সৌরভ চট্টোপাধ্যায়
লেখক ইংরাজি সাহিত্যের ছাত্র। প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়
নববর্ষের মত রবীন্দ্রজয়ন্তীও এ বছর লকডাউনের মধ্যেই। তবু, ২৫ বৈশাখ উদযাপনে উৎসাহের কমতি নেই বাঙালির। গৃহবন্দি থেকেই বিভিন্ন টিভি চ্যানেলের অনুষ্ঠানে অংশ নিচ্ছেন শিল্পীরা। পাশাপাশি পাল্লা ভারী বিভিন্ন সোশ্যাল মিডিয়া পেজ ও গ্রুপের। এ হেন পরিস্থিতিতে রবীন্দ্র-স্মরণে অভিনবত্বের দিক থেকে অনন্য রেডিও কোয়ারেন্টিন কলকাতা। গত মার্চ মাসে লকডাউন ঘোষণার পর থেকেই চলছে এই সদ্য-গঠিত অনলাইন রেডিও স্টেশন। সহনাগরিকদের উদ্দেশে তাঁদের বার্তা “একাকী থেকো না, অসময়ে”।
বিশেষ সম্প্রচার হিসেবে থাকছে চল্লিশ থেকে নব্বইয়ের দশক, দুই বাংলার রাজনৈতিক পালাবদল, মন্বন্তর, দাঙ্গা, দেশভাগ, মুক্তিযুদ্ধ ও পরবর্তী পরিস্থিতি সময় চাক্ষুষ করা সংস্কৃতি আন্দোলনের কর্মী কলিম শরাফীর এক জীবন স্মৃতি। ঢাকা থেকে রেডিও কোয়ারেন্টিনের জন্য পর্বটি নির্মাণ করেছেন প্রদীপ ঘোষ। পাশাপাশি রবীন্দ্র-বরণের চর্বিত-চর্বণের বাইরে দাঁড়িয়ে এক ভিন্ন স্বাদের অনুষ্ঠানমালা প্রস্তুত করেছেন এই কমিউনিটি রেডিও স্টেশনের বন্ধুরা। স্নিগ্ধ শীতল তরুছায়াময় শান্তিনিকেতনের অন্য গল্প শোনাচ্ছেন শিক্ষক ও সমাজকর্মী মনীষা ব্যানার্জী। সে গল্পে কখনও আছে রামযাত্রার বিপরীতে রাখিবন্ধনের বিকল্প হয়ে ওঠা, কখনও ভাগলপুর গণহত্যার পর শান্তিনকেতনের পড়ুয়াদের উদ্যোগে সম্প্রীতির গান। গানের ডালি নিয়ে থাকছেন প্রতুল মুখোপাধ্যায় ও মৌসুমী ভৌমিক। প্রেম-পূজা-প্রকৃতির মধ্যে থেকে শক্তিশালী রাজনৈতিক গানের ক্ষেত্রেও রবীন্দ্রনাথ কতটা জরুরি, আবার মনে করিয়ে দেবেন এই দুই শিল্পী।
“ভেঙে দাও যক্ষপুরীর গড়!”— দুদিনব্যাপী অনুষ্ঠানে প্রতিষ্ঠিত সাহিত্যিক সমালোচকদের মধ্যে থাকছেন অধ্যাপক সঞ্জয় মুখোপাধ্যায়, স্বপ্নময় চক্রবর্তী, কিন্নর রায়, শামিম আহমেদ প্রমুখ। গান্ধি ও রবীন্দ্রনাথের রাজনৈতিক দর্শন নিয়ে তুলনামূলক আলোচনা করছেন প্রাবন্ধিক আশীষ লাহিড়ী। নিজস্ব দৃষ্টিকোণ থেকে রবীন্দ্রনাথের সাহিত্য পর্যালোচনায় থাকছেন শিমূল সেন, অনামিকা রায় প্রামাণিক। আলোচিত হচ্ছে সাম্প্রদায়িকতার রমরমা, উগ্র দেশভক্তির দিনকালে রবীন্দ্রনাথের সমালোচনাত্মক জাতীয়তাবাদের তাৎপর্য, উঠে আসছে ব্যক্তিগত স্মৃতিচারণায় ভুলতে বসা মানুষজন, ঘটনাবলি। অনলাইন কমিউনিটি রেডিওর অন্যতম উদ্যোক্তা কস্তুরী বসু বললেন “ক্লান্ত কোটেশন আর একঘেয়ে রিচুয়ালের বাইরে আজকের সময়ে দাঁড়িয়ে আমাদের এই আগাগোড়া ফ্যাসিবিরোধী মানুষটির কাজ আর ভাবনাকে ফিরে দেখতেই ২৫ বৈশাখের বিশেষ সম্প্রচার।” অন্যতম সহযোগী সুমিত দাস জানালেন, “‘জেনো রেডিও’ ওয়েবসাইট অথবা অ্যাপ ডাউনলোড করে সহজেই শোনা যাচ্ছে রেডিও কোয়ারেন্টাইন কলকাতা। মাত্র দেড় মাসে এই রেডিও পৌঁছে গিয়েছে ৫৪টি দেশের প্রায় বারো হাজার শ্রোতাবন্ধুর কাছে।”
জনা আষ্টেক নাগরিকের প্রাথমিক উদ্যোগে রেডিও কোয়ারেন্টিনের যাত্রা শুরু, ইচ্ছে করলেই সংযুক্ত হয়ে যেতে পারেন যে কেউ। নিয়মিত সম্প্রচারের তালিকায় থাকে কোভিড ১৯ সংক্রমণ, ঝাঁপবন্দি পরিস্থিতির দৈনিক আপডেটসের পাশাপাশি থাকে গল্প, কবিতা, গান, শ্রুতিনাটক, ছোটদের বৈকালিক আসর, চিকিৎসকদের পরামর্শ সহ নানা বিষয়ে অডিও পডকাস্ট। বিনোদন পর্বের সঙ্গেই মিশে থাকে মননশীল বিশ্লেষণধর্মী আলোচনা— মানবাধিকার, গণতন্ত্র, অর্থনীতি, রাষ্ট্রনীতি, অতিমারির ইতিহাস, সামাজিক উৎকণ্ঠার প্রেক্ষিতে সহনাগরিকদের সঙ্গে কথাবার্তার কোলাজ। ইতিপূর্বে হয়ে গেছে মে দিবসে শ্রমিকদের সংহতিতে সারাদিন ব্যাপী বিশেষ সম্প্রচার। বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য পিট সিগার, সত্যজিৎ রায় স্মরণে আড্ডা। শুরু হয়েছে শ্রোতাদের জন্য সাপ্তাহিক কুইজ। সঠিক উত্তরদাতাদের জন্য বরাদ্দ লকডাউন ওঠার পর কলেজস্ট্রিট পাড়ার বিখ্যাত শরবত আর তেলেভাজা। কস্তুরী জানিয়েছেন লকডাউন উঠে যাওয়ার পর কীভাবে কাজ করা যায় তা নিয়ে ভাবনাচিন্তা চলছে। কাজে সারা দিন জুড়ে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে অংশ নিচ্ছেন দুই বাংলা, ত্রিপুরা, অসম সহ দেশবিদেশে ছড়িয়ে থাকা বন্ধুরা। রেডিও কোয়ারেন্টিনের বিশেষত্ব এই জায়গাতেই। শারীরিক বিচ্ছিন্নতার রোজনামচা তৈরি হচ্ছে সামাজিক সংহতিতে— মিলিয়ে যাচ্ছে সীমান্ত।