অনুষ্টুপ রায়
গ্রেগরীয় ক্যালন্ডোরের পঞ্চম মাসে,বাংলা তথা ভারতীয় চলচ্চিত্রের দুই মহীরুহ মৃণাল সেন ও সত্যজিৎ রায় যথাক্রমে ১৪ই মে ১৯২৩ ও ২রা মে ১৯২১’এ জন্মান।
১৯৫৫ সালে এই দুই চলচ্চিত্র নির্মাতার প্রথম কাহিনীচিত্র ‘রাত ভোর’ ও ‘পথের পাঁচালী’র মুক্তি।দুটি ছবির একটি,ভারতীয় চলচ্চিত্রকে বিশ্ব চলচ্চিত্রের দরবারে (উল্লেখযোগ্য) দৃষ্টান্ত রুপে স্থাপন করে।অন্য ক্ষেত্রে পরিচালক নিজেই সৃষ্টিকে ভুলিয়ে দিতে প্রয়াসী।ফল পরবর্তীতে,নীল আকাশের নিচে,বাইশে শ্রাবণ,আকাশ কুসুম,ভুবন সোম,ইচ্ছাপূরণ,ইন্টারভিউ,
কলকাতা৭১,পদাতিক,কোরাস,মৃগয়া,পরশুরাম,একদিন প্রতিদিন,আকালের সন্ধানে,চালচিত্র,খণ্ডহর,জেনেসিস,অন্তরীণ,
ইত্যাদির নির্মাণ।সত্যজিৎ রায় অপু চিত্র ত্রয়ীর ফাঁকে ও পরবর্তীতে সৃষ্টি করেন,পরশপাথর,জলসাঘর,দেবী,তিন কন্যা,কাঞ্চনজঙ্ঘা,মহানগর,চারুলতা,কাপুরুষ-মহাপুরুষ,নায়ক,গুপী গায়েন বাঘা বায়েন,প্রতিদ্বন্দ্বী,সীমাবদ্ধ,জন অরণ্য,শতরঞ্জ কে খিলাড়ি,শাখা প্রশাখা,আগন্তুক,ইত্যাদি।
সম বিষয়ে ছবি করেন দুজনেই,দূর্ভিক্ষ; মন্বন্তর; ক্ষু্ধাগ্রস্ত অসহায় মানুষের বাস্তব চিত্র ফুটিয়ে তুলতে চান, অশনি শঙ্কেত, বাইশে শ্রাবণ ও আকালের সন্ধানে ছবির মাধ্যমে।যদিও,দুজনের উপস্থাপন রীতি ভিন্ন।ওনারা দুজনেই চলচ্চিত্রকে বাস্তবের ঘনিষ্ঠ করে তুলতে সচেষ্ট।বাংলা ভাষার বাইরে বেড়িয়ে,ভারত নামক জাতি-রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ প্রচলিত(বর্তমান জনসংখ্যার ৫২.৮৩ কোটি) ভাষা,হিন্দি ভাষাতে ছবি বানাতে শুরু করেন।সত্যজিৎ,শতরঞ্জ কে খিলাড়ি ও সদগতি তৈরী করেন।মৃণাল সেন,ভুবন সোম (১৯৬৯) দিয়ে হিন্দি চলচ্চিত্র যাত্রা শুরু করেন। এরপর পর্যায়ক্রমে নির্মাণ করেন, এক আধুরি কাহানী (১৯৭১), মৃগয়া (১৯৭৬),খণ্ডহর(১৯৮৩), জেনেসিস (১৯৮৬)। এক দিন আচানক (১৯৮৯) দিয়ে যাত্রার সমাপণ। এর পাশাপাশি,ওড়িয়াতে মাটির মনিশ (১৯৬৬) [বাংলা করলে সম্ভাব্য শিরনাম দাঁড়ায় মাটির মানুষ] ও তেলেগু ভাষায় ওকা উড়ি কথা (১৯৭৭) বানান। এইসবের পাশাপাশি ওনাদের চলচ্চিত্র-পঞ্জি দেখলে জানা যায়, তথ্যচিত্র বানানো অব্যহত থাকে কাহিনী চিত্র নির্মাণের পাশাপাশি।
তবে,দুজনের গড়ে ওঠা ও পথ চলার পরিষর সম্পূর্ণ ভিন্ন।সত্যজিৎ,বই পত্রের (আম আঁটির ভেপু,চাঁদের পাহাড় এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য)চিত্রণ[ইলাস্ট্রেশন] ও বিজ্ঞাপনের অঙ্কন শিল্পী।এর পাশাপাশি,চলচ্চিত্র সম্পর্কে আগ্রহী এক যুবক।ওনার বন্ধু গোষ্ঠী,হরিসাধন দাশগুপ্ত{যার তথ্যচিত্রের প্রয়োজনে পরবর্তীতে চিত্রনাট্য লেখেন},চিদানন্দ দাশগুপ্ত {বিলেত ফেরত,আমোদিনী ছবির নির্মাতা},সুব্রত মিত্র {সত্যজিৎ রায়ের বহু ছবি ছাড়াও জেমস আইভরি,বাসু ভট্টাচার্য,রমেশ শর্মা ও তাং শু শুয়েনের ছবির আলোকচিত্রের দায়িত্ব সামলান},বংশী চন্দ্রগুপ্ত এবং আরো অনেককে নিয়ে সংগঠিত। জাঁ রেনোয়া ‘দি রিভার’ ছবির কাজে কলকাতায় এলে,সত্যজিৎ ওনার সাথে আলাপ করেন।ছবির কাজের সাথে থাকেন।হাতে-কলমে ছবি বানানোর পাঠ নিতে থাকেন। এর পূর্বে, ইংরাজি দৈনিক ও পত্র-পত্রিকায় চলচ্চিত্র সম্পর্কিত প্রবন্ধ লিপিবদ্ধ করেন এবং এই অভ্যাস পরিচালক সত্যজিৎ রায়ের ক্ষেত্রেও অক্ষুণ্ণ থাকে। বিংশ শতকের পাঁচের দশকের গোড়ায়,পথের পাঁচালি বানাতে উদ্যোগী হন।অনেক টানাপোড়নের পরে বছর পাচেক বাদে ছবিটি সম্পূর্ণ হলে বিভিন্ন চলচ্চিত্র উৎসবে সমাদর লাভ করে।তারপর থেকে,বছর প্রতি এক বা একাধিক ছবি নির্মাণ করে চলেন আটের দশক অবধি।শারিরীক অসুস্থতার কারণে এরপরে ছবি বানানোর হার ক্রমশ কমে আসতে থাকে।কলকাতায় প্রথম চলচ্চিত্র সমাজ গঠন করেন চিদানন্দ দাশগুপ্ত,বিজয়া মূলে দের সাথে।
অপরদিকে,মৃনাল সেন সেই সময়ে এক বেরোজগেরে যুবক।গণ-নাট্য আন্দোলনের সাথে পরোক্ষ নৈকট্য বর্তমান।প্যারাডাইস ক্যাফেতে ও ওনার বাড়িতে বন্ধুদের সাথে আড্ডা বসে।সেইসব আড্ডায় যোগ দেন ঋত্বিক কুমার ঘটক,কলিম সরাফি,তাপস সেন,সলিল চৌধুরি,হৃষিকেশ মুখার্জিরা।ওনার লেখনী(তৃতীয় ভুবন) থেকে জানা যায়,”একমাত্র ব্যাতিক্রম ছিল হৃষিকেশ মুখোপাধ্যায় নিউ থিয়েটার্স স্টুডিয়োতে চাকরি করত।বাদ বাকি আমরা সবাই বেকার।” পরবর্তী সময়ে(আনুমানিক ১৯৫১) ‘মেডিক্যাল রিপ্রেজেন্টেটিভের’ এর চাকরি করতে কলকাতা থেকে দূরে চলে যান। ১৯৫৩ সালে স্যর চার্লস(চার্লি) চ্যাপলিন কে নিয়ে বই লেখেন।ওনার তৎকালীন প্রেমিকা(পরবর্তীতে স্ত্রী) গীতা সোম,প্রত্যক্ষভাবে গণ-নাট্য আন্দোলনের সাথে যুক্ত থাকার সুবাদে, ১৯৫২ সালে ঋত্বিক ঘটকের প্রথম কাহিনী চিত্রে(নাগরিক) অভিনয় করেন। অমিতাভ চট্টোপাধ্যায়,ওনার ‘চলচ্চিত্র সমাজ ও সত্যজিৎ রায়’ গন্থের,’সত্যজিৎ চলচ্চিত্রের প্রথম পর্ব: কিছু কথা’ নামক প্রবন্ধে লিখেছেন “……. ছবি তখন না করলেও ছবি নিয়ে ভাবছেন এমন আর এক তরুণ মৃণাল সেন।” আবার,পরবর্তী সময়ে অমিতাভ বাবু,ওনার ‘চলচ্চিত্র ভাবনা’ নামক বইয়ের ‘ভারতীয় চলচ্চিত্রে মৃণাল সেনের তাৎপর্য : ৭০ এর দশকের পটভূমিকায়’ নামের প্রবন্ধে লেখেন “মৃণাল সেনই প্রথম ভারতীয় চলচ্চিত্রকার যিনি চলচ্চিত্রকে দুঃসহ বাস্তবতার গভীরে যে পরিবর্তন ইচ্ছা তার সংগে সংযোগ ঘটালেন।”চাকরি ছেড়ে ফিরে এসে,নীল আকাশের নিচে,বাইশে শ্রাবণ দিয়ে নিজের শৈলী কে মজবুত করলেন।উত্তরোত্তর সেই শৈলীর সাথে সৃষ্টার রূপান্তর ঘটতে থাকে।
মৃণাল,সত্যজিৎ,ঋত্বিকের পাশাপাশি আরো অনেকে ছবি বানানোর চেষ্টা করছিলেন সেই সময়ে।কেউ কেউ ছবি বানিয়েওছেন।যথা,নিমাই ঘোষ- ছিন্নমূল(১৯৫০),পরবর্তীতে মাদ্রাজে চলে যান ও সেখানে ছবি বানান।রাজেন তরফদার,১৯৫৭ সালে অন্তরীক্ষ,১৯৬০’এ গঙ্গা, ১৯৭৫’এ পালঙ্ক,১৯৮৭ তে নাগপাশ, ছাড়াও অগ্নিশিখা -১৯৬২,জীবন কাহিনী-১৯৬৪ ও ১৯৬৭ তে আকাশ ছোয়া(এই তিনটি বর্তমানে খুজে পাওয়া যায়নি) নির্মাণ করেন।তাছাড়া,তরুণ মজুমদারের দুটি ছবির(সংসার সীমান্তে ও গণ দেবতা)চিত্রনাট্য রচনা এবং মৃনাল সেনের(আকালের সন্ধানে ও খন্ডাহার),শ্যাম বেনেগলের আরোহণ ও শেখর চট্টোপাধ্যায়ের বসুন্ধরা তে অভিনয় করেন। বাড়ীণ সাহা, তেরো নদীর পারে,শনিবার ও দুটি তথ্যচিত্র বানান।এইসব তথ্য সমষ্টির উদ্দেশ্য একটিই,বাস্তবিক কাহিনী নিয়ে কাহিনী চিত্র নির্মাণের প্রচলন (ডক্টর কোটনিস কি অমর কাহানী,দো বিঘা জমিন,উদয়ের পথে,ইত্যাদি)শুরু হয়ে থাকলে শৈলীগত ভাবে তার নির্মাণ প্রকরন সেরম চলচ্চিত্রিক(পড়ুন সিনেম্যাটিক) হয়ে ওঠেনি।পূর্বে উল্লেখিতদের(ও যাদের সম্পর্কে এখন আমরা অবগত নই),হাত ধরে বাংলা তথা ভারতীয় চলচ্চিত্রে বাঁক বদল ঘটে।
যাক,যাদের কথা নিয়ে এই প্রবন্ধ,তাদের কথায় ফেরা যাক।সত্যজিৎ রায়কে বাঙালী বালিকা/বালক ও মায় কিশোর সম্প্রদায় কিন্ত প্রথমে চলচ্চিত্র নির্মাতা রূপে চেনেনা। চেনে,প্রদোষ মিত্র,প্রফেসর শঙ্কু ও তারিণী খুড়োর চরিত্রের সৃষ্টিকর্তা ও বড় হতে হতে,গুপী গাইন বাঘা বাইন ও ফেলুদা কে চলচ্চিত্রের পর্দায় ফুটিয়ে তোলার দৌলতে।কিন্তু মৃণাল সেন ,যেহেতু তিনি শিশু সাহিত্য/চলচ্চিত্রে (১৯৭০ এর ইচ্ছাপূরণ ব্যাতিরেকে)কোন ছাপ না রাখেননি। বাল্যে ও পরবর্তীতে চলচ্চিত্রে বিষয়ে আগ্রহী না হলে কখনই পরিচয় ঘটেনা।তাই যা সম্ভাব্য তাই ঘটে। বাংলা সাহিত্যে যেরম, রবি ঠাকুরের মতন বট গাছের ছায়ায় যেমন অনেকে হারিয়ে যেতে বসেন।বাংলা চলচ্চিত্র মাধ্যমের ক্ষেত্রে সেরম,সত্যজিৎ রায় ও ঋতিক ঘটককে[যার অভিনীত একটি চরিত্রের উক্তি “ভাবা প্র্যাক্টিস কর”,বহুল অকারণ ব্যবহারের ফলে অবক্ষয় প্রাপ্ত]ছবি না দেখে থাকলেও নামের সাথে অল্পবিস্তর মানুষ পরিচিত।কিন্ত বাকিরা এত কিছুর পরও থেকে যায় আঁধারে।
বি:দ্র:-মানুষ বলতে ইংরাজি শিক্ষা ব্যবস্থায় শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেনীর সবাই নয়।সাধারণীকরন করে নিগ্রহ করা এই লেখার উদ্দেশ্য নয়। তবে, এইটুকু অবশ্যই বলার,সময়-সুযোগে অজানাকে জানার চেষ্টা তো করা যায় নাকি!