কুন্তলা বন্দ্যোপাধ্যায়
গলিতে সূর্য ওঠে। জানালার বন্ধ পাল্লায় আর এসির ইঞ্জিনে ধাক্কা খেয়ে, ছাদের পেটুনিয়ার পাপড়িতে আর গ্যারেজের চালে টায়ারের বৃত্তে মেনির সঙ্গে গা এলিয়ে অপেক্ষা করে। ক্রমে গলি জাগে। এসির ফরফর থেমে পাম্পের ঘরঘর শুরু হয়। জলের ছরছর। বাসনের ঠনঠন। প্রয়োজনের থেকে জোরে। অনিচ্ছাকৃত নয় সম্ভবত। সম্ভবত, অনভ্যস্ত হাতের হতাশার জানান। বেডরুমে আপত্তির গোঙানি কানে বালিশ চেপে পাশ ফেরে।
ছাদে দাঁড়িয়ে তিনি সব শোনেন। হতাশার হাহাকার, বাধ্যতামূলক বন্দিত্বের বিষাদ, অনিশ্চয়তার আফসোস— যাবতীয় কাতরতা। দীর্ঘশ্বাস ফেলেন। এইসব এড়াবেন বলে তাঁর ব্রাহ্মমুহূর্তে ছাদে আসা। এই বাধ্যতামূলক নির্জনতা যদি মানুষকে নিজেদের ভেতর দিকে তাকাতে উদ্বুদ্ধ করতে পারত। এত অভিযোগ, এত নালিশ। ওরা জানে না, এটা একটা সুযোগ। নিজের ভেতর ডুব দেওয়ার। আত্মানুসন্ধানের; যা তিনি সারাজীবন প্র্যাকটিস করেছেন।
ফুলের গন্ধ, কে জানে কার বাড়ি থেকে ভেসে আসছে। ঘোলাটে আকাশ এই কদিনেই কত পরিষ্কার। তিরিশ বছর পর জলন্ধর থেকে আবার ধৌলাধার পর্বতশ্রেণি দেখতে পাওয়া গেছে। সদ্যোজাত সূর্যের দিকে তিনি মুখ তুলে দাঁড়ান। জবাকুসুম সংকাশংই বটে। কিন্তু সত্যি বলতে কি, জবাকুসুমের থেকে সূর্যের কমলাটা অনেক বেশি বরং গ্রেড এ, ফ্রি রেঞ্জ ডিমের কুসুমের কাছাকাছি— যা তিনি লন্ডনে মেয়ের বাড়ির গিয়ে খেয়েছিলেন।
মুখ নামিয়েই তিনি মুখোমুখি হন আরেকটি দৃশ্যের এবং বিচলিত হন। রাস্তা দিয়ে অলরেডি লোকের আনাগোনা শুরু হয়ে গেছে। স্বাভাবিক সময়ের থেকে অনেক কম। কিন্তু সভ্য দেশের লকডাউনের যে ছবি তিনি দুবেলা প্রত্যক্ষ করছেন টিভিতে ও ফোনের স্ক্রিনে, তার তুলনায় অনেক বেশি। এদিক থেকে ওদিকে একটা লোক গেল। মুখে গামছা পেঁচানো, গায়ে আধময়লা স্যান্ডো গেঞ্জি, খাটো লুঙ্গি। হান্ড্রেড পারসেন্ট ও পাড়ার বস্তির লোক।
তিনি থমকান। আর ও পাড়া বলা যায় কি? বছর দশেক আগে হলেও হয়তো যেত। এখন এরা পৌঁছে গেছে এ পাড়ার প্রান্তসীমায়। আর কয়েক পা। আর কয়েকটা বছর। এর মধ্যে না মরে গেলে নিজের চোখে দেখে যেতে হবে; তাঁর শৈশবের খেলার মাঠ, যৌবনের কফি হাউস, বার্ধক্যের বেনারস জুড়ে লুঙ্গি আর গুটকা আর হুক্কাহুয়া ভাষা দাপিয়ে বেড়াচ্ছে।
উল্টোদিক থেকে আরেকজন আসছে। এর পোশাকআশাক আশানুরূপ, ভদ্রসভ্য। হাফহাতা শার্ট এবং ফুললেংথ ট্রাউজারস। পদচালনার ভঙ্গিমায় পথচারীকে চেনা চেনা ঠেকে। হাতের থলি এবং হাঁটার অভিমুখ থেকে উদ্দেশ্যও স্পষ্ট। পরশুও (নাকি তরশু? উঁহু, পরশুই) এ-ই গিয়েছিল বাজারের থলি হাতে, এই একই সময়ে। একই দিকে। সেদিনও মুখে মাস্ক ছিল না, রুমাল চাপা ছিল। আজও তাই।
এ দেশের শিক্ষিত লোকেরাই নিয়ম মানতে জানে না, অশিক্ষিতদের থেকে আশা করাই মূর্খামি।
লোকটা হেঁটে হেঁটে তাঁর বাড়ি পেরিয়ে গেল।
এতক্ষণে পুরো চেনা গেল। মোড় ঘুরে দোতলা, গেল বছর তিনতলা হয়েছে সম্ভবত, বাড়ি। বছর বছর রং করা লাইট কালারের দেওয়াল জুড়ে বোগেনভিলিয়ার ঝাড়। একতলা দোতলার সবগুলো জানালায় এসি। গেটের ভেতর ছাউনির নিচে বড় একটা গাড়ি দাঁড়িয়ে থাকে। ছেলে বলছিল, হেবি দামি মডেল। গেটের বাইরে মার্বেল ফলকে বাহারি অক্ষরে গোটা পরিবারের নামের পাশে ডিগ্রির মিছিল।
আর পদবী।
গলার ভেতর থেকে বেরিয়ে আসা “হুঃ”টা সামলানো গেল না। কিছু লোক সারাজীবন অন্যায় সুযোগ পেয়ে গেল। মেধা লাগল না, যোগ্যতা লাগল না, স্ট্রাগল লাগল না— স্রেফ পদবীর মইয়ে ভর দিয়ে সবাইকে ল্যাং মেরে টপাটপ টঙে উঠে গেল।
পনেরো মিনিট আগের পরিতৃপ্তিটা খান খান হয়ে যাচ্ছে। ব্যাটাদের বড় বাড় বেড়েছে। চলুক লকডাউন। না খেয়ে মরুক সব। আছড়েপিছড়ে, কাতরেমাতরে।
***
বাইরে রোদ ঝলসাচ্ছে। হাওয়ায় কংক্রিটের গন্ধ। ফেরিওয়ালার হাঁক নেই। পায়রার গুবগুব নেই। পাড়া জুড়ে খালি বিভিন্ন স্কেলে, বিভিন্ন লয়ে এসির মরণপণ সংগ্রাম।
এই ঘরে শুধু ফ্যানের ক্যাঁচকোচ। জরাজীর্ণ ফ্যান অতি ধীরে, দুলে দুলে ঘুরছে। কুড়ি ইঞ্চি দেওয়াল, তিন মানুষ উঁচু সিলিংওয়ালা এ ঘরে তবু উষ্ণতার অভাব। মাঝে মাঝে বরং গা শিরশিরিয়ে ওঠে। দেওয়ালের কোণে কোণে ছায়া। জমে ওঠা বিষয়সম্পত্তি পুরনো কাপড়ের আবরণের নিচে, মৃত ডাইনোসরের পিঠের মতো ঢিবি হয়ে আছে।
একটা জ্যান্ত ডাইনোসরও আছে এই ঘরে। ফ্যানের আওয়াজের ফাঁকে ফাঁকে তার শ্বাসের ঘং ঘং শোনা যায়। জানালার পাশে প্রাচীন কেদারায় বসে সে তার নুলো হাত দিয়ে খড়খড়ি সামান্য ফাঁক করে, ছাগলের মতো ঘোলাটে দুই চোখ সেই ফোঁকরে গুঁজে দেয় এবং পত্রপাঠ রোদের চাবুকে ছিটকে যায়। তেপায়া টেবিল হাতড়ায়। এটা ঠোক্কর খায়, ওটা গড়িয়ে পড়ে। অবশেষে উদ্দিষ্ট বস্তুটি নাগালে আসে। খড়খড়ির ফাটলে মরা চোখের বদলে বাইনোকুলারের দুটো জাগ্রত, বিস্ফারিত চোখ সেঁটে যায়।
কোনও কিছু আঁকড়ে ধরার যন্ত্রণা জং ধরা থাবায় চারিয়ে যায়। কিন্তু এ যন্ত্রণার পুরস্কার আছে। এতদিন হাতে গোনা কয়েকটা জানালা, হাতে গোনা লোক, হাতে গোনা দৃশ্য, হাতে গোনা নাটকের পুনরাবৃত্তি। গত কদিনে দৃশ্যপট বদলেছে। এতদিন ডাইনোসর একা আইসোলেটেড ছিল, এখন সবাই আইসোলেটেড। বাইনোকুলার ঘোরে। ধীরে ধীরে, ডান থেকে বাঁয়ে। বিলম্বিত স্নানের প্রমাণ হিসেবে বারান্দায় দড়ি থেকে ভেজা গোলাপি নাইটস্যুট এবং জাঙিয়া ঝুলছে। ম্যাচিং ব্ল্যাক প্যান্টি এবং ব্রা। শক্তিশালী বাইনোকুলার প্যাডের কিনারায় লেসের কারিকুরি স্পষ্ট তুলে আনে। ডাইনোসরের শ্বাস দ্রুত ও ঘন হয়। ঘং ঘং অবশেষে ক্যাঁচকোঁচকে ছাপিয়ে যায়।
***
অ্যাই, টি শার্ট বদলানোর চ্যালেঞ্জটা দেখেছ?
হোয়াট চ্যালেঞ্জ?
ডোন্ট প্রিটেন্ড। তোমার এক্সও তো বডি দেখিয়ে টি শার্ট চেঞ্জ করেছে। বলতে চাও দেখোনি? ফ্রেন্ডলিস্টে আছে তো।
অন গড দেখিনি। কী চ্যালেঞ্জ শুনিই না।
তুমি যে টি শার্টটা পরে আছ, নট নেসেসারিলি টি শার্টই হতে হবে, টি শার্ট, শার্ট— বেসিক্যালি যে জামাটা পরে আছ, সেটা ছেড়ে অন্য একটা টি শার্ট পরতে হবে। গোটা প্রসেসটা অন ক্যামেরা হবে।
হাউ স্টুপিড।
তোমাদের উইদাউট রিজন ঘরের ভেতর বেনারসি পরে ঘোরাঘুরির চ্যালেঞ্জের থেকে কম।
ইফ ইউ সে সো। তুমি পোস্ট করবে ভাবছ নাকি?
আই হ্যাভ আ বেটার আইডিয়া। আমার বদলে তুমি টি শার্ট চেঞ্জ করো। আমি ভিডিও তুলব।
তারপর ফেসবুকে পোস্ট করব?
তোমার মধ্যে স্লাইট এক্সিবিশনিজম আছে কিন্তু।
কেন, তোমার আপত্তি আছে?
নট অ্যাট অল। আমার কেন আপত্তি থাকবে। তবে ইন জেনারেল বাঙালিদের থাকবে। তাছাড়া ফ্রেন্ডলিস্ট ভর্তি করে তো মাসিপিসি পুষেছ।
মেসোশ্বশুর আর পিসিশাশুড়ি, বল। আমার বাড়ির লোকেরা ফেসবুক করে না।
হাউ প্রোগ্রেসিভ।
বাই দ্য ওয়ে, পুষেছি আবার কী, শ্বশুরবাড়ির লোক রিকু পাঠালে কি ডিক্লাইন করব? এমনিতেই তো… তাছাড়া বুড়োরা লোনলিনেসে ভোগে। কথা বলার লোক নেই। লকডাউনের বাজারে তো চাকরবাকরদের সঙ্গে কথা বলার লাক্সারিও নেই। জাস্ট ইম্যাজিন। আই ফিল সরি ফর দেম।
সরি না হাতি। বাড়িতে এসে গাণ্ডেপিণ্ডে গিলতে গিলতে যখন মিষ্টি করে করে মাইনে কত পাস জিজ্ঞেস করে তখন দেখলে আর অত সরি হতে হত না। কুচুটের ডিব্বা সব এক একটা। যাই হোক, এক্ষুনি তোমার অন ক্যামেরা জামা বদলানো হ্যান্ডেল করার মতো অ্যাডাল্ট আমাদের সোসাইটি হয়নি। অ্যাকাউন্ট রিপোর্টেড হবে, বাড়ির বউ দুশ্চরিত্র বলে বদনাম রটবে, একগাদা ঝঞ্ঝাট। তার থেকে তুমি বরং শুধু আমাকেই দেখাও আপাতত, বুঝলে।
একজন দুই হাঁটু গেড়ে বিছানার ওপর বসে। অন্যজন মোবাইল তাক করে রেকর্ডিং-এর লাল বৃত্তে আঙুল ছুঁইয়ে রেডি হয়। ক্যামেরা রোলিং, অ্যাকশন।
টি শার্ট খোলার প্রক্রিয়া শুরু হয়। তিন বছর বয়স থেকে চর্চিত কুচিপুরির যত বিভঙ্গ ও উজাড় করে দেয়। ক্রমে নিজেকে জানালার কাঁচে লতানো নীল পর্দার মাঝের এক ইঞ্চির ফাঁকে নিজেকে অবস্থিত করে, যাতে রাস্তার ওপারের খড়খড়ির দু ইঞ্চি ফাঁকে সেঁটে থাকা বাইনোকুলারের ভিউ ক্লিয়ার আসে।
আহারে, বুড়োমানুষ।
টি শার্ট বদলানোর খেলা ক্রমে অন্য খেলায় পর্যবসিত হয়। আঙুলের ডগা, পায়ের পাতা, কানের লতি, গলার গহ্বর। নো আদার প্রপস নিডেড।
গাড়ির হর্নে ঘোর কাটে। খেলোয়াড়দের একজন শরীরের ঊর্ধ্বাংশ তুলে পর্দা এক সেন্টিমিটার বাইরের উঁকি দেয়। লাল রঙের আই টোয়েন্টি এসে থেমেছে উল্টোদিকের বাড়ির সামনে।
বুল্টু ফিরল নাকি?
মনে তো হচ্ছে।
ইটালি থেকে এসেছে না?
হুম্। সালা এবার পাড়াশুদ্ধু লোকের করোনা বাধাবে।
আহা, ইটালি থেকে ফিরলেই বুঝি করোনা।
তা নয়। তবে যদি পজিটিভও হয়, বলবে থোড়াই। এ মালকে আমার চেনা আছে। জন্মে ইস্তক দেখছি। হাড়মিটমিটে। বই মুখে করে বসে থাকত বলে কেউ কিছু টের পেত না। করোনার হেল্পলাইন নম্বরটা সেভ করে রেখেছিলে না তুমি?
এয়ারপোর্টে চেকিং হয়েছে নিশ্চয়।
ধুস, ইন্ডিয়ায় আবার চেকিং। পয়সা ছড়িয়ে বেরিয়ে এসেছে। ফোনটা দাও না। হেল্পলাইনটাইন দরকার নেই, সোজা থানায় ইনফর্ম করব সালা।
ছেড়ে দাও না। হয়তো কিছু হয়নি। পাড়ার মধ্যে এইসব করার দরকার আছে?
আলবাত আছে। ইটালি অ্যামেরিকা বার করছি দাঁড়াও। এতদিনের ফুটানির শোধ তুলব এবার।
***
অবশেষে এবেলার কাজ ফুরোয়। ওবেলা শুরু হতে আরও ঘণ্টাকয়েকের ফাঁক। যে ফাঁকটুকুতে কারও কোনও চাহিদা নেই, দাবি নেই, অধিকার নেই।
অন্তত এতদিন ছিল না। এখন পরিস্থিতি বদলেছে। বাড়ির বিভিন্ন কোণায়, সোফায় এবং ডাইনিং টেবিলে অস্থায়ী অফিস খুলেছে। সার্কেল ব্যাক। ডিপ ডাইভ। আউটরিচ। মিটিং-এর পর মিটিং। ফর্ম্যালের ফাঁকে ইনফর্ম্যাল। বাড়িতে থেকে প্রোডাক্টিভিটি কত বেড়ে গেছে, ইয়ার। কবে যে ওয়ার্ক ফ্রম হোম ম্যান্ডেটরি হয়ে যাবে। বসের মুখ দেখতে হবে না।
এসব দেশে ওসব হওয়া চাপের আছে। স্ক্যান্ডিনেভিয়া তো করে ফেলেছে। ওয়ার্ক ফ্রম হোম। কেউ কিচ্ছু বলবে না। বাড়িতে থাকো, কাজ জমা দাও। ব্যস।
থার্ড রাউন্ডের ছ্যাতলা পড়া চায়ের কাপ তুলতে তুলতে কানে যায়। বুক ধুকপুক করে। মা মরে গিয়েছিলেন তিপ্পান্ন বছর বয়সে। গল্প শুনেছেন দিদিমা গেছিলেন তেত্রিশে। সেই হিসেবে তাঁর তিয়াত্তরে যাওয়ার কথা। তার আগেই যদি ভারতবর্ষ স্ক্যানডিনেভিয়া হয়ে যায়?
বামচামের ওপর ড্রেসশার্ট আর টাই পরা প্রিয়জন এসে রান্নাঘরের দরজায় হেলান দেয়। আজ কী মেনু গো?
ডাল, বেগুনভাজা…
বেগুনভাজা! বেগুনভাজা কে খাবে!! মাছভাজা করোনি?
করেছি বাবা। বেগুনভাজা, যিনি গতমাস থেকে প্লান্ট-বেসড হয়েছেন তাঁর জন্য। তাঁর জন্য ছানার ডালনাও হয়েছে। তোমার জন্য চিকেন।
থ্যাঙ্ক গড। শোনো না, ওপরের কাকিমা কী সব হেবি হেবি এক্সপেরিমেন্ট করছে দেখেছ। জাস্ট আটা আর টমেটো দিয়ে একটা কী বানিয়েছে, ফ্যান্টাস্টিক দেখতে। লিখেছে খেতেও নাকি ইকুয়ালি ভালো। রাতে করবে মা?
দরজাটা আস্তে করে ভেজিয়ে তিনি জানালার কাছে এসে দাঁড়ান। রাস্তার ওপারে বন্ধ জানালা। খালি বারান্দা। বারান্দায় যাওয়ার সাহস হচ্ছে না তাঁর, গেলে রাস্তার এদিক ওদিকও ফাঁকা বেরোত নিশ্চিত।
মাথাটা দপদপাচ্ছে। এসির রিমোটটায় চাপ দিয়ে তিনি খাটে গা এলালেন। একসময় ঘুমোনোর নেশা ছিল। এখন ফেসবুকের নেশা হয়েছে। ঘুমের ভেতর তবু দুঃস্বপ্নদের ঢুকে পড়ার সম্ভাবনা থাকে, ফেসবুকে থাকলে সেটুকুও নিশ্ছিদ্র। ঘণ্টার পর ঘণ্টা শোকহীন, রোগহীন, তাপহীন বেঁচে থাকা। সারাশরীর নিঃসাড় ফেলে রেখে খালি আঙুলের ডগা আর চোখের মণির ওপর আর নিচ, নিচ আর ওপর।
টমেটো আর আটার রান্নাটার ছবিটায় থামলেন দু মিনিট। থালার ওপরের ঘ্যাঁটটা ঢেকে গোল গোল করে কাটা টমেটো, গোল গোল করে কাটা পেঁয়াজ, গোল গোল করে কাটা শশা। ফাঁকে ফাঁকে ছোটবেলায় আঁকা সূর্যরশ্মির মতো ডাঁটাশুদ্ধু কাঁচালংকা। পাড়ার সকলেই লাইক দিয়েছে। তিনিও দিলেন।
মিনিট পাঁচেক পর দুটো ছবি তাঁর মনোযোগ টানল। প্রথম ছবিটা ক্যামেরা রাস্তায় রেখে তোলা হয়েছে। সাবজেক্ট— ফাটা পায়ের পাতার দল। ইন ফোকাস, আউট অফ ফোকাস। আবরণহীন ও ক্ষয়াসোল চপ্পল পরিহিত। ফুলপ্যান্ট ও সস্তা শাড়ির ঘের সজ্জিত। প্রাপ্তবয়স্ক ও অপ্রাপ্তবয়স্ক।
দ্বিতীয় ছবিতে পায়ের পাতার বদলে দলে দলে মাথা। ছবিটা তোলা হয়েছে সম্ভবত ড্রোন ব্যবহার করে। মেয়ে গত সপ্তাহেই বলছিল নেক্সট মাসের মাইনে পেয়ে কিনবে। বেশিরভাগের মাথার ওপরেই পুঁটলি চাপানো। কয়েকটা শরীরের ঘাড়ের দু পাশে পা ঝোলানো শিশু।
খানিকক্ষণ দুটো ছবির দিকে তাকিয়ে থাকেন তিনি। হলদে আঙুলের ডগা দিয়ে ফোনের স্ক্রিনে একবার উঠে এবং নেমে সিদ্ধান্ত নেওয়ার চেষ্টা চালান, কোন ছবিটা বেশি করুণ। শেষটা হাল ছেড়ে দুটোই শেয়ার করেন। দু লাইন লেখেন। কত লোকে খেতে পাচ্ছে না। আর আমরা রকমরকম আবিষ্কার চালাচ্ছি রান্নাঘরে। সেসব আবার ছবি তুলে দেখাচ্ছিও। ছিঃ।
দপদপানিটা কমে আসছে অবশেষে। চোখ লেগে আসে।
যতক্ষণ না চিৎকারটা ঘটে। চায়ের দুধ কোথায় গো মা? বলে দাও, আমি নিজেই করে নেব না হয়।
***
পশ্চিমের বাড়িগুলোর ছায়া লম্বা হতে হতে পূর্বের বাড়িগুলোর ছাদ, জানালা ও বারান্দা গ্রাস করে। রাস্তায় গুটিকয়েক লোকের চলাচল। বারান্দার রেলিং-এ ঝুঁকে অল্পস্বল্প বাক্যবিনিময়। আজই তো? করবে তো? এখনও তো টাইম আছে। তবে সব রেডিটেডি করতে হবে। ও বলছিল এ সবে কিছু হওয়ার নয়। কে জানে। কীসে কী হয়। ক্ষতি তো নেই।
মাহেন্দ্রক্ষণ সমাগত হয়। গলির সবাই বারান্দায় এবং জানালায়, ছাদে ও চাতালে বেরিয়ে আসে। হলুদমাখা হাত ও ওয়াকার খামচানো থাবা। বামচাম ও হট প্যান্ট। খণ্ডন-ভব-বন্ধন-এর মন্দ্র রেকর্ডিং পাড়া গমগমায়। শাঁখে ফুঁ পড়ে।
ত্রস্ত মেনি গ্যারাজের অন্ধকারে সেঁধোয়।
এই পুণ্যলগ্নের প্রমাণ রাখতে হাতে হাতে মোবাইল উঠে আসে। হাতে হাত না রাখা যাক, শব্দে শব্দে, আলোয় আলোয় মানুষে মানুষে সেতু বাঁধা হয়। রোগের বিরুদ্ধে, আইসোলেসেনের বিরুদ্ধে, ভাইরাসের বিরুদ্ধে— মানুষ জিতবেই।