Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

কোভিড ১৯: বাদুড়কে খামোখা দায়ী করলে মানবজাতিকেই মূল্য দিতে হবে

ধ্রুবজ্যোতি মুখার্জি

 




দক্ষিণ এশিয়ার ৬৪ জন গবেষক ও সংরক্ষক গত ২৪শে এপ্রিল একটি প্রেস বিবৃতি দিয়ে কোভিড ১৯ নিয়ে বাদুড় সম্পর্কিত ভ্রান্ত প্রচারের বিরোধিতা করেন। সেই নিয়েই ধ্রুবজ্যোতি মুখার্জির প্রতিবেদন। প্রতিবেদক পেশায় শিক্ষক। বিবৃতির মূল সাতটি বিষয় লেখার পাদটীকায় দেওয়া হল।

 

 

তথ্যপ্রযুক্তি বিপ্লব পরবর্তী সময়ে এই প্রথম কোনও ব্যধি বিশ্বজুড়ে অতিমারির আকার ধারণ করল। ফলে একদিকে যেমন বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের চিকিৎসক ও বিজ্ঞানীরা চটজলদি ভাগ করে নিতে পারছেন নিজেদের অভিজ্ঞতা ও গবেষণার ফলাফল, অন্যদিকে এই বিপুল পরিমাণ তথ্য ও তার বিদ্যুতগতি সঞ্চার অধিকারীভেদে সৃষ্টি করছে অহেতুক ভুল বোঝাবুঝি ও অনভিপ্রেত প্রতিক্রিয়া। এই ব্যাপারটাকেই বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ‘ইনফোডেমিক’ নামে অভিহিত করেছে। ভাইরাসঘটিত অতিমারির থেকে কোনও অংশে কম বিপজ্জনক নয় এই তথ্যের অতিমারি।

এইসমস্ত ভুল তথ্য বা অর্ধসত্যের একাংশ কোভিড-১৯ এর ওষুধ বা প্রতিষেধক সম্পর্কে। অন্য অংশটা কোনও ব্যক্তি/গোষ্ঠী/জাতি/প্রজাতি সম্পর্কে বিদ্বেষ তৈরি করার মত। কখনও এই সমস্ত তথ্যের লক্ষ্য বিল গেটস, কখনও তবলিগি জামাত, কখনও চৈনিক জাতি, আর কখনও বা বাদুড়। এই দ্বিতীয় ধরনের তথ্য অনেক সময় আংশিক সঠিক হলেও জনমানসে তার প্রভাব হচ্ছে বিষময়। বিশ্ব জুড়ে নানা সংস্থা চেষ্টা করছে এইসব ভুল খবর/ভুল ধারণাগুলোকে যথাসম্ভব খণ্ডন করার।

সম্প্রতি দক্ষিণ এশিয়ার সংরক্ষক ও গবেষকদের পক্ষ থেকে প্রেস রিলিজের[1] মাধ্যমে একটি বিশেষ বার্তা জারি করা হয়েছে যার উদ্দেশ্য বাদুড়-চামচিকাদের সঙ্গে SARS-CoV-2 সংক্রমণ নিয়ে চালু গুজবের খণ্ডন। যদিও SARS-CoV-2 বা তার পূর্বসূরি SARS-CoV-1 এর উৎস ঠিক কোন প্রাণী তা জানা যায়নি, তবু সোশ্যাল মিডিয়ার কিছু পোস্ট এবং অসমর্থিত মতামতের ওপর ভিত্তি করে দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন দেশে বাদুড় এবং চামচিকা সম্পর্কে জনমানসে তীব্র দ্বেষ এবং আতঙ্ক সৃষ্টি হয়েছে। ভারতে বেঙ্গালুরুর আশপাশ থেকে পাওয়া খবর অনুযায়ী যেসব গাছে এদের বাসা আছে বেছে বেছে সেসব গাছ কেটে ফেলছে মানুষ, বা প্রশাসনের ওপর চাপ তৈরি করছে কেটে ফেলার জন্য। পরিস্থিতি দ্রুত সামাল দেওয়ার জন্য সেখানে সরকারিভাবে এ ধরনের গাছ কাটা বা বাদুড়-চামচিকাদের কলোনি ঘাঁটানোর বিরুদ্ধে আদেশ জারি করতে হয়েছে।

মজার কথা হল বাদুড়-চামচিকা সম্পর্কে এহেন বিদ্বেষ সৃষ্টির পেছনে খোদ আইসিএমআর-এর একটি রিপোর্ট আংশিকভাবে দায়ী। সপ্তাহ দুয়েক আগে প্রকাশিত ঐ রিপোর্টে বলা হয় যে ভারতে পাওয়া যায় এমন দুটি বাদুড় প্রজাতির মধ্যে ব্যাট করোনাভাইরাসের অস্তিত্ব পাওয়া গেছে। যেসব সংবাদপত্রে এ খবর বেরোয় সেগুলিতে একথাও একইসঙ্গে বলা হয় যে আইসিএমআর এর রিপোর্ট অনুযায়ী ঐ ব্যাট করোনাভাইরাসের সঙ্গে SARS-CoV-2র সম্পর্ক অনেক দূরের, এবং প্রথমটির থেকে কোনওভাবেই মানুষের মধ্যে দ্বিতীয় ভাইরাসঘটিত রোগটি ছড়াতে পারে না। কিন্তু স্পষ্টতই সোশ্যাল মিডিয়ার গুজবযন্ত্র পরবর্তী সময়ে পুরো খবরটির বদলে শুধু হেডলাইনের ওপর জোর দেয়, যার বিষময় ফল হল সম্পূর্ণ নিরপরাধ কিছু বাদুড়/চামচিকার আশ্রয়হীন হওয়া।

গবেষকরা আরও জানাচ্ছেন যে SARS-CoV-2র সঙ্গে সবচেয়ে নিকট সাদৃশ্য পাওয়া যায় যে ব্যাট করোনাভাইরাসের তার নাম RaTG13। এই স্ট্রেইনটি ইন্টারমিডিয়েট হর্স-শু ব্যাট নামে একটি বাদুড় প্রজাতিতে (অভারতীয়) পাওয়া গেছে। অধুনা গবেষণালব্ধ তথ্য অনুযায়ী এই দুটি ভাইরাস আনুমানিক চল্লিশ থেকে সত্তর বছর আগে বিবর্তনের আলাদা পথ বেছে নেয়। এখানে মনে রাখতে হবে চার বা সাত দশক সময় কোনও ভাইরাসের বিবর্তনের পক্ষে বিরাট লম্বা সময়। এর সোজাসুজি অর্থ হল এই যে RaTG13 ভাইরাসের মানুষে সংক্রমিত হওয়ার কোন সম্ভাবনাই নেই। বস্তুত এই ভাইরাসটির স্পাইক প্রোটিন কোনভাবেই মানুষের ফুসফুসের এপিথেলিয়ামের রিসেপ্টরের সঙ্গে SARS-CoV-2র মত করে আটকাতে পারবে না নিজেকে।

গত পাঁচ ছয় দশক জুড়ে একের পর এক জুনটিক (পশুপাখি থেকে মানুষকে ‘হোস্ট’ হিসেবে বেছে নেয় এমন) ভাইরাসের আক্রমণের সাক্ষী আছি আমরা। বিজ্ঞানীদের মতে এর অন্যতম প্রধান কারণগুলি হল বনভূমি ধ্বংস করে রাস্তা/শিল্পোদ্যোগ বানানো, বন্যপশু এবং গৃহপালিত পশুপাখিদের আন্তর্জাতিক বাজার, মাংস-শিল্পের জন্য তাদের বিরাট সংখ্যায় চাষ করা ইত্যাদি। অর্থাৎ, বিভিন্ন মানুষী কার্যকলাপই জুনটিক ভাইরাসগুলিকে সুযোগ করে দিচ্ছে মানুষের হাতে বিপন্ন বিভিন্ন প্রজাতি থেকে মানুষকেই হোস্ট হিসেবে বেছে নেওয়ার। SARS-CoV-1-এর মত নভেল করোনাভাইরাসও একই পথ ধরে এসেছে, এবং ঠিক কোন কোন প্রাণীকে এর আগে তারা সেতু হিসেবে ব্যবহার করেছে তা এখনও আদৌ স্পষ্ট নয়। কিন্তু এটুকু নির্দ্বিধায় বলা যায় যে বাদুড়-চামচিকাদের মেরে ফেলে, বা তাদের নিরাশ্রয় করে বর্তমান সঙ্কট থেকে বাঁচার কোনও পথ মিলবে না। বরং নিজেদের অপরিণামদর্শিতার ফলে আরও বড় বিপদ ডেকে আনতে পারে এহেন কাজকর্ম।

বাদুড়-চামচিকারা বাস্তুতন্ত্রের এক অতি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। একাধিক ম্যানগ্রোভ উদ্ভিদ ছাড়াও মহুল গাছের পরাগসংযোগ ঘটায় বাদুড়রা। এছাড়া তুলো আর চায়ের মত নানা অর্থনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ ফসলের কীট দমনেও সাহায্য করে এরা। শহরায়ন, বৃক্ষচ্ছেদনের মত একাধিক কারণে এমনিতেই বাদুড়দের সংখ্যা সারা দেশ জুড়ে কমে আসছে, এমতাবস্থায় ভুল তথ্যে বিশ্বাস করে যদি মানুষ এদের শত্রু ভেবে আক্রমণ করে তাহলে তা হবে অত্যন্ত লজ্জার। তাই সবার কাছে আবেদন, গবেষক ও সংরক্ষকদের এই বার্তা যত বেশি সম্ভব মানুষের কাছে পৌঁছে দিন। কোভিড-১৯ এর প্রতিষেধক এখনও আবিষ্কার হয়নি, কিন্তু বাদুড়দের বিরুদ্ধে ছড়িয়ে পড়া ইনফোডেমিকের প্রতিকার আছে, এবং তা হল সঠিক তথ্য। আসুন, সঠিক তথ্যকে হাতিয়ার করে এই লড়াইয়ে সামিল হওয়া যাক।


[1] বাদুড়/চামচিকে ও কোভিড ১৯-এর গুজব বন্ধ করতে দক্ষিণ এশিয়ার গবেষক ও সংরক্ষকদের সাতটি মূল বক্তব্য

  1. SARS-CoV-2 বা এর পূর্বসূরির উৎস কী তা এখনও জানা যায়নি। এই মহামারির জন্য বাদুড় বা অন্য কোনও প্রাণীকে দায়ী করা একেবারেই যুক্তিহীন।
  2. বিজ্ঞানীরা দৃঢ়ভাবে জানিয়েছেন যে SARS জাতীয় ভাইরাস বাদুড়/চামচিকে থেকে মানুষের দেহে সরাসরি আসার সম্ভাবনা অত্যন্ত কম। বাদুড়/চামচিকের মলমূত্রের থেকেও করোনা বা এই জাতীয় ভাইরাস সংক্রমণের কোনও প্রমাণ পাওয়া যায়নি।
  3. ICMR (Indian Council for Medical Research)-এর সাম্প্রতিক রিপোর্টে দক্ষিণ এশিয়ার দুই প্রজাতির বাদুড়ের দেহে যে ব্যাট করোনাভাইরাস (BtCoV)-এর উল্লেখ করা হয়েছে, তা মানবস্বাস্থ্যের কোনও ক্ষতি করে বলে জানা যায়নি। গবেষণায় পাওয়া BtCoV ভাইরাস SARS-CoV-2-এর থেকে আলাদা এবং কোভিড ১৯-এর কারণ নয়।
  4. বর্তমানে এবং অতীতে ঘটা প্রাণীবাহিত রোগ সংক্রমণের তথ্যগুলি থেকে বোঝা যায় যে, এই জাতীয় সংক্রমণের পেছনে প্রধানত বন্যপ্রাণীর আন্তর্জাতিক বাণিজ্য এবং বৃহত্তর মাপের প্রাণিসম্পদ চাষের ভূমিকা রয়েছে। বাদুড় বা অন্যান্য বন্যপ্রাণীর প্রতিশোধমূলক হত্যা বা তাদের প্রাকৃতিক বাসস্থান থেকে উচ্ছেদ করে সমস্যার কোনও সমাধান হবে না। বরং এতে বাস্তুতন্ত্রের ভারসাম্য নষ্ট হবে।
  5. বাদুড় ও চামচিকেরা পরিবেশে অত্যাবশ্যক ভূমিকা পালন করে। তারা ম্যানগ্রোভ এবং অন্যান্য অনেক বাণিজ্যিক এবং সাংস্কৃতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ উদ্ভিদের পরাগমিলন ঘটায়। পতঙ্গভুক চামচিকেরা ধান, ভুট্টা, তুলো ও সম্ভবত চা গাছেরও ক্ষতিকারক কীটপতঙ্গের ব্যাপক খাদক। অতএব, বাদুড়/চামচিকে পরিবেশ এবং মানবস্বাস্থ্যের উপকার করে এবং বিপুল অর্থনৈতিক সুবিধা দেয়।
  6. এই মুহূর্তে আমাদের চারপাশের বাদুড়/চামচিকেদের সঙ্গে স্বাস্থ্যকর সহাবস্থানের জন্য বর্তমান সমাজের রোগবিষয়াদি তথ্যগুলোর সঙ্গে সঙ্গে বাদুড়/চামচিকেদের সম্পর্কে সচেতনতাও একান্তভাবে জরুরি। আমরা সংবাদমাধ্যমগুলোকে অনুরোধ করছি যে তারা যেন বিবৃতি প্রকাশের আগে বাদুড় ও অন্যান্য প্রাণীদের উপর বিরূপ প্রভাব পড়ার সম্ভাবনা খতিয়ে দেখেন।
  7. সবশেষে পরিবেশ ও অর্থনীতিতে বাদুড় ও চামচিকেদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা এবং তাদের ধীর বংশবৃদ্ধির কথা বিবেচনা করে আমরা দক্ষিণ এশিয়ার সমস্ত দেশের সরকারকে বাদুড় ও চামচিকে সংরক্ষণের আইনি পরিকাঠামো শক্তিশালী করে তোলার জন্য বিশেষভাবে অনুরোধ করছি।

*চিত্রসূত্র: https://www.birdlife.org/worldwide/news/important-update-bats-do-not-spread-covid-19