নীলিম
“পলিটিকাল ইকনমির চোখে প্রোলেতারিয়েত, অর্থাৎ সর্বহারা শ্রমজীবী হল ঘোড়ার মতো কর্মক্ষমতা বজায় থাকার জন্যে তার যতটা দরকার সে কেবল ততটাই পাবে। যখন সে কাজ করছে না তখন আর তাকে মানুষ বলে বিবেচনা করার দরকার নেই।”
-কার্ল মার্কস-
(ইকনমিক অ্যান্ড ফিলজফিক্যাল ম্যানুস্ক্রিপ্টস)
সম্ভবত ‘লকডাউন’ এর সাইড এফেক্ট হিসেবে পৃথিবী জোড়া দূষণ কমে যাওয়ায় শুধু ইউরোপ নয় সারা পৃথিবীতেই আবার কমিউনিজমের ভুত দেখা দিয়েছে। আগামীকাল লেনিনের দেড়শতম জন্মদিবস। লেনিন একবার বলেছিলেন “পুঁজির শাসন হলো অন্তহীন ভয়াবহতা”। যা আমরা প্রত্যক্ষ করে চলেছি আমাদের দেশে ‘লকডাউন’ শুরু হওয়ার পর থেকে। যাদের পরিযায়ী শ্রমিক হিসেবে দেখা গেছিল দিল্লির আনন্দবিহার বাসস্ট্যান্ড থেকে দেশের হাইওয়ে ধরে হাঁটতে তাদের আমরা খুব একটা যদিও দেখতে পাই না আমাদের দৈনন্দিনতায় তবু তাদের দাম ছিল কোম্পানি, ঠিকাদারদের কাছে। ‘লকডাউন’ শুরু হওয়ার সাথে সাথেই তারা হয়ে গেলেন ‘অতিরিক্ত’। কাজ হবে না তাই তাদেরও দাম নেই। তারপর থেকে লেনিন কথিত ‘অন্তহীন ভয়াবহতা’র স্বরূপ ফুটে উঠলো দেশ জুড়ে।
সামাজিক বৈষম্য বিষয়ক গবেষক কনিকার সংগৃহীত তথ্য অনুযায়ী ‘লকডাউন’ শুরু হওয়ার পর থেকে ১৯শে এপ্রিল পর্যন্ত মারা গেছেন ৪৯৬ জন শ্রমিক!! শুধুমাত্র অনলাইনে খবর সার্চ করে আর কিছু এলাকার থেকে পাওয়া খবরের ওপর ভিত্তি করেই এই রিপোর্ট তৈরি করছেন কনিকা। ফলে এটা ধরে নেওয়াই যায় যে ‘অন্তহীন ভয়াবহতা’র সামগ্রিক চিত্র তার পক্ষে তুলে ধরা সম্ভব নয়। আর সেটা সম্ভব নয় বলেই বোঝা যায় এই ভয়াবহতা সত্যিই অন্তহীন। আসলে ‘লকডাউন’ ঘোষণা করার আগে এদের কথা রাষ্ট্র ভাবার প্রয়োজন বোধ করেনি। আর যারা ‘করোনা’য় মরার ভয়ে সিঁটিয়ে ছিলাম(এখনও আছি) তাদের কেউ কেউ মুখে শ্রমিক-কৃষকদের কথা বললেও আসলে আমাদের জীবনবোধে যে এরা অনুপস্থিত তার প্রমাণ ‘লকডাউন’কে আমাদের সোচ্চারে সমর্থন। ‘স্টে হোম সেভ লাইফ’ এর প্রোফাইল পিকচার ফেসবুকে ডিপি করে বসে থাকা আমাদের মাথাতেও আসেনি যে এই বাড়ি যারা বানিয়েছেন তারা রাস্তাতে হাঁটছেন। যদিও ‘করোনা’র কোনো ওষুধ না থাকা সত্বেও এতে মারা যাওয়ার চেয়ে সেরে ওঠার সংখ্যা এতে তিনগুন(এই দেশে) তাও আমরা ‘মহামারী’ তে মরার ভয়ে স্বচ্ছন্দে রাষ্ট্রের সুরে সুর মেলালাম। রাষ্ট্রের এই ‘লকডাউন’ এর পেছনে যে উদ্যেশ্যই থাক আমাদের যা ছিলো তাকে রাজনৈতিক বোধহীন স্বার্থপরতা বাদে আর কিচ্ছু বলা যায় না। এঙ্গেলস একজায়গায় ‘সামাজিক হত্যা’ বলে একটা কয়েনেজ ব্যবহার করেছিলেন। যার ব্যাখ্যায় তিনি বলেছিলেন ” রাজনৈতিক এবং সামাজিক অভিজাতরা সচেতনভাবে এমন একটা অবস্থা তৈরী করে যেখানে সমাজের দরিদ্র এবং প্রান্তিক জনগণ জীবনের সমস্ত প্রয়োজনীয়তাগুলির থেকে বঞ্চিত হয়ে এমন একটা পরিস্থিতের মুখোমুখি হয় যখন তাদের থেকে হয় বেঁচে থাকা প্রত্যাশা করা যায় না নয়তো তাদের জন্য অপেক্ষা করে থাকে অকাল এবং অস্বাভাবিক মৃত্যু”। রাষ্ট্র এবং আমরাই বোধহয় এই সময়ের ‘রাজনৈতিক এবং সামাজিক অভিজাত’।
মার্কসের যে কথা দিয়ে শুরু করেছিলাম তার প্রমাণ শুধু পরিযায়ী শ্রমিকেরাই বহন করছেন তা নয়। এই রাজ্যের জুট মিলগুলির দিকে তাকালেও তারই প্রমাণ দেখতে পাবো। সর্বভারতীয় ‘লকডাউন’ এর ২ দিন আগেই এই রাজ্যে ‘লকডাউন’ ঘোষণা হয়েছিল। এই পুরো সময়টায় কেন্দ্রীয় সরকার এবং রাজ্য সরকার উভয়েই কোম্পানিগুলি আর ঠিকেদারদের উপদেশ দিয়েই দায় সেরেছে যে শ্রমিকদের মজুরি দিয়ে দিন। কোনো নির্দেশ জারি করে নি। কোম্পানি বা ঠিকেদারেরা প্রোডাকশন বন্ধ হওয়ার সাথে সাথেই শ্রমিকদের প্রতি সমস্ত দায় থেকে হাত ঝেড়েছে। যদিও প্রোডাকশন চালু থাকাকালীনও শুধু শ্রমিক এবং তার পরিবারের বেঁচে থাকা টুকু বাদে আর কোনো দায় দায়িত্ব যে এরা কোনোদিনই পালন করবে না সেটাও মার্কস বলে গেছিলেন বহু আগে। প্রোডাকশন বন্ধ থাকলে সেই দায়টাও ঝেড়ে ফেলা হয়। ‘লকডাউন’ এর মজুরির কথা তো ভুলে যাওয়াই ভালো নিজের পিএফের টাকা শ্রমিকেরা তুলতে গিয়ে দেখে তার যা পদ্ধতি তাতে টাকা তোলার আপ্লিকেশন ঠিকঠাকভাবে জমা পড়তেই অধিকাংশ শ্রমিকের তিন চারবার আপ্লিকেশন বাতিল হবে, আবার নতুন করে করতে হবে। সব একবারে যদি ঠিকঠাক করা যেত তাও কম করেও ৭ দিন লাগতো টাকা ‘ইপিএফও’র একাউন্ট থেকে শ্রমিকের একাউন্টে যেতে। এটাও এক দারুন ফান্ডা। টাকা ব্যাঙ্কের থেকে ব্যাঙ্কেই যাবে। শ্রমিকের হাতে নগদ পৌছবে কমই। ফলে মুদ্রা নামক ‘সার্বজনীন-সর্বশক্তিমান’ পণ্যটি রয়ে যাবে ব্যাঙ্ক পুঁজির আওতাতেই। শিল্প পুঁজি আর ব্যাঙ্ক পুঁজির মেলবন্ধনে গড়ে ওঠা লগ্নি পুঁজির হাতেই যাবতীয় ক্ষমতা ও নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্রীভূত, যেমন লেনিন ব্যাখা করেছিলেন। সেই ‘অন্তহীন ভয়াবহতা’ও পাল্টায় নি, সেই ক্ষমতা এবং নিয়ন্ত্রণের কেন্দ্রীভবনও পাল্টায় নি।
মজুরির প্রশ্নই যে নেই তাতো আগেই আলোচনা হলো। যখনই কেন্দ্রীয় সরকার জুট মিল খোলার জন্য চাপ দিল আর রাজ্য সরকার মিল খোলার অনুমতি দিল তখনই কোম্পানিগুলির ‘দায়িত্ববোধ’ উথলে উঠলো শ্রমিকদের প্রতি। মিল গেটে নোটিশ পড়লো “শ্রমিকদের সমস্যার কথা মাথায় রেখে” কোথাও এডভ্যানস হিসেবে ৫০০০ কোথাও ৪৫০০ টাকা দেওয়ার তো কোথাও ৫কেজি চাল, ২কেজি আলু দেওয়ার। লক্ষ্য করুন, ‘এডভ্যানস’, মজুরি নয়। ‘এডভ্যানস’ মানে একধরনের দাদন প্রথা। এডভ্যানস শোধ না হওয়া অবধি লাইন ছুটি পাওয়ার রাস্তা বন্ধ, মেডিকেল ছুটি পাওয়ার রাস্তাও বন্ধ। এই এডভ্যানস এর রাজনীতি জুট মিলে নতুন নয়। একবার এডভ্যানস নিলে অন্তত ৫-৬ মাসের চাপ। কারণ প্রতি ১৫ দিনের মজুরি থেকে কাটা হবে এডভ্যানসের টাকা। আরও খেয়াল করুন মজুরির অধিকার থেকে কিন্তু বঞ্চিত করা হচ্ছেই। আর কোম্পানির অনুগ্রহ হিসেবে দেখানো হবে এডভ্যানস এর রাজনীতি কে। এগুলো করতে হবে দুটি কারণে। প্রথমত, মিল খুলতে হবে, শ্রমিক কাজ করবে, প্রোডাকশন চালু হবে, তাই শ্রমিককে মানুষ ভাবতে হবে এবার। যেটা এই কদিন ভাবার দরকার ছিল না। তাই মিল চালু হওয়ার আগে রাতারাতি দান খয়রাত আর এডভ্যানস এর রাজনীতি। দ্বিতীয়ত, শ্রমিকের মর্যাদাবোধে আঘাত হানতে হবে, তাই ত্রান-অনুদানের রাজনীতি। শ্রমিকের ওপর মর্যাদাহীনতা-অধিকারহীনতার হেজিমনি কায়েম করে তাদের নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। ত্রান-অনুদানের রাজনীতির সাথে এডভ্যানস সুন্দরভাবে শাসকের রাজনৈতিক অর্থনীতিকে তুলে ধরবে, চ্যাম্পিয়ন করবে। এই ছিলো পরিকল্পনা।
মিল চালু হওয়ারও শর্ত আছে। ১২ ঘন্টার দুটি শিফট। আর এই শর্তে বড় ইউনিয়নগুলির খুব আপত্তি আছে বলে মনে তো হচ্ছে না। যেমন মজুরির দাবীতে বিক্ষোভ ডেকেও তাদের টিকিটিও দেখতে পাননি শ্রমিকেরা এই বিষয়েও একই ব্যাপার। কিন্তু সারা পৃথিবীর আকাশেই আবার কমিউনিজমের ভুত দেখা দিয়েছে। অবশ্য সেই ভুতের দেখা এখনও তারাই পাচ্ছেন যারা বিশ্বাস করেন যেমন মাও সে তুং বলেছিলেন “জনগণই ইতিহাসের চালিকা শক্তি”। ১২ ঘন্টা কাজের প্রশ্নে শ্রমিকেরা রাজি নন। তাদের বিক্ষোভে আপাতত মিল খোলা সম্ভব হয় নি। দুটি মিল খুলেও বন্ধ করতে বাধ্য হতে হয়েছে। একটি মিলে শ্রমিকদের চাপে ১২ ঘন্টার জায়গায় টানা ৮ ঘন্টা কাজের প্রস্তাব দেয় মিল ম্যানেজমেন্ট। শ্রমিকেরা রাজি নয় দুই হাফে ৮ঘন্টা কাজের বাইরে অন্য কোন শর্ত মেনে নিতে। এক শ্রমিকের নিজের কথায় “মে দিবস সামনেই, ৮ঘন্টা কাজের অধিকার ছাড়বো না”। মে দিবস যদিও সরাসরি কমিউনিজমের সাথে জড়িত ছিল না। তাও মে দিবসের উত্তরাধিকার কমিউনিজমই বহন করেছে সবচেয়ে সোচ্চারে। সেই কমিউনিজমের ভুত উঁকি মারছে। আগেও আলোচনা হয়েছে সেই ভুতকে আমাদের মধ্যে একটা সংখ্যালঘু অংশই দেখতে পাচ্ছে। তবে যারা দেখতে পাচ্ছে তাদের সেই ভুতই হয়ত ভরসা জোগাচ্ছে। এই ‘সংখ্যালঘু’দের এখন দেখার আছে লেনিনের কথা মতোই “..সংখ্যালঘুরা কতটা শক্তিশালী..”।