Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

অভিবাসী শ্রমিকের মহানিষ্ক্রমণ: রুটি, রেললাইন ও উন্নয়নের গল্প

দেবব্রত শ্যামরায়

 



লেখক গদ্যকার, রাজনৈতিক বিশ্লেষক

 

 

 

এই লেখাটা শুরু করতে হচ্ছে একটি ছবির কথা দিয়ে। ছবি অর্থে স্থিরচিত্র। ছবিটা ইতিমধ্যে যাকে বলে ভাইরাল। ছবিটায় আমরা দেখতে পাচ্ছি, রেলওয়ে ট্র‍্যাকের ওপর ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কয়েকটা রুটি। ব্যস, এই এটুকুই। রুটি ও রেললাইন। আর কিছু নয়। অথচ এই সামান্য ফ্রেমটাই এক মুহূর্তে গোটা দেশের, কোভিড-আক্রান্ত ভারতবর্ষের ভয়াবহ বাস্তবতার কথা বলছে।

ছবিটির প্রেক্ষিত ইতিমধ্যে আমরা সবাই জেনে গেছি। ছবিটি মহারাষ্ট্রের ঔরঙ্গাবাদে বদনাপুর ও করমাড স্টেশনের মাঝামাঝি রেলওয়ে ট্র‍্যাকের। মহারাষ্ট্রের জলনা থেকে ১৫৭ কিলোমিটার দূরে ভুসাবলের পথে হাঁটা দিয়েছিলেন জনা কুড়ি শ্রমিকের একটি দল। ঠিক যেমনভাবে গত এক-দেড়মাস ধরে নানা রাজ্যে লকডাউনে আটকে পড়া অভিবাসী শ্রমিকেরা বাড়ি ফেরার চেষ্টা করছেন। গ্রাসাচ্ছাদনের জন্য নিজের গ্রাম-মফস্বল ছেড়ে ভিনরাজ্যে বাস করেন তারা। কেউ একা, কেউ বা সপরিবার। এ বছর মার্চ মাসে সংসদে দাঁড়িয়ে সরকার স্বীকার করেছিল, সারা দেশে অভিবাসী শ্রমিকের সংখ্যা বর্তমানে কমপক্ষে দশ কোটি, তাও এর বাইরেও একটা বড় সংখ্যা রয়েছে যারা নথিবদ্ধ নয়। এদেরই একটা বিরাট অংশ এবার ঘরে ফেরার তাড়নায় পথে নেমেছেন। নয়ডা থেকে বীজপুর। আহমেদাবাদ থেকে রায়বেরিলি। কেউ কেউ ঘরভাড়া দিতে না পেরে বিতাড়িত হয়ে রাস্তায় নামতে বাধ্য হয়েছেন। কেউ বা পেটের জ্বালায়। কাজ বন্ধ, মালিক বা কন্ট্রাক্টর এই দুঃসময়ে কোনওরকম দায়িত্ব নিতে রাজি নয়, সামান্য সঞ্চিত অর্থ যেটুকু ছিল, যথারীতি, ফুরিয়েছে৷ নিজের গ্রাম-মফস্বল থেকে দূরে কর্মস্থলে থাকার কারণে হাতের কাছে রেশন কার্ডও নেই, তাই সরকারি খাদ্যের জোগান থেকে বঞ্চিত হয়েছেন তারা। অতঃপর তারা কয়েকশো এমনকি হাজারখানেক কিলোমিটার দূরে নিজেদের গ্রামে ফেরার কথা ভাবতে শুরু করেছেন, এই আশায় যে বুড়ো বাপ-মা, আত্মীয়স্বজনের কাছে ফিরতে পারলে অন্তত লবণ-রুটি খেয়েও বেঁচে থাকা যাবে, মাথা গোঁজার ঠাঁইটুকু মিলবে। তাই তারা হাঁটছেন। কেউ বা চলেছেন সাইকেলে। রাষ্ট্রের প্রতিনিধি পুলিশ তাদের দেখতে পেলেই লাঠি চালাচ্ছে, লকডাউন ভাঙার ‘অপরাধে’। তাই বেশিরভাগ সময়েই রাজপথ এড়িয়ে শ্রমিকদের নেমে যেতে হচ্ছে মেঠো রাস্তায়, রেলপথে। পায়ের সস্তার চপ্পল কিছুদূর যাওয়ার পরেই ছিঁড়ে যাচ্ছে। রোদে-জলে কষ্ট হচ্ছে মহিলাদের, সঙ্গের বাচ্চাদের। রাস্তায় কোনও খাবারের দোকান খোলা নেই, জলের ভাঁড়ারও অপ্রতুল। এই চূড়ান্ত অমানবিক পরিস্থিতি অগ্রাহ্য করে পথে নেমেছেন শ্রমিকেরা। ঠিক কতজন অভিবাসী শ্রমিক পথে নেমেছেন? না, সংখ্যাটা জানা নেই। বস্তুত, এরা যে এত বিপুল সংখ্যায় সারা দেশে ছড়িয়ে আছেন, এবং এক প্রাণান্তকর সঙ্কটের মধ্যে পড়তে যাচ্ছেন, তা জানতই না এবং ভাবতে পারেনি মাত্র চার ঘণ্টার নোটিশে দেশজুড়ে লকডাউন ঘোষণা করে দেওয়া কেন্দ্র সরকার। অস্বীকার করে লাভ নেই, এই অজ্ঞতা ও উদাসীনতার শরিক ছিলাম আমরাও, আমরা অর্থাৎ দেশের বাকি অংশ— মূলত বিপুল মধ্যবিত্ত এবং কতিপয় উচ্চবিত্ত জনগণ।

ঔরঙ্গাবাদের ঘটনায় ফিরে আসি। ঘটনাটা ছোট করে এইরকম, পায়ে হেঁটে ভুসাবল স্টেশনে পৌঁছে, সেখান থেকে ‘শ্রমিক স্পেশাল’ ট্রেন ধরে মধ্যপ্রদেশের উমারিয়া ও শাহদোল জেলায় নিজেদের গ্রামে ফেরার পরিকল্পনা ছিল এই শ্রমিক দলটির৷ সেদিন হাঁটতে হাঁটতে রাত নামলে পথশ্রমে ক্লান্ত হয়ে রেলওয়ে ট্র‍্যাকের ওপরেই ঘুমিয়ে পড়েন তাঁরা। রেললাইনের ওপর ঘুমোনোর কারণ, এক— তাঁরা ভেবেছিলেন রেললাইনে শোওয়া নিরাপদ। যেহেতু লকডাউন, তাই কোনও ট্রেন চলছে না। দুই— আশেপাশে অপরিচ্ছন্ন উঁচুনিচু জংলা জায়গার তুলনায় রেলট্র‍্যাকটাই তুলনামূলক পরিচ্ছন্ন, এমনকি লাইনে মাথা রেখে শোওয়াও খানিক আরামের। পরেরদিন অর্থাৎ মে মাসের আট তারিখ ভোর ৫টা ১৫ নাগাদ একটি খালি মালগাড়ি যখন এই দলটির চোদ্দ জনকে পিষে ও তিনজনকে গুরুতর আহত করে চলে যায় (যাঁদের মধ্যে দুজন শ্রমিক, কিছুক্ষণ পরে, হাসপাতালে মারা যাবেন), তখন তাঁরা অঘোরে ঘুমোচ্ছিলেন। মালগাড়ির তীব্র হুইসল এবং জেগে ওঠা গুটিকয়েক শ্রমিকের চেষ্টাতেও বাকিদের শেষ ঘুম ভাঙেনি। মুহূর্তে রেললাইন জুড়ে ছড়িয়ে পড়ল তাঁদের সম্পত্তি— পোঁটলা-পুঁটলি, দাঁতন, ছেঁড়া চটি, গামছা, সস্তার মোবাইল ফোন ইত্যাদি। আর কটি রুটি৷ এই রুটিগুলির ছবিই আমরা সকালে উঠে চা-কফি খেতে খেতে সোশাল মিডিয়ায় দেখছিলাম আর আমাদের অবশিষ্ট মধ্যবিত্ত বিবেক ঘটনার অভিঘাতে কুঁকড়ে যাচ্ছিল।

কিন্তু দেশজুড়ে বিবেকবান সাধারণ মানুষের সাময়িক শিউরে ওঠার মূল্যে কি এবার অভিবাসী শ্রমিকদের মৃত্যুমিছিল বন্ধ হবে? প্রশ্ন। ষোলজন শ্রমিকের রেলের চাকায় পিষে মৃত্যু কি নিছক আরেকটি পথদুর্ঘটনা নাকি তাঁদের ধীরে ধীরে যমের দক্ষিণ দরজা অবধি ঠেলে দেওয়ার জন্য আমাদের রাষ্ট্র ও তার মুনাফাকেন্দ্রিক উৎপাদন ব্যবস্থা প্রত্যক্ষভাবে দায়ী? উন্নয়ন নামের একমুখী ন্যারেটিভটির প্রতি দেশবাসীর প্রশ্নহীন আনুগত্যই কি বহুকাল ধরেই ভারতবর্ষে শ্রমিক নিধনের ক্ষেত্র তৈরি করেছে? প্রশ্ন এগুলিও। প্রসঙ্গগুলি নিঃসন্দেহে জটিল, বহুস্তর, তবু সাম্প্রতিক ঘটনাক্রমের দিকে চোখ রেখে রাষ্ট্র বনাম অভিবাসী শ্রমিক সম্পর্কের প্রবণতাগুলি বুঝে নেওয়ার যথাসাধ্য চেষ্টা করা যাক।

প্রথমেই, কোনওরকম দ্বিধা না রেখে বলে ফেলা দরকার যে দেশের সরকার, যারা নির্বাচনে জিতে এসে প্রতিটি নাগরিকের জান ও মালের সুরক্ষার দায়িত্ব মাথা পেতে নিয়েছে, এই দশ-এগারো কোটি প্রান্তিক শ্রমজীবী মানুষদের অস্তিত্ব তাদের ভাবনাবলয়ে ছিলই না। রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক স্তরের বাইরেও নানা ক্ষেত্রে দৃশ্যমান যে নাগরিক ইন্টালিজেন্সিয়া, তারাও এই বিপুল দেশীয় শ্রমিক সমাজের উপস্থিতি ও তাদের জীবনে ঘনিয়ে ওঠা আশু সঙ্কটের কথা আগাম চিন্তা করতে পারেননি (আর একথা স্বীকার করে নেওয়া দরকার, এখনও পর্যন্ত দলমত নির্বিশেষে ভারতবর্ষের যেকোনও নির্বাচিত সরকার এই প্রিভিলেজড নাগরিক অংশেরই একটি শ্রেণিগত সম্প্রসারণ ছাড়া অন্য কিছু নয়।) তাই, অভিবাসী শ্রমিকদের নিয়ে সরকারের এই উদাসীনতা ও অদূরদর্শিতা কি শুধুমাত্র তাদের অকর্মণ্যতা, আরেকটি প্রশাসনিক মিসম্যানেজমেন্ট, নাকি শ্রমিকদের প্রতি রাষ্ট্রের এই ব্যবহার তার রক্তের মধ্যে বহমান সাধারণ চরিত্রলক্ষণ? উত্তর পেতে গত দেড় মাসের সময়রেখায় একবার চোখ বোলানো যাক। খানিকটা দীর্ঘ ও পুনরাবৃত্তিময় লাগলেও, অভিবাসী শ্রমিকদের যাত্রাপথের এই লেখচিত্রটা এক জায়গায় টুকে রাখাটা দরকার বলে মনে হল।

মার্চ ২২: কেন্দ্র সরকার করোনা সংক্রমণের সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও বিদেশে থাকা ভারতীয় অর্থাৎ এনআরআই, অভিবাসী ও পর্যটকদের দেশে ফিরে আসার সুযোগ করে দিতে আন্তর্জাতিক উড়ান ঝুঁকি নিয়ে দীর্ঘদিন চালু রাখেন। মে ২২-এ শেষ উড়ান চালানোর অন্তত কুড়ি ঘণ্টা আগে থেকেই বিমান চলাচলের চূড়ান্ত সময়সীমা ঘোষণা করা হয়েছিল। অন্যদিকে, সেই একই সরকার দেশজুড়ে ছড়িয়ে থাকা অভিবাসী শ্রমিকদের ঘরে ফেরার বিন্দুমাত্র সুযোগ না দিয়ে মাত্র চার ঘণ্টার নোটিসে সারা দেশে পরিবহন ব্যবস্থা স্তব্ধ করে দেন।

এপ্রিল ১৪: প্রথম ও দ্বিতীয় দফার লকডাউন চলাকালীনই অভিবাসী শ্রমিকেরা নিরুপায় হয়ে ঘরে ফেরার জন্য রাস্তায় নেমেছিলেন। কারণগুলো আমরা খানিক আগেই জেনেছি। এপ্রিল মাসের ১৪ তারিখ প্রধানমন্ত্রীর ভাষণের অব্যবহিত পরেই প্রায় ৩০০০ শ্রমিক মুম্বইয়ে বান্দ্রায় রাস্তায় জড়ো হয়েছিলেন। তাদের আশা ছিল, প্রথম দফার লকডাউন মিটলে তারা নিজের নিজের গ্রামে ফিরতে পারবেন। অথচ কেন্দ্র সরকারের তরফে তখনও পর্যন্ত কোনও শ্রমিক নীতি ছিল না, এমনকি পরিস্থিতির গুরুত্ব অনুযায়ী রাজ্য সরকারগুলির প্রতি কোনও বার্তা ও দিকনির্দেশও দেওয়া হয়নি। জাতির উদ্দেশ্যে দেওয়া প্রধানমন্ত্রীর ভাষণে দেশের সাধারণ মানুষ স্টিলের থালা বাজাবেন না জার্মান সিলভারের বাটি, মোমবাতি জ্বালাবেন না মশাল, লকডাউন চলাকালীন ব্যক্তিগত যোগব্যায়ামের ভিডিও কখন কীভাবে সোশাল মিডিয়ায় আপলোড করতে হবে, ইত্যাদি নিয়ে যে পরিমাণ স্পষ্টতা ছিল, সরকারের চিন্তা ও কাজে অভিবাসী শ্রমিকদের সমস্যার প্রতি মনোযোগ তার ভগ্নাংশও ছিল না।

এপ্রিল ২৫-২৮: বিভিন্ন রাজ্যে আটকে থাকা অভিবাসী শ্রমিকদের নিয়ে কী করা যাবে তা নিয়ে গোটা এপ্রিল মাস জুড়ে প্রশাসনিক স্তরে কোনও ঐকমত্য ছিল না৷ অভিবাসী শ্রমিকদের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ উত্তর প্রদেশের বাসিন্দা, ২৫ এপ্রিল নিজের রাজ্যের শ্রমিকদের আবেদনে সাড়া দিয়ে উত্তর প্রদেশ সরকার নয়ডা সীমান্তে বাস সার্ভিস চালু করে শ্রমিকদের ঘরে ফেরানোর সিদ্ধান্ত নেন। বাসের সংখ্যা যথেষ্ট না হওয়ায় সমান্তরালভাবে গজিয়ে ওঠে অসাধু পরিবহন সিন্ডিকেট, যারা তিন-চার-পাঁচ হাজার টাকার বিনিময়ে শ্রমিকদের দ্রুত ঘরে ফেরাবে, এই প্রতিশ্রুতি দিয়ে শ্রমিকদের সঞ্চয় লুঠ করতে শুরু করে। ঘরে ফিরেও শান্তি নেই। ঘরফেরতা শ্রমিকদের পশুর মতো রাস্তায় বসিয়ে কীটনাশক স্প্রে করে ‘সংক্রমণমুক্ত’ করার মর্মান্তিক ছবি আমরা কদিন আগেই সংবাদমাধ্যমে দেখেছি। এই পরিস্থিতিতে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রক ২৮ এপ্রিল পুনরায় প্রতিটি রাজ্যের বর্ডার সিল করে দেওয়ার নির্দেশ দেন, ও শ্রমিকরা যে যেখানে আছেন, তাদের সেখানেই থেমে যেতে বলেন। বাড়ি ফেরার উদ্দেশ্য নিয়ে রাস্তায় নেমে পড়া হাজার হাজার শ্রমিকের দল আরেকবার নতুন করে সমস্যায় পড়েন৷

মে ৩: অবশেষে মে মাসের তিন তারিখ, অর্থাৎ দ্বিতীয় পর্যায়ের লকডাউনের শেষ দিনে, ভারতীয় রেল নানা রাজ্যে আটকে পড়া শ্রমিকদের জন্য ‘শ্রমিক স্পেশাল’ ট্রেন চালানোর কথা ঘোষণা করে। অর্থাৎ এতদিনে, লকডাউন শুরুর প্রায় দেড় মাস পরে কেন্দ্রীয় সরকারের তরফে শ্রমিকদের জন্য একটি ঠিকঠাক(?) ‘evacuation plan’ ভাবা সম্ভব হল। বলে রাখা দরকার, ততদিনে ঘরে ফিরতে মরিয়া শ্রমিকদের মৃত্যুর সংখ্যা প্রায় চল্লিশ ছুঁই ছুঁই, যার মধ্যে বারো বছরের কিশোরী তেলেঙ্গানার লঙ্কাক্ষেতের শিশুশ্রমিক জামলো মকদমের মৃত্যু আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় খবর হয়েছে। অপুষ্টিতে ভোগা বেচারি মেয়েটি দীর্ঘ পথ হাঁটার ক্লান্তি সহ্য করতে না পেরে লুটিয়ে পড়ে ছত্তিশগড়ে এসে, তাঁদের গ্রাম বীজপুর থেকে মাত্র কয়েক কিলোমিটার আগে।

মে ৫: ‘Evacuation plan’ যে ঠিকঠাক ছিল না, তা প্রকাশ পেতে খুব একটা দেরি হয় না৷ অভিবাসী শ্রমিকদের রেল ভাড়া কে দেবে, তা নিয়ে শুরু হয়ে যায় কেন্দ্র-রাজ্য চাপানউতোর। রেলের নির্দেশিকায় বলা ছিল শ্রমিকেরা যে রাজ্যে ফিরবে, সেই রাজ্যের সরকারকে যাত্রা শুরু আগেই ভাড়া মিটিয়ে দিতে হবে। ‘শ্রমিক স্পেশাল’-এর টিকিটের দাম গন্তব্যে পৌঁছনোর সাধারণ স্লিপার টিকিটের মূল্য থেকে সামান্য বেশি, কারণ রেলকে সোশাল ডিসট্যান্সিং-এর বিধি মেনে কমসংখ্যক যাত্রী নিয়ে যাত্রা করতে হচ্ছে, অর্থাৎ আটকে পড়া শ্রমিকদের ঘরে ফেরানোর দায়িত্ব পালন করতে নেমেও রেলমন্ত্রক তাদের লাভক্ষতির হিসেব ছাড়তে পারেনি। বিরোধীদের তোলা বিতর্কের চাপে বিজেপি নেতৃত্ব প্রচার করার চেষ্টা করে যে ভাড়ার ৮৫% কেন্দ্র বহন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে, কিন্তু খোদ বিজেপি-শাসিত গুজরাটই অভিবাসী শ্রমিকদের কান মলে পুরো ভাড়া আদায় করেছে, এই সত্য সামনে চলে আসায় বিজেপির মুখরক্ষার তত্ত্ব শেষমেশ ধোপে টেঁকে না। এছাড়াও সুপ্রিম কোর্টে মে মাসের প্রথম সপ্তাহে এই সংক্রান্ত একটি জনস্বার্থ মামলা চলাকালীন বিচারপতি সলিসিটর জেনারেলকে প্রশ্ন করেন, কেন্দ্র সরকার কি সত্যিই শ্রমিকদের ৮৫% ভাড়া বহন করছে? উত্তরে সলিসিটর জেনারেল তুষার মেহতা জানান যে এই নিয়ে এখনও পর্যন্ত তাঁর কাছে কোনও তথ্য নেই৷ সবমিলিয়ে রাষ্ট্রের অসংবেদনশীল মুখ আরেকবার সকলের সামনে চলে আসে। স্পষ্ট হয়ে যায়, রাষ্ট্রের গুরুত্বের তালিকায় অভিবাসী শ্রমিকের স্থান ঠিক কোথায়। এই রাষ্ট্র কোভিড যুদ্ধে চিকিৎসক ও চিকিৎসাকর্মীদের অভিনন্দন জানানোর জন্য ৮৬৯ কোটি টাকা (সংবাদসূত্র অসমর্থিত) খরচা করে হাসপাতালগুলির ওপর বায়ুসেনার বিমান থেকে পুষ্পবৃষ্টি করার মতো দানবিক অপচয় করতে পারে, বিদেশে আটকে পড়া এনআরআই অভিবাসী ‘শ্রমিক’-দের এয়ার ইন্ডিয়ার বিশেষ বিমানে বিনা পয়সায় দেশে ফিরিয়ে আনতে পারে, অথচ দারিদ্র্যরেখায় দাঁড়িয়ে থাকা শ্রমজীবীদের ঘরে ফেরার পথখরচ মকুব করতে পারে না।

মে ৬: এখানেই শেষ নয়। গত ৬ তারিখ কর্নাটকের মুখ্যমন্ত্রী ইয়েদুরাপ্পার সঙ্গে রাজ্যের নির্মাণশিল্পের কর্ণধারদের একটি সভা হয়। তার কিছু পরেই কর্নাটক সরকার রেলকে চিঠি লিখে শ্রমিকদের নিজেদের রাজ্যে ফেরার জন্য নির্দিষ্ট সমস্ত ‘শ্রমিক স্পেশাল’ ট্রেন বাতিল করতে বলে। চিঠিটি লেখার আগে শ্রমিকদের মত নেওয়ার কোনও প্রয়োজন বোধ করেনি সরকার। দেশনির্মাণে শ্রমিকেরা বলিপ্রদত্ত, তাদের মত নেওয়ার আবার কী দরকার! তাছাড়া কাজে ফিরবে, পারিশ্রমিক পাবে, এর চেয়ে বেশি শ্রমিকের আর কী চাহিদা থাকতে পারে! প্রাচীন রোমের ক্রীতদাস প্রথার কথা মনে করিয়ে দেয় ‘গণতান্ত্রিক’ সরকারের এই পদক্ষেপ। আর হ্যাঁ, গুজরাটের মতোই এক্ষেত্রেও রাজ্য সরকার নিজেদের খরচে অভিবাসী শ্রমিকদের বাড়ি পৌঁছে দিচ্ছিলেন না। শ্রমিকরা সকলে রীতিমতো নিজেদের পকেটের টাকায় নির্ধারিত ভাড়া দিয়ে টিকিট কেটেছিলেন৷ যাই হোক, সমালোচনার চাপে ইয়েদুরাপ্পা নিজের সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করলেও ততক্ষণে প্রমাণিত ‘গণতন্ত্র’ বলে খাতায়-কলমে যে রাষ্ট্রটিতে আমরা বাস করি, সেটি আসলে কাদের বশ। ট্র‍্যাজিক নাটকের শেষ অঙ্কে এসে রাষ্ট্রের শ্রেণিচরিত্র নির্ভুলভাবে উন্মোচিত হয়ে গেছে৷

এই পর্যন্ত লিখে কোভিড-আক্রান্ত সময়ে অভিবাসী শ্রমিকদের ললাট লিখনটি গুটিয়ে ফেলতে পারলে ভালো হত, লেখাটির আকার কমত, পাঠকও হাঁফ ছেড়ে বাঁচতেন। কিন্তু তা হবার জো নেই। ১০ মে সকালে পাওয়া সর্বশেষ খবর অবধি উত্তরপ্রদেশ সরকার আগামী তিন বছরের জন্য রাজ্যে শ্রম আইন শিথিল করেছে৷ একই পথে হাঁটছে মধ্যপ্রদেশ এবং গুজরাট সরকারও। চোখ বন্ধ করে বলে দেওয়া যায়, আইন শিথিল করার লাইনে কর্নাটকসহ অন্যান্য বিজেপি-শাসিত রাজ্যগুলির যোগদান শুধুমাত্র সময়ের অপেক্ষা। এর অর্থ লকডাউনের জেরে এই দেড় মাসে শিল্পক্ষেত্রে যে ঘাটতি হয়েছে, তা পূরণ করার লক্ষ্যে শ্রমিকের অধিকার যাতে বাধা হয়ে না দাঁড়ায়— তা সুনিশ্চিত করা। সরকারি ঘোষণাপত্রে লেখা থাকছে শিল্পক্ষেত্রগুলিকে উৎপাদন বৃদ্ধিতে আরও বেশি স্বাধীনতা দেওয়ার স্বার্থে এই পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে। কী ধরনের স্বাধীনতা? কার স্বাধীনতা? প্রথমত, শ্রমদানের সময় আট ঘণ্টা থেকে বাড়িয়ে ১২ ঘণ্টা করা হবে, অর্থাৎ এই বাড়তি চার ঘণ্টার জন্য শ্রমিক ওভারটাইম পাবেন না। এর অর্থ হল কর্মক্ষেত্রে শ্রমিকের অধিকারকে খর্ব করে শিল্পপতির দায়দায়িত্বহীন মুনাফার অধিকারকে আরও স্বাধীনতা দেওয়া হচ্ছে। শিল্পমালিক শ্রমিককে সাধারণ কাজের পরিবেশ অর্থাৎ কাজের জায়গায় হাওয়া-বাতাস চলাচলের ব্যবস্থা, শৌচাগার, সুরক্ষা সামগ্রী ইত্যাদি দিতে বাধ্য থাকবে না। লকডাউনের মরা গাঙে লগ্নির বান ডেকে যাবে। সমাজকর্মী, RTI (Right to Infomation) ও NREGA (Right to Work) আন্দোলনের কর্মী অরুণা রায় অবশ্য রাজ্য সরকারগুলির এই ধরনের আচরণে মোটেই অবাক হননি। Outlook-কে দেওয়া একটি সাক্ষাৎকারে তিনি বলছেন, ইতিমধ্যে ২০১৯-এ সংসদে কেন্দ্রীয় সরকার শ্রম আইন শিথিল করার বিল এনেছিল। অপেক্ষা ছিল শুধু তা কার্যকর করার৷ কোভিড সঙ্কটের সময় উৎপাদন বাড়ানোর অজুহাত কাজে লাগিয়ে এই দানবিক শ্রমিকস্বার্থ বিরোধী আইনটি কাজে লাগানো হল।

যেটা মনোযোগ দিয়ে লক্ষ করবার বিষয়, এতক্ষণ অস্বচ্ছ জিগস পাজলের আলাদা আলাদা খণ্ডগুলো ক্রমশ স্পষ্ট হয়ে উঠছে। প্রতিটি ঘটনাক্রম, রাষ্ট্রের প্রতিক্রিয়া সবকিছু যেন একসূত্রে বাঁধা— আর তা হল উৎপাদন আরও উৎপাদন, আরও নির্দিষ্টভাবে বললে, শ্রমিক স্বার্থ বিসর্জন দিয়ে সুলভ উৎপাদন। চিনের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বিশ্ববাজারের দিকে চোখ রেখে পাঁচ ট্রিলিয়ন অর্থনীতির স্বপ্ন ধাওয়া করতে গেলে এ ছাড়া আর কোনও উপায় নেই। এই যুক্তি পারম্পর্যে ফেলে দেখলে, এনআরসি-সিএএ-র মতো আপাত অর্থ অপচয়কেও এই লক্ষ্যের সঙ্গে সাযুজ্যপূর্ণ বলে হবে। লক্ষ্যে সফল হলে অনুপ্রবেশের জুজু এবং সংখ্যালঘু বিদ্বেষের রাজনীতিতে ভর করে দিল্লির মসনদ সুরক্ষিত রাখা যাবে। একইসঙ্গে এক বিপুল সংখ্যক মানুষকে বে-নাগরিক করে দিয়ে অধিকারহীন সস্তা শ্রমিক হিসেবে কাজে লাগানো যাবে। অনেক কম দামে দ্রব্য ও পরিষেবা উৎপাদিত হবে। অর্থনীতি আর উন্নয়ন হাত ধরাধরি করে চলবে, মিটিমিটি হাসবে।

বিশ্বায়ন-উত্তর ভারতে বিগত তিরিশ বছরে শেকড়বিহীন উচ্চমধ্যবিত্তদের সংখ্যা চক্রবৃদ্ধিহারে বেড়েছে, মূলত তারাই এই উন্নয়ন মডেলের স্টেকহোল্ডার ও তল্পিবাহক। আর এই পথে চলার দায় শুধুমাত্র বর্তমান শাসক দল অর্থাৎ বিজেপির ওপর বর্তালে ভুল করা হবে। নয়ের দশকের শুরু থেকেই এই পরিত্রাণহীন পথ আমরা বেছে নিয়েছি, বাঘের পিঠে চড়ে বসেছি, বিজেপি সরকার নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে ক্ষমতায় এসে বাঘটার দৌড়ের গতিবেগ বাড়িয়ে দিয়েছে মাত্র। গতি বাড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে প্রান্তিক মানুষের স্বার্থকে বিযুক্ত করলে, খেটেখাওয়া মানুষের বুনিয়াদি অধিকারকে নস্যাৎ করলে, পরিবেশের বাধ্যবাধকতাকে অস্বীকার করে উন্নয়নের সুপারহাইওয়েতে লৌহশকটের চাকায় ঝড় তুললে, যা হওয়ার তাই হবে, রাষ্ট্র হয়তো বা উন্নত হবে, কিন্তু দেশ মরবেই৷

ঠিক যেমন মারা গেলেন ঔরঙ্গাবাদের রেলট্র‍্যাকে ওই হতভাগ্য ষোলোজন। তাঁরা আমাদের এই দরিদ্র দেশের মাটিমাখা গতরখাটা মানুষজন। যতক্ষণ কর্মস্থলে মুখ বুজে কাজ করেন এইসব শ্রমিকেরা, ততক্ষণই তাঁদের মূল্য, তার বাইরে নয়। লকডাউনে কাজের জায়গা ত্যাগ করে বাড়ি ফিরতে চাওয়া অর্থাৎ হঠাৎ অনুৎপাদক হয়ে পড়া এর ষোলজন মানুষ তাই উৎপাদনের নেশায় বিভোর রাষ্ট্রের কাছে নিতান্ত মূল্যহীন। আমরা জানি, ব্রিটিশ জমানায় যখন ভারতবর্ষকে রেলরাস্তা দিয়ে দৈর্ঘ্যে প্রস্থে বেঁধে ফেলা হয়েছিল, সেদিন থেকেই উপমহাদেশে ঔপনিবেশিক শাসনের উত্থান সূচিত হয়েছিল। পাশাপাশি সেই রেললাইন পাততে গিয়ে বাঘের আক্রমণে, ম্যালেরিয়ার প্রকোপে, সাপের কামড়ে মারা গিয়েছিলেন হাজার হাজার শ্রমিক। আমরা জানি না সেদিনও তাদের কোমরের ঘুনসিতে জড়িয়ে রাখা খাবার রেললাইনে ছড়িয়ে পড়েছিল কিনা৷ উনিশ শতকের আলোকপ্রাপ্তির ঠিক করে দেওয়া সংজ্ঞা অনুযায়ী অপু যদি কাশবনের ভেতর দিয়ে ট্রেনের সঙ্গে তাল মিলিয়ে ছুটতে পারে, ধোঁয়া-ওগড়ানো ট্রেনের দৃপ্ত চলন দেখতে পায়, তাহলে নিশ্চিন্দিপুরের বদ্ধ যাপনের বাইরে শহুরে আধুনিক জীবন তার জন্য অপেক্ষা করে থাকবে। অন্যদিকে দুর্গা গতির সঙ্গে তাল রাখতে পারে না, পিছিয়ে পড়ে, ট্রেন দেখা তার ভাগ্যে জোটে না, তুমুল বৃষ্টিতে ভিজে একদিনের জ্বরে সে চিরতরে তলিয়ে যায়৷ এযুগে তারই নাম জামলো মকদম। এইভাবেই তীব্রগতির রেলগাড়ি যদি আধুনিক সভ্যতার মননে-চিন্তনে উন্মাদ উন্নয়নের মেটাফর হয়, পুঁটলিতে সামান্য কটা রুটি বেঁধে নিয়ে ভারতবর্ষের বুকের ওপর দিয়ে হেঁটে যাওয়া শ্রমিক চিরকালই সেই উন্নয়নের সামান্য ফুটনোট হিসেবে থেকে যাবে৷ কোভিডকে ধন্যবাদ, দ্য গ্রেট ইন্ডিয়ান ড্রিম-এর পলেস্তারা খসিয়ে সে প্রতিদিন আমাদের দেশের অন্তর্লীন ও দগদগে শ্রেণিবৈষম্যকে কী নির্ভুল নগ্ন করে দিচ্ছে!

রুটি ও রেললাইন। উন্নয়নের চাকায় পিষে যাওয়া ষোল জন শ্রমিকের লাশ আর চারপাশে ছড়িয়ে যাওয়া রুটির টুকরো সভ্যতার ঘিষাপিটা সেকেলে গল্পটাই আজ আরেকবার আমাদের মনে করিয়ে দিয়ে গেল।