সুশোভন ধর
লেখক রাজনৈতিক কর্মী ও ভাষ্যকার
When society places hundreds of proletarians in such a position that they inevitably meet a too early and an unnatural death, one which is quite as much a death by violence as that by the sword or bullet; when it deprives thousands of the necessaries of life, places them under conditions in which they cannot live – forces them, through the strong arm of the law, to remain in such conditions until that death ensues which is the inevitable consequence – knows that these thousands of victims must perish, and yet permits these conditions to remain, its deed is murder just as surely as the deed of the single individual; disguised, malicious murder, murder against which none can defend himself, which does not seem what it is, because no man sees the murderer, because the death of the victim seems a natural one, since the offence is more one of omission than of commission.
–Friedrich Engels, Condition of the Working Class in England
৬ই মে তথ্যপ্রযুক্তি শিল্পের অন্যতম বড় প্রতিষ্ঠান উইপ্রোর এক মহিলা কর্মচারী আত্মহত্যা করেন। কেরলের বাসিন্দা জিনামল জোসেফ কোচির ইনফো-পার্কে উইপ্রোর অফিসে কর্মরত ছিলেন। তাঁর ভাইয়ের করা অভিযোগ (এফআইআর) অনুসারে, জিনামল তাঁর চাকরি হারানোর খবর পেয়ে প্রবল মানসিক চাপে পড়েন। এবং তজ্জনিত অবসাদের কারণেই আত্মহত্যার পথ বেছে নেন। অনেক বিশেষজ্ঞ মনে করছেন যে কৃষি সঙ্কটের সূত্র ধরে গত আড়াই দশক ধরে আমরা যেভাবে কৃষক আত্মহত্যা দেখছি, করোনা ভাইরাস তথ্যপ্রযুক্তি শিল্পের ওপর সেই ধরনের ছাপ ফেলতে চলেছে। এই অনুমান যদি কালক্রমে সত্যি হয় তাহলে তা বিভিন্ন কারণে এক বড় বিপর্যয় ডেকে আনবে। ঘটনার ভয়াবহতা এখন থেকেই অনুমান করা যাচ্ছে।
করোনা অতিমারির দোহাই দিয়ে সারা দেশে চাকরি হ্রাস এবং বেতন হ্রাসের দমকা হাওয়া বইতে শুরু করেছে। এদেশের অন্যতম বড় শিল্পপতি টাটা গোষ্ঠীর কথা ধরা যাক। এই গোষ্ঠী তার বেশ কিছু সংস্থায় কর্মীদের বেতন কমানোর পরিকল্পনা করেছে। তাদের পরিচালিত বিমান সংস্থা ভিস্তারা, এপ্রিল-মে-জুন মাসের জন্য ৪০০০ কর্মীর ৩০ শতাংশকে বাধ্যতামূলক ছুটিতে পাঠিয়েছে। অবশ্যই বিনা বেতনে। টাটার এই আচরণ ব্যতিক্রমী কোনও ঘটনা নয়। সারা বিশ্ব জুড়েই একই ঘটনা দেখা যাচ্ছে। আমি আগেই লিখেছি যে এই অতিমারি কোনওভাবেই সঙ্কটের কারণ নয়, অনুঘটক মাত্র। এবং, প্রতিটি আর্থিক বিপর্যয় বা অর্থনৈতিক সঙ্কটে যা হয়ে থাকে সেই চিত্রনাট্যের পুনরাবৃত্তি আমরা আবার দেখছি। শাসকশ্রেণি তার নিজের সৃষ্ট সঙ্কটের ভার অত্যন্ত সুকৌশলে সমাজের শ্রমজীবী মানুষের কাঁধে চাপিয়ে দিচ্ছে। একেবারে বাঁধা ছকে বিভিন্ন ছুতোয়-নাতায় তারা দেশের খেটে খাওয়া মানুষের অধিকার সঙ্কুচিত করতে ব্যস্ত। এই ব্যাপারে আরও বিস্তারিত ব্যাখ্যায় পরে আসছি। কিন্তু আপাতত এইটুকুই বলতে চাই যে সঙ্কট সত্ত্বেও মালিকশ্রেণি সর্বশক্তি দিয়ে নিজের মুনাফা অক্ষত রাখার চেষ্টা করবে তাতে সমাজে যে প্রভাবই পড়ুক না কেন। গত কয়েকদিন ধরে বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা বা রেডিও-টেলিভিশনে শ্রম আইন সংশোধনের যে খবর ভেসে আসছে, বিষয়টিকে এই আলোকেই দেখতে হবে।
অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ
অর্থনীতি যখন লকডাউনের সঙ্গে টিকে থাকার লড়াই করছে এবং একইসঙ্গে কোটি কোটি শ্রমিক অনিশ্চয়তার ঘোর ঘনঘটায় দিন গুজরাচ্ছেন ঠিক সেই সময় কিছু কিছু রাজ্য সরকার গত কয়েক সপ্তাহে শ্রম আইন প্রয়োগের ক্ষেত্রে শিথিল হওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এই ব্যাপারে সবচেয়ে এগিয়ে তিনটি বিজেপিশাসিত রাজ্য— উত্তর প্রদেশ, মধ্য প্রদেশ ও গুজরাত। তবে কংগ্রেসশাসিত রাজস্থান ও পাঞ্জাব এবং বিজু জনতা দল-শাসিত ওড়িশাও এই দৌড়ে আছে, যদিও একটু পিছিয়ে। শ্রম আইন লঙ্ঘনের এই খেলায় সবচেয়ে এগিয়ে উত্তর প্রদেশ। যোগী সরকার আগামী তিন বছর সমস্ত শ্রম আইন প্রয়োগ স্থগিত রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তার এই মারণ কোপ থেকে রক্ষা পেয়েছে মাত্র চারটি আইন— নির্মাণ শিল্পে জড়িত শ্রম আইন ১৯৯৬, শ্রমিকদের ক্ষতিপূরণ আইন ১৯২৩, দাস শ্রমিক বিলোপ আইন ১৯৭৬ এবং মজুরি আইনের ৫ নং ধারা (সময়ে মজুরি পাওয়া সংক্রান্ত আইন)। মহিলা ও শিশু শ্রমিক সংক্রান্ত আইনের ধারার কোনও পরিবর্তন হয়নি। অর্থাৎ সেই আইন বাতিল হয়নি বলে জানানো হয়েছে রাজ্য সরকারের তরফে।
সরকারিভাবে দাবি করা হচ্ছে আইনের এই বদল সংশ্লিষ্ট রাজ্যগুলির উন্নয়নের স্বার্থে। রাজ্যগুলির অর্থনীতি চাঙ্গা করার উদেশ্যেই এই পরিবর্তন। উত্তর প্রদেশের শ্রমমন্ত্রী স্বামী প্রসাদ মৌর্য একধাপ এগিয়ে দাবি করেছেন যে এই সমস্ত পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে শ্রমিকদের স্বার্থরক্ষার্থে। এর ফলে নতুন বিনিয়োগ আসবে এবং বন্ধ হয়ে যাওয়া শিল্পক্ষেত্র নতুন করে চাঙ্গা হওয়ার সুযোগ পাবে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে উত্তরপ্রদেশের নথিভুক্ত শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা ৩৪ লক্ষ। যদিও বাস্তবে মোট বেকার বা অর্ধ-বেকার অর্থাৎ যাদের কোনও সুনির্দিষ্ট কাজ নেই, তাদের ধরলে এই সংখ্যা যে কয়েক কোটি ছাড়াবে তাতে সন্দেহ নেই। বিজেপি কথিত হিন্দু কুলতিলক যোগী আদিত্যনাথের মুখ্যমন্ত্রিত্বে দুই বছরের কম সময়ে উত্তরপ্রদেশের শিক্ষিত বেকারত্বের হার বেড়েছে ৫৮ শতাংশ[1]। স্বভাবতই যে রাজ্যে শ্রম দফতরের অস্তিত্বই অর্থহীন সেই রাজ্যের তথাকথিত একজন শ্রমমন্ত্রী যে নির্লজ্জতার সমস্ত সীমানা ছাড়াবেন তাতে বিচিত্র কী?
লেবার কোড বিল ২০১৯
শ্রম আইন সংশোধনের এই প্রক্রিয়াটিকে আকস্মিক কোনও ঘটনা হিসাবে দেখলে ভুল হবে। প্রথমত বলা ভাল যে ভারতবর্ষের শ্রম আইনের আওতায় বেশিরভাগ শ্রমিক বা শ্রমজীবী মানুষ পড়েন না। সামান্য একটা তথ্য থেকেই বিষয়টি পরিষ্কার হয়ে যাবে। এদেশের শ্রমশক্তির ৯৪ শতাংশ অসংগঠিত ক্ষেত্রে নিযুক্ত। এই অংশের শ্রমিকদের না আছে কোনও বাঁধা কাজ অথবা কোনও চাকুরি বা পেশাজনিত নিরাপত্তা। এই মানুষগুলি আদতে কোনও শ্রম আইনের আওতায় ছিলেন না। ইদানীংকালে এদের একটি ছোট অংশের জন্য আইন করে ন্যূনতম মজুরি বা কিছু কিছু সামাজিক প্রকল্প চালু হয়েছে। কিন্তু এই আইনগুলি আদৌ কতটা মাটিতে পা রেখে হেঁটে চলে বেড়াতে পারছে তা নিয়ে প্রশ্ন আছে। দ্বিতীয়ত, অসংগঠিত শ্রমিক শুধু অসংগঠিত ক্ষেত্রেই নেই, তা সংগঠিত ক্ষেত্রেরও অনেকখানি জুড়ে রয়েছে। সংগঠিত ক্ষেত্রের অর্থাৎ কারখানা/দপ্তরের ঠিকা, বদলি, ভাগা, পার্ট-টাইম সবই অসংগঠিত শ্রমিক। এমনকি সরকার, যাকে মডেল নিয়োগকর্তা বলে ধরা হয়, সেই সরকারি দপ্তর ও কলকারখানাতেও ঠিকা শ্রমিকের অনুপাত সত্তর শতাংশের কাছাকাছি। অতএব অন্যান্য বেসরকারি ক্ষেত্রে এই অনুপাত কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে তা সহজেই অনুমেয়। তৃতীয়ত, সংগঠিত ক্ষেত্রের বহু শিল্পের— যেমন এ রাজ্যের চা বাগান, পাটকল, ইত্যাদি, অন্যান্য রাজ্যেও এই ধরনের উদাহরণ পাওয়া যাবে— শ্রমিকদের অসংগঠিত শিল্পের শ্রমিকদের মতোই দেখা হয়। অর্থাৎ, আইন থাকলেও তার বাস্তব প্রয়োগ খুব সীমিত। এছাড়াও আইন প্রয়োগের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট সরকার ও তার দপ্তর এবং আদালতের উৎসাহের ঘাটতি নিয়ে আলোচনা করতে বসলে একটি গোটা মহাভারত হয়ে যাবে।
কিন্তু এদেশের মালিকশ্রেণি শ্রমিকদের এই ভাঙাচোরা আইনি রক্ষাকবচ দিতেও নারাজ। এবং এই কারণেই তাঁরা মোদিকে নিয়ে বাজি ধরেছিলেন। ২০১৪ সালে মোদি ক্ষমতায় এসেই শ্রম আইন নিয়ে টানাটানি শুরু করে। শ্রম আইন সংশোধনের নামে শ্রমিকদের এক বড় অংশকে আইনের বাইরে নিয়ে চলে যাওয়া হয়। পাঁচ বছর ধরে বিভিন্ন রকমের প্যাঁচগোচ করে এই স্বঘোষিত হিন্দু সম্রাটের প্রধানমন্ত্রিত্বের দ্বিতীয় ইনিংসে শ্রম আইন সংশোধন করতে সংসদে বিল পেশ করা হয়। ২০১৯এর নভেম্বরে স্থায়ী চাকরি বিলোপ ও ছাঁটাই অবাধ করাতে লোকসভায় পেশ করা হয় শিল্প সম্পর্ক কোড বিল। শ্রমিক স্বার্থ বিরোধী এই বিলের মাধ্যমে মোদি সরকার অত্যন্ত সুচারুভাবে শ্রমিকদের বিরুদ্ধে কার্যত যুদ্ধ ঘোষণা করেছে। শ্রমিকদের ইউনিয়ন গঠনের অধিকারের ওপর বড়সড় থাবা বসাতে চায় সরকার। একদিকে যখন আমাদের বিরুদ্ধে হিন্দুত্ববাদী শক্তিকে লেলিয়ে দেওয়া হয়েছে অন্যদিকে একইসঙ্গে কায়দা করে জনস্বার্থবিরোধী বিভিন্ন কালা কানুন নির্দ্বিধায় পাশ হয়ে গেছে।
উপরোক্ত আইনি সংশোধনের মাধ্যমে স্বল্পমেয়াদি চুক্তিতে নিয়োগের ঢালাও অধিকার দেওয়া হয়েছে। এর ফলে কার্যত সরকারি ও বেসরকারি ক্ষেত্রে স্থায়ী চাকরির ব্যবস্থা বিলোপ হয়ে যাবে। ছাঁটাই অবাধ করার ব্যবস্থা রাখার সঙ্গে সঙ্গে চাকরির যেটুকু নিরাপত্তা ছিল তা তুলে দেওয়া হয়েছে। এই কোড বিল শ্রমিকদের যেটুকু সামাজিক সুরক্ষা ছিল তাতেও আঘাত হেনেছে। শ্রমিক আন্দোলনের দীর্ঘ লড়াইয়ের ফলে অর্জিত শ্রমিকদের দাবি আদায়ের জন্য বারগেইন বা দরকষাকষির অধিকার ছাঁটা পড়েছে। বিলে শ্রমিক ইউনিয়নের কর্মকর্তা নির্বাচনে যে অধিকার ছিল তাও খর্ব করে বলা হয়েছে ইউনিয়নের কর্মকর্তা শিল্পমালিক ঠিক করবে। এই বিলে ৩০০ জনের ওপর কর্মীসংখ্যা হলেই ছাঁটাই করতে প্রশাসনিক অনুমতির কথা বলা হয়েছে। ৩০০ কর্মীর কম শ্রমিক হলে সেখানে ছাঁটাই করার কোনও অনুমতির প্রয়োজন হবে না। দেশে বর্তমানে ৮০ শতাংশ শিল্পে কর্মীর সংখ্যা ৩০০ জনের কম। ফলে এতে বেশিরভাগ শিল্পে ছাঁটাই অবাধ হয়ে গেল। উল্লেখ্য, দেশের ৪৪টি শ্রম আইন বিলোপ করে তৈরি হচ্ছে ৪টি শ্রম কোড।
এমনিতেই নয়া-উদারবাদী জমানায় শ্রম আইন প্রায় উঠেই গেছে। সমস্ত নিয়মকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে বেশিরভাগ বেসরকারি সংস্থায় চলছে চুক্তির ভিত্তিতে অস্থায়ী নিয়োগ। কিন্তু সরকারি সংস্থায় এখনও অনেক ক্ষেত্রে পাকা চাকরির ব্যবস্থা রয়েছে। এই বিল পাশ হলে সরকারি ক্ষেত্রেও পাকা চাকরির ব্যবস্থাও লোপ পাবে। মালিকরা ঠিক তাই চায়। সেই লক্ষ্যে দ্রুত এই বিল পাশ করে তা সরকারি ক্ষেত্রে চালু করে দিতে চায় কেন্দ্রীয় সরকার।
শ্রম আইন সংশোধন
বিখ্যাত সাংবাদিক পি সাইনাথ গত কয়েক দশক ধরে তাঁর কলামের মাধ্যমে গ্রামীণ ভারতের চিত্র, বিশেষ করে কৃষকদের অবস্থা ও কৃষকদের আত্মহত্যার কথা, তুলে ধরছেন। গ্রামীণ ভারতের বিভিন্ন দুর্দশার কথা এক সূত্রে গেঁথে ১৯৯৬ সালে তিনি একটি বই প্রকাশ করেন। ‘Everybody Loves a Good Drought’ বইটি পড়লে জলের মতো পরিষ্কার হয় যায় যে স্বার্থান্বেষী মহল কেন এবং কীভাবে একটি খরা বা প্রাকৃতিক দুর্যোগের ফয়দা তোলে। বেশিরভাগ মানুষ ভিটেমাটি ছাড়া হলেও কতিপয় মানুষ এই দুর্যোগগুলিকে ব্যবহার করে লাল হয় ওঠে। সেই কারণেই তারা খরা বা এই ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগের অপেক্ষায় তীর্থের কাকের মতো বসে থাকে। আমাদের দেশের মালিকশ্রেণি চাতক পাখির মতো এই অতিমারির দিন গুনছিলেন।
সেই কারণেই দৈনিক কাজের ঘণ্টা এক ধাক্কায় আট থেকে বারো করে দেওয়া হয়। ওভারটাইম কাজ করালেও বাড়তি হারে মজুরির কথা তুলে দেওয়া হয়। আগেই বলেছি যে উত্তর প্রদেশে আপাতত সমস্ত শ্রম আইন স্থগিত করা হয়েছে, এমনকি ন্যূনতম মজুরির আইনও। এর ফলে সেখানে কোনও কাজ করাতে শ্রমিক লাগবে না কারণ ক্রীতদাসদের দিয়েই কাজ করানো হবে। শোষণের জন্য এর চেয়ে সুবিধাজনক পরিবেশ পাওয়া দুষ্কর। এই পদক্ষেপগুলিকে সংস্কার বলে সমাজে দেখানোর চেষ্টা হলেও এগুলি আসলে অধিকার লঙ্ঘনের অপপ্রয়াস। সমস্ত শ্রম আইন হঠিয়ে দেওয়ার অর্থ হল শ্রমিকরা শুধু ন্যূনতম অধিকার থেকেই বঞ্চিত হবেন না, তাঁদের মজুরি থেকেও বঞ্চিত হবেন। এর ফলে আমরা দেখব কীভাবে সংস্থাগুলি শ্রমিক ছাঁটাই করে ফের তাঁদের কম মজুরিতে বহাল করবে।
যে সরকার করোনা অতিমারির ও লকডাউনের হাত থেকে শ্রমিকদের বাঁচাতে সংস্থাগুলিকে কর্মী ছাঁটাই না করতে এবং পুরো মজুরি দিতে বলেছিল, তারাই এখন শ্রমিকদের দাবিদাওয়া থেকে বঞ্চিত করতে শুরু করেছে। এ ছাড়াও শ্রমিকদের আরও বেশি আইনি রক্ষাকবচের প্রশ্ন তো দূরের কথা, এবার সংগঠিত ক্ষেত্রের শ্রমিকরাও অসংগঠিত শ্রমিকে রূপান্তরিত হবেন কারণ তাঁদের কোনও সামাজিক নিরাপত্তা থাকবে না। তাহলে কি তাৎক্ষনিক জনরোষ অন্যদিকে ঘোরাতে জনসমক্ষে এইসব নাটুকে ঘোষণা দেওয়া হয়? প্রশ্নের উত্তর পেতে, পাঠক, একটু সরকারের ইএমআই সংক্রান্ত ঘোষণাটি মনে করুন।
বিভিন্ন গবেষণা জানাচ্ছে যে করোনা অতিমারির আগেই অর্থনৈতিক মন্দার কারণে মজুরি বৃদ্ধির হার কমছিল। সংগঠিত ও অসংগঠিত মজুরির হারের মধ্যে ফারাক বেড়ে যাচ্ছিল। যেমন গ্রামীণ ভারতে অস্থায়ী শ্রমিক হিসাবে কাজ করেন এমন একজন মহিলা, শহুরে সংগঠিত ক্ষেত্রের পুরুষ কর্মীর মাত্র ২০ শতাংশ মজুরি পান। এর মধ্যে এই শ্রম আইন সংশোধন মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা। যদি সমস্ত শ্রম আইন বিলুপ্ত করা হয় তাহলে প্রায় সব নিয়োগই কার্যত অসংগঠিত হয়ে পড়বে এবং মজুরি কমবে ব্যাপক হারে। এ ব্যাপারে কোনও শ্রমিক কারও কাছে আর অভিযোগ জানাতেও পারবেন না।
শ্রম অধিকার সঙ্কোচনের সঙ্গে নিয়োগ বৃদ্ধি এবং আর্থিক বৃদ্ধির সম্পর্ক কী? বাজারে সঙ্কটের প্রধান কারণ অতি-উৎপাদন এবং আমজনতার ক্রয়ক্ষমতা কমতে থাকা। এ কথা সাধারণ বুদ্ধিতে বোঝা যায় যে শ্রমিকের মজুরি কমলে অর্থনীতিতে এই প্রবণতাগুলিই শক্তিশালী হয়। তর্কের খাতিরে নয় মেনে নেওয়া গেল যে অন্যান্য বাজারের মতো শ্রমবাজারের মজুরি কমলে অর্থাৎ শ্রমের দাম কমলে শ্রমিকের চাহিদা বাড়তে পারে। কিন্তু অতীত অভিজ্ঞতা বলছে শ্রম আইন শিথিল করার ফলে শ্রমিকদের স্বার্থ অরক্ষিত হওয়ার জেরে লগ্নির প্রচেষ্টা এবং নিয়োগের সংখ্যা বাড়েনি।
গোটা দেশের বেকারত্বের হার দেখলে বোঝা যায় যে বহুল পরিমাণে শ্রমশক্তি অব্যবহৃত রয়েছে। অতিমারির সুযোগ নিয়ে সংস্থাগুলি ৪০ শতাংশ বেতন কাটছে এবং ছাঁটাই করছে। সব মিলিয়ে চাহিদা কমেছে। তাহলে প্রশ্ন, এই অবস্থায় কোন সংস্থা বেশি নিয়োগ করবে। বরং এক্ষেত্রে উলটো যুক্তি অনেক বেশি প্রাসঙ্গিক। রাজ্যগুলি যদি কাজের সময় ৮ থেকে বাড়িয়ে ১২ ঘণ্টা না করে দুটি ৮ ঘণ্টার শিফট করত তাহলে আরও বেশি মানুষ কাজ পেতেন। আরও অনেক বেশি নিয়োগ বাড়ত। যে যুক্তিই দেওয়া হোক না কেন সরকারের এই পদক্ষেপ কার্যত নিয়োগের সংখ্যা বহুলাংশে কমাবে।
কয়েকটি রাজ্যে এই পরীক্ষানিরীক্ষা শুরু হলেও কালক্রমে এই ব্যবস্থা গোটা ভারতের ক্ষেত্রেই মডেল হয়ে দাঁড়াবে যদি এর বিরুদ্ধে কোনও প্রতিরোধ গড়ে না ওঠে। একে অতিমারি, তাঁর ওপর অর্থনৈতিক সঙ্কট— এ দুইয়ের জাঁতাকলে পিষ্ট শ্রমিকদের দুর্বলতার সুযোগ নিতে ঘাপটি মেরে বসে ছিল মালিকশ্রেণি। ফলে সঙ্কট যত ঘনীভূত হয়েছে শাসকশ্রেণি তত বেশি তাদের কব্জা সুদৃঢ় করেছে। ঠিক এই কারণেই আমাদের সম্মিলিত ভূমিকা এখন অনেক বেশি জরুরি।
শেষ করি বন্ধু জয় বসুর কথা দিয়ে— “প্রতিটি সঙ্কট একটি মোড় ঘোরবার সময়। কোনদিকে মোড় ঘুরবে, সেটা কারা কতটা প্রস্তুত তার ওপর নির্ভর করে। পৃথিবী জোড়া এই সঙ্কটে, পৃথিবীব্যাপী পরিবর্তন অবশ্যম্ভাবী। সেই পরিবর্তন ডানদিকে না কি বাঁদিকে ঘটবে, সেটা আমাদের ওপর নির্ভর করছে। টু বি অর নট টু বি, দ্যাট ইজ দ্য কোয়েশ্চেন।”
[1] https://www.moneycontrol.com/news/business/economy/about-34-lakh-people-in-up-unemployed-congress-shashi-tharoor-says-up-stands-for-unemployed-people-4952531.html