সুশোভন ধর
লেখক রাজনৈতিক কর্মী ও ভাষ্যকার
অপরে পাওনা আদায় করেছে আগে,
আমাদের পরে দেনা শোধবার ভার–উটপাখি, সুধীন্দ্রনাথ দত্ত
লকডাউনের দ্বিতীয় ইনিংস প্রায় শেষের মুখে। শোনা যাচ্ছে যে এই অধ্যায়ের শেষেও আমাদের বন্দিদশা কাটার সম্ভাবনা প্রায় নেই বললেই চলে। মে মাসের ৩ তারিখের পরে আরেক দফা অন্তরীণ থাকতে হবে। আপাতত ১৪ দিন ঘোষিত হয়েছে কিন্তু জনমত অনুসারে হয়ত গোটা মে মাস জুড়েই এই ব্যবস্থা চলবে। এবারে অনেক রংবেরঙের বাহারি নাম দিয়ে— রেড জোন, অরেঞ্জ জোন, গ্রিন জোন, ইত্যাদি— বন্দিদশার ভাগাভাগি হবে। তবে তাতেও আমাদের সমাজজীবন বা অর্থনীতির ওপর থেকে কালো মেঘের ঘনঘটা খুব একটা কাটবে অনুমান করা যাচ্ছে না। করোনা ভাইরাসের করালগ্রাস সুদীর্ঘ ছায়া ফেলেছে সারা বিশ্বের মতো আমাদের অর্থনীতির ওপরেও। ইতিমধ্যেই অনেকে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন যে গত শতাব্দীর দুই বিশ্বযুদ্ধ দুনিয়ার অর্থনীতিকে যে সঙ্কটের গাড্ডায় ফেলেছিল আমরা আবার তার পুনরাবৃত্তি দেখতে পারি। এমনকি দেখা দিতে পারে মহামন্দা৷
আর্থিক মন্দা
করোনা ভাইরাস এবং তার গতিপথ রোধ করতে অভূতপূর্ব এ লকডাউনে ভারতের অর্থনীতির অবস্থা শোচনীয়। ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে গেছে, বেকারত্ব বেড়েছে এবং কমেছে উৎপাদন। বিশ্বের অন্যতম প্রধান রেটিং সংস্থা মুডিজ এই অতিমারির শুরুতে বলেছিল যে করোনার প্রভাবে ভারতের আর্থিক বৃদ্ধির হার আগামী আর্থিক বছরে ৬.৬ শতাংশ নয় বরং তা কমে দাঁড়াতে পারে ৫.৪ শতাংশ হারে। অর্থাৎ বিগত বছরের মতোই আর্থিক বৃদ্ধি হবে বলে তারা মনে করেছিল। কিন্তু পরে তারাই আবার মার্চে এই পূর্বাভাস নামিয়ে আনে ২.৫ শতাংশে, এবং শেষ পর্যন্ত এপ্রিলে ০.২ শতাংশে।[1] আরেক খ্যাত সংস্থা বার্কলেস-ও একইভাবে দেশব্যাপী ৩রা মে পর্যন্ত লকডাউনের ঘোষণা হওয়ার পর তাদের আগের পূর্বাভাস (২.৫ শতাংশ) পরিবর্তন করে ০-তে নিয়ে আসে।[2] এর আগে মনে করা হয়েছিল যে এই লকডাউনের জেরে দেশীয় অর্থনীতির ক্ষতি হবে প্রায় ৯ লাখ কোটি টাকা।[3] বার্কলেস-এর সাম্প্রতিক অনুমান অনুযায়ী এই সংখ্যাটিও দাঁড়িয়েছে ১৭.৭৮ লাখ কোটি টাকা।[4] বিশ্বের পাশাপাশি দেশের অর্থনৈতিক ব্যবস্থাও প্রায় ভেঙে পড়েছে। এর জেরে বহু লোকের কাজ হারানোর সম্ভাবনা আছে যা বাজারে চাহিদা আরও কমাবে।
আমরা ইতিপূর্বে দেখেছি যে হঠাৎ করে লকডাউন ঘোষণার ফলে বিভিন্ন রাজ্যে কীভাবে লাখ লাখ শ্রমিক আটকে পড়েছেন। এই দিন আনি দিন খাই মানুষগুলি অসহায়ভাবে নিজেদের নিয়তির কাছে আত্মসমর্পণ করে টিকে আছেন। অনেকেই পরিবার ও বাচ্চাকাচ্চা, এমনকি দুগ্ধপোষ্য শিশু বা সদ্যোজাত সন্তান নিয়ে কার্যত বিভিন্ন রাজ্য সরকার ও স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার দেওয়া খাবার ও আশ্রয়ের ওপর ভরসা করে বেঁচে আছেন। সকলেই যে এই সুযোগ পাচ্ছেন, এমন নয়। কাজ নেই বলে তাঁদের হাতে টাকাও নেই। এই শ্রমিকেরাও ঘরে ফেরার জন্য মরিয়া। অনেকে পায়ে হেঁটে বাড়ি ফিরতে গিয়ে জীবন হারিয়েছেন। মাথায় রাখতে হবে যে এদেশের শ্রমশক্তির প্রায় ৯৪ শতাংশ অসংগঠিত ও অনানুষ্ঠানিক শিল্পে যুক্ত এবং মোট উৎপাদনে তাদের অবদান ৪৫ শতাংশ। আশঙ্কা হল এই মানুষগুলি শেষ পর্যন্ত কোথায় গিয়ে দাঁড়াবেন। লকডাউন ওঠার পরেও কি তাঁরা পারবেন নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে মানুষের মতো বেঁচে থাকতে?
আগের এপিসোড
অবশ্য এই আর্থিক সঙ্কটের মূল কারণ করোনা ভাইরাস বা তজ্জনিত অচলবস্থা নয়। সঙ্কটের ছায়া আগে থেকেই ক্রমশ ঘোরতর হচ্ছিল আমাদের অর্থনীতির ওপর। বাতাসে বারুদের গন্ধ বহুদিন ধরেই ছিল। এই অতিমারি একটি স্ফুলিঙ্গের কাজ করেছে মাত্র। গত বছর বেকারত্বের হার ৪৫ বছরের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ছিল। ৮টি প্রধান শিল্পখাতে উৎপাদন কমেছিল ৫.২ শতাংশ, যা গত ১৪ বছরে সর্বনিম্ন। ২০১৯ সালে গাড়ি শিল্পে অতি-উত্পাদনের সঙ্কট শুরু হওয়ার ফলে চিন, জার্মানি, গ্রেট ব্রিটেন এবং অন্যান্য দেশের মতো ভারতেও গাড়ি বিক্রি ব্যাপক হারে হ্রাস পায়, বিশেষত ছোট গাড়ি। এর ফলে গাড়ি উত্পাদন হ্রাস পায়। এছাড়া রিয়েল এস্টেট, এনার্জি, FMCG, কনজিউমার ডিউরেবল, ইস্পাত ইত্যাদি শিল্প অতি-উত্পাদনের কবলে পড়ে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় যে ২০১৯-এর জুলাই মাসে ইস্পাতের দাম টন প্রতি ৪০ হাজার টাকার নিচে নেমে যায়। এর ফলে ইস্পাত নির্মাতারা ক্ষতির মুখে পড়তে থাকে। এই ধরনের আরও অনেক উদাহরণ দেওয়া যায়। আর্থিক দুর্গতির আরও একটি বড় প্রমাণ ছিল হু হু করে বাড়তে থাকা কর্পোরেট ঋণের পরিমাণ। ২০১৭ সালে ক্রেডিট সুইস সংস্থার একটি রিপোর্ট ভারতের কর্পোরেট ঋণ নিয়ে আশঙ্কার প্রতি আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। দেখা যায় যে বহু কর্পোরেট সংস্থা ঋণের সুদ দেওয়ার মতো মুনাফা অর্জন করতে পারছে না। এই বাণিজ্যিক সংস্থাগুলির ঋণখেলাপির প্রভাব পড়ে এদেশের ব্যাঙ্কিং ব্যবস্থার ওপর। যে অর্থ তারা পরিশোধ করতে পারছিলেন না তা ব্যাঙ্কের খাতায় অনাদায়ী ঋণ (NPA) হিসাবে পুঞ্জীভূত হয় এবং শেষ পর্যন্ত এই লোকসানের ভারে ব্যাঙ্কগুলির অবস্থা খারাপ হতে থাকে। প্রসঙ্গত বলা যায় যে ২০১৫ থেকে অনাদায়ী ঋণের পরিমাণ এমনভাবে বেড়েছে যে তা আজ রাষ্ট্রায়ত্ত ক্ষেত্রের ব্যাঙ্কগুলির অস্তিত্ব নিয়েই টানাটানি শুরু করেছে। আমি গত নভেম্বর মাসে একটি লেখায়[5] এই বিষয়গুলি বিশদে ব্যাখ্যা করে আশঙ্কার কথা স্পষ্টভাবে জানিয়েছিলাম।
একথা নিঃসন্দেহে বলা যায় যে বেশ কয়েক বছর ধরে থমকে থমকে চলা অর্থনীতির কঙ্কালসার চেহারা করোনা ভাইরাসের এক ফুঁয়ে উন্মোচিত হয়েছে। আমি আবার পরিষ্কার করতে চাই যে এই অতিমারি কোনোভাবেই সঙ্কটের উৎস নয়, অনুঘটক মাত্র। এদেশের পুঁজিপতিরা, শিল্পমহল, রাজনৈতিক নেতৃত্ব ও সর্বোপরি শাসকশ্রেণি এবং অবশ্যই তাদের ধামাধরা সংবাদমাধ্যম এই অতিমারির ওপর সমস্ত দোষ চাপিয়ে নিষ্কলঙ্ক হতে চায়। কিন্তু এসব শিশুভোলানো গল্পের সীমা থাকা উচিত। এই দুই ঘটনার— অর্থনৈতিক সঙ্কট এবং করোনা ভাইরাস অতিমারি— মধ্যে একটি অনস্বীকার্য যোগসূত্র অবশ্যই আছে। কিন্তু সব গণ্ডগোলের উৎস করোনা ভাইরাস, এই ধরনের সরলীকৃত এবং কপট ব্যাখ্যা চোখ বুজে মেনে নেওয়া যাবে না। এই অতিমারিকে নন্দ ঘোষ ঠাউরে শাসকশ্রেণির এই সমস্ত মিথ্যা ব্যাখ্যার আসল উদ্দেশ্য হল নিরানব্বই শতাংশ মানুষের দৃষ্টি অন্যদিকে ঘুরিয়ে দিয়ে, রাষ্ট্র ও সরকারের যোগসাজশে বৃহৎ পুঁজির স্বার্থে দেশজুড়ে যে ধরনের আর্থ-সামাজিক নীতি গ্রহণ করা হয়েছিল তাকে সমালোচনার কাঠগড়া থেকে অব্যহতি দেওয়া। তার অকার্যকারিতা ও দায় নিয়ে কোনও ধরনের কাটাছেঁড়া যাতে না হয় তা নিশ্চিত করা। গত তিন চার দশক ধরে লুটেপুটে খাওয়ার যে সবপেয়েছির আসর তারা বসিয়েছিল তা নিয়ে আলোচনার সুযোগ বন্ধ করা।
কে নেবে এই সঙ্কটের দায়?
প্রশ্ন হল যে এই সঙ্কটের দায়ভার কার ওপর পড়বে। পুঁজিপতি শ্রেণি অবশ্যই এর দায়ভার নেবে না। উল্টে এই সঙ্কট দেখিয়ে তারা সরকারের কাছ থেকে আরও কত রকমের ভর্তুকি ও অন্যান্য সুবিধা আদায় করতে পারে সেই চেষ্টায় মগ্ন থাকবে। এই বিপন্নতা তাদের সামনে কোন কোন ধরনের মুনাফা অর্জনের পথ খুলে দিতে পারে তার সুলুক সন্ধানে তারা ইতিমধ্যেই ব্যস্ত আছে।
লকডাউনের শুরুতেই পরিযায়ী শ্রমিকদের চরম দুর্দশা আমরা প্রত্যক্ষ করেছি। লকডাউন ও তার ছায়া যত দীর্ঘায়িত হচ্ছে সেই দলে নাম লেখাচ্ছেন অগুনতি মানুষ। অফিস-কাছারি, কলকারখানা বন্ধ হয়ে যাওয়ার ফলে লক্ষ লক্ষ মানুষ ইতিমধ্যে কর্মহীন হয়ে পড়েছেন। লকডাউনের সময়ে শ্রমিক ছাঁটাই করা যাবে না। এমনকি, বেতন-সহ অন্য পাওনাও সময়ে মিটিয়ে দিতে হবে— কেন্দ্রীয় ও রাজ্য সরকার এহেন নির্দেশিকা জারি করলেও তাকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে শিল্প-মালিকরা মার্চ মাসের বেতনও বকেয়া রেখে দিয়েছেন।[6] এমনকি বহু ক্ষেত্রে আগের বেতন বাকি রেখে টাকা মারার ফন্দি করছে মালিকপক্ষ। অসংগঠিত শিল্পের কথা ছেড়েই দিলাম। পশ্চিমবঙ্গের বড় শিল্প বলে পরিচিত পাটকল ও চা বাগানের মতো সংগঠিত শিল্পের মালিকরাও একই পন্থা নিয়েছে।[7] ইতিমধ্যে রাজ্য শ্রম দফতরে শ্রমিক ছাঁটাই ও বেতন না দেওয়া সংক্রান্ত বহু অভিযোগ জমা পড়েছে। বেসরকারি ক্ষেত্রে শ্রমিকদের ওপর এই বঞ্চনার প্রতিকার চেয়ে শ্রম আধিকারিকদের কাছে আবেদন করেছেন ইউনিয়নগুলি ও শ্রমিক নেতারা। একই অবস্থা গণ-পরিবহণ শিল্পে যুক্ত শ্রমিকদের। বহু জায়গা থেকে শ্রমিক বিক্ষোভের খবর পাওয়া গেছে। সমস্ত ক্ষেত্রে শ্রমিকদের অভিযোগ বেতন না পাওয়ার ফলে প্রায়ই অনাহারে দিন কাটছে তাঁদের।[8]
অসংগঠিত শিল্পের শ্রমিকদের কথা যত কম বলা যায় তত ভাল। তাদের না আছে কোনও স্থায়ী চাকুরি, জমানো টাকা বা সামাজিক সুরক্ষা। একই কথা প্রযোজ্য বহু স্বনিযুক্ত মানুষ এবং ছোট ব্যবসায়ীদের ক্ষেত্রে। ইতিমধ্যে দেখা গেছে হকার ও পথবিক্রেতাদের মতো লোকজন পরিবার পরিজন নিয়ে বেঁচে থাকার স্বার্থে নিজেদের সামান্য পুঁজি ভেঙে খরচ করে ফেলেছেন। অথবা তারা ধার করতে শুরু করেছেন। অবশ্য এই বাজারে বড় মহাজন ছাড়া কজন তাদের ধার দেবে বলা শক্ত। ধার নিতে পারলেও তা উচ্চ সুদে নিতে হবে যা তারা কবে শোধ করতে পারবেন বা আদৌ করতে পারবেন কিনা তা নিয়ে যথেষ্ট সংশয় থাকে। সমস্যা হল যে এই সমস্যার সমাধান কোন পথে সেটাও স্পষ্ট করে বলা যাচ্ছে না। তবে একটা কথা নিশ্চিত যে বিষয়টি সাময়িক নয় এবং সরকারি উদাসীনতা ও অবহেলায় তা জটিলতর হচ্ছে। কারণ নিচের তলার মানুষগুলিকে নিয়ে বেশি ভাবার সময় সরকারের নেই। তাই শেয়ার বাজারের পতন রোধ করতে তড়িঘড়ি করে সরকার ও রিজার্ভ ব্যাঙ্কের তরফ থেকে একগুচ্ছ পদক্ষেপ ঘোষণা করা হয়। লকডাউন শুরু হতেই এদেশের মালিক ও সবচেয়ে বিত্তবান বেতনভোগীদের স্বার্থে আয়কর ও জিএসটি জমা দেওয়ার সময় বাড়ানো হয়। কর্পোরেট বিষয়ক দপ্তর, কোম্পানি প্রোবেশন, দেউলিয়া ঘোষণা, বাণিজ্য, আর্থপরিষেবা, এসব নিয়েও পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়।[9] কিন্তু লকডাউনে গরিব মানুষ ও দিনমজুর কীভাবে খাবে, তা নিয়ে ভাবার সময় কোথায়?
সরকার অবশেষে কয়েকটি ঘোষণা করে। রেশন সংক্রান্ত ঘোষণায় বিনামূল্যে খাদ্যশস্যের কথা বলা হয়েছে কিন্তু তা সার্বিক খাদ্যের প্রয়োজনের তুলনায় খুবই সামান্য। এছাড়া ডিজিটাল কার্ড থাকা না থাকার সমস্যায় সকলে এই খাদ্যশস্য পাবেন কিনা বলা শক্ত। দ্বিতীয়ত কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী দাবী করেন যে তাঁরা নাকি ১,৭০,০০০ কোটি টাকার প্যাকেজ দিচ্ছেন। কিন্তু তার উপাদানগুলি খতিয়ে দেখলে বোঝা যায় বহু চালু স্কিম একত্রিত করে তিনি এই প্যাকেজ ঘোষণা করেছেন। এই প্যাকেজের অন্তর্ভুক্ত স্বাস্থ্যকর্মীদের জন্য বিমা ব্যবস্থায় মূল লাভ হবে বিমা কোম্পানির, যাকে প্রিমিয়ামটা দেওয়া হবে। প্রথমে রাষ্ট্রায়ত্ত স্বাস্থ্যক্ষেত্রকে ভেঙে ফেলা হল। তারপর স্বাস্থ্যব্যবস্থার নামে বিমা কোম্পানিগুলির মুনাফা অর্জনের ব্যবস্থা হল। ভাল করে হিসাব করলে পরিষ্কার যে সব মিলিয়ে বরাদ্দ ১,৭০,০০০ কোটির চেয়ে অনেক কম। আর দীর্ঘমেয়াদি কোনও পরিকল্পনাই নেই।[10]
এই অতিমারির আগেই আমরা বাজারে চাহিদা কমে যাওয়া, উৎপাদনে অতিমন্দা, বেকারত্ব অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যাওয়া, আর্থিক সঙ্কট এবং তারপর প্রবল ঋণসঙ্কট দেখেছিলাম৷ বলা বাহুল্য এই সমস্ত চরম অর্থনৈতিক সঙ্কটের লক্ষণ আরও ঘনীভূত হবে৷ লক্ষ লক্ষ মানুষ কর্মহীন হয় পড়বে। অতিমারির প্রভাব সম্পর্কে মার্চ মাসেই বিশ্ব শ্রম সংস্থা জানিয়েছিল যে কমপক্ষে পৃথিবীজুড়ে আড়াই কোটি মানুষ কর্মচ্যুত হবেন।[11] তখনই আশঙ্কা ছিল যে সংখ্যাটা আরও বাড়বে। সেই আশঙ্কাই সত্যি করে ২৯শে এপ্রিল আইএলও শ্রমের জগতে করোনাভাইরাসের প্রভাব সম্পর্কিত তার নিজস্ব রিপোর্টে (ILO Monitor third edition: COVID-19 and the world of work.) জানায় যে, সাড়ে তিরিশ কোটি পূর্ণ সময়ের কাজ চলে যাবে এর ফলে। সংগঠিত ক্ষেত্রে পূর্ণ সময়ের কাজের যদি এই অবস্থা হয় তাহলে অসংগঠিত অসুরক্ষিত শ্রমিকদের ওপরে কতটা ভয়াবহ প্রভাব পড়তে পারে তা সহজেই অনুমেয়। হ্যাঁ, এই ক্ষেত্রের ১৬০ কোটি শ্রমিক– বিশ্বের মোট শ্রমশক্তির অর্ধেক– জীবিকা হারাবেন। বহু ব্যবসা মার খাবে। অনেক ছোট ব্যবসায়ী নতুন করে ব্যবসা শুরু করতে পারবেন না। আরও অগুনতি মানুষ ঋণের ফাঁদে জড়িয়ে পড়বেন। পরবর্তীকালে এই সংস্থার আরও একটি রিপোর্ট থেকে জানা যায় যে ভারতে অসংগঠিত ক্ষেত্রের ৪০ কোটি শ্রমিক লকডাউনের ফলে গভীর দারিদ্রে নিমজ্জিত হবেন। তাঁরা কে কতটা ঘুরে দাঁড়াতে পারবেন সেই সম্বন্ধে কোনও আশার আলো এই মুহূর্তে নেই।
আক্রমণাত্মক ধনতন্ত্রের যুগে এই সামগ্রিক সঙ্কট থেকে পুঁজিপতিরা বিভিন্ন সুযোগ খুঁজবে। মুনাফা কামানোর সুযোগ, তাদের রাজনৈতিক প্রকল্প এগিয়ে নিয়ে যাওয়ারও সুযোগ। ইতিমধ্যে গুজরাটের বণিকসভা এক বছরের জন্য শ্রমিকদের ট্রেড-ইউনিয়ন করার অধিকার মুলতুবি করার দাবি তুলেছে।[12] আমরা ইতিপূর্বে দেখেছি যে বিভিন্ন ধরনের কালাকানুন কেন্দ্রের শাসক দল কীভাবে তাদের অধীনে থাকা কোনও এক রাজ্য সরকারের মাধ্যমে বাস্তবায়িত করে এবং তারপর তা সারা দেশে ছড়িয়ে দেয়। অতএব তাদের স্বর্গরাজ্য গুজরাট থেকে তোলা এই দাবী খুবই ইঙ্গিতবাহী। এর পাশাপাশি রাজস্থান, পাঞ্জাব ও গুজরাট সরকার কারখানা আইন, ১৯৪৮-এর বিশেষ ক্ষমতাবলে আইনসভাকে এড়িয়ে ১২ ঘণ্টার শ্রমদিবস ঘোষণা করেছে।[13] কারখানা আইন, ১৯৪৮ অনুযায়ী কোনও শ্রমিক দৈনিক ৯ ঘণ্টা বা সাপ্তাহিক ৪৮ ঘণ্টার ওপর কাজ করলে এই বাড়তি কাজের সময়কে ওভারটাইম শ্রম হিসাবে ধরতে হবে। এই আইনের ধারা ৫৯ আরও বলছে যে এই বাড়তি কাজের জন্য তাকে প্রতি ঘণ্টা হিসাবে দ্বিগুণ মজুরি দিতে হবে। গুজরাট সরকার স্পষ্ট বলেছে এই শ্রমিকদের কোনও ওভারটাইম দিতে হবে না। শ্রম বিষয়ক বিশেষজ্ঞদের মতামত যে এই ধরনের পদক্ষেপ বিশ্ব শ্রম সংস্থার নিয়মের পরিপন্থী। এই জাতীয় পদক্ষেপ আভাস দেয় যে সঙ্কটে জর্জরিত শ্রমজীবী মানুষের ওপর কী ধরনের আক্রমণ আসতে চলেছে। একই রকম ইঙ্গিতপূর্ণ কেন্দ্রীয় সরকারি কর্মচারীদের মহার্ঘভাতা ২০২১ সালের জুলাই মাস অবধি স্থগিত রাখার নির্দেশ।[14] অনেকে সওয়াল করতে পারেন যে সরকারি কর্মচারীরা মোটা মাইনে পান এবং তাদের মতো মধ্যবিত্তদের কিছু সুযোগ সুবিধা খর্ব হলে বিরাট কিছু যাবে আসবে না। কিন্তু সমস্যা অন্য জায়গায়। একথা ঠিক যে সরকারি কর্মীরা অন্যান্য ক্ষেত্রের শ্রমিকদের তুলনায় অনেক বেশি সুরক্ষিত। কিন্তু মনে রাখতে হবে সেই কারণেই শ্রমিক-মালিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে তাঁরা একটি বেঞ্চমার্ক বা মানদণ্ড। তাদের সুযোগসুবিধা যদি অনায়াসে খর্ব করা যায়, তাদের সংগঠিত প্রতিরোধ যদি গুঁড়িয়ে দেওয়া যায় তাহলে অন্যান্য শ্রমিকদের যেমন ইচ্ছা তেমনভাবে কাজ করানো যাবে। মাইনে ও অন্যান্য সুযোগসুবিধা মর্জিমাফিক নিয়ন্ত্রণ করা যাবে। সঙ্কট ও ব্যবসার আর্থিক সমস্যার কথা তুলে কাজের ঘণ্টা যথেচ্ছভাবে বাড়ানো যাবে। তাই আমাদের দাবী করতে হবে অন্যান্য শ্রমজীবী মানুষকেও তাদের সমান মজুরি ও সুযোগসুবিধা দেওয়ার। সরকারি কর্মীদের অধিকার খর্ব করার নয়।
একইসঙ্গে বাড়িয়ে তোলা হবে প্রতিবাদী কণ্ঠের ওপর দমনপীড়ন। কোথাও অর্থনীতির দোহাই পেড়ে বা কোথাও জাতীয় স্বার্থের ধুয়ো তুলে ধরে। এই ‘জাতীয় স্বার্থ’ শক্তিশালী করতে আরও বেশি উগ্র-হিন্দুত্ববাদের দাপাদাপি বাড়বে। এবং তা সরকারি মদতে। ঠিক এই কারণেই উন্নত মজুরি, রাষ্ট্রায়ত্ত গণস্বাস্থ্য ব্যবস্থা, বাসস্থান, শিক্ষা ইত্যাদি দাবীগুলিকে ‘জাতীয় স্বার্থের’ নামে ছেড়ে দিলে চলবে না। তাই প্রয়োজন জাতীয় স্বার্থের নতুন সংজ্ঞা গড়ে তোলা যা শ্রমজীবী মানুষের কাজের অধিকার, উপযুক্ত মজুরির অধিকার, জীবিকার অধিকার এবং অন্যান্য গণতান্ত্রিক অধিকার সুনিশ্চিত করবে। মুনাফার অধিকার নয়। পুঁজির স্বার্থে অর্থনৈতিক বৃদ্ধি শুধুমাত্র পুঁজিপতিদের বিকাশ ঘটায়। খেটে খাওয়া মানুষ চুইয়ে পড়া এক-আধটা দানাপানি পেতে পারেন কিন্তু এই বিকাশ তাদের পেট ভরাবে না। আমাদের সামাজিক ন্যায়ের ওপর ভিত্তি করে উন্নয়নের নতুন মাপকাঠি খুঁজতে হবে।
[1] Moody’s slashes India’s growth estimate to 0.2% for 2020 from 2.5%; Business Standard, 29 April 2020
[2] Barclays cuts GDP forecast for India to zero for 2020; liveMint, 14 April 2020
[3] Experts Say India May Lose Rs 9 Lakh Crore in Covid-19 Lockdown, Urge Govt to Announce Economic Package; News18, 25 March 2020
[4] Coronavirus: Barclays says Indian economy to lose Rs 17.78 lakh crore; cuts GDP growth to zero; Business Today, 14 April 2020
[5] কর্পোরেট ঋণ কি এদেশের অর্থনৈতিক সঙ্কটের অনুঘটক?; চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম, ১০ নভেম্বর ২০১৯
[6] বেতন চেয়ে শ্রমিক-ক্ষোভ কারখানায়; আনন্দবাজার পত্রিকা, ২৯ এপ্রিল ২০২০
[7] লকডাউনের সময়ের মজুরি দিতে রাজি নন মালিকপক্ষ, বিতর্কে বেতন হল না জলপাইগুড়ির চা বাগানে; The Wall, ৪ এপ্রিল ২০২০
[8] লকডাউনে চূড়ান্ত আর্থিক সমস্যায় কারখানার শ্রমিকরা, বকেয়া বেতনের দাবিতে বিক্ষোভ শ্রমিকদের; এই বাংলায়.com, ১৩ এপ্রিল ২০২০
[9] COVID-19: Acuite Ratings pitches for Rs 11.2 lakh crore stimulus package to revive economy; Economic Times, 29 April 2020 (last update)
[10] Why Economists Think India’s Rs 1.7 Lakh Crore Relief Is Not Enough; BloombergQuint, 26 March 2020
[11] Almost 25 million jobs could be lost worldwide as a result of COVID-19, says ILO; Press Release, International Labour Organisation, 18 March 2020
[12] Prohibit formation of labour unions for a year: GCCI; Times of India
[13] Covid-19 impact: Gujarat, Punjab increase working hours in factories; Business Standard, 22 April 2020
[14] DA for Central govt employees frozen till July 2021; National Herald, 23 April 2020