Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

আমার নাই বা হল পারে যাওয়া

জ্যোতির্ময় দত্ত

 

জ্যোতির্ময় দত্ত নামটি হয়তো নতুন প্রজন্মের কাছে তেমন সুপরিচিত নয়, কিন্তু যাঁরা বাংলা ভাষা, সমাজ ও সাহিত্যের নিবিড় চর্চা করেন, তাঁরা অবশ্যই কবি ও সাংবাদিক জ্যোতির্ময় দত্তকে চিনবেন। ষাটের দশকের প্রাণবান এই তরুণ নিজের জীবন নিয়ে নানা পরীক্ষানিরীক্ষা করেছেন৷ দীর্ঘ সময় ধরে বাংলা ও ইংরেজি ভাষার প্রধান পত্রিকাগুলিতে লেখালেখি করেছেন। দেশে বিদেশে নানা অগ্রণী প্রতিষ্ঠানে সাংবাদিকতা করা ছাড়াও অধ্যাপনা করেছেন শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ে। আবার জীবনের কোনও এক বাঁকে পৌঁছে প্রতিষ্ঠার সমস্ত চিহ্ন ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে ঝাঁপ দিয়েছেন স্বাধীন পত্রিকা প্রকাশ করার মতো অনিশ্চিত জীবনে। জ্যোতির্ময় সম্পাদিত 'কলকাতা' বাংলা সাময়িকপত্র প্রকাশনার জগতে একটি ইতিহাস৷ জরুরি অবস্থার সময় 'কলকাতা' নিষিদ্ধ হয় ও রাষ্ট্রদ্রোহের অপরাধে জেলে যেতে হয় জ্যোতির্ময়কে৷

জ্যোতির্ময় দত্তের বর্ণময় স্মৃতিকথা ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়েছিল আজকাল পত্রিকার রবিবাসরীয় ক্রোড়পত্রে৷ সেই দীর্ঘ স্মৃতিচারণ 'আমার নাই বা হল পারে যাওয়া' গ্রন্থে সঙ্কলিত হয়ে দুই খণ্ডে প্রকাশিত হয়েছে। প্রকাশক অন্বয়। চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম-এর হুইলার্স স্টল বিভাগের উদ্ধৃত অংশটি বইটির প্রথম খণ্ড থেকে নির্বাচিত, যেখানে 'কলকাতা' পত্রিকা চালানোর দিনগুলিতে জ্যোতির্ময়ের আর্থিক সমস্যা ও মানসিক টানাপোড়েনের অকপট ছবি ধরা পড়েছে।

ঝাঁঝরিতে জল রাখার মতো আমেরিকায় উপার্জিত সঞ্চয় ও স্টেটসম্যান-এর প্রভিডেন্ট ফান্ড রাতারাতি শুকিয়ে গেল৷ কাগজ প্রেসে দেব কী, দৈনিক খরচে পড়ছে টান। প্রথম প্রথম এই টানাটানিই এক উৎকৃষ্ট অজুহাত— আমেরিকা থেকে জাহাজে আসা দৈত্যাকার ফ্রিজ-এ সি বেচে দেওয়ার সপক্ষে। শিকাগোতে যেসব যন্ত্রপাতি জীবনযাপনে আমাদের অত্যাবশ্যক মনে হয়েছিল, ছয় দশক শেষের কলকাতায় তা ঘোরতর কুৎসিত ঠেকছে, তা ঝটপট বিক্রি করে দিতে পারলে চক্ষুর আরামও হবে, আবার কাগজ চালানোর রেস্তও জুটবে৷ স্টেটসম্যানের পার্সোনাল কলামে বিজ্ঞাপন দেওয়ামাত্র টেলিফোন শশব্যস্ত। নানান হিসেব কষে কী দাম বলা উচিত, সে-বিষয়ে আমরা ইতস্তত করছি, এমন সময় দরজায় কড়ানাড়া। তখনও বেশ সকাল, এক নিউ আলিপুরবাসিনীর আবির্ভাব।

খয়ের-রঙ রেফ্রিজারেটর আর হাঙর-দাঁত কাটা এয়ারকন্ডিশনার দেখে তিনি মুগ্ধ৷ আর কেউ পাছে কিনে নেয়, এই ভয়ে তিনি আমাদের মধ্যবিত্ত কল্পনাবহির্ভূত টাকায় দুটি যন্ত্র কিনে নিলেন৷ ব্যাপারটা কালোবাজার, ঠিকই, কিন্তু লব্ধ অঙ্কের সিংহভাগ সাহিত্যের হিতেই ব্যয় হয়েছিল। তাই বিশেষ বিবেক-দংশন ঘটেনি৷ হাত কামড়াতে উদ্যত হয়েছিলাম বেশ কয়েক মাস পরে, যখন বুঝলাম খয়ের-রঙা ফ্রিজ কোনও কামধেনু নয়, রজতশুভ্র এসি এমন হাঁস নয় যা বারবার ডিম পাড়ে৷ কোনও নিয়মিত উপার্জন বিনা সংসার চলে না৷ যখন চোখে বেশ অন্ধকার দেখছি, তখন উদ্ধারে এলেন নিউ ইয়র্কের এশিয়া সোসাইটির বনি ক্রাউন। বু.ব.-র সূত্র বিদেশ যাওয়ার আগে থেকেই বনি ক্রাউনের সঙ্গে আলাপ। মার্কসিজমের প্রভাব রুখতে, পশ্চিম থেকে অনেক সাংস্কৃতিক রথীরা সে যুগে নিয়মিত কলকাতা আসতেন- যেমন ‘ডার্কনেস অ্যাট নুন’-এর লেখক আর্থার কোয়েসলার, ‘নিউ ডায়ারেকশনস’-এর প্রতিষ্ঠাতা জেমস লকলিন কিংবা রকফেলার ফাউন্ডেশনের গিল প্যাট্রিক৷ এশিয়া সোসাইটি হয়ত সেই মতাদর্শের ঠান্ডা লড়াইয়েরই একটি প্রচ্ছদ। কিন্তু কী সুন্দর একটি প্রচ্ছদ! বনি ক্রাউন যেমন বিদূষী তেমনই রূপসী। দক্ষিণ কোরিয়া থেকে পাকিস্তান ও ইরান-বহু দেশেই ছড়িয়ে ছিল তাঁর ভক্তরা। আর আমার তিনি করেছিলেন বিশুদ্ধ উপকার। তাঁর চেষ্টায় আমার কৃত বিনয় মজুমদার ও আরও কয়েকজনের কবিতার অনুবাদ বেরিয়েছে হাডসন রিভিউ, ম্যালাহাট রিভিউ ইত্যাদি মার্কিন সাহিত্য পত্রিকায়৷ ডলার অঙ্কে সে বাবদ যে টাকা পেয়েছি, তা সামান্যই, কিন্তু পাথর টপকে টপকে এক বিপদ সাগর পার হতে বনি ক্রাউন আমাকে যে নিঃস্বার্থ সাহায্য করেছিলেন, তাতে ওয়াশিংটন বনাম মস্কোর লড়াইয়ের কোনও যোগ ছিল না৷ পাথরে আকীর্ণ ছিল পথ, কিন্তু হায়, আমি শুনতে পাইনি তাতে ঝর্ণা ঝরানো কোনও বাণী৷

আমার     পথে পথে পাথর ছড়ানো।
তাই তো তোমার বাণী বাজে ঝর্ণা-ঝরানো।
আমার বাঁশি তোমার হাতে     ফুটোর পর ফুটো তাতে
তাই শুনি সুর অমন মধুর পরান-ভরানো।

বিপদ হল যে, রবীন্দ্রনাথে পরাণ-ভরানো বাঁশির মাঝে-মাঝে আমি শুনতে পাচ্ছিলাম এক গান্ধি ঘট্টমের কাউন্টারপয়েন্ট, এক কঠোর নৈতিকতার আহ্বান৷ প্রত্যেক ব্যক্তির মধ্যেই আছে দুই মেরুর আকর্ষণ৷ আমার ক্ষেত্রে দেখেছি তাল সামলানো দায়। নিরাপদ চাকরি ছেড়ে ভাসিয়েছি ‘কলকাতা’ পত্রিকা। মীনাক্ষী বিরুদ্ধতা তো করেইনি, সব কাজে সহায় হয়েছে। সত্যজিৎ রায়ের সুদীর্ঘ ইন্টারভিউয়ের ট্রান্সক্রিপশন করেছে সুবীর ২৫ ভাগ, মীনাক্ষী ৭৫। কলকাতার প্রুফও দেখেছে যদি ৭৫ ভাগ সুবীর ও অমিয়, তবে ২৫ ভাগ মীনাক্ষী৷ চাকরি ছাড়াতে হ্যাঁ বলেছে, সতীশ সেন নাটকে হয়েছে নায়িকা, কলকাতায় আর বিজ্ঞাপন নেব না সিদ্ধান্তেও না করেনি। কিন্তু ক্রমশ আমার গোঁয়ার্তুমি চরমে ঠেকেছিল। সব কলুষমুক্ত হব; কবিতা অনুবাদকের কাজও যথেষ্ট বিশুদ্ধ নয়; সাহিত্যও বিলাস- এ সব তার মনে হয়েছে পাগলামি। বেশিক্ষণ সিধে সমতলে চলা আমার ধাতে নেই। একটু পর-পরই চড়াই-উৎরাইয়ের জিগ-জ্যাগ আমাকে আকর্ষণ করেছে৷ খাদে পড়ে গিয়ে একেবারে চুরমার না-হওয়া পর্যন্ত হুঁশ হয় না আমার। ত্যাগের মারীচের পেছনে আমি ছুটছি। পরিবার দূর হয়ে যাচ্ছে।

রাতের মাছি যেমন ছাদের অন্ধকার কোনায় পড়ে থাকে, আমিও তেমন কোনা খুঁজছিলাম। আমার আচরণ পরিবারের সকলকে পীড়া দিত- ধুলোমাখা খালি পা, রুক্ষ চুল, ঘাম চিটচিটে জামা-ট্রামে পর্যন্ত চড়ি না সেকেন্ড ক্লাস ছাড়া। গোগো তিতির আমার সঙ্গে রাস্তায় বেরোতে সংকোচ বোধ করত। বু.ব.-র সঙ্গে সেই নিবিড় বন্ধুত্ব দেখতে দেখতে শুকিয়ে গেল৷ বনি ক্রাউন লেখার জন্য তাগাদা দিচ্ছেন, ডিমক ইঙ্গিত করছেন ফিরে যাওয়ার, কিন্তু আমি এক স্বখাত গর্তে ডুবে যাচ্ছি। শারীরিক কষ্ট মনে হচ্ছে তীব্র সুখ৷ মীনাক্ষীকে কী ছেলেমেয়েকে যে অত্যাচার করছি, সে বোধ তখন লুপ্ত। তবু একবার মন-গড়া নীতি ভেঙে প্লেনে উঠেছিলাম- দীনেন গুপ্তর ছবি ‘বনজ্যোৎস্না’-র শুটিংয়ে ভুটান সীমান্তে যাওয়ার জন্য৷ ছবিটিতে মীনাক্ষী নায়িকার ভূমিকায় অভিনয় করেছিল৷ আউটডোর শুটিংয়ে সমিত ভঞ্জ, অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায়, কামু মুখার্জি, কাজল গুপ্ত-কত উপভোগ্যই না হতে পারত। কিন্তু আমি তখন কালো বিপদের ঘূর্নাবর্তে হাবুডুবু খাচ্ছি৷ কলকাতার পরবর্তী সংখ্যায় লিখেছিলাম ‘সীমান্তের চিঠি’, যা পড়ে বু.ব. খুব দুঃখ পেয়েছিলেন। সেই সংখ্যায় আমার আর একটা লেখা ছিল-হো চি মিনের অবিচুয়ারি। লিখেছিলাম- সাম্রাজ্যবাদী জাহাজে একমাত্র যে শ্রেণিতে যাত্রা সম্ভব তা বয়লার রুমের খালাসি রূপে।

সমাজ, সভ্যতা, প্রযুক্তি সব কিছুর বিরুদ্ধে তখন উগ্রমূর্তি। মীনাক্ষীর জীবন তার নিজের নিয়মে চলত। আমি গোঁ ধরেছিলাম যে, তিতির গোগো পুরনো কোনও বাংলা স্কুলে যাবে৷ মীনাক্ষী তাতে কোনও পাত্তা দেয়নি। বাড়িতে পার্টি, আড্ডাও বন্ধ হয়নি৷ একবার অধ্যাপক ডিমককে নিয়ে চিৎপুরে রয়্যাল ইন্ডিয়া হোটেলে বিরিয়ানি খেতে যাওয়া হচ্ছে, ওরা গেল ট্যাক্সিতে, আমি আগে আগে বেরিয়ে ট্রামে৷ পকেটে করে কাগজ মুড়ে নিয়ে গিয়েছিলাম নিজের জন্য বেগুন ভাজা। সবাই বিরিয়ানি, মাংসের চাঁপ উপভোগ করছে, আমি সদর্পে খাচ্ছি রুটি বেগুন ভাজা৷ এটা যে অন্যের উপর নৈতিক নিপীড়ন, তা বুঝতে সময় লেগেছিল। এটুকু ভেবে নিজেকে প্রবোধ দিচ্ছি যে, এই বিকৃত চরমপন্থা থেকে শীঘ্রই বেরিয়ে আসতে পেরেছিলাম, গান্ধি পারেননি।

মীনাক্ষী অবশ্য কখনওই সভ্যতা বিরোধের প্রতি আকৃষ্ট হয়নি৷ একবার গান্ধির আত্মজীবনীতে কস্তুরবার নিগ্রহের কথা পড়তে পড়তে বইটা আমার মুখের ওপর ছুঁড়ে দিয়েছিল।

আমার নাই বা হল পারে যাওয়া (প্রথম খণ্ড)। জ্যোতির্ময় দত্ত। অন্বয়। প্রথম প্রকাশ ২৪ ডিসেম্বর ২০১৭। প্রচ্ছদ – হিরণ মিত্র। মূল্য- ৪০০ টাকা।


বানান অপরিবর্তিত