Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

রুহদারের অষ্টম অঙ্ক

সন্দীপন গঙ্গোপাধ্যায়

 




লেখক পেশায় প্রযুক্তিবিদ্যার শিক্ষক। বিশ্বসাহিত্য, মার্গ সঙ্গীত আর সারা পৃথিবীর সিনেমার একনিষ্ঠ ভক্ত।

 

 

 

“আপ ডক্টর হ্যায় ক্যা?”
“ম্যায় ডক্টর কি রুহ হু!!”

স্ট্রাটফোর্ড আপন অ্যাভন— এর সেই কালজয়ী স্রষ্টার নাটকের সংলাপ (I am thy father’s spirit, Doom’d for a certain term to walk the night) বিশাল ভরদ্বাজের ‘হায়দার’ (২০১৪) ছবিতে এইভাবে এক ভারতীয় প্রেক্ষিত নিয়ে এসেছিল। হ্যামলেটের বাবার বিদেহী আত্মার ফ্যান্টাসি এলিমেন্ট রূপকার্থে নিতান্ত বাস্তবের এক অসমীকরণে পরিণত হয়েছিল, রাষ্ট্র যার নিয়ন্তা। ওই সিনেমার এই ছোট চরিত্রেও নিজের অভিনয়ের মুন্সিয়ানা প্রদর্শন করার বেশ কিছু আগেই অবশ্য ইরফান খান ভারতীয় চলচ্চিত্রের একজন আইকন তৈরি হয়ে গেছেন এবং আন্তর্জাতিকভাবেও পরিণত হয়েছেন ভারতীয় সিনেমার অন্যতম মুখ হিসেবে। বিশালেরই পরিচালনায় উইলিয়াম শেক্সপিয়রের রচনার আর একটি অনন্য সিনে অ্যাডাপটেশন ‘মকবুল’ থেকেই ইরফানের সিনেমা যাত্রাপথের একটা অন্য অধ্যায়ের সূচনা যেখানে তিনি জাত চেনালেন নিজের অভিনয়কলার। ততদিনে বেশ কিছু ব্রিটিশ এবং আমেরিকান প্রযোজনার অন্যতম অভিনেতা হিসেবেও তাঁর প্রশংসা জুটেছে সাধারণ চিত্রমোদী দর্শক এবং বিদগ্ধ সমালোচক মহলে। তবে এসব ঘটনা লড়াইয়ের বেশ কিছু অধ্যায়, বেশ কিছু আলাপ, জোড়ের পরবর্তী ঝালা।

বিশাল ভরদ্বাজ পরিচালিত হায়দার ছায়াছবিতে রুহদারের ভূমিকায় অনন্য ইরফান

ভারতীয় নাট্য অঙ্গনের এক প্রখ্যাত শিক্ষক ইব্রাহিম অলকাজি যে অভিনয় শিক্ষায়তনকে বিশ্বমানের করে তুলেছিলেন রাজধানীর সেই ন্যাশনাল স্কুল অফ ড্রামাতে ১৯৮৪ সালে ছাত্র হিসেবে ভর্তি হন সাহাবজাদে ইরফান আলি খান। রাজস্থানের টঙ্ক জেলার খাজুরিয়া গ্রামের এই যুবক ততদিনে অবশ্য জয়পুর থেকে এমএ পাস করেছেন। এরই মধ্যে আবার অনূর্ধ্ব তেইশ বিভাগে ফার্স্ট ক্লাস ক্রিকেট প্রতিযোগিতার অন্যতম সিকে নাইডু টুর্নামেন্টে খেলার সুযোগ এসেছিল। যদিও সে পথে আর পা বাড়ানো হয়নি, টাকার অভাব তখন সেই প্রথম তারুণ্যের যাত্রাপথের প্রতিবন্ধক। পারিবারিকভাবে একটা মোটামুটি ব্যবসা ছিল টায়ারের। এর মধ্যে কিছুদিন নানা এটা সেটা করার ফাঁকে মুম্বাইতে এসি মেশিন সারানোর সঙ্গে যুক্ত থেকে সুযোগ আসে সুপারস্টার রাজেশ খান্নার বাড়িতে ওই যন্ত্র সারাবার। ভারতীয় সিনেমা মহাকাশের এক উজ্বল তারকাকে কাছ থেকে দেখার অনন্য সেই অভিজ্ঞতা পরবর্তীকালে শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করতেন ইরফান।

এনএসডি থেকে সসম্মানে উত্তীর্ণ হবার সাথে সাথেই মীরা নায়ারের ‘সালাম বোম্বে’ (১৯৮৮) ছবিতে খুব ছোট একটা রোলের জন্য অফার এল। পেশাদার সেই চিঠিলেখকের চরিত্র, মূল কিশোর চরিত্র কৃষ্ণাকে যে দু ছত্র লিখে দিচ্ছিল তার বাড়িতে পাঠানোর জন্য। এই ছবিটা জাতীয় এবং আন্তর্জাতিকভাবে প্রশংসিত হয়, ইরফানের অভিনয়ের প্রশংসাও জোটে কিন্তু ওই রুপোলী ছায়ার জগতে সেই অর্থে দৃঢ় কোনও নোঙর জোটে না। এরপর বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রে অভিনয়ের জন্য ডাক আসে ছোটপর্দা থেকে। সোভিয়েত আমলের নাট্যকার মিখাইল সাত্রোভের নাটক অবলম্বনে উদয় প্রকাশের অনুবাদে ‘লাল ঘাস পে নীল ঘোড়ে’ টেলিফিল্মে লেনিনের রোল করেন ইরফান, যা প্রশংসিত হয় গুণীজনদের মধ্যে। এছাড়া আলি সরদার জাফরির প্রযোজনায় ক্যহকসাঁ টেলি সিরিজের এক পর্বে প্রখ্যাত মার্ক্সবাদী উর্দু কবি মাকদম মোহিউদ্দিনের চরিত্রে আবার এক দাগ কাটা অভিনয়ের সাক্ষর রাখলেন ইরফান। এই সময়েই গুলজারের পরিচালনায় কিরদার টিভি সিরিজের এক পর্বে সমরেশ বসুর ‘আদাব’ অবলম্বনে ‘খুদা হাফিজ’ টেলিপ্লেতে ওম পুরীর পাশাপাশি ইরফানের অভিনয় ছিল নজরকাড়া। এসবের সূত্রে ধীরে ধীরে নজরে আসছিলেন তিনি। ডাক এল দুজন বড় মাপের পরিচালক বাসু চট্টোপাধ্যায় এবং তপন সিংহের কাছ থেকে। বাসুবাবুর পরিচালিত ‘কমলা কি মৌত’ ছায়াছবিতে রূপা গঙ্গোপাধ্যায়ের বিপরীতে ইরফানের অভিনয় নাম কাড়ল। কিন্তু প্রকৃত অর্থে এই পর্বে ওঁর অভিনয়ের ক্যানভাস একটা বড় সামিয়ানার তলায় এল তপন সিংহ পরিচালিত ‘এক ডক্টর কি মৌত’ ছায়াছবি থেকে। ভারতে টেস্টটিউব বেবির প্রকৃত জনয়িতা ডাক্তার সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের জীবন অবলম্বনে রমাপদ চৌধুরীর গল্প ‘অভিমন্যু’ থেকে এই ছবি বানিয়েছিলেন তপনবাবু। একজন সৎ এবং আদর্শদৃপ্ত সাংবাদিকের চরিত্রে ইরফানের অভিনয় তাঁকে কিছুটা আন্তর্জাতিকভাবেও পরিচিতি দেয়। যদিও মুম্বইয়ের মেনস্ট্রিম ছবির জগতে নিজেকে পুরোপুরি প্রতিষ্ঠা করার সুযোগ আসে শূন্য দশকের কালখণ্ডে। এর মাঝখানের অধ্যায়ে অবশ্য দূরদর্শনের বেশ কিছু বিগ ব্যানার ধারাবাহিকে অভিনয় করা হয়ে গেছে ইরফানের যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য ‘শ্রীকান্ত’, ‘চাণক্য’, ‘ভারত এক খোঁজ’, ‘চন্দ্রকান্তা’, ‘দ্য গ্রেট মারাঠা’ ইত্যাদি। কেবল টিভির জমানাতেও স্টার প্লাসের হিট ধারাবাহিক ‘স্টার বেস্টসেলার্স’-এ ইরফানের অভিনয় নজর কেড়েছিল মিতা বশিষ্ঠ, টিস্কা চোপড়ার পাশাপাশি।

সালাম বোম্বে (১৯৮৮) ছায়াছবির এক পার্শ্বচরিত্রে

অটো প্রেমিঞ্জারের পরিচালনায় হলিউডের বিখ্যাত ফিল্ম নোয়ার ‘লরা’ অবলম্বনে ২০০৩ সালে পুজা ভাটের প্রযোজিত ‘রোগ’ ছায়াছবিতে সেই প্রথমবার মুখ্য চরিত্রে অভিনয়ের সূযোগ পেলেন ইরফান। এরপর অবশ্য আর বেশি অপেক্ষা করতে হয়নি। এর দু বছরের মাথায় ম্যাকবেথ অবলম্বনে বিশালের সেই অনন্য মকবুল ছবিতে ভারতীয় চলচ্চিত্রের আঙিনা সত্যি একটা কাল্ট মর্যাদা পেল বিদেশি ক্লাসিক সাহিত্যকে সিনেমার ব্যাকরণে ভারতীয় সমাজজীবনের খণ্ডচিত্রের এক অসাধারণ ক্যানভাসে প্রতিফলিত করার জন্য। মুম্বইয়ের অন্ধকার জগতের চিত্রণে মকবুল ছবিতে ‘লেডি ম্যাকবেথ’ টাব্বুর পাশাপাশি ইরফানের অভিনয় স্মরণীয় হয়ে রইল দর্শক এবং ক্রিটিকমহলে। বলা যেতে পারে এই চলচ্চিত্র ইরফানের ক্যারিয়ারে একটা সিনেমাটিক ল্যান্ডমার্ক। এরপর একে একে মীরা নায়ারের ‘নেমসেক’ (২০০৬), অনুরাগ বসুর ‘লাইফ ইন আ মেট্রো’ (২০০৭), শ্রেষ্ঠ অভিনয়ের জন্য জাতীয় পুরষ্কারপ্রাপ্ত ‘পান সিং তোমর’ (২০১১) থেকে শুরু করে ২০১৩ সালে সেই উচ্চ প্রশংসিত ছবি ‘দ্য লাঞ্চবক্স’ যে ছবির দৌলতে কান চলচ্চিত্র উৎসব থেকে এল স্বীকৃতির শিরোপা, জুটল বাফটা পুরস্কারের জন্য নমিনেশন। ততদিনে ইরফান নামটাই অভিনয়ের একটা সমার্থক শব্দে পরিণত হয়ে গেছে বিরাট সংখ্যক দর্শকের হৃদয়ের ওয়াইড স্ক্রিনে। বলিউডের খানত্রয়ীর রাজত্বেও ইরফানের অভিনয়ের ঘরানা একটা আলাদা আসন পেয়েছে। এসেছে জাতীয় পুরস্কার (পদ্মশ্রী, ২০১১), আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি।

দ্য লাঞ্চবক্স (২০১৩) ছবির দৃশ্য

সেই ১৯৯৮ সাল থেকেই অবশ্য নানা বিদেশি প্রোডাকশনের ব্যানারে অভিনয় করেছেন ইরফান। রোহিংটন মিস্ত্রির কাহিনি অবলম্বনে কানাডিয়ান প্রোডাকশনে ‘সাচ আ লং জার্নি’ (১৯৯৮) বা ২০০১ সালে ব্রিটিশ প্রোডাকশনের হিন্দি ছায়াছবি ‘দ্য ওয়ারিয়র’-এ অভিনয় কিছুটা এক্সপোজার দিলেও সেটার পরিধি বাড়ে পরবর্তীকালে। ‘দ্য অ্যামেইজিং স্পাইডার ম্যান’ (২০১২), ‘লাইফ অফ পাই’ (২০১২), ‘জুরাসিক ওয়র্ল্ড’ (২০১৫) বা ‘ইনফার্নো’ (২০১৬) এইসব বিগ ব্যানার হলিউডি ছবিতে ইন্টারন্যাশনাল স্টার কাস্টের পাশাপাশি পার্শ্বচরিত্রেও যথেষ্ট প্রশংসিত হয়েছিল ইরফানের কাজ। ব্রিটিশ ফিল্ম ক্রিটিক পিটার ব্র্যাডশ দ্য গার্ডিয়ান পত্রিকায় ইরফানের অভিনয়ের ভূয়সী প্রশংসা করে ওঁর অভিনয়রীতিকে দক্ষিণ এশিয়া এবং হলিউডের ছায়াছবির দুই বিপরীত ঘরনার এক গুরুত্বপূর্ণ সেতু বলে অভিহিত করলেন। এর মাঝে হোম বক্স অফিসের ‘ইন ট্রিটমেন্ট’ (২০১০) টিভি সিরিজে গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রে অভিনয় করা হয়ে গেছে ওঁর। কচিকাঁচাদের মধ্যে থেকেও একটা বড় প্রশংসা এসেছে ডিজনির ‘দ্য জাঙ্গল বুক’ (২০১৬) ছায়াছবির হিন্দি ভার্সানে ‘বাল্লু’ চরিত্রে ওঁর কণ্ঠদানে। মূলধারার হিন্দি ছবির চকোলেট, ম্যাচো এই নানা স্টারডমের একেবারে অন্য স্রোতে শুধুমাত্র চরিত্রের নিবিড় শ্যেডগুলো অনন্য কিছু অভিব্যক্তির মাধ্যমে সাফল্যের সঙ্গে উপস্থাপিত করতে পারার স্বাভাবিক ক্ষমতা ততদিনে দর্শকের মনে একটা পাকাপাকি জায়গা করে দিয়েছে ইরফানের জন্য। ‘হায়দার’ (২০১৪), ‘গুন্ডে’ (২০১৪), ‘মাদারি’ (২০১৬), ‘হিন্দি মিডিয়ম’ (২০১৭) প্রভৃতি এই পর্বের ছবিগুলোতে এই অনন্য অভিনয়ের সিগনেচার টাচ ছিল অব্যাহত। হিন্দি মিডিয়মের জন্য এর মধ্যে এসেছে শ্রেষ্ঠ অভিনয়ের ফিল্মফেয়ার পুরষ্কার।

এর মধ্যে ২০১৮তে এল একটা দুঃসংবাদ। ইরফান অসুস্থ, নিউরো-এন্ডোক্রিন টিউমার বা অন্যকথায় ক্যান্সারে আক্রান্ত। ওঁর নিজস্ব টুইটার ছাড়াও নানা নিউজ পোর্টালের আনাচ কানাচ থেকে পাওয়া এই খবরে একটা বিষাদের আবহ তৈরি হল দর্শকদের মনে, আসলে প্রিয় অভিনেতাকে ততদিনে ভেতর ঘরের জায়গা দিয়ে ফেলেছে আসমুদ্র হিমাচলের একটা বড় অংশ। আশা ছিল যে লড়াকু ইরফান জীবনযুদ্ধেও কর্কটের এই প্রত্যাঘাতকে প্রতিহত করতে পারবেন। এর মাঝেই অবশ্য মুক্তি আসন্ন ছবি ‘আংরেজি মিডিয়ম’ নিয়ে ওঁর অনেক স্বপ্নের কথার শুনিয়েছিলেন তিনি। প্রায় বছরভর চিকিৎসার পর গত ফেব্রুয়ারি মাসে ইরফান ফিরলেন ইউনাইটেড কিংডম থেকে। কিন্তু ভেতরে ভেতর হয়তো অসীমের ওই আকাশপারের কোনও নাট্যকার ওপারের কোনও গোপন, গহীন পালায় একটা চরিত্র নির্দিষ্ট করে রেখেছিলেন এই কুশলী অভিনেতার জন্য। গত ২৮শে এপ্রিল শারীরিক অবনতির জন্য ভর্তি করা হয় মুম্বইয়ের কোকিলাবেন ধিরুভাই আম্বানি হসপিটালে, এর পরদিনই গত ২৯শে এপ্রিল বুধবার নাগাদ তাঁর অগণিত ভক্তদের কাঁদিয়ে পরপারের এক নৈসর্গিক চরিত্রের জন্য পাকাপাকিভাবে বাছা হল ইরফানকে। কিছু অভিনেতা আক্ষরিক অর্থেই অমর। আমাদের স্মৃতি সত্তার ছায়াপটে মানবচরিত্রের নানা বর্ণালীর স্তানিস্লাভস্কীয় গহীনতার ছাপ রেখে যান তাঁরা। জীবননাট্যের সপ্তম অঙ্কের শেষে পরবর্তী কোন অসীমের চরিত্রায়নেও হয়তো আমাদের মনে এভাবে চিরস্থায়ী রয়ে গেলেন ইরফান খান।