শতাব্দী দাশ
লেখক গদ্যকার, প্রাবন্ধিক, শিক্ষক ও সমাজকর্মী
‘লকার-রুম টক’ অধুনা লিঙ্গরাজনীতিতে, এবং ভাষার রাজনীতিতেও, একটি পরিচিত লব্জ। আক্ষরিকভাবে এর মানে, যে ভাষায় লকার রুমে খেলোয়াড়রা নিজেদের মধ্যে কথা-টথা বলে। স্পোর্টস, অন্য যেকোনও পেশার মতোই, এককালে ছিল পুরুষ-অধ্যুষিত। এমনকী এখনও, সাধারণের চোখে ক্রিকেট হল পুরুষের খেলাধুলো। মেয়েদের ক্রিকেট ঠিক ক্রিকেট নয়, বরং ‘মহিলা-ক্রিকেট’। মোদ্দা কথা, খেলাধূলা বিষয়টাই মূলত পুরুষালি এবং মহিলা-খেলাধূলা উপগ্রহের মতো সেই সাম্রাজ্যের চারপাশে ঘোরাফেরা করে। সুতরাং চলতি ভাষায় ‘লকার-রুম’ পুরুষের একান্ত চারণভূমিরই দ্যোতক। খেলোয়াড়ের ক্ষেত্রে লকার-রুম যা, চোদ্দ-পনেরোর মফস্বলি ছেলের ক্ষেত্রে রোয়াকের আড্ডাও তা, আঁতেলের কাছে কফি হাউজও তা৷ অথবা কোনও বয়েজ হস্টেল, মেস, যেকোনও ছেলেলি জমায়েত, রূপকার্থে সবই ‘লকারস রুম’।
‘বয়েজ লকার রুম’ নামক সমাজ-মাধ্যমের একটি গ্রুপ নিয়ে সকলে উদ্বেল হচ্ছেন গত দিনকতক। দিল্লির কোনও এক নামি ইংরাজি মাধ্যম স্কুলের ছেলেদের সেই গ্রুপের স্ক্রিনশট এবং তাদের নিজস্ব ইনবক্সের স্ক্রিনশট কী করে যেন জনসমক্ষে এসে গেছে। তা নিয়ে যাবতীয় শোরগোল। বলা বাহুল্য এই ছেলেগুলি ‘লকার রুম’ কথাটির আক্ষরিক শুধু নয়, আলঙ্কারিক মানেও ভালোমতোই জানে। পুরুষদের একান্ত আলোচনার ভূমি, যেখানে নারীদের সম্পর্কে অশালীন/পলিটিকালি ইনকারেক্ট মন্তব্য করা যায়। তাই তারা তাদের ইন্সটাগ্রাম গ্রুপের নাম রেখেছিল ‘বয়েজ লকার রুম’। স্ন্যাপচ্যাটেও এরকম দলের সন্ধান পাওয়া গেছে।
তারা ধর্ষণ করেছে কিনা জানা নেই। স্ক্রিনশটে ধর্ষণের বর্ণনাও আছে, যদিও ধর্ষিতার এফআইআর নেই। কিন্তু একটি মেয়েকে গ্যাংরেপ করার বিস্তারিত প্ল্যান তারা করেছিল তো বটেই। সেটাও দণ্ডনীয় অপরাধ, তাই দিল্লির মহিলা কমিশন সুয়োমোটো কেস করেছে। উপরন্তু তারা যে ভবিষ্যতেও ধর্ষণ করবে না, এমনটা জোর দিয়ে বলা যায় না৷
বয়ঃসন্ধির ছেলেদের খুব কাছ থেকে দেখার অভিজ্ঞতা হয় প্রত্যেক দিন। অধুনা ‘টক্সিক ম্যাসকুলিনিটি’ বা বিষাক্ত পৌরুষ বলে যাকে, তার সূচনার বয়সের আমি কর্মসূত্রে সাক্ষী। কেঁদে ফেলা পুরুষসুলভ নয়, অনুভূতিপ্রবণ বা আবেগসর্বস্ব হওয়া পুরুষসুলভ নয়, কিন্তু কর্তৃত্ব করা, দখল করা, গায়ের জোরে ছিনিয়ে নেওয়া পুরুষসুলভ— এইসব ধারণা ছোটবেলা থেকেই যেভাবে চারিয়ে যায় মগজে, তার সাক্ষী থাকি নিত্যদিন৷
ভুল বোঝাবুঝির অবকাশ যাতে না থাকে তাই বলে রাখি, পুরুষ মাত্রই ‘বিষাক্ত’— তা বলা হচ্ছে না। কিন্তু হ্যাঁ, যে যে কার্যকলাপ সমাজের চোখে ‘ঠিকঠাক পুরুষ’ করে তোলে একজন ব্যক্তিকে, বা আদর্শ পৌরুষের যে সব নিদান পেতে পেতে একজন পুং-শিশু বড় হয়, তা অনেকাংশেই বিষাক্ত; ক্ষতিকর প্রথমত তার নিজের জন্য, দ্বিতীয়ত অন্যদের জন্যও।
টক্সিক ম্যাসকুলিনিটি হল ‘পৌরুষ’-এর এমন এক সঙ্কীর্ণ ধারণা, যা ‘পৌরুষ’-কে হিংসাত্মক কার্যাবলি, যৌনক্ষুধাসর্বস্বতা, আক্রমণাত্মক আচরণ, অনুভূতিশূন্যতা এবং (ধনতান্ত্রিক পরিকাঠামোয়) আর্থ-সামাজিক কৌলিন্য দিয়ে সূচিত করে। এ হল পুরুষত্বের এমন এক সাংস্কৃতিক ধারণা, যেখানে শক্তিপ্রদর্শন ও কর্তৃত্বই কেন্দ্রীয় ‘গুণ’। আবেগ, অনুভূতির যেকোনও প্রকাশ এই সংস্কৃতিতে পুরুষের ‘দুর্বলতা’ বা প্রকারান্তরে ‘মেয়েলি’। ‘হাইপারসেক্সুয়াল’ বা ‘অতিমাত্রায় যৌনভাবে সক্রিয়’ হওয়া এখানে স্বীকৃত, কিন্তু কনসেন্টের ধারণা স্বীকৃত নয়। টক্সিক ম্যাসকুলিনিটিতে আক্রান্ত পুরুষ ‘মেয়েলি’ ও ‘হীনবীর্য’ হিসেবে চিহ্নিত হওয়ার ভয়ে নিরন্তর ভোগে। এই ভয় তাদের দিয়ে অনেক কিছু করিয়ে নিতে পারে। সে অন্যের উপর শারীরিক আক্রমণ করতে পারে, আক্রমণাত্মক কথা বলে অন্যদের অতিষ্ঠ করে তুলতে পারে, যৌন নির্যাতনও করতে পারে৷ সবের মূলেই থাকে ‘নারী’ বা ‘সম্পত্তি’ বা ‘ভূখণ্ড’-এর কর্তৃত্ব না হারানোর, কোনও যুদ্ধেই না হারার ‘পুরুষোচিত’ জেদ৷
আবার কোনও পুরুষ বা বালক হয়ত আদৌ আক্রমণাত্মক নয়৷ অত্যাচারীও নয়৷ টক্সিক ম্যাসকুলিনিটি তাকেও প্রভাবিত করতে পারে৷ কীভাবে? ধরা যাক এক কিশোর (এমনকী পূর্ণবয়স্ক পুরুষও হতে পারে) যৌন নির্যাতনের শিকার৷ কিন্তু সে যখন নিজের উপর ঘটা অত্যাচারের কথা বলতে চাইছে, বাধ সাধছে সেই ভয়— আমাকে কেউ কম ‘পুরুষ’ ভাববে না তো?
যে ছেলেটি সায়েন্স পড়তে বাধ্য হল সাহিত্য ‘মেয়েলি’ বিষয় বলে, যে কোমলমতি ছেলেটির খিস্তি না দিলে বন্ধুমহলে মান থাকে না, একটি বাচ্চা ছেলে বলেছিল ভিড়ের মধ্যে বন্ধুরা জোর করে তার একটি হাত দিয়ে কোনও এক মেয়ের বুক ছুঁইয়ে দিয়েছিল— এরা প্রত্যেকে পিতৃতন্ত্রের নির্মম শিকার। এদের দেখতে পাই চারপাশে, সর্বত্র৷ বছর কয়েক আগে দিল্লিতে প্রদ্যুম্ন বলে বাচ্চা ছেলেটিকে যে কিশোর মারল, সেই কিশোরের কী এমন মানসিক বিকার ছিল? এত কম বয়সে সেই বিকার এল কোথা থেকে? কিংবা ভিন্নধর্মী মেয়ে আসিফাকে ধর্ষণ করেছে যে কিশোর? ভিনধর্মীকে পুড়িয়ে দিচ্ছে যে কিশোরেরা? নির্ভয়া কাণ্ডে চোদ্দ বছরের সেই ধর্ষকের বিকারকে কীভাবে ব্যাখ্যা করব, যে বলেছিল যোনিতে রড ঢোকানোর প্ল্যান তারই ছিল? এরা সকলেই কি কম বয়সে টক্সিক ম্যাসকুলিনিটির শিকার নয়?
সুতরাং, টক্সিক ম্যাসকুলিনিটি নিয়ে কোনও আলোচনার উদ্দেশ্য পুরুষ-নিন্দা নয়৷ পুরুষকে বিষাক্ত অপরাধী ঠাওরানো নয়৷ বরং তা গঠনমূলক পৌরুষের ধারণা গড়ে তোলার প্রথম ধাপ হতে পারে৷
***
‘লকার রুম টক’ দিয়ে শুরু করা গেছিল। তাই ভাষার রাজনীতি নিয়েও দু চার কথা বলা যাক। কারণ আপাতত আমাদের হাতে আছে সাউথ দিল্লির কিশোরদের বাচিক যৌন হিংসার পরিচায়ক কিছু স্ক্রিনশট। তারা সত্যিকারের ধর্ষণ করেছে কিনা, তা প্রমাণসাপেক্ষ। আর করে থাকলেও বাচিক যৌন হিংসা শারীরিক হিংসার থেকে বিচ্ছিন্ন কিছু নয়।
লিঙ্গভিত্তিক হিংসাকে যদি আমরা একটা পিরামিড হিসেবে কল্পনা করি, তবে তার শীর্ষবিন্দুতে রাখতে হবে নারী বা তৃতীয় লিঙ্গের জীবনহানি-কে। ঠিক তার পরের ধাপেই থাকবে তাদের উপর যৌন অত্যাচার। তারপর নামতে নামতে সেই পিরামিডের শেষ ধাপ বা ‘ভূমি’-তে অবশ্যই থাকবে লিঙ্গায়িত ভাষা, যা বিভেদকে মননে, মেধায়, চিন্তনে, সংস্কৃতিতে চিরস্থায়ী করছে।
ভাষার লিঙ্গায়ন আসলে বিভিন্ন পদের (parts of speech) লিঙ্গায়নের থেকে শুরু হয়। বাংলায় এখন শুধু বিশেষ্য পদ কম-বেশি লিঙ্গায়িত, আগে বিশেষণও তাই ছিল। হিন্দিতে সেইসঙ্গে ক্রিয়াপদ লিঙ্গায়িত। ইংরেজিতে পাই লিঙ্গায়িত সর্বনাম (He, She, It), যা বহু দিন ধরেই তুলে দেওয়ার চেষ্টা চলছে। প্রাচীন ভাষাগুলিতে এই লিঙ্গায়ন আরও নানা পদে প্রকট৷ ভাষা যত সরল হয়েছে, লিঙ্গায়নের প্রভাব ব্যকরণগতভাবে কমেছে। কিন্তু ‘জেন্ডার-রোল’ বা সামাজিক-লিঙ্গ-ভূমিকার পরিবর্তন ঘটতে এখনও ঢের দেরি। ভাষাও এই বৈষম্য বহন করছে।
পানীয়-র বিজ্ঞাপনে একটা সপ্রশ্রয় বাণী থাকত— ‘Men will be men’। বহুদিন পরে মুলায়ম সিং যাদব প্রায় একই সুরে ধর্ষণ প্রসঙ্গে বলেছিলেন— ‘ছেলেরা ভুলচুক করেই ফ্যালে।’ কখনও মেয়েদের উত্যক্ত করাকে এরকম প্রশংসনীয় পুরুষোচিত সাফল্যও ভাবা হয়৷ ক্রিকেটার হার্দিক পান্ড্য যেমন বলেছিলেন, নাইটক্লাবে নানা যৌন অভিযানের পর বাবা-মা পিঠ চাপড়ে ‘প্রাউড অফ ইউ’ বলেন।
অন্যদিকে মেয়ে হয়েও কেউ পরিবারের দায়িত্ব নিলে বাবা-মা খুশি হয়ে বলেন— ‘ও তো আমাদের ছেলে-ই।’ কিংবা ‘এই তো ব্যাটাছেলের মতো কাজ।’ ‘মেয়ে হলেও অঙ্কে ভালো’, ‘মেয়ে হলেও ফুটবলার’, ‘মহিলা-ক্রিকেট’, ‘মেয়ে-ডাক্তার’ এসব তো চলতি ভাষার অংশ৷ অন্যদিকে শোনা যায়, ‘Be a man’, ‘ছেলেদের কাঁদতে নেই’। যদিও ১৬-২৪ বছর বয়সী ছেলেদের মধ্যে আত্মহত্যার হার দেখে মনে হয়, বিশেষত শেষ বাক্যটির বোঝা বওয়া বড় কঠিন।
প্রধানমন্ত্রীর প্রচারের ম্যানিফেস্টোয় ‘ছাপান্ন ইঞ্চির বুক’ উল্লিখিত হয়। মার্কিন রাষ্ট্রপতি ডনাল্ড ট্রাম্প যত্রতত্র নারীবিদ্বেষী ভাষা ব্যবহার করেন। ভাষার নিপীড়নক্ষমতাকে সন্দেহ করা তাই অবশ্যকর্তব্য হয়ে পড়ে।
লক্ষণীয়, পুরুষের পুরুষকেই খিস্তি করার ভাষায় যদি থাকে যৌনতা বা ধর্ষণের ইঙ্গিত, তা আসলে অন্যান্য লিঙ্গের প্রতিই অবমাননাকর হয় বেশিরভাগ ক্ষেত্রে। আর যদি তা না থাকে, তবে সেসব খিস্তি আদৌ তেমন তীব্র হয় না। পুরুষবাচক খিস্তিতে ঝাঁঝালো অভিঘাত চাইলে, চার-অক্ষর-পাঁচ-অক্ষরই ভরসা, কারণ সেক্সিস্ট না হলে খিস্তি জমে না। অপছন্দের মেয়েকে ‘খানকি’ বলা যায়, অপছন্দের ছেলের জন্য পুরুষ-দেহব্যবসায়ীর প্রতিশব্দ ব্যবহৃত হয় না। তাকে ‘খানকির ছেলে’ বলে। মা তুলে গালাগালি সব ভাষায় পুরুষকে অপমানের অন্যতম স্বীকৃত উপায়৷
‘তিনি বেশ্যালয়ে যান’, এই বাক্যে ‘বেশ্যা’ খিস্তি নয়। কিন্তু ‘বেশ্যার জাত’ বললে তা খিস্তিই বটে। ‘বেশ্যা’-র অর্থসম্প্রসারণ অত্যন্ত রাজনৈতিক। সীমানালঙ্ঘনকারী যেকোনও নারী, সে ছোট জামাকাপড় পরুক, চাকরি করুক বা মুখে মুখে তর্ক করুক, সে ‘বেশ্যা’ বা ‘খানকি’ বা ‘রেন্ডি’ বলে অভিহিত হতে পারে।
পুরুষের যৌনাঙ্গের একাধিক প্রতিশব্দও পাওয়া যায় খিস্তির ক্যাননে। পুরুষাঙ্গই যেন পুরুষের শক্তি তথা দুর্বলতার নিয়ামক। যথেষ্ট পুরুষ নয় বোঝাতে ব্যবহৃত স্ল্যাং হল ‘দাঁড়ায় না’। ‘হিজড়া’ হল পৌরুষের অভাব বোঝাতে ব্যবহৃত গালাগাল, যা সরাসরি তৃতীয় লিঙ্গের প্রতি অবমাননাকর। ‘ছক্কা’ ব্যবহৃত হয় সমকামীদের জন্য, মেয়েলি পুরুষদের জন্য ‘বৌদি’। ‘গাঁড় মেরে দেওয়া’-র অর্থ জব্দ করা, অথচ তার মধ্যে বলপূর্বক পায়ুমৈথুনের ইঙ্গিত স্পষ্ট৷ রেপ-রেটরিক, সেক্সিস্ট ও নারীবিদ্বেষী রেটরিক তাহলে প্রায়শই আমরা ব্যবহার করে থাকি প্রচলিত ভাষায়।
কোনও ভাষায় ব্যবহৃত শব্দ, শব্দের অর্থ দ্বারা সেই ভাষাভাষির সমাজিক অবস্থা, ব্যক্তির মানসিক অবস্থা প্রকাশ পায়৷ মানব-মস্তিষ্কের উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে অবিন্যস্ত আওয়াজ থেকে ক্রমে ভাষা এসেছে। তা চিন্তার বাহন হয়েছে। যত চিন্তনক্ষমতা বেড়েছে, সমাজ-সংস্কৃতি জটিল হয়েছে, তত ভাষাও জটিল হয়েছে। সমাজ ও সংস্কৃতি অনুসারেই গড়ে উঠেছে ভাষাটির স্ট্রাকচার, ভাষার শব্দগুলোর অর্থ। সেই স্ট্রাকচারের বাইরে গিয়ে চিন্তা করা তারপর কঠিন হয়েছে। কারণ চিন্তার জন্য শব্দ লাগে, শব্দের অর্থ লাগে। যে শব্দ বা শব্দের অর্থই এখনও ভাষায় আসেনি, তার দিকে সাধারণ মানুষের চিন্তা ধাবিত হতে পারে না৷ তাই সমাজকে নতুন ছাঁচে ঢালতে গেলে তার ভাষাতেও নজর দিতে হবে। ভাষাকে রিক্লেইম করতে হবে।
***
সাইবার জগতে টক্সিক ম্যাসকুলিনিটি বিরল কিছু নয়। যাঁরা সাউথ দিল্লির ঘটনায় বিচলিত হচ্ছেন, তাঁদের জেনে রাখা ভালো যে এরকম গোপন গ্রুপ সমাজমাধ্যমে আছে কয়েক লাখ। ফেসবুক, ইন্সটাগ্রাম, হোয়াটস্যাপ জুড়ে এদের বিস্তার। ২০১২ সালে কুইন্সল্যান্ডের দুই ছাত্র ‘12 Years Old Slut Memes’ নামে এক ফেসবুক পেজ চালু করে, যার লক্ষ্যই ছিল অপছন্দের মেয়েদের বিনা অনুমতিতে তাদের ছবি/বিকৃত ছবি পোস্ট করা। ফেসবুক কিন্তু পেজটিকে ব্যান করেননি, ‘on grounds of free speech’. তার ফল আশানুরূপই হয়েছে। আজ এমন বহু ভারতীয় পেজও আছে, যেখানে ফেসবুক বা ইন্সটাগ্রাম থেকে মেয়েদের র্যান্ডম ছবি চুরি করে আপলোড করা হয়। গুগল-ড্রাইভ বানিয়ে মেয়েদের মর্ফড নগ্ন ছবি শেয়ার করারও চল হয়েছে৷
লকডাউনে কিশোর-কিশোরীদের হাতে অনেকটা অবসর। তাদের অনলাইন উপস্থিতি বাড়বে। কিন্তু ডিজিটাল উপস্থিতি যতটা বাড়বে, ততটা বাড়বে না ডিজিটাল কনসেন্ট বা ডিজিটাল সেফটি নিয়ে ধারণা। তাই তাদের মধ্যে সাইবার জগতে যৌন নির্যাতন ঘটানোর প্রবণতা বাড়বে, বাড়বে নির্যাতনের শিকার হওয়ার হারও।
আরেকটি প্রশ্ন উঠে আসে। ধর্ষণে যাঁরা ফাঁসির বিধান দেন বা ধর্ষকের ফাঁসি নিয়ে যাঁরা উল্লসিত হন, তাঁরা দিল্লির নাবালকদের নিয়ে কী বিধান দেবেন? ধর্ষক তো অপর। ঘিনঘিনে জন্তুবৎ। খুন করে দিলেই রাতারাতি সমাজ পরিশুদ্ধ৷ এই নাবালকগুলিকেও মেরে ফেলা যাক? নাকি অপেক্ষা করব তাদের প্রকৃত ধর্ষক হওয়া অবধি, আর তারপর মেরে ফেলব? শাস্তি, না অপরাধ কমানো, কোনটা মূল লক্ষ্য? এমনকী যদি দুটিই কাম্য হয়, তবুও কোনটা অগ্রাধিকার পাবে?
আসলে প্রাথমিক নীতি হওয়া উচিত ছেলেদের জেন্ডার স্টাডিজের আওতায় আনা। অধুনা জেন্ডার স্টাডিজে মেন্স স্টাডিজ একটা গুরুত্বপূর্ণ অংশ। সাউথ দিল্লির ছেলেরা জেনেছিল, লকার রুম, লকার রুম টক, মেয়েদের ভোগ্য ভাবা, ভাবতে ভাবতে ধর্ষণের পরিকল্পনা করা— এসব পুরুষ হওয়ারই পাঠ। এভাবেই জেনে আসছে আমাদের চারপাশের ছেলেরা, আবহমান কাল ধরে। তাদের সেই চিন্তনের প্রক্রিয়ায় সমাজের দায় কীভাবে অস্বীকার করি? ধর্ষণ-সংস্কৃতির দায় অস্বীকার করি কী করে? ধর্ষণ সংস্কৃতি হল সেই সংস্কৃতি, যা যাপনে, বিনোদনে, ভাষায়, মজাকিতে, এমনকী মহৎ শিল্প-সাহিত্যেও ধর্ষণ বা যৌনহিংসাকে ‘স্বাভাবিক’ করে তুলেছে। ফলে, সে সংস্কৃতিতে প্রকৃত ধর্ষণ নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা।
এই ছেলেদের সঙ্গে কথা বলা দরকার। এই বয়সি সব ছেলেদের সঙ্গেই কথা বলা দরকার। ব্যক্তিগতভাবে শুধু না, সাংগঠনিকভাবে। পরিবার থেকে স্কুল বা সিলেবাস হয়ে রাষ্ট্র পর্যন্ত বিভিন্ন স্তর সহায়ক হলে, সে কাজ সহজ হত। কিন্তু তারা সহায়ক নয়। বড় দেরি হয়ে যাচ্ছে।
বাড়িতে ও স্কুলে লিঙ্গসাম্যের শিক্ষা চাই। লিঙ্গসাম্যের শিক্ষা মানে ‘মেয়েদের সম্মান করো’ নয় শুধু। ‘ছেলেদের রং বনাম মেয়েদের রং’/’ছেলেদের খেলনা বনাম মেয়েদের খেলনা’/’মেয়েদের কান্না বনাম ছেলেদের কঠোরতা’ এই আপাত সাধারণ ধারণাগুলো শিশুমনে গেঁথে দেওয়ার সময় থেকেই অসাম্য শুরু হয়। ভবিষ্যতের কঠোর ও ক্ষমতাশালী মানুষেরা তো এ ভাষাতেই কথা বলবে, আলোচনা করবে। এভাবেই তাদের যৌন ফ্যান্টাসিতে বাসা বাঁধবে ধর্ষণ। তারা যৌনতায় সহমতিতে অবিশ্বাসী হবে, সম্পর্ক বলতে বুঝবে কর্তৃত্ব। আশ্চর্য কী!
টক্সিক ম্যাসকুলিনিটি একটি সামাজিক অসুখ। তাকে জিইয়ে রাখার দায় হয়ত খানিক আপনারও। ধর্ষকের ফাঁসি নিয়ে যতবার উদ্বেল হচ্ছেন, ততবার আসলে নিজের কর্তব্য, নিজের দায় ঝেড়ে ফেলছেন না তো? নিজেকে লিঙ্গসাম্যে দীক্ষিত করা কঠিন। ধর্ষকের ফাঁসির দাবিতে সরব হওয়ার চেয়ে, তা অনেক বেশি কঠিন৷ ‘আনলার্নিং’ সত্যিই নিরলস সাধনা ও অভ্যাসের বিষয়৷ তারপর আসে ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে লিঙ্গসাম্যের শিক্ষা দেওয়া, যা সম্ভব নিজে সে বিষয়ে সুশিক্ষিত হলেই। তার পরেও থাকে বিচ্যুতি, ভুল। ভাষায়, আচরণে এমন ছাপ থেকে যায়, যা লিঙ্গসাম্যের পরিপন্থী৷ তবু চেষ্টাটুকু শুরু হোক। দাবি যদি তুলতেই হয়, তবে স্কুল সিলেবাসে জেন্ডার স্টাডিজ অন্তর্ভুক্ত করার দাবি তোলা যাক। সিলেবাস যেভাবে অসাম্যকে দীর্ঘস্থায়ী করে, তাকে চ্যালেঞ্জ করা যাক। বালকেরা যখন ধর্ষণ-পরিকল্পনায় রত, তখন ধর্ষকের ফাঁসি বা এনকাউন্টার উদযাপন করার ঝোঁক নেহাতই ফাঁকিবাজি নয়?