Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

দুই মেরু

দুই মেরু : রিমি মুৎসুদ্দি

রিমি মুৎসুদ্দি

 

এক

-শান্ত থাকা প্র্যাকটিস কর। ভাবার মতো শান্ত থাকাও একটা অভ্যাস।
-উফফ, এতক্ষণে একটা কাজের কথা বললে।
-শান্ত থাকা কি মুখের কথা? যদিও বলা যত সহজ, নিজের জীবনে কাজে লাগানো ততই কঠিন রে। কিন্তু তুই পারবি। আমাকেও পারতে হবে রে।

কথাটা বলেই ফোন কেটে দেয় বিপাশা। ফোন কেটে দেওয়ার শব্দটা শুনতে পায় শ্রীপর্ণা। ঠিক যেন বহুদিন আগের ল্যান্ডফোন রেখে দেওয়ার শব্দ। এই শব্দটার কথা বিপাশাকে বলেছেও। শুনে অবশ্য হো হো করে হেসে উঠেছে বিপাশা।

-তুই একটা আস্ত…!

কথাটা সম্পূর্ণ করেনি বিপাশা। রোজই রাতের দিকে ওর ফোনে অভ্যস্ত হয়ে গেছে শ্রীপর্ণা। এই ফোনটা না এলে ঠিক ঘুম আসে না ওর। একবার তুমুল জ্বর হয়েছিল বলে বিপাশা ফোন করতে পারেনি। ও অনেকক্ষণ অপেক্ষা করে নিজেই ফোন করেছিল। প্রতিবারই ফোন বেজে গেছে। ওপাশ থেকে কেউ ধরেনি। অথচ বিপাশার ছেলে বর কেউ তো ফোনটা সেদিন ধরতে পারত? ধরল না কেন? তাহলে ওরাও কি ওকে…

শ্রীপর্ণা বেশিক্ষণ ভাবতে পারে না এসব কথা। মাথার মধ্যে তীব্র যন্ত্রণা হতে থাকে। পরপর দুদিন সেবার ফোন আসেনি বিপাশার। খুব অস্থির লাগছিল ওর। একবার ভাবল চলে যাবে ওর বাড়ি। কিন্তু সে তো অনেক দূরে। অন্যদেশ, অন্যশহর। কী করে যাবে ও?

নিজের মেয়ে রোদসী ফোন করেই না প্রায়। ওই যে কয়েকবার ফোন কেটে দিয়েছিল ও। তারপর থেকেই মেয়ের ফোন আর আসে না। প্রবাল মাঝেমাঝে ফোন করে অবশ্য। প্রবালের ফোনেই ও মেয়ের খবর পায়। মাঝেমাঝে যদি মিসড কল আসত ওর ফোনে? তাহলে ও নিশ্চয়ই ভাবত রোদসী ফোন করেছে। মায়ের গলাটুকু শুনবে বলে। যেমন ও মাঝেমাঝে করত।

সব কথা এখন আর মনেও পড়ে না। বিপাশার কথাটা মায়ের কথাই। মা সবসময় বলত, “শান্ত থাকা অভ্যেস করো শ্রী।”

 

দুই

-তুমি আমাকে সত্যি নিয়ে যাবে? কুণালের বাড়িতে?

বিস্ময় আর আনন্দে মাখামাখি শ্রীপর্ণার মুখের দিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে যায় প্রবাল। ওর গায়ের রং একটু চাপা। গালে পাঁচ আঙুলের দাগ এখনও লাল হয়ে ফুলে রয়েছে। ও যদি ফর্সা হত দাগগুলো আরও বেশি স্পষ্ট হত। ঠোঁটের কোণে রক্ত জমাট বেঁধে শুকিয়ে গেছে। আর পারছে না প্রবাল। বড় ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। চুলের মুঠি ধরে দেওয়ালে স্ত্রীর মাথাটা ঠুকে দিয়ে হতাশভাবে বসে পড়ল মেঝেতে।

শ্রীপর্ণার চোখে জল নেই একফোঁটাও। শরীরে ব্যথার অনুভূতিও বুঝতে পারে না প্রবাল। রাগটা আবার চাগাড় দিয়ে উঠছে। শ্রীপর্ণা বলেই চলেছে, “সত্যিই তুমি আমাকে নিয়ে যাবে? কুণালের বাড়িতে? আমি থাকব ওখানে? এবার থেকে ওখানেই থাকব আমি?”

প্রবাল আর একমুহূর্তও অপেক্ষা করতে রাজি নয়। হয়ত একটা খুনোখুনি হয়ে যাবে এরপর। তাই শ্রীপর্ণাকে তৈরি হতে বলে গাড়ি বার করে ও।

শ্রীপর্ণা একটা ছোট ব্যাগও নিয়েছে ওর সঙ্গে। চালকের আসনে প্রবাল। শ্রীপর্ণা পেছনে নয় প্রবালের পাশেই এসে বসল। একবার ব্যাগের দিকে তাকিয়ে ও জিজ্ঞাসা করল, “ওইটুকু ব্যাগে সব জিনিস নিয়েছ তোমার?”

কোনও উত্তর নেই। ঘষা কাচের মধ্যে দিয়ে বাইরের পৃথিবী দেখার আশায় মুখ বাড়িয়েছে প্রবালের স্ত্রী।

গাড়ি চলছে বড় রাস্তা দিয়ে, কখনও ট্রাফিকের ক্যাকোফোনি, কখনও সরু গলি, বড় রাস্তা আবার গলি পেরিয়ে মোর, মোর পেরিয়ে তেমাথা। পিচগলা রোদ কাচ গলে ভেতরে আসতে পারছে না। আলোটুকু তবু এসে পড়ছে। গাড়ি চলছে।

 

তিন

-শ্রীপর্ণাদি একটা স্যারিডন হবে? মাথাটা এত ধরেছে আজ।

কুণালের প্রশ্নে শ্রীপর্ণা যেন একটা ঘোর ভেঙে জেগে ওঠে। এরকম ঘোরের মধ্যে চলে যাওয়া তো ওর আজকের নয়। সেই কোন ছোটবেলায় কানুমামা এসে ওকে টিপে টিপে দেখত। যেন মাছের পেট টিপে পরখ করছে। নরম হয়ে গেছে কিনা? টাটকা কিনা? আর পান খাওয়া ছ্যাতলা পরা দাঁত বের করে হাসতে হাসতে বলত, “খেয়ে খেয়ে কেমন ফুলছে দেখ ছোড়দি? এটাকে তুই বাড়ি থেকে বের না করতে পারলে তোর জীবনে শান্তি আসবে না। এতদিনে কোথায় ওর নিজের মামাবাড়ি বা আর কোথাও পার করে দিবি, তা না খাইয়ে খাইয়ে গতরটা বাড়াচ্ছিস শুধু ওর।”

এই কথা শুনে ওর মা মানে সৎ মা তো তেড়েফুঁড়ে উঠত। “আমার কপাল। এই আপদটাকে কে নেবে? মামা মাসিরা সব এক একটা হাড় বজ্জাত। কেউ নেবে না। আবার মাঝেমাঝে ইস্কুলে গিয়ে দেখা করে আসবে ওর সঙ্গে। আমার বাড়িতে তো নো এন্ট্রি। আর এত মার খায় তবুও মরে না এই আপদ? নিজের মাকে খেয়ে এখন আমাকে না গেলা পর্যন্ত এর শান্তি আছে?”

মায়ের কথায় ও ওই ভঙ্গি দেখে কী ভয়ই না পেত শ্রীপর্ণা। ওর নিজের মা তো অসুখে মারা গেছে। ওর কী সত্যিই কোনও দোষ এতে?

এরপর কানুমামা খুব জোরে গাল দুটো টিপে বলত, “খবরদার, কাউকে যদি বলিস কিছু তাহলে একেবারে পুঁতে ফেলব তোকে।”

-বলে আবার না ও? দেখতে ওইটুকু হলে কী হবে? মাথায় শয়তানি বুদ্ধি আর প্যাঁচ। নিশ্চয়ই সব বলে মাসিদের ও। তাই তো সেদিন তোর জামাইবাবু মাংস এনে আমাকে বলে কিনা, “মেয়েটাকে একটু দিও? মাংস খেতে মেয়েটা বড় ভালবাসে।”

কথাটা বলেই ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে ওর সৎ মা। কানুমামা তখন ওর মায়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়।

-আচ্ছা কাঁদিস কেন ছোড়দি?
-কাঁদব না? আমার কপাল দেখ! নিজের পেটের ছেলেটার খোঁজ তার বাপ নেয় না। একবারও বলে না আমাদের সুবলকে দু টুকরো বেশি দিও মাছটা বা মাংসটা। খালি ওই মা-খাকি মেয়ের দিকেই যত নজর ওর?
-দাঁড়া, এমন শিক্ষা দেব না?

শিক্ষা দেওয়ার কথা শুনলে ওর ছোট্ট শরীর কেঁপে উঠত। মনে হত একছুটে পালিয়ে যায় সেখান থেকে। কিন্তু কোথায় পালাবে? কার কাছে যাবে? ছোটমাসি স্কুলে এলে ওর খুব বলতে ইচ্ছে করত “আমাকে নিয়ে চল মণি।”

কিন্তু মণি এসেই মামির অত্যাচারে ওর নিজেরই বাড়ি ছাড়ার কথা বলত রোজ। কী করে আর শ্রীপর্ণা একথা বলে?

-মাংস সেদিন একটুকরোও এই হারামজাদিকে দিইনি। বারবার ঘুরঘুর করছিল আমার সুবলের সামনে তবুও দিইনি। সারারাত ওই উঠোনে দাঁড় করিয়ে রেখেছি। সকালে জ্বর এল। আবার নিজেই সেরে গেল। কথায় বলে না রাক্ষসীর প্রাণ!
-না না। ওসব করতে যাস না। ফৌজদারি মামলায় পড়ে যাবি। মারধোর করিস না। খেতে দিস না ঠিকই করিস।

এইসব কথা ওর সামনেই ওরা বলত। আর সেই শীতের রাতে উঠোনে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে অথবা কানুমামা যখন হাত ধরে ওকে ঘরের মধ্যে টেনে এনে দরজাটা বন্ধ করে দিত, শ্রীপর্ণা চেঁচিয়ে কাঁদতে পারত না। এক ফোঁটাও জল ওর চোখে আসত না। ও একটা ঘোরের মধ্যে চলে যেত। একটা অন্য জগতে ডুব দিয়ে ওর সামনের অন্ধকার ঘর, কানুমামার ছ্যাতলা পরা দাঁত, উঠোনের অন্ধকার অথবা ঠান্ডা হিমধরা বাতাস সব ভুলে যেত ও। আর দেখতে পেত ছাদে অনেক ফুল ফুটেছে আর সেই ফুলের মধ্যে ওর নিজের মায়ের উজ্জ্বল হাসি। “দেখ শ্রী, এই ক্যাকটাসের ফুলটাকে দেখ।”

“গোলাপ, লিলি, গাঁদা ফেলে ক্যাকটাসের ফুল কেন দেখতে বলছ মা?”
“কত কাঁটার মধ্যেও এই ফুলটা ফুটে রয়েছে। না বেশি জল দিতে হয়, না কোনও যত্ন করতে হয়। চারিদিকে শুধু কাঁটা। তাও ফুলটা ফুটে রয়েছে। আর কি উজ্জ্বল রং দেখ!”

কী যেন নাম বলেছিল মা? আজ আর মনে নেই ওর। তখনও মনে পড়ত না ওর। জ্বর সেরে যেত নিজে থেকেই। শরীরের ব্যথাগুলোও মিলিয়ে যেত। নিজেকে ওই ক্যাকটাসের ফুলের মতোই মনে হত বরাবর। বাবা থেকেও নেই। বাবা যদি ভুলেও কখনও ওর জন্য ভালমন্দ আনত অথবা ওর খোঁজখবর করত তাহলে তো ওর ওপর অত্যাচার আরও বেড়ে যেত।

উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার আগের রাতে কানুমামা আর মা মিলে সব বইখাতা পুড়িয়ে দিয়েছিল। ভাগ্যিস এডমিট কার্ডটা ছিল! আর বাবা সকালে নিয়ম করে পরীক্ষা হলে পৌঁছে দিত! প্রথম পেপার পরীক্ষার পর বেশিরভাগ ছাত্রছাত্রীরই মা আসত স্কুলে। ডাব নিয়ে, খাবার নিয়ে। শ্রীপর্ণা একা একাই হয়ত ঝালমুড়ি আব ছোলাভাজা কিনে খেত। বাবা পরীক্ষার হলে পৌঁছে দিয়ে যাওয়ার সময় কটা পয়সা দিয়ে যেত হাতে। বাবার চোখে কি তখন জল দেখেছিল ও?

মনে পড়ে না সেসব আর। সেই যে নিজেকে একটা ঘোরের মধ্যে ডুবিয়ে নিয়ে যাওয়া সেটা কবে থেকে যেন অভ্যেস হয়ে গেছে ওর। প্রবালের সঙ্গে বিয়ে চাকরি সন্তান পুরো এই সমস্ত জীবন ধরে কতবার যে ঘোরের মধ্যে নিজেকে ডুবিয়ে কত কিছু থেকে মুক্ত করেছে নিজেকে!

কিন্তু এই ঘোরগুলো থেকে ফিরলেই খুব অবসাদ আসে ওর। স্বাভাবিক কাজ করতে খুব কষ্ট হয়। সেই ছোটবেলা থেকেই ওর মনে হত সবার মতো ওরও যদি একটা মা থাকত? তাহলে এই ঘোরে ডুবে যেতে হত না কখনওই। প্রবালের সঙ্গে বিয়ের পরও ও প্রবালের মার মধ্যে ওর ছোটবেলায় মরে যাওয়া নিজের মাকে খুঁজে পায়নি। ছোটবেলা থেকে এতরকম অভিজ্ঞতা দিয়ে গেছে যে এর কারণও অবশ্য খুব বেশি ভাবায়নি ওকে। কারণ, ততদিনে একগাদা ওষুধ ওর সর্বক্ষণের সঙ্গী।

 

চার

-কী হল? ওষুধ আছে? স্যারিডন না হলে ক্যালপল থাকলেও হবে।

শ্রীপর্ণা এইবার একটু অপ্রতিভ হল। কুণাল কি বুঝতে পেরেছে কিছু? তাড়াতাড়ি ব্যাগ খুলে ওষুধ খুঁজতে লাগল।

-ব্যাগ ভর্তি এত ওষুধ! এত ওষুধ খাও তুমি?

ভেবেছিল নিজের কথা কুণালকে বলবে না ও। কিন্তু তারপর থেকেই কী যে হল? কুণালকে ভরসা করতে শুরু করল। ঠিক কবে কোন কথায় যে ভরসা করতে শুরু করেছে তা একদম স্পষ্ট মনে আছে শ্রীপর্ণার।

-তোমাকে আমার মায়ের কাছে নিয়ে যাব দিদি। দেখবে তুমি তোমার মাকেই ফিরে পেয়েছ। যাবে আমাদের বাড়িতে?

কুণালের এই কথায় শ্রীপর্ণার মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠেছিল সেদিন।

-মা! আহ! কী সুখ এই ডাকে! কতদিন ডাকতে পারিনি আমি। না। কোনোদিনই ডাকতে পারিনি। কোনোদিনই না।

দু হাতে মুখ ঢেকে কেঁদে উঠেছিল ও। কুণাল একটা পাখির ছানার মতো বুকে জড়িয়ে নিয়েছিল সেদিন ওকে। কুণালের বুকে মাথা রেখে ওর পুরুষগন্ধের মধ্যে মাকে খুঁজেছিল শ্রীপর্ণা। ওর মাকে। সেই ক্যাকটাসের ফুল দেখে খুশি হত যখন মা আর ও কাছে গেলে ওকে জড়িয়ে ধরে বলত, “শ্রী, ক্যাকটাসের ফুল হতে হবে জীবনভর।”

মা তখন স্নান সেরে সবে ছাদে আসত। পেছন পেছন শ্রীপর্ণাও আসত। মায়ের মাথার জবাকুসুম তেলের গন্ধ আজীবন ওর সঙ্গে রয়ে গেছে। কুণালের বাড়িতে যেদিন ওর মায়ের সঙ্গে প্রথমপরিচয় হল। কুণালের মাকে মা ডাকা শুরু করল। ওর সব কথা শুনে কুণালের মা ওকে বুকে জড়িয়ে ধরলে ও জবাকুসুমের গন্ধটা আবার পেয়েছিল।

শ্রীপর্ণার জীবনে খুব বেশি প্রেম আসেনি। বলতে গেলে ওর স্বামী প্রবালই ওর প্রথম প্রেম ছিল। ও সারাজীবন প্রবালের মধ্যেও সেই জবাকুসুমের গন্ধটা খুঁজেছে। মেয়ে রোদসীকে জড়িয়ে ধরে গন্ধটা খোঁজার চেষ্টা করেছে। মেয়ে বিরক্ত হয়ে বলত, “মা কি এত শুঁকছ বলো তো?”

প্রবাল, রোদসী, কুণাল কারও মধ্যে কোনওদিন ও ফিরে পায়নি ওর সেই পরম স্নিগ্ধ জবাকুসুমের গন্ধ। কিন্তু কুণালের মার মধ্যে সেদিন খুঁজে পেয়েছিল ও। অফিস ফেরত রোজ ও কুণালের বাড়ি যেত। এরপর তো প্রায়ই অফিস যেত না। বাড়ি থেকে বের হয়ে কুণালের বাড়ি চলে যেত। কুণাল অনেকবার বারণ করেছিল। এভাবে এত ছুটি নিতে না করত ওকে। কুণালের দিদি বিপাশা বাপের বাড়ি এলে শ্রীপর্ণার আরও ভাল লাগত। বিপাশাও ওর খুব ভাল বন্ধু হয়ে উঠেছিল। কুণালের মা নিজের মেয়ের মতোই ভালবাসত ওকে। আর বাড়ির কথা বলে কান্নাকাটি করলে শুধু বোঝাত, “শান্ত থাকা প্র্যাকটিস করো শ্রী।” বিপাশাও এই একই কথা বলে আজও।

বাড়ির কথা বলতে প্রবাল আর রোদসীর কথা। প্রবালের সঙ্গে কানুমামা বা ওর সৎ মার ঘনিষ্ঠতা না হোক বেশ ভাল একটা যোগাযোগ রয়েছে। শ্রীপর্ণা তা মেনে নিতে পারত না। প্রবালকে তো ওর কষ্টের সব কথা ও বলেছিল। ছেলেবেলায় কানুমামা আর মা মিলে কী অত্যাচার করত সেসব জানিয়েছিল। প্রথম যেদিন প্রবাল এসব শুনেছিল, ওকে খুব আদর করেছিল। সেদিনের সবটা আদর মিথুন ওর প্রতি প্রবালের স্নেহ, ভালবাসা বলেই মনে হয়েছিল। কিন্তু তারপর কেমন যেন অস্থিরতা, দুর্ব্যবহার ফুটে উঠতে শুরু করল প্রবালের ব্যবহারে। যেকোনও ছোটখাটো বিষয়ে ওকে দায়ী করা। ওর প্রতিটা কাজের খুঁত ধরা এমনকি ওকে পাগল, মেন্টাল বলে সর্বসমক্ষে ডাকা শেষপর্যন্ত ওর মানসিক স্থিরতা ভেঙে পড়েছিল। এমনকি বাবার দেখাদেখি মেয়ে রোদসীও কোনও কিছুতে মতের মিল না হলে অথবা মা কোনও আবদার পূরণ না করতে পারলে পাগল, মেন্টাল বলে গালাগাল দিতে শুরু করে ওকে। এইসব শুনতে শুনতে কেমন যেন হিস্টেরিয়া মতো হয়ে যেত এক একদিন ওর। শেষে প্রবালই শহরের নাম করা এক মনোরোগ বিশেষজ্ঞকে দেখাতে নিয়ে যায়। তাই ওর ব্যাগ ভর্তি অত ওষুধ থাকে সবসময়।

অফিস কামাই করে কুণালের বাড়ি যাওয়া প্রবাল জানতে পারে একদিন। মেয়ে রোদসী হস্টেল থেকে ফোন করে যাচ্ছেতাই অপমান করে প্রায় প্রতিদিনই। তবুও ও অনড়। কুণালদের বাড়ি ও যাবেই। বেশিরভাগ দিনই কুণাল বাড়ি থাকে না। ও তো কুণালের কাছে যায় না। কুণালের মার কাছে যায়। ওখানে গেলেই তো সব নষ্ট হওয়া সময় যেন ফিরে আসে ওর কাছে। সেই সময়গুলো তো ওর অধিকারের সময়। এরকমই তো একটা জীবন হওয়া উচিত ছিল ওর। যেখানে মায়ের স্নেহে, স্পর্শে, গন্ধে, ভালবাসায় কেটে যেতে পারত ওর শৈশব!

কুণালের মা ওকে দেখে কোনওদিন বিরক্ত হননি। গায়ে মাথায় আদর করে হাত বুলিয়ে দিতেন। দুপুরে খেতে না চাইলে জোর করে নিজে হাতে খাইয়ে দিতেন ওকে। তারপর দুপুরে শুয়ে শুয়ে কত গল্প একসঙ্গে ওরা করত। বিপাশা যখন ওর বাচ্চাটাকে নিয়ে বাড়ি আসত সেদিন তো সারা বাড়িতে বাচ্চাটাকে নিয়ে হইচই পড়ে যেত। কুণালও তাড়াতাড়ি অফিস থেকে ফিরে আসত। কুণালের মা কিন্তু হাজার ব্যস্ততার মধ্যেও শ্রীপর্ণার খাওয়া, সময়মতো ওষুধ খাওয়া সবদিকে নজর রাখতেন। কুণাল ঠিকই বলেছিল নিজের মেয়ের মতোই উনি ভালবেসেছিলেন শ্রীপর্ণাকে।

প্রবাল সেদিন মারতে মারতেই ওকে কুণালের বাড়িতে নিয়ে এসেছিল। আর প্রথমটায় বিশ্বাস করেনি শুধুমাত্র কুণালের মার কারণেই এবাড়ির প্রতি ওর স্ত্রীর যাবতীয় আকর্ষণ। কিন্তু ডাঃ দাস শুধুমাত্র এ শহরের নয়, ভারতবর্ষের একজন বিখ্যাত মনোরোগ বিশেষজ্ঞ, তিনি যখন বললেন, “আপনার স্ত্রীর বাইপোলার ডিসঅর্ডার। কুণালের মাকে পেয়ে উনি এক অন্য মানুষে পরিণত হন। এর মধ্যে কুণালের সঙ্গে ওর কোনও প্রেম নেই।” প্রবাল বিশ্বাস করে। আশ্বস্ত হয়।

শ্রীপর্ণা বাড়ি ফিরে যাবে না কিছুতেই। ডাঃ দাস বোঝান, “শ্রীপর্ণা, আপনার বাইপোলার। ওটা আপনি নন। আপনি ছোট নন এখন। আপনার মা নেই। মারা গেছেন আপনার ছোটবেলায়। আপনি বোঝার চেষ্টা করুন। আপনি একজনের স্ত্রী। একজনের মা।” ও আরও বেশি ভেঙে পড়ে। “আমি কোনওদিন একজন সন্তান হিসাবে পিতামাতার কাছে ভালবাসা মর্যাদা পাইনি। স্ত্রী হিসাবেও সম্মান পাইনি স্বামীর কাছে। আর মা হয়ে মেয়ের কাছেও। আমার কোনও বাড়ি নেই। আমি কারও স্ত্রী নই, কারও মা নই।”

শ্রীপর্ণা অনড়। বাড়ি যাবে না কিছুতেই। কুণালের দিদি বিপাশাই প্রস্তাব রাখে। একটা মেয়েদের হোম আছে। যেখানে সেইসব নির্যাতিতা মহিলারা যাঁরা সংসারে ফিরে গিয়ে আরও একবার আঘাত, অসম্মান, অমর্যাদার মুখোমুখি হতে চান না অথবা যে একা মেয়েরা সংসারে ভাই দাদার বশ্যতা স্বীকার করে বাঁচতে চায় না, অথবা স্বামী মারা গেলে যাঁদের থাকার সেরকম জায়গা নেই। একা থাকার বদলে এইরকম একটা হোমে থাকলে নিজেদের সুরক্ষিত মনে করে, সেরকমই একটা হোম ‘আমার বাড়ি’। শহর থেকে খুব দূরেও নয়। বারুইপুরে। শহরের সঙ্গে যোগাযোগও করার অসুবিধা নেই। আবার পরিবেশটাও ভাল। তাছাড়া, বিপাশা নিজেই বরের বদলির কারণে অস্ট্রেলিয়া চলে যাচ্ছে। এরকম সময় খুব তাড়াতাড়ি একটা সমাধান প্রয়োজন। কুণালের বাড়িতে থাকাটা সমাধান নয়। ওর এই রোগ সারানোটা অত্যন্ত জরুরি।

সবাই মেনে নেয় এই ব্যবস্থা। শ্রীপর্ণাও শান্তভাবে হোমে চলে আসে। কিন্তু কী যেন একটা অভিমান। কার ওপর বুঝতে পারে না ও। বিপাশা অতদূর থেকে প্রায়ই ফোনে খোঁজ নেয়। কুণালের বিয়ে হয়েছে সদ্য। ওর নতুন বউ ভুল বুঝতে পারে ভেবে শ্রীপর্ণা ওদের বাড়িতে মাকে দেখতে যায় না। মাঝেমাঝে অন্য একটা ফোন থেকে ফোন করে মায়ের গলা শোনে। মা ফোন ধরলে কিছু বলে না ও। ফোন রেখে দেয়। কিন্তু বিপাশা ফোন না করলে খুব অস্থির হয়ে পড়ে ও। বিপাশা ফোন করলে ওর মনে পড়ে যায় ও আসলে দুটো মেরুতে চলে যেতে পারে স্বচ্ছন্দে। অনেককিছুই নেই ওর। তবুও এই সহজ যাতায়াত একমাত্র ওরই বিশেষ ক্ষমতা। তাই প্রবালের স্ত্রী, রোদসীর মা মেন্টাল, বাইপোলার ডিসঅর্ডারে ভোগা একজন পেশেন্ট হয়েও ও কিন্তু মাঝেমাঝেই সেই ছাদের বাগান, ক্যাকটাস ফুল, জবাকুসুমের তেলের গন্ধেরখুব কাছে চলে আসতে পারে আর শুনতে পায়, মা বলছে, “শান্ত থাকা প্র্যাকটিস কর শ্রী। ক্যাকটাসের ফুলগুলো দেখো! এত কাঁটার মধ্যেও কী শান্ত, কী উজ্জ্বল!”