Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

ভারত কি ধর্মনিরপেক্ষ দেশ?

ধর্ম ও রাষ্ট্র | প্রথম বর্ষ, চতুর্থ যাত্রা | আগস্ট, ২০১৭

মাধব গোডবোলে

 

অনুবাদ : স্বাতী মৈত্র

মাধব গোডবোলে ছিলেন ভারত সরকারের গৃহমন্ত্রক ও ন্যায়মন্ত্রকের সচিব। এই রচনাটি তাঁর ‘Is India a Secular Nation?’-শীর্ষক একটি বক্তৃতার অংশ। এই বক্তৃতা দেবার কথা ছিল ইন্ডিয়ান ইন্সটিট্যুট অফ পাবলিক অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের মহারাষ্ট্র বেঞ্চের ‘বি জি দেশমুখ মেমোরিয়াল লেকচার ২০১৬’-শীর্ষক একটি অনুষ্ঠানে – ৪ঠা এপ্রিল ২০১৬ তারিখে। অনুষ্ঠানটি হঠাত করে বাতিল করে দেওয়া হয়, অনুষ্ঠিত হবার মাত্র তিনদিন আগে। সম্পূর্ণ বক্তৃতা এই লিঙ্কে ধরা আছে– 

 

প্রেক্ষাপট

শুরুতেই বলে রাখি যে আমি ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শে দৃঢ় বিশ্বাস রাখি। আমি বিশ্বাস করি যে ভারতীয় সমাজের বহুধর্মী, বহুভাষী, বহু সংস্কৃতি-সম্পন্ন চরিত্রকে বাঁচিয়ে রাখবার একমাত্র উপায় ধর্মনিরপেক্ষতার চর্চা ও প্রসার। এই মুহূর্তে, ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা ভারতের জনসংখ্যার ২০ শতাংশ, এবং তাঁদের মধ্যে ১৪.২% মুসলমান সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত। কিছু হিসেব অনুযায়ী, আগামী কিছু বছরে এই সংখ্যা ২৫ শতাংশের একটু বেশিতে এসে দাঁড়াবে। এস্টিমেট অনুযায়ী মুসলমান সম্প্রদায় তার মধ্যে ২০ শতাংশ মতন স্থান দখল করবেন। এইবার, কোনও এক সমাজের এক চতুর্থাংশ যদি অবহেলিত, বঞ্চিত, এবং সেই সমাজে অবাঞ্ছিত বোধ করেন, তাহলে সেই সমাজের উন্নতি হওয়া বা সেখানে শান্তি বজায় থাকা সম্ভব না।

আজকাল এ দেশে সংখ্যালঘু তোষণ, বিশেষত মুসলমান তোষণ, নিয়ে অনেক কথা বলা হয়। এই তথাকথিত মুসলমান “ভোটব্যাংক” নাকি বিশেষ কিছু রাজনৈতিক দলের সুবিধা করে দিয়েছে বা দেয়। কিন্তু আমরা যদি জাস্টিস সাচার কমিটির রিপোর্টের অর্থ-সামাজিক সূচকগুলো ভালো করে পরীক্ষা করে দেখি, তবে পরিষ্কার বোঝা যায় যে মুসলিমরা আসলে চিরকাল ভারতীয় সমাজে প্রান্তিকই রয়ে গেছেন। চিন্তার বিষয় হল যে মাননীয় লোকসভার সদস্যরা সাচার কমিটি রিপোর্ট বা জাস্টিস রঙ্গনাথন মিশ্র কমিটির মূল রেকমেন্ডেশনগুলি নিয়ে নিজেদের মধ্যে আলোচনা করার সময়ই পাননি। এই দুটি হাই লেভেল বিশেষজ্ঞ কমিটিকে তৎকালীন ইউনাইটেড প্রগ্রেসিভ অ্যালায়েন্স (ইউপিএ) সরকার নিযুক্ত করেছিল। আজকের বক্তৃতার বিশিষ্ট শ্রোতামণ্ডলীর অনেকেই জানবেন যে সিভিল সার্ভিসের জগতে পূর্বসূরি ও উত্তরসূরির সম্পর্ক খুব একটা মসৃণ হয় না, যাকে প্রিডিসেসর-সাকসেসর কমপ্লেক্স বলা যেতে পারে। দুঃখের কথা এই যে বিশেষজ্ঞ কমিটি ও কমিশনগুলোও এই একই ভাইরাসের দ্বারা আক্রান্ত হয়েছে। এর ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শটাই। অথচ এই আদর্শই ভারতীয় সমাজের বিবিধ ধারার মিলন ঘটাবে বলে এক সময় আশা করা হয়েছিল। সেখানে আজ আমরা নির্দ্বিধায় বলতে পারি যে ধর্মনিরপক্ষেতা শব্দটা প্রায় হাস্যস্পদ হয়ে দাঁড়িয়েছে। সংখ্যাগুরু ও সংখ্যালঘু, কেউই তা নিয়ে সন্তুষ্ট নয়। ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শ আজ তার সমস্ত বিশ্বাসযোগ্যতা হারিয়েছে।

ভারতীয় সংবিধানকে পৃথিবীতে সবথেকে স্পষ্টভাবে ধর্মনিরপেক্ষ সংবিধানগুলির একটি বলে গণ্য করা হয়। কিন্তু তার সাথে এটাও মনে রাখা দরকার যে আমাদের মাননীয় সংবিধান প্রণেতারা কিন্তু ‘সেকুলার’ শব্দটির প্রয়োগ সম্পর্কে একমত হতে পারেননি। তাঁদের আশঙ্কা ছিল যে ‘সেকুলার’ শব্দ ব্যবহার করা হলে দেশের সংবিধানকে অনেকে ধর্ম-বিরোধী বা অধার্মিক ভেবে নিতে পারেন। তাঁরা মনে করেছিলেন যে, একটা দেশ শাসন করার জন্য সেই দেশের সংবিধানে যে প্রকারের নীতি ও আদর্শের পরিচয় থাকা উচিত, তা একমাত্র ধর্মীয় অনুশাসন বিধি থেকেই আসতে পারে। এই কারণে তাঁরা সংবিধানে ‘সেকুলার’ শব্দটি ব্যবহার করে সেই নীতি ও আদর্শের জোর কেড়ে নিতে চাননি। তারপর ১৯৭৬ সালে, এমারজেন্সির সময়, সংবিধানের এই ত্রুটি সংশোধন করা হয় এবং ৪২তম অ্যামেন্ডমেন্টের সাহায্যে সংবিধানের প্রিঅ্যাম্বলে ‘সেকুলার’ শব্দটি সংযোজন করা হয়।

আজকে ভারতবর্ষের ধর্মনিরপেক্ষতা সত্যিই কিছু কঠিন প্রশ্নের মুখোমুখি। স্বাধীনতার পরে এই প্রথম হিন্দু রাষ্ট্রের ব্যাপারে এতটা প্রকাশ্যে, এতটা ঔদ্ধত্যের সাথে, এবং এতটাই অধ্যবসায়ের সাথে আলোচনা হচ্ছে। এখন মনে হচ্ছে জনতা সরকার ১৯৭৮ সালে যে কন্সটিটিউশন বিল (৪৪তম অ্যামেন্ডমেন্ট)-এর প্রস্তাব দিয়েছিল তা ভাগ্যিস সেই সময় রাজ্যসভায় পাশ হয়নি। এই সর্বনাশা প্রস্তাবে বলা হয়েছিল যে সংবিধানে কোনও গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে পরিবর্তন আনতে গেলে, অর্থাৎ অ্যামেন্ডমেন্ট করাতে গেলে, দেশব্যাপী রেফেরেন্ডাম বা গণভোট করাই যথেষ্ট। এই প্রস্তাব বাস্তবায়িত হলে সংবিধানের ধর্মনিরপেক্ষ চরিত্র পরিবর্তনের পক্ষে যে জনমত গড়ে তোলার অপচেষ্টা করা হত সে নিয়ে কোনও সন্দেহই নেই। আর আজকের এই পোলারাইজড রাজনৈতিক আবহাওয়ায় হয়তো তা সংখ্যাগুরুর সমর্থন পেয়ে পাশও হয়ে যেত। দেশের উচ্চতম কোর্টও এই বিষয়ে চিন্তিত। সুপ্রিম কোর্ট বলছে, “ভারতবর্ষ এখনও অবধি ধর্মনিরপেক্ষ দেশ… আমরা জানি না তা কতদিন থাকবে।”

ধর্মনিরপেক্ষতা— সাংবিধানিক অনুশাসন বিধি এবং বাস্তব

ভারতের সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতার মূল নিয়মবিধিগুলি সম্পর্কে অনেকগুলি ধারা রয়েছে। কিন্তু বাস্তব ছবি সেসবের থেকে পুরোই আলাদা এবং হতাশাজনক। সংখ্যালঘু এবং সংখ্যাগুরু, সব সম্প্রদায়ের মানুষই আজ এই বাস্তব ছবি দেখতে দেখতে ধর্মনিরপেক্ষতা প্রসঙ্গেই হতাশ। ফলে যে আদর্শের সাহায্যে সবাইকে কাছে টানার কথা ছিল, সেই আদর্শই আজকে সমস্ত সম্প্রদায়কে একে অপরের থেকে দূরে ঠেলে দিয়েছে। এ প্রসঙ্গে আমার আগামী বইয়ে আমি বিস্তারিত আলোচনা করেছি। এও আলোচনা করেছি, হিন্দু কোড বিলের বিরুদ্ধে হিন্দু সমাজের থেকে কতটা আপত্তি এসেছিল এবং এমনকি কংগ্রেসের বড় বড় নেতারাও সেই সময়ে হিন্দু আইনে সংস্কার আনার কতটা বিপক্ষে ছিলেন। জহরলাল নেহরুর প্রতি আমাদের চিরকৃতজ্ঞ থাকা উচিত এই কারণেই যে তিনি অন্তত এই বিষয়ে দৃঢ় অবস্থান নিয়ে প্রয়োজনীয় আইনগুলো পাশ করার বন্দোবস্ত করেন। আবার এটাও সত্যি এবং দুর্ভাগ্যজনকও বটে যে তিনি অভিন্ন দেওয়ানি বিধি লাগু করা নিয়ে একই রকম দৃঢ় অবস্থান নিতে ব্যর্থ হয়েছিলেন। যদি মুসলিম পার্সোনাল আইনের সংস্কার সেই সময়েই করা হত, তাহলে এত দিনে দেশের সামাজিক ও ধর্মীয় চিন্তাধারার আমূল পরিবর্তন ঘটে যেত। সেই সুবর্ণ সুযোগ একবার হাতছাড়া হয়ে যাওয়ার পর এই মুহূর্তে অভিন্ন দেওয়ানি বিধি চালু করা সত্যি সমস্যাজনক হবে, তা সে সুপ্রিম কোর্ট যতই বলুন না কেন। অভিন্ন দেওয়ানি বিধি চালু একমাত্র হতে পারে যদি মুসলমান সমাজের ভিতর থেকে একটি জোরদার উদারপন্থী ও সংস্কারপন্থী আন্দোলন উঠে আসে। কিন্তু ট্র্যাজেডি হল, কোনও রাজনৈতিক দলই মুসলমান সমাজের মধ্যে আধুনিক, বিজ্ঞানমনস্ক, উদারপন্থী, ও আলোকপ্রাপ্ত নেতৃত্ব তৈরি করতে উৎসাহী নয়।

যে কোনও ধর্মনিরপেক্ষ দেশে ধর্ম সম্পূর্ণভাবে ব্যক্তিগত বিষয় হওয়া উচিত— ধর্মের সাথে দেশ শাসনের কোনও সম্পর্ক থাকাই উচিত নয়। বোম্মাই কেসে মহামান্য সুপ্রিম কোর্ট বলেছিলেন যে রাজনীতির থেকে ধর্মকে যদি পৃথক না করা হয়, তাহলে শাসক দলের ধর্মই রাষ্ট্রের ধর্ম হয়ে ওঠে। আমরা এখন সেটাই দেখতে চলেছি।

ধর্মনিরপেক্ষতার সক্রিয় প্রয়োগ

ভারতবর্ষের ভবিষ্যতের সাথে ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শের নিবিড় যোগ আছে। কিন্তু তা সত্যিসত্যিই সফল করে তুলতে অনেকগুলো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে হবে। প্রথমত, ‘সেকুলার’ বা ধর্মনিরপেক্ষ শব্দটির ঠিকঠাকভাবে সংজ্ঞায়িত করা দরকার। ধর্মনিরপেক্ষতাকে যেহেতু ভারতীয় সংবিধানের মূল কাঠামোর অঙ্গ হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে, অতএব আমাদেরকে যে কোনও নির্বাচিত সরকারকে তার সঠিক প্রয়োগ বা অপপ্রয়োগের জন্য দায়ী করতে হবে। কিন্তু সরকারের দায়িত্ব কেমনভাবে বিচার হবে যদি ‘সেকুলার’ শব্দের সঠিক সংজ্ঞাই না থাকে?

দ্বিতীয়ত, ‘সংখ্যালঘু’ শব্দটিরও সঠিক সংজ্ঞার প্রয়োজন। ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শ দাঁড়িয়ে আছে সংখ্যালঘুদের স্বীকৃতি ও সুরক্ষার ভিত্তিতে। এরা অঙ্গাঙ্গীভাবে সম্পর্কিত। আমরা আশা করতেই পারতাম যে আমাদের সংবিধানের কারিগরেরা ‘সংখ্যালঘু’ কী ও কারা, তা বলে দিয়ে যাবেন। কিন্তু দুঃখের বিষয়, তা হয়নি।

তৃতীয়ত এবং সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে ধর্মনিরপেক্ষতা সম্পর্কে সাংবিধানিক নির্দেশ পালনের উদ্দেশ্যে একটা কমিশন গঠন করা। সেই কমিশন যাতে সফল হতে পারে, তা নিশ্চিত করতে সংবিধান সংশোধন করেই তাকে নিয়োগ করতে হবে, এবং তার নেতৃত্বে রাখতে হবে দেশের কোনও প্রাক্তন প্রধান বিচারপতিকে।

চতুর্থত, রাজনীতির সাথে ধর্মের কোনও সম্পর্ক যেন না থাকে, এই ব্যবস্থা করতে হবে। এই কাজটা এতটাই জরুরি যে নষ্ট করার মতন একটুও সময় আমাদের আর নেই— এই মুহূর্তেই এই কাজ শুরু করা উচিত। বহুকাল আগে, ১৯৪৮ সালের তেসরা এপ্রিল, কন্সটিটুয়েন্ট অ্যাসেম্বলিতে (লেজিসলেটিভ) এই বিষয়ে একটি রেজলিউশন পাশ হয়। নেহরু সেই রেজলিউশনকে স্বাগত জানিয়ে বলেন যে “সরকার তার ক্ষমতার মধ্যে যত কিছু করা সম্ভব, তার সবই করার চেষ্টা করবে যাতে এই রেজলিউশনের মূল উদ্দেশ্য সফল হয়।” কিন্তু নিজেই ১৭ বছর প্রধানমন্ত্রী থাকা সত্ত্বেও তিনি এই রেজলিউশন লাগু করার উদ্দেশ্যে কোনও সিদ্ধান্ত নিয়ে উঠতে পারেননি। তারপর, ইন্দিরা গান্ধী এবং রাজীব গান্ধী যখন ক্ষমতায় ছিলেন, তখন তাঁদেরও লোকসভায় দুই-তৃতীয়াংশর সমর্থন ছিল— এঁরা ছাড়া কোনও প্রধানমন্ত্রীই লোকসভায় এতটা সংখ্যাগরিষ্ঠতা উপভোগ করেননি। তা সত্ত্বেও ইন্দিরা বা রাজীব, কেউই সংবিধান সংশোধন করার চেষ্টা করেননি, কারণ তাঁরা সম্ভবত এর দ্বারা রাজনৈতিকভাবে উপকৃত হতেন না। এই প্রসঙ্গ আবার উঠে আসে বাবরি মসজিদ ধ্বংসের পরে, যখন কংগ্রেসের ধর্মনিরপেক্ষতা সম্পর্কে দেশেবিদেশে প্রশ্ন উঠতে শুরু করে। পিভি নরসিংহ রাও-এর সরকার তখন আবার রাজনীতির থেকে ধর্মকে আলাদা করার জন্য উদ্যোগী হয়, এবং ১৯৯৩ সালে পার্লামেন্টে দুটো বিল পেশ করে— কন্সটিটিউশন (৮০তম অ্যামেন্ডমেন্ট) বিল এবং রিপ্রেজেনটেশন অফ দা পিপল অ্যাক্টের অ্যামেন্ডমেন্ট। সাংসদদের সমর্থন না পাওয়ায় সেই বিলগুলি পাশ হয়নি।

যদি এই বিষয়ে ঠিকঠাক আলোচনা না হয় এবং সংবিধানের অ্যামেন্ডমেন্ট করা না হয়, তাহলে ভারত নামক রাষ্ট্রের ধর্মনিরপেক্ষতা নিয়ে আলোচনা করাই বৃথা। পূর্ব অভিজ্ঞতা এবং ১৯৯৩ সালে সংসদে হওয়া ডিবেটের সময় নানান রাজনৈতিক দলের করা কিছু সঙ্গত প্রশ্নের ভিত্তিতে আমার ব্যক্তিগত মত হল এই আইনের যাতে অপব্যবহার না হয়, তার ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন। সেই কারণে আমি বলব যে, এই অ্যামেন্ডমেন্ট বিলের ক্ষমতা যেন ধর্মের সাথে যুক্ত যে কোনও রাজনৈতিক দলের রেজিস্ট্রেশন বাতিল করা, ও এই ধরনের দল যেন দেশের যে কোনও স্তরেই ভোটে দাঁড়াতে না পারে, তা নিশ্চিত করাতেই সীমাবদ্ধ থাকে।

এর পরের বিষয়টি ধর্ম প্রচারের অধিকার। হাই কোর্ট ও সুপ্রিম কোর্টের এই প্রসঙ্গে অনেক জাজমেন্ট আছে, যেখানে পরিষ্কার ভাষায় বলা হয়েছে যে ধর্ম প্রচারের অধিকার মানে ধর্মান্তরিত করার অধিকার নয়। এই সমস্যার মূলে আঘাত দিতে হবে, এবং সেই জন্য সংবিধানের ২৫তম ধারার সংশোধন করে “প্রচার” শব্দটাই বাদ দেওয়া প্রয়োজন।

আরও একটা বিষয় মনোযোগ দাবী করে। আমার মতে সংখ্যালঘু শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলিকে যে সাংবিধানিক সুরক্ষা দেওয়া আছে, তা তুলে দেওয়াই বাঞ্ছনীয়। কন্সটিটুয়েন্ট অ্যাসেম্বলিতে এর অনেক বিরোধ সেই সময়েই করা হয়েছিল, কিন্তু কংগ্রেস সংখ্যালঘু সম্প্রদায়গুলির প্রতি উদার হতে চেয়েছিল। তারা তখন ভেবে দেখেনি যে এর ফল হিসাবে ভবিষ্যতে পৃথক ধর্মীয় সত্তার বিকাশ ঘটবে, এবং দেশের ধর্মনিরপেক্ষ শিক্ষাব্যবস্থা ক্ষতিগ্রস্ত হবে। আজকের দিনে দাঁড়িয়ে এই অধিকার রাখবার আর কোনও যুক্তিসঙ্গত কারণ নেই। হয়তো সংখ্যালঘু ভাষা শিক্ষার প্রতিষ্ঠানগুলি এখনও থাকার প্রয়োজন আছে। কিন্তু বিশ্বায়ন ও আধুনিক ইনফরমেশন টেকনোলজির সাহায্যে যে গতিতে সারা দেশে, এমনকি গ্রামাঞ্চলেও, ইংরেজি মাধ্যমের প্রসার হয়েছে, সেই প্রেক্ষিতে এই ভাষা শিক্ষার প্রতিষ্ঠানগুলির ভবিষ্যতও হয়তো আর বেশিদিন নয়।

অবশেষে, গো হত্যার বিরুদ্ধে সংবিধানে যে ধারা রয়েছে, সেই ধারা অবিলম্বে বাদ দিতে হবে। যদিও ভারতীয় সংবিধানের ৪৮তম ধারা ডিরেক্টিভ প্রিন্সিপল অফ স্টেট পলিসির অংশ, তাও আজকাল আলোচনায় এই ধারাটিকে প্রায় মৌলিক অধিকারের সমান গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু এখানে প্রশ্ন একটাই– গো হত্যা বন্ধ করার পিছনে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের ধর্মীয় অনুভূতি ছাড়া অন্য কোনও যুক্তি আছে কি? এবং এটাও মনে রাখতে হবে, হিন্দু সমাজের সমস্ত অংশ থেকে এই দাবী আদৌ উঠে আসেনি। সবচেয়ে বড় কথা, এই ধরনের কোনও বিধিনিষেধ ধর্মনিরপেক্ষতার বিরোধী। মহারাষ্ট্রের মতন খরাবিধ্বস্ত রাজ্যে এই রকম বিধিনিষেধ হলে চাষিদের প্রভূত সমস্যা হওয়ার সম্ভাবনা।

ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শকে জোরদার করতে দুটি মূল জায়গায় ইলেক্টোরাল সংস্কারের দরকার। প্রথম, ভোটদান আবশ্যিক করা, এবং দ্বিতীয়, ভোটে জেতার জন্য ৫০ শতাংশ + এক ভোট পাওয়ার নিয়ম করা।

ফলে এ নিয়ে কোনও সন্দেহ নেই যে ভারতীয় সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শের সাথে অনেক জায়গাতেই আপোষ করা হয়েছে। ধর্মনিরপেক্ষতাকে এ দেশের জীবনযাত্রার অংশ করে তুলতে হলে আরও অনেক কাজ বাকি আছে।