সমরেন্দ্র বিশ্বাস
সেই নীলাভ হোর্ডিং। মেয়েটি সেই ছবি। বাসের জানালা দিয়ে বিজ্ঞাপনের হোর্ডিংটা দেখেই দীপ্তেন্দুর মনটা ফুরফুরিয়ে উঠল। এই ভালো লাগাটা নতুন নয়। বরং একটা পুরোণো আবেগ, চেনা আবেগ। দীপ্তেন্দুর মনটা আকাশে ভেসে গিয়ে পক্ষীরাজ ঘোড়া হতে চাইল।
তার চোখ আটকে আছে মেয়েটার মুখে, পাশেই দৃশ্যমান তিন-তিনটে নীলাভ পাপড়িতে। বিশালাকায় হোর্ডিং। ঐ মেয়েটা তাকে ইশারায় ডাকছে। এক্ষুনি নিয়ে যাবে। কোন নীলাভ হলের অন্তরঙ্গ জলশায়। পুরোণো গানের কয়েকটা কলি দীপ্তেন্দুর গলায় উঠে এল।
অফিসে যাবার রাস্তা। অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকা বাসটা ছেড়ে দিয়েছে। দৃশ্যবদল হল। শহরের বদলে যাওয়া অন্য দৃশ্যপট। কিছুক্ষণ আগেই সে হোর্ডিং দেখাছিল। তার সেই আবেগটা আপাতত থিতিয়ে এল। কিছুটা সময় পরেই বাস তাকে মেট্রো স্টেশনের স্টপেজে নামিয়ে দিল।
মেট্রোরেলের সিঁড়ির মুখে দাঁড়িয়ে তার চোখাচোখি হল আবার সেই মেয়েটার সঙ্গে। বিজ্ঞাপনের মুখ। সেই চোখ, সেই আহ্বান, সেই স্বর্গীয় সুষমা। ভীড়-ভার মেট্রো স্টেশন। পেছনের লোকেদের অস্বস্তিকর ধাক্কায় আবার দৃশ্যবদল হল।
অফিসের লিফ্ট বেয়ে উঠতে উঠতে দীপ্তেন্দু চোখ বন্ধ করে রইল। একটা বিজ্ঞাপনের নীলাভ দৃশ্য তার চেতনাকে আজকাল আচ্ছন্ন করে দিচ্ছে।
তিনটি নীলাভ পাপড়ি। নীলের এমন অপার্থিব শোভা নন্দনকাননেই মেলে। স্বর্গের মতো তার রঙ। তিনটি পাপড়ি অসাধারণ ছন্দময়তায় পাশাপাশি লগ্ন হয়ে আছে। সঙ্গে বিজ্ঞাপনের সেই মেয়েটির মুখ। খুশি খুশি! বিজ্ঞাপনের হোর্ডিং-এ লেখা তিনটি শব্দ – ‘আমি তোমাকেই চাই!’
অফিসের চেয়ারে বসে দীপ্তেন্দু কাজের ফাইলগুলো দেখতে লাগল। তাকে গ্রামসংক্রান্ত কিছু পরিসংখ্যান আর সার্ভের খোঁজখবর নিতে আজকেই বাইরে যেতে হবে। শহর ছাড়িয়ে দূর একটা গ্রামে।
অফিসের বেয়ারা তার হাতে পৌঁছে দিল একটা নীল খাম। আজকেই আবার সেই নীল। খামের এককোণে সেই এমব্লেম, সেই ব্রান্ড – তিনটি নীলাভ পাপড়ি!
দীপ্তেন্দু খাম খুলল। একটা নীলাভ চিঠি। দামি তার কাগজ। তাতেও এক কোণে সেই মেয়েটির হাসি হাসি মুখ। ছবির পাশে তিনটি শব্দ – ‘আমি তোমাকেই চাই’, একটা কোম্পানির প্রোডাক্ট ক্যাটালগ। সে চিঠিটা উলটে পালটে দেখল। চিঠির কাগজে মেয়েটির ঐশ্বর্যময় উপস্থিতি। এ ছাড়া তাতে পড়ে নেওয়ার মতো তেমন কিছু সে খুঁজে পেল না। তবুও ঐ চিঠির নীল পাপড়িগুলো আর সেই মেয়েটি তাকে ডেকে পাঠিয়েছে। দীপ্তেন্দুর আবার মনে হল সমস্ত কিছুর সীমানা ছাড়িয়ে এ চিঠির আবেদন অতি দীর্ঘ। খামের উপর কম্পিউটারে কম্পোজ করা তার নাম – দীপ্তেন্দু বসু, ঠিকানাটাও ঠিকঠাক লেখা। সে সরকারী অফিসের একজন বাবু কর্মচারী। সে কি এতই গুরুত্বপূর্ণ। কে তাকে এমন চিঠি পাঠালো, সঙ্গে একটা লাইন – আমি তোমাদেরও সঙ্গে নিতে চাই।
সরকারী সার্ভে সংক্রান্ত কাজে দূরবর্তী গ্রামটিতে পৌঁছোতে বিকেল হয়ে গেল। অখ্যাত সেই গ্রামটিতে পৌঁছেই সে দেখল, সেখানেও ওই নীলাভ পোস্টার, কিন্তু সাইজে ছোট। সেই বিজ্ঞাপনের পোস্টার ও তাতে আঁকা তিনটি পাপড়ি দিয়ে কারা যেন দোকানগুলোকে ঘিরতে চেয়েছে, ঘিরতে চেয়েছে গ্রামগুলোকেও।
আসপাশের কিছু খবরাখবর নেয়া ও অফিসের কাগজপত্তর দেখা – এসব করে নিতে বেশ রাত হয়ে গেল। যারা দীপ্তেন্দুর সঙ্গে দেখা করতে এসেছিল, তারাও চলে গেল। গ্রামের রাত বেশ গহন আর গভীর। ভীষণ নির্জনতা। এখানকার একটা সস্তা পান্থ-নিবাস, তার দোতালার ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে সে দেখতে লাগল গ্রামের ছোটছোট ঘরবাড়ি, পায়ে হাঁটা রাস্তা, প্রচুর গাছ-গাছালি – ল্যাম্পপোস্ট। মাথার উপরে জ্বলজ্বল করছে পূর্ণিমার চাঁদ – মুখখানা তার গোলগাল বিধবা-যুবতীর। চাঁদের আলোয় দীপ্তেন্দুর চোখ আটকে গেল সামনেরই দেয়াল জোড়া সেই বিশাল পোস্টারে। আবার সেই মেয়েটি! নীল ব্লাউজ, নীল শাড়ি। সে দীপ্তেন্দুর দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি হাসছে। ওখানেও ফুটে আছে তিনটি নীলাভ পাপড়ি। বিজ্ঞাপনের পোস্টার। আমি তোমাকেই চাই। মেয়েটি চুপিসারে দীপ্তেন্দুকে ডাকছে।
স্বর্গীয় সুষমাময় ঐ বিজ্ঞাপনের মেয়েটির সামনে চাঁদের আলোয় একা একা ভিজতে ভিজতে দীপ্তেন্দুর মনে এল নন্দিতার কথা। তাদের কলেজ জীবন। তাদের পাশাপাশি থাকা, হাঁটা। নন্দিতার শরীরের গন্ধের সঙ্গে ঐ একলা মেয়েটির শরীরের গন্ধ অসম্ভব মিলে গেল। ঐ নীলাভ মেয়েটির শরীরময় জেগে ওঠা অসংখ্য ঢেউ দীপ্তেন্দুর শরীরেও আলোড়ন তুলল। গভীর রাত্রে তার শরীর উষ্ণ হল।
পরদিনই অফিস সংক্রান্ত টুকিটাকি কাজ শেষ। গ্রাম থেকে গ্যালোপিং ট্রেনে শহরে ফেরত আসতে আসতে কখন যেন সে ঘুমিয়ে পড়েছিল। সে ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে দেখতে লাগল একটা প্রতীক চিহ্ন, তার মধ্যকপালে – তিনটে নীল ফুলের পাপড়ি তার কপালকে সুড়সুড়ি দিচ্ছে, তার সমস্ত তেজস্বিতাকে শুষে নিচ্ছে। একটা বিজ্ঞাপনের প্রতীক – তিনটে মাত্র পাপড়ি আর একটা মেয়ের মুখ – তার উনচল্লিশ বছরের বয়সকে এলোমেলো করে দিচ্ছে – তার ভেতরটাকে অস্থির করে দিচ্ছে। যেন দীপ্তেন্দুর আকাশে ডানা মেলবে, তাকে আকাশযানে এক মহাদেশ থেকে অন্য মহাদেশে নিয়ে যাবে! তার সামনে আজকাল আজকাল শুধু মাত্র তিনটি নীলাভ পাপড়ির ঘোর, মেয়েটির লিপিহীন অদৃশ্য খোলা চিঠি।
পরদিনে আবার রোজকার অফিস। নিজের টেবিলে বসে কিছু ভাবতে ভাবতে প্রতীক চিহ্নর কথা তার মাথায় এলো। তিনটি নীলাভ পাপড়ি – এটা তো একটা নামকরা কোম্পানীর এমব্লেম। মনে হল, তাদের আদি গাঁয়ের শিবমন্দিরের চূড়ায় আঁকা স্বস্তিক চিহ্নর কথা, সেটাও একটা প্রতীক। এই স্বস্তিক চিহ্ন কখনোই তার মন কাড়ে নি – এ চিহ্ন কেমন বৈরাগ্যময়। আবার হিটলারের হাতে এই স্বস্তিকাচিহ্ন কেমন ফ্যাসিস্ট। তার ঠাকুমার কপালে কারুকার্য করা লম্বা চন্দনের দাগ – সেও এক বৈষ্ণবীয় বিজ্ঞাপন – কী সে দিতে পারে? মেরেছো কলসীর কানা, তাই বলে কি প্রেম দেব না – এমনতরো প্রেম! ভোটের মিছিলে দেখা কত না প্রতীক চিহ্ন – এগুলো বড়ো যান্ত্রিক, খুব চিল্লামিল্লি। শ্লোগান মুখর। হাসি পায় দীপ্তেন্দুর – এসব প্রতীক মানেই প্রতিশ্রুতিময় ভোটের পোস্টার, ভোট শেষে রাস্তা নোংরা, পলিথিনে বর্ষায় ড্রেন জ্যাম, কোথাও কোথাও অখন্ড দুর্নীতি, কোথাও দুঃশাসনের মহাভারত। দুনিয়াতে কতই না প্রতীক চিহ্ন আছে – হাতা, হাতুড়ি, ধানগাছ, লন্ঠন – ঠন্ ঠন্।
অথচ তিনটি নীলাভ পাপড়ি – এই প্রতীকচিহ্ন, এই সিম্বল তা যেন অনেক বেশি রুচি-শিল্পময়, অনেক বেশি স্বর্গীয়, অনেক বেশি আকর্ষণীয়, অনেক বেশি রোমাঞ্চকর।
দীপ্তেন্দু সত্যি সত্যি নতুন করে প্রেমে পড়েছে। বিজ্ঞাপনের সেই মেয়েটির প্রেমে। বিজ্ঞাপনের একটা প্রতীক চিহ্নের প্রেমে। তিনটি নীলাভ পাপড়ি – স্বর্গীয় যার শোভা – তার অলৌকিক প্রেম! তিনটি শব্দের নিষ্কলঙ্ক প্রেমগীতি – ‘আমি তোমাকেই চাই ….’। কেন চাই, কী ভাবে চাই, কোথায় চাই – এসব প্রশ্ন উত্তরহীন। সুন্দরীর জল-সাঁতারের মোহময়তা। কারণ প্রেমের উত্তর শব্দহীন, বিবশতা মাখা।
বিকেলে অফিস থেকে বেরিয়ে দীপ্তেন্দু একটা ট্যাক্সি নিল। আজ আয়াসের বিকেল, অফিসের কাজে গ্রামে গিয়ে কিছু টিএ-ডিএ’র অতিরিক্ত পয়সা তার পকেটে। জওহরলাল নেহেরু রোড। হু-হু হাওয়া। ময়দানের পাশ দিয়ে ট্যাক্সি ছুটছে। গোধূলি এখানে বোঝা যায় না। সন্ধ্যা হবো হবো। সন্ধ্যার ম্লান আলোকে ইতস্তত দাঁড়িয়ে আছে মিউনিসিপ্যালিটির আলোকিত বাতিস্তম্ভ। তখনই তার চোখ আটকে গেল। রাস্তার উপরেই সেই আলোকময় হোর্ডিং। আকাশ জোড়া। সেই মেয়েটার হাসি হাসি মুখ। তিনটে শব্দ – ‘আমি তোমাকেই চাই।’ মহিমাময়, প্রেম-প্রাচুর্যে ভরপুর সেই অবিস্মরণীয় প্রতীক, তিনটি নীলাভ পাপড়ি।
আলোকময় হোর্ডিংটা দেখেই দীপ্তেন্দু হঠাৎ সিদ্ধান্ত নিল। ‘ট্যাক্সি থামাও, আমি নেমে যাবো। ট্যাক্সি থামাও।’
ট্যাক্সি থেকে নেমে দীপ্তেন্দু সন্ধ্যার শহরের একটা প্রধান রাজপথ ধরে হাঁটতে লাগল। একটা ঘোর। একটা বিবশতা।
দীপ্তেন্দু ভুলে গেছে, এই রাস্তাতেই, অনেক বছর আগেকার কথা। ওরা কতবার হেঁটে গেছে – ও আর নন্দিতা। ঐ সাউথ ইন্ডিয়ান রেস্টুরেন্টে কতবার ধোসা খেয়েছে। মেয়েটির সঙ্গে তার ছাড়াছাড়ি হয়ে গেছে সেই কবে। এমন কি আজকাল তার কথা দীপ্তেন্দুর তেমন মনে পড়ে না। ভুলে গেছে, নন্দিতা কি এখন দিল্লীতে? শুনেছিল, সে নাকি বড়ো বাড়িতে থাকে, দামি গাড়ি নিয়ে ঘোরে। অথচ সেই ভুলে যাওয়া মেয়েটা তার সম্বিতকে জাগাতে পারল না। তার স্বপ্নে এখন হোর্ডিংএ আঁকা একটি মেয়ে! একটা ঘোরের মধ্যে হাঁটতে হাঁটতে সে তার মধ্যকপালে সেই অবাস্তব মেয়েটার স্পর্শমাখা তিনটি নীলাভ পাপড়িকে অনুভব করল। কয়েকদিন হল তার স্নায়ুকে অবশ করে দিচ্ছে একটা বিজ্ঞাপন। দিনরাত্রি তার চোখে ভেসে আসছে সেই মেয়েটি। একটা দ্রুতগামী চলন্ত কারের হাওয়া, তার তীব্র হর্ণ দীপ্তেন্দুর শার্টের আস্তিন ছুঁয়ে গেল। সে একটা ঘোরে আচ্ছন্ন!
দীপ্তেন্দুর কী চাই? তার বাবা-মা এখনো বেঁচে আছে। ঘরে বউ আছে। ছোটো ছোটো ছেলেমেয়ে আছে। পকেটে কলেজের ডিগ্রী আছে। মোটামুটি মাসমাইনের টাকা আছে- মাইনে চলনসই, বলনসই; যদিও ততটা পর্যাপ্ত নয়। আর পর্যাপ্ত ইনকাম কোন চাকুরীজীবিরই বা থাকে? তাহলে দীপ্তেন্দুর কী চাই? তা সে জানে না। সে নীলাভ পাপড়ির দৃষ্টিমায়ায় ঘোরগ্রস্ত, ‘আমি তোমাকেই চাই’- এই আবেদনে বিহ্বল। ঢেউতোলা সেই বিজ্ঞাপনের মেয়েটির আবেদনে অত্যন্ত সংক্রামিত।
তিনটি নীলাভ পাপড়ির সংক্রমনে আক্রান্ত, দীপ্তেন্দু এই ব্যস্ত শহরটার উপর দিয়ে হাঁটতে লাগলো। উদ্দেশ্যবিহীন সে এগোতে লাগল। সে ভুলে গেল তার শৈশব, তার যৌবন, তার দেশভূমি – বর্তমান অবস্থান। ভুলে গেল সে যে একজন সাধারণ সরকারী কর্মচারী। বিজ্ঞাপনের একটা নীলাভ আবেদন থেকে তার যেন মুক্তি নেই।
হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎই সে দাঁড়িয়ে পড়ল। তার নজরে এল বিজ্ঞাপনে দেখা সেই ব্রান্ডেড কোম্পানিটির শো-রুম! ঝলমলে আলোক সজ্জা। সে ভূতগ্রস্তের মত মাল্টিপ্লেক্সের ভেতর ঢুকে গেল। কাঁচের দরজা, কাঁচের দেয়াল, উপরে সেই নীলাভ আলোটা জ্বলছে!
সামনেই সত্যি সত্যি সেই মেয়ে – নীলাভ যার শাড়ি, হাসি হাসি মুখ। যেন কতকালের চেনা।
দীপ্তেন্দু স্বপ্নাবিষ্টের মতো মেয়েটির দিকে এগোতেই দেখলো, তার কাঁধে, শাড়ির আঁচলে লগ্ন হয়ে আছে সেই স্বপ্নময় প্রতীকচিহ্ন – মানে কোম্পানির এম্বলেম – তিনটি নীলাভ পাপড়ি। সেই হাসির আবাহনে মিশে ছিল পুরোনো পরিচিত কিছু বর্ণমালা, আমি তোমাকেই চাই!
বাঙালি কথায় মেয়েটি আরো উজ্জ্বল হলো। বুকে তার দুলে উঠলো ঢেউ। দেহে জাগলো তরঙ্গমালা – ‘আরে দীপ্তেন্দু – তুমি – কতদিন বাদে, এসো এসো ভেতরে এসো।’ ভাবটা এমন, আমি তোমাকেই চাই। ‘আই অ্যাম ওয়েটিং ফর ইউ লঙ্’ – যেমন বলে থাকে সুশিক্ষিত কোন কলগার্ল। সম্মোহিত দীপ্তেন্দুকে নিয়ে মেয়েটি সুবিশাল কমপ্লেক্সে ঢুকলো।
দীপ্তেন্দু ঘোরে, চলমান ঘুমে। সে মেয়েটির পিছু পিছু হাঁটতে হাঁটতে বিশাল মাল্টিপ্লেক্সের সাজসজ্জা দেখতে লাগল। অনেক মানুষ, নানান বিপনণ সামগ্রী। একই পরিসরে ব্যাঙ্কের কাউন্টার। কফি স্ন্যাক্স-এর স্টল, ব্রা-প্যান্টির শো কেস। শিশুদের বসে থাকবার ক্রেশ। পুরো একটা আন্তর্জাতিক দুনিয়া আটকানো রয়েছে এই বিল্ডিং কমপ্লেক্সে; জাপানি, জার্মানি, বিলাতী, আমেরিকান, ইন্দোনেশিয়ান, চাইনিজ – সব কিছু। এখানে আছে এক্ষুনি ভাড়া খাটতে যাবে এমন মানুষ, খাঁচায় ভরা কুকুরের বাচ্চা ডগি। বোতলে ভরা অ্যামিবা, কাঁকড়ার নড়নচড়ন। এক একটা হলের ভেতরে থরে থরে সাজানো এক এক টাইপের পণ্যসামগ্রী , কিংবা প্রাণী সম্পদ। যাদের টাকা আছে তারা কিনবে। যাদের কাছে টাকা নেই তারা শুধু দেখবে। সবারই জন্যে আমন্ত্রণ। সবারই জন্যে বিশ্বায়ন। একটা ছোটোখাটো লাইন – কমপ্লেক্সের ভেতরে অলটাইম মেশিন। এটিএম কাউন্টারের মতো একটা এম্প্লয়মেন্ট সেলও।
মেয়েটি তাকে একান্তে ডেকে নিল। কথাবার্তায় আরো উজ্জ্বল হল।
একটা সুসজ্জিত ইন্টারনেট কাম কফিরুমে দুটো মখমলে মোড়া চেয়ার। দীপ্তেন্দু আর মেয়েটি মুখোমুখি বসল।
‘সব পাখি ঘরে আসে – সব নদী ……
…… মুখোমুখি বসিবার বনলতা সেন।’
কলেজের উন্মুক্ত আঙ্গিনায়, কিংবা ঘরোয়া আবৃত্তির আসরে নন্দিতা আবৃত্তি করত। পুরোনো দিনের সেই নন্দিতার চোখের সঙ্গে আজকের এই নীলাভ-পাপড়ি মেয়েটির কোথাও কি কিছু মিল আছে?
মেয়েটি ধীরে ধীরে জিজ্ঞেস করলো- ‘বলো কী নেবে?’ মেয়েটির কাঁধের শাড়িতে সেফ্টিপিন আঁটা প্রজাপতির তিনটি নীলাভ পাখনা কাঁপছে। ‘কফি? না রাম? হুইস্কি, না কি গোয়ার ফেনি তোমার পছন্দ?’
নীলাভ মেয়েটি মুখ খুলল। ‘আমাদের হাজার হাজার প্রোডাক্ট। কী চাই? মোটরকার, টেলিভিসন, কম্পিউটর, মেডিকেল ইকুইপমেন্ট, মেডিসিন, …… বলো তোমার কিছু কি চাই? সমস্ত জিনিষ নিয়ে আমরা দূরদূরান্তের শহর ও গ্রামগুলোতেও পৌঁছে গেছি।’
‘শুধু জিনিষ বেচা? না না শুধু তাই নয়। আমরা কিনিও। বিশাল আমাদের বিজনেস। যেমন টিম্বার, আয়রণ-ওর, ইস্পাত, কেক, আবার ভালো আমের শরবত। হু হু ! আরো অনেক কিছু। যেমন কোন লোকের থেকে আমরা সার্ভিসও কিনতে পারি। আমাদের প্রয়োজন মতো যে কোন লোকের সার্ভিস, তার সময়, তার ঘণ্টা, তার বউ-বাচ্চা – এসবও আমরা কিনে নেই। ভালো টাকা, মোটা টাকা।’
‘এই কেনা একদিনের জন্যে হতে পারে, কয়েকদিনের জন্য, কয়েক মাসের জন্যে, অথবা কয়েকটা বছরের জন্যে। এমন কি এই কিনে নেয়ার শর্তটা সারাজীবনের জন্যেও লাগু হতে পারে। অবশ্য তার জন্যে আমাদের কোম্পানি যে টাকা দেবে তা অনেকেই স্বপ্নেও ভাবতে পারবে না!’
‘যাক্ গে ওসব কথা। তুমি এখন কোথায় চাকরি করছো?’
দীপ্তেন্দু আম্তা আম্তা করে বলল, ‘এই আর কি। একটা ছোটখাটো সরকারী সংস্থায়’।
মেয়েটি বলল, ‘তুমি তো আমাদের কোম্পানিতে জয়েন করতে পারো। আমাদের অনেক লোক দরকার।’
দীপ্তেন্দু এই প্রস্তাব কিংবা তার ক্ষমতাতে সন্দেহ প্রকাশ করতেই মেয়েটি তার কাঁধের নীলাভ পাপড়িগুলো সেট করতে করতে বলল, ‘দ্যাখো নি আমাদের বিজ্ঞাপন? আমাদের মূল কথা – আমি তোমাকেই চাই। মানে আমরা মানুষের সেবা করতে চাই। এই কথাগুলোকেই চার দিকের দেয়ালে, মিডিয়ায়, বিজ্ঞাপনে, বড়ো বড়ো হোর্ডিং-এ দিকে দিকে শহরে গ্রামে সব জায়গাতেই আমরা ছড়িয়ে রেখেছি।’
এতো বিজনেস, এতো বিদেশিয়ানা! এতক্ষণের তিনটি নীলাভ পাপড়ির স্বর্গীয় সম্মোহন থেকে দীপ্তেন্দু নিজেকে কিছুটা নিষ্ক্রান্ত করতে পারল। এতো বানিজ্যিক কথাবার্তা তার আর ভালো লাগছে না।
দীপ্তেন্দু চোখ তুলে বাইরে তাকাল। কাঁচের দেয়াল। সুভেদ্য দৃষ্টি। লোকজনের আনাগোনা। বিপণনের অসম্ভব আয়োজন।
এতক্ষণে তার নজরে এল, লাইট সিগ্ন্যালে রং-বদল করছে বড় হরফের শব্দগুলো – ‘ – একটি – বৃহৎ – আন্তর্জাতিক – সংস্থা – ’ । শব্দগুলোর পরেই কোম্পানির এমব্লেম – তিনটি নীলাভ পাপড়ি – যা আলোতে উজ্জ্বল ও মুহুর্মুহু দৃশ্যমান। শহরের এই সম্ভ্রান্ত অঞ্চল ছাড়িয়ে কোম্পানির এই আলোক বিকিরণ ছড়িয়ে পড়ছে দূর দিগন্তে, ঘূর্ণায়মান কোন স্যাটেলাইটে।
তারা দুজনে যে রুমটায় বসে আছে, দীপ্তেন্দু তা খুটিয়ে খুটিয়ে দেখতে লাগল, নেট-কাফের আদলে সুসজ্জিত সেই রুম। এক পাশের দেয়ালে তিন তিনটে ছবি। একটিতে আঁকা ভারতবর্ষের ম্যাপ। অন্যটিতে চিত্রিত সমস্ত পৃথিবী, সেই ম্যাপে দেখানো হয়েছে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ ও বড়ো বড়ো শহরের নাম। তৃতীয় ছবিতে কোন শিল্পীর আঁকা বাউল-রবীন্দ্রনাথ, বড়ো লোকেদের ড্রইংরুমে যেমন অয়েল পেন্টিং সাজানো থাকে – পেন্টিং এর নীচে লেখা বাংলা দু’টো লাইন –
‘দিবে আর নিবে, মিলাবে মিলিবে, যাবে না ফিরে-
এই ভারতের মহামানবের সাগরতীরে।।’
দীপ্তেন্দুর সামনের মেয়েটি এখনও নীলাভ হয়ে আছে; পরিধানে, চোখের চাহনিতে, হাতের রিস্ট-ওয়াচে। মেয়েটি বারবার তার কাঁধের এমব্লেমটি ঠিক করছে। যেন তিনটে নীলাভ পাপড়ি তার শাড়ির যথাস্থানে শোভা না পেলে তৎক্ষণাৎ কোন একটা পরীক্ষায় ভয়ংকর নম্বর কাটা যাবে। দীপ্তেন্দুর মনটা কেমন করে উঠল।
অবশেষে মেয়েটি আরো একবার ভ্রমরকালো চোখের, না – না – নীল নীল চোখের চাহনি খেলিয়ে দীপ্তেন্দুকেই বলল, – ‘দিল্লীতেই ছিলাম। ক’মাস হল এই মাল্টিন্যাশানালে জয়েন করেছি। বিজনেস্ ডেভলপ্মেন্ট- কাম – মার্কেটিং একজিকিউটিভ।
হাতে নন্দিতার ভিজিটিং-কার্ড নিয়ে অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই দীপ্তেন্দু বড়ো রাস্তায় নেমে এসে শুনতে পেল কোলাহল, ট্যাক্সির হর্ণ, রোডের ট্রাফিক, মানুষজনের দৈনন্দিন ব্যস্ততা।
সে ভেবে অবাক হলো, নন্দিতা কি করে আজ হোর্ডিং-এ আঁকা বিজ্ঞাপনের মেয়ে হয়ে গেছে? বিশাল নীলাভ বিজ্ঞাপনের বোর্ড, তিনটি নীলাভ পাপড়ির বাণিজ্যিক বিকিরণ তার এককালের ভালোলাগা মেয়েটিকে খেয়ে ফেলেছে! অবশেষে এতদিনকার নীল পাপড়ির ঘোর দীপ্তেন্দুর ভেতর থেকে ধীরে ধীরে উবে যেতে থাকল। এতদিন ধরে চুপি চুপি উপভোগ করছিল বিজ্ঞাপনের মেয়েটির প্রতিরোধহীন আকর্ষণ, হঠাৎ করেই তার পায়ের কাছে গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে পড়ল সেই দীর্ঘকায় শার্সিটা, যা ছিল তার অত্যন্তই একান্ত। তার ভেতরকার এতোদিনের চাপা জ্বর জ্বর ভাবটা এখন একদম ঠান্ডা হয়ে এল।
সেদিন কিন্তু নিজের ঘরে ফিরে এসে দীপ্তেন্দুর সত্যি সত্যি জ্বর এল। জ্বরের ঘোরে সে আবার নীল নীল স্বপ্ন দেখতে লাগল। তার বউ মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছিল। সত্যিকারের জ্বরের বিকারে সে বিড়-বিড় করে বলতে লাগল – ‘বাইরের আকাশটা নীল, মাল্টিন্যাশানালের ছাতটা নীল। বিজ্ঞাপনের হোর্ডিংটাও। আরে তোমার হাতটাও যে যন্ত্রণায় নীল হয়ে আছে? বউ, তুমিও কি যন্ত্রণায় আছো?’
বোতাম খুলে যাওয়া ব্লাউজ, এলোমেলো শাড়ির মহিমা নিয়ে বউটা তখন বিছানায় সত্যি সত্যিই দীপ্তেন্দুর পাশে জেগে ছিল।