আলম খোরশেদ
আলম খোরশেদ পেশায় প্রকৌশলী, আর নেশায় লেখক, অনুবাদক, সমালোচক ও সংস্কৃতি সংগঠক। উত্তর আমেরিকায় দীর্ঘ প্রবাসজীবনের ইতি টেনে স্থায়ীভাবে দেশে ফিরে এসেছেন ২০০৪ সালে। বর্তমানে, চট্টগ্রাম শহরে ’বিস্তার’ নামে একটি শিল্পকেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ও পরিচালক। প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা কুড়িটিরও অধিক।
শিরোনামায় উৎকীর্ণ প্রশ্নটি করেছিলেন খোদ রবীন্দ্রনাথ, সেই কবে, তাঁর বিখ্যাত গান্ধারীর আবেদন কবিতায়, ধৃতরাষ্ট্রের মুখ দিয়ে। আর এর উত্তরে গান্ধারী উচ্চারণ করেছিলেন একটি সংক্ষিপ্ত অথচ তীব্রতুমুল, সত্যদর্শী বাক্যবন্ধ : ‘দুঃখ নব নব!’ হায়, সেই ধর্মজাত দুঃখের দিন বুঝি আজও আমাদের ফুরল না! অথচ আমরা নিজেরা কি এই প্রশ্নটা কখনও করি নিজেদেরকে, কিংবা করার সাহস রাখি? না, কারণ ধর্ম আজও এই উপমহাদেশের সিংহভাগ, শিক্ষিত অশিক্ষিত নির্বিশেষে, মানুষের কাছে কোনওপ্রকার প্রশ্নের অতীত, জিজ্ঞাসার ঊর্ধ্বে, সভয়ে সংরক্ষিত একটি ভীষণ স্পর্শকাতর বিষয়, যেখানে হাত দিলেই মনে হয় আমাদের জীবন জ্বলেপুড়ে ছত্রখান হয়ে যাবে। কিন্তু তাতে করে কি সেই সর্বনেশে আগুনের লোলুপ শিখার হাত থেকে আমরা বাঁচতে পেরেছি আদৌ?
যেদিকে তাকাই আজ শুধু হিংসা আর হনন আর সংঘাত আর সন্ত্রাস আর অপমান আর অন্ধকার আর রক্ত আর মৃত্যু আর পীড়ন আর পরাজয়। এই পরাজয় মনুষ্যত্বের, মানবতার, সভ্যতার, সুনীতির, সুন্দরের এবং শেষ পর্যন্ত, স্বয়ং ধর্মের। কেননা ধর্মের কথা ছিল মানুষকে ধারণ করবার, তাকে সত্যের পথে চালিত করার, তাকে শান্তি, সম্প্রীতি ও সার্থকতার সন্ধান দেওয়ার। কিন্তু বাস্তবে আমরা দেখছি ঠিক তার উল্টোটি। আমারই প্রিয় স্বদেশে, যে ধর্মনিরপেক্ষতার মন্ত্রণায় দীক্ষিত হয়ে এই দেশটির জন্ম হয়েছিল একদা, সেখানেই আজ দেখি ধর্মভিত্তিক রাজনীতির রমরমা; ধর্মীয় মৌলবাদ, গোঁড়ামি, পশ্চাদপদতা, রক্ষণশীলতা, অসহিষ্ণুতা এবং ঘৃণ্য সাম্প্রদায়িকতার বিষ ছড়িয়ে পড়েছে আমাদের সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে। অন্যদিকে পাকিস্তান নামক দেশটিতে আজ ধর্মীয় কূপমণ্ডুকতা ও তালেবানি জঙ্গীবাদের আক্রমণ ও আগ্রাসনে সভ্যতার শেষ সলতেটুকুও নিভে যেতে বসেছে। আর, প্রতিবেশী ভারতের গণতান্ত্রিক ঐতিহ্যের সুযোগ নিয়ে ধর্মীয় মৌলবাদী একটি দল তো খোদ রাষ্ট্রক্ষমতাই দখল করে বসেছে, এবং সেই ক্ষমতার অপপ্রয়োগ করে সভ্যতার চাকাকে সবলে পেছনে টানছে, এতটাই যে, গোরক্ষার নামে তারা আজ মেতে উঠেছে নরহত্যার পাশবিক উল্লাসে।
কোনও শুভবুদ্ধিসম্পন্ন, সচেতন, চিন্তাশীল মানুষের পক্ষে মানবসভ্যতার এই অবক্ষয় ও অধোগতি মেনে নেওয়া সম্ভব নয়। তাই সময় এসেছে, এই ক্রমবর্ধমান সামাজিক মহামারী রোধে আমাদের কিছু একটা করার। আমরা জানি, ধর্মের মতো এমন একটি শাশ্বত, সর্বজনীন ও স্পর্শকাতর বিষয়কে আমরা চাইলেই এক কথায় তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিতে পারব না, ইংরেজিতে যাকে বলে, Just wish it away! বিশেষ করে, যেখানে জীবের অমোঘ ও অনিবার্য পরিণতি, মৃত্যুকে জয় করা এখনও সুদূর পরাহত রয়ে গেছে, এবং প্রাণের সৃষ্টিও সম্ভবপর হয়নি অদ্যাবধি, বিজ্ঞানের সর্বাত্মক প্রচেষ্টা সত্ত্বেও। এই দু’টি আপাত অসম্ভবের কাছে হার মেনেই তো জগতের দুর্বলচিত্ত মানুষেরা ধর্ম নামের এক অলীক স্বপ্নের কাছে তার জীবন সমর্পণ করে বসে আছে প্রশ্নহীন আনুগত্যে। আর তাদের এই দুর্বলতা ও অন্ধ আনুগত্যকে কাজে লাগিয়ে তাদের স্বার্থসিদ্ধি করছে যত ধর্মব্যবসায়ীর দল। যদিও আমরা এও জানি, পৃথিবীর সমগ্র জনগোষ্ঠীর বেশ বড় একটা অংশ, প্রধানত সমাজতন্ত্রী দেশসমূহের নাগরিকেরা– প্রাক্তন ও বর্তমান মিলিয়ে– এবং ইউরোপ, আমেরিকার সিংহভাগ বিজ্ঞানমনস্ক, যুক্তিবাদী মানুষ দিব্যি ধর্মকে বাদ দিয়েই তাদের জীবন পরিচালনা করছে পরিপূর্ণ সন্তুষ্টি ও সার্থকতার সঙ্গে। এবং সেটা সম্ভব হয়েছে মূলত তাদের শিক্ষাব্যবস্থার বৈজ্ঞানিক চরিত্র এবং রাষ্ট্রব্যবস্থার ধর্মনিরপেক্ষতার নীতির কারণে। এছাড়া সেখানকার মূলধারার রাজনীতিতে ধর্মের মিশ্রণ ও ব্যবহারকে কঠোরভাবে নিরুৎসাহিত করার কারণেও।
আমাদের দেশগুলোতেও জোরালো কণ্ঠে এই দাবিগুলো তুলতে হবে। ধর্ম একটি ব্যক্তিগত বিশ্বাস ও চর্চার বিষয়। কারও কারও কাছে তা বিশ্বাস ও বিধানের ঊর্ধ্বে এক ধরনের আত্মিক অনুসন্ধান ও অভিযাত্রাও বটে। ব্যক্তির এই বিশ্বাস ও আধ্যাত্মিকতার প্রতি আমাদের পরিপূর্ণ সম্মানবোধ রয়েছে, কিন্তু এর চর্চাটিকে যথাসম্ভব ব্যক্তিগত ও পারিবারিক পরিসরে সীমাবদ্ধ রাখাই প্রত্যাশিত এবং শ্রেয়, বিশেষত যেখানে একটি সমাজে বিভিন্ন ধর্মে বিশ্বাসী এবং অবিশ্বাসী মানুষের সহাবস্থান রয়েছে। ধর্মচর্চার সামাজিক ও বাহ্যিক বহিঃপ্রকাশের ক্ষেত্রেও একটি সীমারেখা এবং বিধিবিধান থাকা আবশ্যক, যেন তা নাগরিক সংহতি ও শৃঙ্খলাকে বিঘ্নিত না করে এবং অপরাপর ধর্মাবলম্বীদের, বিশেষ করে সংখ্যালঘুদের, মধ্যে কোনওপ্রকার মনস্তাত্ত্বিক অভিঘাত না ফেলে। শিক্ষাব্যবস্থায়, বিশেষ করে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের পাঠ্যসূচিতে, ধর্মীয় শিক্ষার অর্ন্তভুক্তির কোনও প্রয়োজন আছে বলে মনে হয় না। কেননা তা বিদ্যার্থীদের কচিমনে অকারণে বিভেদ ও বিভ্রান্তির জন্ম দেবে, যার জের তাকে আজীবন বইতে হতে পারে। এটির দায়িত্ব বরং অভিভাবকদের হাতে ছেড়ে দেওয়াই সবচেয়ে সঙ্গত; ধর্মচর্চাকে যেখানে ব্যক্তিগত ও পারিবারিক পরিমণ্ডলে সীমাবদ্ধ রাখার কথা বলা হচ্ছে সর্বত্র, সেখানে স্বাভাবিকভাবেই ধর্মশিক্ষাকেও পরিবারের এক্তিয়ারের মধ্যে রাখাটাই সুবিবেচনার পরিচায়ক।
সবশেষে, রাষ্ট্রের কথা। কেননা রাষ্ট্রের চরিত্র সত্যিকার অর্থে ধর্মনিরপেক্ষ, মানবিক ও গণতান্ত্রিক না হলে এই সমস্যার স্থায়ী সমাধান সম্ভব নয় কোনওমতেই। নাগরিকদের গণতান্ত্রিক অধিকার প্রয়োগ করে এবং প্রয়োজনে আন্দোলনের মাধ্যমে রাষ্ট্রকে তাই সর্বাগ্রে ধর্মনিরপেক্ষতার নীতি ও আদর্শকে তার রাষ্ট্রপরিচালনার ক্ষেত্রে প্রয়োগ করতে বাধ্য করতে হবে আমাদের। শুধু তাইই নয়, যথাযথ আইন প্রণয়ন করে এবং তার সুষ্ঠু প্রয়োগের মাধ্যমে, সমাজে সংগঠিত ধর্মচর্চা ও রাজনীতিতে ধর্মের ব্যবহারকে নিষিদ্ধ করতে হবে পুরোপুরি। পাশাপাশি সাহিত্যে, শিল্পে, সংস্কৃতিতে ও সকলপ্রকার বৌদ্ধিক তৎপরতায় বিজ্ঞানমনস্কতা, যুক্তিবাদ, বিশ্বমানবতা, প্রকৃত ধর্মনিরপেক্ষতা ও ধর্মীয় সম্প্রীতির আদর্শকে সবার ওপরে স্থান দিতে হবে দেশের শিল্পী ও ভাবুকসমাজকে। এক্ষেত্রে বাংলাদেশের শিল্পী, লেখক ও বুদ্ধিজীবী সমাজের রয়েছে একটি অত্যন্ত গৌরবময় ঐতিহ্য। আমরা আশা করব, সেই সংগ্রাম ও প্রতিবাদের ঐতিহ্যে অনড় থেকে তাঁরা বাংলাদেশের মাটিকে ধর্মান্ধতার অভিশাপ থেকে মুক্ত করতে সক্ষম হবেন একদিন। জানি, জীবনানন্দের ভাষায়, এ ’অনেক শতাব্দীর মনীষীর কাজ’, তবু ফের তাঁকেই উদ্ধৃত করে বলি, ’এই পথে আলো জ্বেলে, এ-পথেই পৃথিবীর ক্রমমুক্তি হবে।’