কল্পর্ষি বন্দ্যোপাধ্যায়ের কবিতা
চিঠি ২: কারমেল কনভেন্টের মেয়েকে
যতদূর মনে পড়ে আমিই প্রথম তোমাকে শস্যগানময় পৃথিবীর কথা বলেছিলাম।
মনে করো সেই সেদিনও চৈত্রমাস, আমি তোমার চোখে সর্বনাশ দেখেও আংটি বদল করলাম আর দীর্ঘ চুম্বনে আমাদের দুচোখে কৃষ্ণতম ঘুম নেমে এল। ক্রমশই অস্পষ্ট হয়ে আসছিল ঝলসানো শিকার নিয়ে ওদের গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব। আমরা শেষবারের মতো বললাম ‘এ পৃথিবী শুধু কবি আর মেষপালকের হবে’, মনে আছে?
মনে আছে; আমার সেই বাষ্পজন্মে পুনর্জন্মরোধের বিপুল প্রার্থনা? সূর্যের ঔরসে গর্ভবতী মেঘ থেকে বৃষ্টির মতো সেই অজ্ঞান মাধ্যাকর্ষণময় ঝরে পড়া!
অসুস্থ করিডোর থেকে তোমাকে জানাই, দ্যাখো আজ আলতোয়া মেঘ আর বেপরোয়া সবুজ, তবু, আমি আত্মজ রাখব না।
চিঠি ৪: কারমেল কনভেন্টের মেয়েকে
‘ফ্যান্টাবিউলাস’ শব্দে আজ সারাটা দুপুর উপুড় করে রাখি। শেষ কবে না দেখার ভানে সঙ্গিনীর হাত ধরে চলে গ্যাছো। আজও কিছু অনুষঙ্গ পড়ে আছে চোখের স্নায়ুতে। সেরকমই একাকী বহুক্ষণ ঘাটের রাণায়।
‘বুড়ো আংলা’ পড়েছ কখনও? রিদয় নামের ছেলেটিকে মনে পড়ে?
(কবিতার বই: তথ্যচিত্র)
রাষ্ট্র
না বোঝার প্রশ্নে ম্লান, যেন মৃত, যেন সে বধির
রহস্যের খুব কাছে এসে ফিরেছে মানুষ আজ
নতমুষ্ক
তার গ্লানি বেতন বাহিত প্রাণধারণের
ফলত মশক ওড়ে, মুখে মুখে
শোষণের ইতিহাস নিয়ে
বাঁচে আরও অন্ধকার, ম্যালেরিয়া বেঁচে থাকে
ভোরের মেথর এসে কচুবনে কামান চালায়
স্বীকারোক্তি
হত্যার ফ্যাসাদে জাগি স্ত্রীলোকের বাসি বিছানায়
জাগি আমি প্রতিদিন সান্ধ্য আজকাল
সিসের অক্ষর জিভে, যাই তথ্যের গভীরে আরও
জনে জনে বন্ধুদের বলি ‘ডেকো না আমাকে আর
সবান্ধব আনন্দ সন্ধ্যায়’
গুপ্তহত্যা মনে পড়ে, মনে আসে চক্রান্তের আলো
চলেছে বাঘের পিঠে ইহ ভরসন্ধেকাল
নারীর হত্যায় জেগে প্রতিটি মৈথুন কালে
কথা বলি নিচু মনে, অসহায় নিজেকে জাগাই
তুমি তো তপতী পাল, তাল তাল সোনা
ইশারা লাস্যের মতো, মাংস অবয়ব
ব্যথা ও সৌন্দর্যের মাঝে
দু-এক কলম লিখি এই কথা পাপ আর অপরাধ
পুলিশের মতো
রক্ষক
যদি শরীর সম্মতি পায়, তক্ষকের ডাকে জাগে
অলস দুপুর
যদি কিশোরীর হৃদয় দৌর্বল্য, তার পুতুল খেলায়
বর-বৌ বিয়ের মধ্যে যুগপৎ জেগে ওঠে ব্যথা ও আরাম
যদি তার করতল স্পর্শ করে অন্ধ গানের স্যার
যদি ভাঙে গান, শরীর-ও ভেঙে যায় কিছু, কারাগার
অনন্ত বৃষ্টির ভিতর
যদি সে মিলায় দূরে, দূর কোনও দিগন্তরেখায়
রক্ষকের মতে, আমিও পিছনে যাব, অরুন্তুদ
বিষাদ যাত্রায়
সম্পর্ক-ছিন্নাকে
আয়ুর অমৃত শুধু তিষ্ঠে ক্ষণকাল
তুমি যদি তাকে একবার ছোঁও, আর
তাকে না-ছোঁও দুবার
ক্ষয়
ভাবি আমি মিলনের শ্বাসরুদ্ধ তিল
যেখানে ঘুমাও পাশে ব্যাঙ্ককর্মী ক্লার্ক
আত্মগোপনের কালে অসহায় সাক্ষ্যগুলি মিথ্যা মিথ্যা
ব্যথা নিরোধক চাঁদ এসে স্বপ্নে বলে যায়
আত্মরতি
একটি চুম্বনের মানে নাতিশীতোষ্ণ আবহাওয়াই ভাবি
হয়তো কখনও পাব, হস্তে ধৃত প্রিয় পুরুষার্থটির মতো
একান্ত নিজের করে, শুধু এই বোধ, বিরহের কোনও প্রান্তে
ভ্রান্তি হয়ে জ্বলে, যদি মানো, এই জ্বলা নিরর্থক।
দিবসে মোমের মতো
তবে আজ তোমাকে গোপনে বলি, শোনো
আমার সকল প্রেম মুকুরের উল্টো পিঠে ন্যস্ত হয়ে আছে
অবসরে কখনও তাকাও, দ্যাখো, আহত মাছের চোখ
ভাসে দর্পণের সুকঠিন জলে
(কবিতার বই: ব্যথা নিরোধক চাঁদ)
অনামা কবিতাগুচ্ছ
একটি ছুরিকা আর পুরুষাঙ্গে
তফাৎ সম্ভব নয় যা কিছু হত্যার পরে চালনা নিষ্ফল হয়
হায়, মালবিকা, ঘৃণা করে তাকে
জানিয়েছে, বিবাহবিচ্ছেদের পরে
চা পান করানোর অছিলায়
*
যে কোনও শ্রমের কাছে
তোমার নখের রঞ্জন
অশ্লীলতা মনে হয়
মনে হয়, গলা টিপে ধরি
*
যে গান শোনে না কেউ
জেনো তাও নিষ্ফলা নয়
পাখিরা গানের শেষে
কবে করে শ্রোতার প্রত্যাশা
সহসা আলোকপ্রাপ্ত কবিদের নিয়ে
কোনও আলোচনা নয়
ওইদিকে পানশালা
ওই দেখো অন্ধকারে
গন্ধহীন পুস্প ফুটে আছে।
*
যেরূপ স্বর্গীয় হর্ষ অনূদিত হয়
প্রকৃত কবিতা পাঠে এবং সঙ্গমে
তদ্রুপ বিষাদের ছায়া
যদি করে গ্রাস, জীব-মহীরুহ
জীবন সঙ্গীতময়, অনুরণনের মতো
তোমার সমস্ত লেখা আমার রচনা
*
মাধবী, সহজ লতা, ফুলেদের জটিলতা ক্রমে
জীবনে এসেছে
আক্রোশে প্রেমের বশে, ছিড়েছি তোমার পাতা
মাধবী, হত্যার পর, বৃতির বেদনা যেন
আমাকে বিধেছে
মাধবী, গ্রহের টানে, অনেক ভ্রমণ হল
এ বছরে প্রেম হল আমাদের, যার-পর-নেই
হিন্দিতে
অভিজ্ঞতাগুলি, আরব সাগর জলে মিশে আছে
মাধবী, সহজলতা, জটিলতা থেকে শুধু ফুলগুলি
তুলে নিতে চায়
*
যখন দূরত্ব দেখি, কাছে-দূরে, আকাশের তারায়-তারায়
কোথাও তো জলাশয় আছে ভেবে, জাগে প্রাণ, যেন জাগে
মিলনার্ত ভেকের মতন, আকাশে উদ্বাহু হয়ে
দ্যাখা যায়, ঋতু জুড়ে আষাঢ়ের মতো
এক সম্ভাবনা পড়ে থাকে
শুধু অসফল মানুষের তার কাছে বসা আর হয় না তো
এ জীবনে, একাকিত্ব, অন্ধকারে যৌথ ঝরে পড়ে।
(কবিতার বই: যে গান শোনে না কেউ)
কল্পর্ষি বন্দ্যোপাধ্যায়ের কবিতা: বিচ্ছুরণ ও আলো
মণিশংকর বিশ্বাস
১.
…‘শাওন রাতে যদি/স্মরণে আসে মোরে’— এটা বাঙালির র-নার্ভ (Raw Nerve)-কে দারুণভাবে টাচ্ করবে। এটা আমি বিদেশেও দেখেছি, বাঙালি অনেকেই বলে উঠেছে, “ও গান শুনিও না।” প্রত্যেক জাতিরই এমন একটা র-নার্ভ থাকে। … ‘শাওন রাতে যদি / স্মরণে আসে মোরে’— এটা গাইলে বাঙালির মনোজগতে (Psyche)-র প্রতিক্রিয়ার কথা যদি ভাবেন তাহলে ইউ আর থিংকিং ইন টার্মস অফ ফর্ম, নট ইন টার্মস অফ কনটেন্ট। কনটেন্ট। কনটেন্ট-ওয়াইজ এ জিনিসটা অত্যন্ত বাজে— রাবিশ।… ‘র নার্ভ’ বলতে আমি যা বোঝাতে চেয়েছি সেটা বিরাট একটা অ্যাসোসিয়েশনাল ব্যাপার। প্রথমত বর্ষার গান, আর একটা মধ্যযুগের কবিতা। আমাদের ভিতরে পদাবলী, রাধার অভিসার, যমুনা নদী— এই ডার্ক ফোর্সেস (Dark Forces)-গুলো কাজ করে।
সাক্ষাৎকার: উৎপল কুমার বসু, যোগসূত্র, কলকাতা, ১৯৯৪
কল্পর্ষির কবিতা আমরা কেমনভাবে পড়ব, এমনকি কেমনভাবে গ্রহণ করব, সে সব কিছুর সঙ্গেই উপরের এই কথাগুলি সম্পৃক্ত। কল্পর্ষি বন্দ্যোপাধ্যায় ‘আধুনিক বাংলা কবিতা’-র কেউ নন। আজকের নব্বই, শূন্য ইত্যাদি দশক-ওয়াইজ বাংলা কবিতাও কল্পর্ষির কবিতাকে তেমন চেনে না। রাস্তাঘাটে, অর্থাৎ লিটল ম্যাগাজিনের বাসস্টপ বা ফেরিঘাটে যে কখনওই দেখা হয়নি, তা হয়ত নয়, কিন্তু কল্পর্ষির কবিতার কৌলীন্যই হোক বা মেইনস্ট্রিম বাংলা কবিতার মূলত আদেখলেপনাই হোক, খুব আলাপ-পরিচয় আড্ডা, বসন্তকেবিন ইত্যাদি যে হয়েছে এমনও নয়। তবে আমি এর জন্য মূলত কল্পর্ষি বা কল্পর্ষির কবিতা-ভাষাকেই দায়ী করব। এবারে ২১শে ফেব্রুয়ারি উপলক্ষে কল্পর্ষির লেখা ফেসবুক স্ট্যাটাসটির শুরুতেই ছিলেন মৃদুল দাশগুপ্ত, “তার পূর্ব-পুরুষরা স্বপ্নাদেশে লিখেছিলেন মঙ্গলকাব্য…” শুধুই কাকতালীয়? আমার মনে হয় না। বস্তুত কল্পর্ষির কবিতাভাষা কোনওদিন এই স্বপ্নাদেশের কথা ভোলেনি। তাই অত্যল্প লিখেও কল্পর্ষি যে এত উল্লেখযোগ্য কবি, তা শুধু এই কারণে নয় যে কল্পর্ষি বন্দ্যোপাধ্যায় একজন অসাধারণ কবি, বরং একবিংশ শতকের বাংলা কবিতায়, কল্পর্ষিই সম্ভবত একমাত্র দশকহীন কবি। কল্পর্ষির কবিতা, আমাদের ‘র-নার্ভ’-কে টাচ করে। টোকা দেয়।
২.
বৃক্ষ হতে পতিত যে ফল তা কেন ঊর্ধ্বে যাবে না, ভেবেছি তো আমিও অনেক, জনান্তিকে, সূত্র আবিষ্কারকের মতো নিষ্ঠায়, মজা পুকুরের ধারে ঘাটের রানায় আজ এই তথ্য ব্রহ্মাণ্ডের নিহিত ইশারা মনে হয়, মনে হয় এরকমই কোনও বোধে ও বিভ্রমের সূর্যাস্তে পুরুষের প্রার্থনা ছিল ভালবাসা আর বিষ শুধু তার নিজস্ব অর্জন, তারপর আর ভাবতে পারি না, চোখে জল আসে…
আমিও চেয়েছি হতে তোমাদেরই বিনয়ের ছাত্রের মতো মৃত্তিকার, আমারও প্রয়াস আছে যেন বিল্বপত্রে পুষ্পাঞ্জলি হব…
কল্পর্ষি বন্দ্যোপাধ্যায়, ব্যথা নিরোধক চাঁদ, বিভাব
কোথায় পড়েছিলাম মনে নেই, বিনয় মজুমদারকে কোনও এক সমালোচক জিজ্ঞেস করেছিলেন, “বিনয়দা, অনেকেই তো বলেন, আপনি জীবনানন্দ দ্বারা প্রভাবিত।” বিনয় মজুমদার তাঁর উত্তরে বলেছিলেন, “হ্যাঁ ঠিকই তো, আমার লেখায় জীবনানন্দের প্রভাব আছে।” তারপর কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে উনি উত্তর দিয়েছিলেন, “সেটাই তো স্বাভাবিক, আমার লেখায় জীবনানন্দের প্রভাব থাকবে…।” অথচ এই প্রভাবের অনেকরকম ব্যাখ্যা আমরা জেনেছি, বিশেষত বাংলা কবিতার সাপেক্ষে। অনেকেই, অগ্রজ কবিদের প্রভাব সম্পর্কে শুধু নাকউঁচু নন, ছোট বড় নানা আকারের কবিকে এই প্রভাবের জাল কেটে বেরোবার জন্য জিয়ল মাছের মতো ছটফট করতেও দেখেছি আমরা। কবি অলোক সরকারের মতো কেউ কেউ আবার নির্দ্বিধায় নতুনত্বকেই (অরিজিনালিটি) কবিতার মোক্ষ জেনেছেন। অথচ ভাবনার একটু অন্তঃপুরে পৌঁছালেই দেখা যায়, প্রভাব কখনও কখনও অনুপ্রেরণার হাত ধরে অন্তঃপ্রেরণার সঙ্গে সম্পর্কিত হয়ে ওঠে। তখন এই প্রভাবকে আর বহিরাগত বলে মনেও হয় না। এবং এই ‘প্রভাবদোষ’ তখন বর্জনীয় কিছুও নয়। সুতরাং আমার বিনীত মতানুযায়ী প্রভাব দুরকম। প্রথম রকমটি হল বাহ্যিক প্রভাব। এবং দ্বিতীয়রকম প্রভাব আত্মিক। কল্পর্ষির কবিতা পড়তে গিয়ে আমার তাই মনে হয়েছে, বিনয় মজুমদার-উত্তর বাংলা কবিতায় যদি সত্যিই কোনও কবি বিনয় মজুমদারকে আত্মায় ধারণ করে থাকেন, সেই কবির নাম, কল্পর্ষি বন্দ্যোপাধ্যায়।
৩.
Between the wolf in the tall grass and the wolf in the tall story there is a shimmering go-between. That go-between, that prism, is the art of literature.
Vladimir Nabokov
এখন পর্যন্ত কল্পর্ষির কবিতাগুচ্ছ সম্পর্কে প্রায় কিছু বলা হল না। আসলে এভাবে একেকটি কবিতা ধরে আলোচনা করতেও চাইনি। প্রথম দুটি কবিতা, কল্পর্ষির প্রথম বই ‘তথ্যচিত্র’ থেকে। বলাই বাহুল্য এই বই যখন রচিত হয়েছে, তখন আমাদের বন্ধুদের সকলেরই কবিতার মূলধারাটি ছিল প্রেমার্তি। কিন্তু লক্ষ্যণীয় এই যে প্রথম থেকেই, সেই তরুণ বয়স থেকেই, কল্পর্ষির কবিতা-ভাষা সম্ভ্রান্ত ও প্রদোষের ন্যায় গাঢ়, কিন্তু সান্ধ্য নয়। ফলে যদিও রহস্যময়, এই পথে হাঁটতে পাঠকের হোঁচট খেতে হয় না। বরং ‘ব্যথা নিরোধক চাঁদ’-এর আলোয় কল্পর্ষি আমাদের নিয়ে যান, ক্রমশ গভীর থেকে এক গভীরতর দিকে। এমনকি সত্তর ও আশির দশকের কবিরাও যে ধরনের সব চমকপ্রদ কবিতা লিখেছেন, যেরকম স্মার্ট কবিতা লিখেছেন এবং প্রায় হাস্যকর প্রশংসাবাক্য (“উঁনি খুব স্মার্ট লেখেন”) মাথায় নিয়ে গর্বিত পদচারণা করেছেন বাংলা কবিতার ছিটমহলে সেখানে একজন তরুণ কবি, কীভাবে এতখানি স্থির লক্ষ্য, চমকহীন, ‘আনস্মার্ট’ পঙক্তি (“আমার সকল প্রেম মুকুরের উলটো পিঠে ন্যস্ত হয়ে আছে/ অবসরে কখনও তাকাও, দ্যাখো, আহত মাছের চোখ/ ভাসে দর্পণের সুকঠিন জলে”) লিখেও বুলস আই বিদ্ধ করতে পারেন তা ভেবে অবাক হতে হয়। উৎপল কুমার বসু যা বলেছিলেন বিনয় সম্পর্কে, আমিও সেই একই কথা ধার করি কল্পর্ষি সম্পর্কে, “বিস্ময়কর তাঁর ভাষার উপর দখল।” বস্তুত কল্পর্ষির কবিতা, বিনয় মজুমদারের ‘ফিরে এসো চাকা’ এবং উৎপল কুমার বসুর ‘চৈত্রে রচিত কবিতা’-র সমসাময়িক, অভিজাত।
আর একটা কথা বলে এই লেখা শেষ করব। কথাটি বলবার আগে কল্পর্ষির লেখা, এই নামহীন কবিতাটি আবার ফিরে পড়ব।
“যেরূপ স্বর্গীয় হর্ষ অনূদিত হয়
প্রকৃত কবিতা পাঠে এবং সঙ্গমে
তদ্রূপ বিষাদের ছায়া
যদি করে গ্রাস, জীব-মহীরুহ
জীবন সঙ্গীতময়, অনুরণনের মতো
তোমার সমস্ত লেখা আমার রচনা”
কবিতাটি পড়বার পর, প্রথমত বিশ্বাস হতে চায় না, কবিতাটি শেষ হয়ে গেছে। প্রথমে আমার মনে হয়েছিল এটি কল্পর্ষির কবিতা থেকে একটি উদ্ধৃতি, পুরো কবিতা নয়। এতটাই সংক্ষিপ্তাকার এই কবিতা। অথচ বারকয়েক পড়বার পর এই নিরাভরণ কবিতাটির ব্যাপ্তি এবং মহত্ব সম্পর্কে আর কোনও সন্দেহ থাকে না। কল্পর্ষি যে শুধু কম লিখেছেন তা নয়, তাঁর বেশিরভাগ লেখাগুলিই ক্ষুদ্রকায়। অথচ আমরা প্রায় সর্বত্র কল্পর্ষির লেখায় এই বিশেষ গুণটি লক্ষ করে থাকি। কল্পর্ষির ক্ষুদ্রকায় কবিতাগুলি প্রকৃত প্রস্তাবে ব্যাপ্ত ও দীর্ঘ। মাইক্রো-এপিক।
দ্বিতীয়ত, মনে হয় এই কবিতাটি আমি বহুকাল আগেই কোথাও পড়েছি। যেমন হয় রাগাশ্রয়ী কোনও গান প্রথমবার শুনলে। মনে হয়, অবচেতনায় অন্তঃসলিলা হয়ে এই সুর বয়ে যাচ্ছিল বহুকাল ধরে। এইমাত্র সে প্রকাশিত হল।
ব্যক্তিগতভাবে আমি মনে করি, কল্পর্ষির কবিতায় এই লিরিসিজম ও মাইক্রো-এপিকধর্মিতাই ভ্লাদিমির নবোকভ কথিত প্রিজমটি। বলাই বাহুল্য যার বিচ্ছুরণ, আলো আমাকে কল্পর্ষির কবিতার প্রতি আবিষ্ট করে রাখে।