটির জন্য মৃত করোনার জন্য মৃত থেকে আলাদা করলে সরকারের লাভ হতে পারে, আক্রান্ত ও মৃতের কিন্তু তাতে পুরোপুরি ক্ষতি। করোনার মৃত্যু ও চিকিৎসার খরচ ইন্স্যুরেন্সের তালিকাভুক্ত। এই মৃত্যু আলাদা করা মরার উপর আক্ষরিক অর্থে খাঁড়ার ঘার নামান্তর।
পাশাপাশি চিকিৎসক ও চিকিৎসা কর্মীদের সুরক্ষার প্রশ্ন এর সঙ্গে জড়িত। এই রাজ্যে অত্যল্প পরীক্ষার জন্য অসুস্থ মানুষ যে কোনও হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য হাজির হচ্ছেন। করোনা পরীক্ষার কোনও বিধিবদ্ধ ব্যবস্থা না থাকার ফলে একের পর এক স্বাস্থ্যকর্মী আক্রান্ত হচ্ছেন ও হাসপাতালও বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। প্রায় ত্রিশ জন স্বাস্থ্যকর্মী ইতিমধ্যে আক্রান্ত ও ছয় সাতটি হাসপাতাল আংশিক বা পুরোপুরি বন্ধ করে দিতে হয়েছে। উহানে প্রাথমিক অবস্থায় ঠিক এই ঘটনা ঘটেছিল। মোট ১২০০০ চিকিৎসক ও চিকিৎসা কর্মী তখন সংক্রমণের শিকার হয়েছিলেন। তখন, অসুখের প্রাথমিক ধাক্কায় বেসামাল ছিল প্রশাসন। প্রায় চার মাস পরে ২২ লাখ কেসের অভিজ্ঞতা আমাদের শিখিয়েছে কীভাবে এর মোকাবিলা সম্ভব।
এই রাজ্যে অবশ্য অতীত ত্রুটি থেকে শিক্ষাগ্রহণের কোনও ইচ্ছা নেই। ডেঙ্গুর সময় আমরা বারবার সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছি যে রাপিড টেস্ট করে যত বেশি সন্দেহজনক রোগী নির্ণয়ের সুবিধা থাকবে তত সাধারণ মানুষ সুরক্ষিত থাকবেন। তখন রাপিড টেস্ট ছিল সরকারের চক্ষুশূল। এখন রাপিড টেস্ট মেনে নিয়েও তা রূপায়ণে গড়িমসি করছেন।
সরকারের ধারণা যত কম কেস দেখানো যায় তত ভালো। বলা বাহুল্য, এর পেছনে যে সীমাহীন অশিক্ষা ও নির্বুদ্ধিতা আছে তা বলার জন্য কোনও যোগ্য লোক প্রশাসন বা বৌদ্ধিক জগতে নেই, অন্তত এই রাজ্যে নেই। সরকারের সাফল্য বেশি সংখ্যক কেস খুঁজে বার করার মধ্যে। তারপর তার জন্য আইসোলেশন ও চিকিৎসার ব্যবস্থা চিকিৎসকদের হাতে ছেড়ে দেওয়া উচিত। কোনও কমিটি বা নতুন নিয়ম অবতারণা করে চিকিৎসকদের উপর অহেতুক প্রশাসনিক চাপ তৈরি করা বিপর্যয় মোকাবিলার মূল সূত্রের বিরোধী।
আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল চিকিৎসক ও চিকিৎসা কর্মীদের সুরক্ষার প্রশ্ন। সুরক্ষাবর্মগুলি একবার ব্যবহার করে ফেলে দেওয়া দরকার। সারা দেশে প্রতিদিন পাঁচ লক্ষ এইরকম disposable PPE দরকার। এই রাজ্যে দরকার প্রায় হাজার ত্রিশ। এখন পর্যন্ত ১২০০০ এমন সরঞ্জামের ব্যবস্থা হয়েছে। ফলে অনেকে সার্জিক্যাল মাস্ক পরেই করোনা মোকাবিলায় নামছেন।
সরকার রাতারাতি সবকিছু ব্যবস্থা করে ফেলবেন এমন আশা করা ঠিক হবে না। কিন্তু, অহেতুক চিকিৎসকদের ব্যাপারে নাক না গলিয়ে সরকারের উচিত সরবরাহ অক্ষুণ্ণ রাখা ও চিকিৎসার সঙ্গে যুক্ত মানুষের মনোবল অটুট রাখতে সাহায্য করা। প্রচুর টেস্ট করতে পারলে আমরা এই বিপদ থেকে উদ্ধার পাব। সর্বস্তরের মানুষের কাছে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে শক্তি সংহত করার চেষ্টা করতে হবে। সরকারকেই অগ্রণী হয়ে সবার সহযোগিতা কামনা করতে হবে।