Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

একটা-দুটো সত্যি কথা

প্রবুদ্ধ বাগচী

 



লেখক গদ্যকার, সমাজভাবুক

 

 

 

কোভিড ভাইরাসের সংক্রমণের ঋতু শুরু হওয়ার পরে যাঁরা ভেবেছিলেন এই বিপন্ন সময়ে দেশে আর যাই হোক সঙ্কীর্ণ সাম্প্রদায়িক রাজনীতির পালা আপাতত বন্ধ থাকবে আমি তাঁদের দলে পড়ি না। কারণটা খুব স্পষ্ট। সিএএ বা নাগরিকপঞ্জি নিয়ে যে গণবিক্ষোভ সেই ডিসেম্বরের থেকে শুরু হয়েছিল যার সলতে পাকানো হয়েছিল তারও আগে, সেই ঘটনাটার একটা গতিজাড্য ছিল যা ইচ্ছে করলেই থামানো যায় না। কারণ তার জেরেই তো দিল্লির দাঙ্গা খুব পরিকল্পনা করে ঘটানো হল ফেব্রুয়ারির শেষ সপ্তাহে। সাময়িকভাবে করোনা ভাইরাস ঘাড়ের ওপর এসে পড়ায়, অনেক কাজ মুলতুবি রয়েছে। কিন্তু কেন্দ্রীয় শাসকদলের সাম্প্রদায়িক কর্মসূচি আরও বড় ব্যাপার, করোনা মোকাবিলার কন্ট্রোল রুমের মতোই তাঁদের কোনও ছুটি নেই বরং আছে নানা ফন্দিফিকির করে নিজেদের সঙ্কীর্ণ ভাবনাগুলোকে ক্রমাগত দেশের বেশিরভাগ মানুষের ভিতরে ছড়িয়ে দেওয়ার অভিসন্ধি। লকডাউনে তাঁদের অবসর নেই।

দিল্লির নিজামুদ্দিন কাণ্ডে এই প্রচার প্রথমেই বেশ একটা হালে পানি পেল যার মূল দায়িত্ব অবশ্যই তবলিগির আয়োজকদের, তারা এতগুলো মানুষকে জমায়েতের চেষ্টা করে ঘোর অন্যায় করেছেন। ওই সংগঠন বিষয়ে যেটুকু খবর পাওয়া গেছে তা হল, তারা নাকি ইসলাম ধর্মকে কীভাবে আরও সুচারুভাবে পালন করা যায় মূলত তার অনুশীলন করে থাকেন। ধর্ম পালনের অধিকার সাংবিধানিকভাবে স্বীকৃত, তবে এই একুশ শতকে এই ধরনের চর্চার প্রাসঙ্গিকতা নিয়ে প্রশ্ন আছে। জিজ্ঞাসা আছে কেন ও কীভাবে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র দফতরের অধীন দিল্লি পুলিশ ও বিদেশ দফতর এই জমায়েতকে উপেক্ষা করল ও বিদেশি পর্যটকদের ছাড় দিল— এই বিষয়ে আজও অবধি কোনও তদন্ত হয়েছে বলে খবর নেই। কিন্তু এর ফলে যেটা হল, দেশজোড়া একটা প্রচার ছড়িয়ে পড়ল, তবলিগি যোগের জন্যই নাকি কোভিড ছড়িয়ে পড়ছে। কেন্দ্রের স্বাস্থ্য দফতরের বুলেটিনেও এই কথা বলা হয়েছে।

ফিরে আসি আমাদের রাজ্যের আঙিনায়। এই রাজ্যেও নিজামুদ্দিনের ঘটনায় যুক্ত ব্যক্তিদের চিহ্নিত করে তাঁদের দ্রুত আইসোলেশনে পাঠানো হয়েছিল। কিন্তু একটা প্রচার অন্তত সোশ্যাল মিডিয়ায় বেশ খেয়ে গেল যে এই তবলিগি যোগের ফলে আমাদের রাজ্যের সার্বিক সংক্রমণ চিত্রটাও নাকি ঘোরালো, যা বাস্তব সত্যের ধার কাছ দিয়েও যায় না। আর যতদিন যাচ্ছে এমন একটা ধারণা বারবারই ফিরে ফিরে ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে যে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষের সঙ্গে এই রোগের ছড়িয়ে পড়া, না-পড়ার প্রত্যক্ষ সম্পর্ক রয়েছে। ডাহা মিথ্যা।

এই প্রবণতা থেকে রাজ্যে বা বৃহত্তর কলকাতায় লকডাউন শুরু হওয়ার পরে পরেই সোশ্যাল মিডিয়ায় দেখা যেতে লাগল বিশেষ বিশেষ সংখ্যালঘু অধ্যুষিত এলাকায় নাকি লকডাউন মানা হচ্ছে না এমন কথার সমর্থনে তৈরি ভিডিও ক্লিপ। এগুলোর সত্যতা নিয়ে সংশয় আছে। যেহেতু এই রাজ্যে সংক্রামিত এলাকাগুলির বিস্তারিত বিবরণ প্রশাসনিকভাবে প্রকাশ্যে এসেছে অনেক পরে, ফলে ওই না-জানা তথ্য নিয়ে এই ধরনের ভুল বা অপ্রমাণিত প্রচারের সুবিধে হয়েছে বেশি। লকডাউনের দ্বিতীয় পর্যায় পেরিয়ে আমরা যখন সম্ভবত তৃতীয় পর্বের দিকে এগিয়ে চলেছি তখনও এই প্রচার চালু আছে যে এই সংক্রমণের মূল কারণ নাকি সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের আইন না-মানা বেপরোয়া ভাব যাদের জন্য আধা-সামরিক বাহিনী নিয়ে এসে তাঁদের টাইট দেওয়া নিয়েও কেউ কেউ প্রস্তাব পেড়েছেন, তাঁদের মধ্যে রাজ্যের প্রথম নাগরিকও আছেন।

কিন্তু আসল সত্যিটা তাহলে কী?

আমাদের রাজ্যে ও সারা দেশে এক মাসের ওপর লকডাউন চালু থাকার পর রোগের যে সংক্রমণ মানচিত্র প্রকাশ হয়েছে তাতে এটা স্পষ্ট যে অন্তত এই রাজ্যে রোগটা মূলত শহরাঞ্চলের মধ্যে সীমাবদ্ধ। গোটা দেশেও মোটামুটি এই একই চিত্র। বৃহত্তর কলকাতার তিনটে জেলায় এই রোগের প্রকোপ সর্বাধিক— কলকাতা, হাওড়া ও উত্তর চব্বিশ পরগণা। অল্প হলেও পূর্ব মেদিনীপুর তার মধ্যে পড়ছে কারণ হলদিয়া বন্দর ঘিরে কিছু এলাকার চরিত্র অনেকটাই শহুরে। এই সত্যটা যদি এড়িয়ে না যাই তাহলে বিচার করতে হবে গোষ্ঠী সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ার ক্ষেত্রে সব থেকে বিপজ্জনক এলাকা হল শহরের বস্তি অঞ্চলগুলি, কারণ এই এলাকায় মানুষ থাকেন খুব ছোট জায়গায় এবং অনেকটা ঘন সন্নিবদ্ধ অবস্থায়। সরকারিভাবে বসতির সংজ্ঞা হল সাতশো বর্গমিটার এলাকায় ষাট থেকে সত্তরটি পরিবার বা তিনশো মানুষের বসবাসের জায়গা, সব জায়গায় এই সরকারি হিসেব কার্যকর হয়ে আছে এমন ভাবার কোনও কারণ নেই। শুধু কলকাতা পুর এলাকার চল্লিশ শতাংশ মানুষ বস্তি এলাকায় বাস করেন, ২০১১র জনগণনার সূত্র অনুযায়ী যা প্রায় পনেরো লক্ষের মতো। হাওড়া পুরসভার বর্তমান ৬৬টি ওয়ার্ডের মধ্যে অন্তত ৬০টি এলাকায় বসতি এলাকা রয়েছে। উত্তর চব্বিশ পরগণার ব্যারাকপুর মহকুমার চোদ্দটি পুরসভা এলাকায় রয়েছে বিপুল বসতি অঞ্চল, বারাসত মহকুমার অন্তর্গত তিনটি ও বসিরহাট মহকুমার দুটি পুরসভায় বসতি রয়েছে। এই সব বস্তি অঞ্চলে সব ধর্মের মানুষের বাস। কোথাও কোথাও রয়েছে নির্দিষ্টভাবে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের বসবাস। যেমন, কলকাতার রাজাবাজার, গার্ডেনরি‌চ, তপসিয়া ইত্যাদি এলাকা, হাওড়ার পিলখানা, টিকিয়াপাড়া, উন্সানি ইত্যাদি, ব্যারাকপুর মহকুমার টিটাগড়, কামারহাটি ইত্যাদি। অনেক জায়গার নাম বাদ পড়ে গেল অবশ্যই।

এখন এই সব এলাকায় সাধারণভাবে মানুষের জীবনযাপনের অবস্থাটা ও পরিবেশটা ঠিক কেমন?

বস্তি ঘিরে নানা উন্নয়নমূলক কর্মসূচির কথা বলা হলেও তা কোথাও বস্তির বাসিন্দাদের আদর্শ বসবাসের কথা বলে না, আদতে যা করা হয় ও হয়েছে তা হল, তাঁদের মৌলিক কিছু চাহিদাকে কিছুটা পূরণ করা। শহরের কোনো বস্তি এলাকাই এখন বিদ্যুতের সংযোগবিহীন নয়, পানীয় জলের বা শৌচাগারের একটা চলে যাওয়ার মতো ব্যবস্থা আছে। যদিও প্রতিটি ঘরে পানীয় জলের সুবিধা বা পরিবার পিছু একটি শৌচাগার আজও সেখানে বিলাসিতা বরং বলা ভাল আকাশকুসুম। সরকারি পরিসংখ্যান অনুযায়ী কলকাতার বসতি এলাকার বাহাত্তর শতাংশ বাড়ি পুরো বা অর্ধাংশ পাকা (২০১১র তথ্য) কিন্তু সেখানে পরিবার পিছু ঘরের পরিসর যে কতটা সঙ্কীর্ণ সেগুলো নিজেরা না চোখে দেখলে ঠাহর করা মুশকিল। সরকারি হিসেবেই সাতশো বর্গ মিটার জায়গায় সত্তরটি পরিবার থাকলে প্রত্যেকের গড় বরাদ্দ হয় দশ বর্গ মিটার অর্থাৎ আক্ষরিক অর্থেই দশ ফুট বাই দশ ফুট— মনে রাখতে হবে, এই অংশের মধ্যেই কিন্তু সাধারণের ব্যবহার্য কলতলা, শৌচাগার পড়ে যায়— ঠিক যেভাবে ফ্ল্যাট কিনতে গেলে প্রোমোটার কমন স্পেসের জন্য আমাদের থেকে দাম ধরে নেয় এবং আমাদের বরাদ্দ বর্গ এলাকার মধ্যে ধরা থাকে সিঁড়ি বা চাতালের জায়গা, লিফটের অংশটুকু। তবে শুধু এই গাণিতিক হিসেব দিয়ে প্রকৃত সত্যটার নাগাল পাওয়া যাবে না। এইসব অপরিসর ঘরে গাদাগাদি করে থাকে পরিবারের চার পাঁচ বা তারও বেশি সদস্য, সেই থাকাটা চোখে দেখে অনুভব করার বিষয়। সরকারি সমীক্ষা জানাচ্ছে, বস্তিগুলির একটি ঘরে গড়ে পাঁচ জন থাকেন এবং ওই ঘর তাঁদের রান্না, রাতে শোওয়া ও বাস করা সব প্রয়োজনেই  ব্যবহার হয়। কীভাবে একই ঘরে তক্তপোষকে বিভাজিকা করে কেউ শোয় বিছানার ওপরে কেউ মাটির ওপর সেটা সাধারণ বুদ্ধিতে বুঝতে পারা মুশকিল। আর মুশকিল বলেই খুব সহজ এমন সব কথা হাওয়ায় ভাসিয়ে দেওয়া যে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের কেউ ঘরে থেকে আইন মেনে লকডাউন পালন করছেন না। যারা এইসব বলার জন্য মুখিয়ে আছেন তাঁদের কাছে ঘর শব্দটা যে ব্যঞ্জনা নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে আসলে ঘর তেমন নয়, অন্তত অনেকের কাছে। তাঁদের কাছে এই তথ্য অবিশ্বাস্য শোনাবে, কলকাতার বস্তিগুলির মধ্যে একষট্টি শতাংশ পরিবার একটি মাত্র ঘরে পরিবার নিয়ে বাস করেন!

বলা বাহুল্য, এইসব বস্তি এলাকায় সংখ্যালঘুরাও থাকেন। কলকাতায় ধর্মীয় সংখ্যালঘু হিসেবে মুসলিম মানুষদের সংখ্যা একুশ শতাংশের কাছাকাছি, হাওড়া শহরের জন্য সঠিক পরিসংখ্যান না থাকলেও পুরসভার অন্তত বারো থেকে পনেরো শতাংশ ওয়ার্ডে মুসলিম নাগরিকের বাস, উত্তর চব্বিশ পরগণার ক্ষেত্রে শহরাঞ্চলের সঠিক পরিসংখ্যান এখনই হাতের কাছে পাওয়া যাচ্ছে না কিন্তু বেশ কিছু এলাকায় সংখ্যালঘুরা থাকেন। বসতি অঞ্চলের সাধারণ যে চেহারা তাঁদের অবস্থান তারই ভিতর। কলকাতার কাশীপুর, বেলগাছিয়া বা তপসিয়ার প্রত্যন্ত বসতিতে মানুষের অবস্থা স্বচক্ষে দেখেছি, দেখেছি টিকিয়াপাড়া, বেলিলিয়াস রোড, পিলখানা এলাকায় ঠিক কেমন পরিবেশে সংখ্যালঘুরা বাস করেন, যাকে ঠিক স্বাভাবিক মানুষের জীবন বলা চলে না। তাহলে তারা লকডাউনে কী করবেন? নিজেদের ঘরের সঙ্কীর্ণ পরিসরে লকডাউনের সামাজিক দূরত্ব মানা কার্যত তাঁদের কাছে প্রহসন। তাঁদের বিপদটা আসলে ঘরে বাইরে। যারা উপায় থাকা সত্ত্বেও আইন মানছেন না তাঁদের পক্ষে কোনও কথা বলছি না, কথাটা তাঁদের নিয়ে যাঁদের পক্ষে ঘুপচি বসতিতে ঢুকে পরিবারের সঙ্গে দলা পাকিয়ে থাকা আর আইন মানা বা না-মানা একই ব্যাপার— ভাইরাসের সংক্রমণ ছড়ানোর পক্ষে সবটাই উনিশ বিশ।

এর ওপরে এটাও মনে রাখতে হবে এইসব বসতিতে যারা বাধ্যত থাকছেন তাঁরা অর্থনৈতিক বিচারে সমাজের প্রান্তীয় শ্রেণির মানুষ। ছোটখাটো ব্যবসা, দোকান, অসংগঠিত ক্ষেত্রে সামান্য চাকরি, অটো বা ট্যাক্সি চালানো এইসবই তাদের প্রধান জীবিকা— প্রয়োজন থাকুক না থাকুক লকডাউন এবার সরাসরি হাত বসিয়েছে তাঁদের জীবন-জীবিকায়, দিন-আনি-দিন-খাই-এর হিসেব আর মিলছে না। সহজাত প্রতিক্রিয়ায় তাঁরা উদ্বিগ্ন, বিপন্ন। সেই তাড়না তাঁদের এনে ফেলছে রাস্তায়, সামাজিক পরিসরে যা ততখানি আর আইন শৃঙ্খলার সমস্যা নয়।

লকডাউন আর কিছু করতে পারুক বা না-ই পারুক আমাদের আর্থিক বৈষম্যের মানচিত্রকে বেহদ্দের মতো প্রকাশ করে দিয়েছে এই কথা অস্বীকার করে লাভ নেই। এখানে সংখ্যালঘু বা সংখ্যাগুরুর কোনও আলাদা হিসেব নেই। তবে আর্থিক সমীক্ষা বারবারই দেখিয়ে দেয় রাজ্যের সংখ্যালঘুদের মধ্যে দারিদ্র বেশি, সাক্ষরতা কম, সামাজিক অবস্থানের সূচক নীচের দিকে। এর মধ্যে তন্ন তন্ন করে খুঁজলে দেখা যাবে শহুরে সংখ্যালঘুদের সিংহভাগই দরিদ্র, প্রান্তীয়, জীবনযাপনের সুবিধেহীন। সামাজিক জীবনের এই দগদগে ক্ষত আজ পেকে ওঠা ফোঁড়ার মতো ফেটে বেরোবে এর মধ্যে কোনও সামঞ্জস্যের অভাব আছে কি?

তবু সবটা বলা হল না। হ্যাঁ, খুব সংগঠিতভাবে কোভিড সংক্রমণের সঙ্গে সংখ্যালঘুদের গড়পড়তা জুড়ে দেওয়া হচ্ছে আসলে যা একটা বৃহত্তর পরিকল্পনার অঙ্গ। কিন্তু সত্যি কি তাই? খুব সম্প্রতি (২৯ এপ্রিল) এই রাজ্যের কোভিড সংক্রামিত এলাকাগুলোকে সরকারিভাবে তিনটে রঙের জোনে ভাগ করা হয়েছে তার মধ্যে সবথেকে আক্রান্ত স্পর্শকাতর এলাকা কলকাতা, হাওড়া, উত্তর চব্বিশ পরগণা, কিছুটা পূর্ব মেদিনীপুর। মূলত এগুলো শহর এলাকা, অল্প কিছু গ্রামীণ এলাকা রয়েছে। সেখানে তাকিয়ে দেখছি, রাজ্যের সর্বাধিক সংখ্যালঘু বাস করেন যে কয়েকটি জেলায় তার মধ্যে মুর্শিদাবাদ, মালদা, দক্ষিণ চব্বিশ পরগণা সম্পূর্ণ নিরাপদ। হাওড়া জেলার উলুবেড়িয়া মহকুমায় প্রচুর সংখ্যালঘু মানুষ থাকেন, থাকেন সদর মহকুমার ডোমজুড়, জগৎবল্লভপুর বা পাচলা এলাকায়, থাকেন হুগলি জেলার চুঁচুড়া সদর, চন্দননগর ও শ্রীরামপুর মহকুমায়, বীরভূমে, পূর্ব বর্ধমানে— এর কোনওটিই রেড জোন বলে চিহ্নিত হয়নি। হয়নি সীমান্তবর্তী নদীয়া, উত্তর ও দক্ষিণ দিনাজপুর বা কোচবিহার জেলা। এমনকি, উত্তর চব্বিশ পরগণার বসিরহাট মহকুমার বিস্তীর্ণ সংখ্যালঘু গ্রাম আমাদের সামনে কোনও লাল সঙ্কেত দিচ্ছে না, এই জেলার প্রধান বিপদ ব্যারাকপুর ও বারাসত মহকুমার পুর এলাকা।  সংখ্যাগত দিক দিয়ে এইসব নিরাপদ গ্রামীণ এলাকায় যত মুসলিম নাগরিক থাকেন তাঁদের থেকে অনেক কমই আছেন লাল হয়ে থাকা জনপদে। এগুলো নিছক গাণিতিক হিসেব, যার মধ্যে কোনও কল্পনা বা সঙ্কীর্ণ ধান্দাবাজির মিশেল নেই।

তবু দীর্ঘ লকডাউনের বাজারে যারা আজও খেয়ে-পরে-বাজার করে দিব্যি বেঁচে আছে এবং সেই সঙ্গে যারা চালু রেখেছে তাদের ঘৃণা ছড়ানোর কন্ট্রোল রুম, তাদের সত্যিই কোনও কাজ নেই বলা চলে না। এই ধরনের কুৎসা ছড়ানোটাই তাদের এখন একমাত্র কাজ আর আমাদের অনেকেরই কাজ সেগুলোকে অলস মস্তিষ্কে প্রশ্নাতীত বলে গ্রহণ করা। এবং হাতের স্মার্ট ফোনের মধ্যবর্তিতায় সেটিকে কৌশলে ছড়িয়ে দেওয়া। সংবাদমাধ্যমে দেদার ছবি আসছে কীভাবে নানা ‘ভদ্রলোক এলাকার’ বাজারে ক্রেতারা উপচে পড়ে ভিড় করছেন, পাড়ার মোড়ে চায়ের দোকান চলছে, চলছে ক্লাবে আড্ডা কিন্তু সেগুলোকে আইনভাঙা থেকে তাঁরা উত্তীর্ণ করেছেন অত্যাবশ্যক কাজে। আর সংখ্যালঘু কেন, কোনও বস্তিবাসীদের যারা ঘুণাক্ষরেও খবর রাখে না, যারা তাদের জীবনের এক আনাও শরিক নয় তারা এখন তাদের আইন না মানা নিয়ে ভীষণ বিচলিত! শুধু বিচলিত নয় একটা অভিযুক্তপক্ষ হিসেবে দাঁড় করিয়ে দিতে ভয়ানক রকমের উদগ্রীব। আসলে ওই বিপরীত পক্ষটাকেই আজ তাদের সব থেকে বেশি দরকার, নইলে ঘৃণা ঢুকবে কোন পথে!