Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

Man O’ War Jetty

ঋত্বিক চক্রবর্তী

 

প্রিন্সেপ ঘাট যদি বাঙালির চিরন্তন প্রেমের সাক্ষী হয়, ম্যান ও ওয়ার তবে বয়ে চলে খানিক ভয়াবহতার স্মৃতিকে।প্রিন্সেপে যদি গোধুলিবেলায় নামে গোলাপের বৃষ্টি, ম্যান ও ওয়ার তবে দেখেছে রক্তের বন্যা।না, না, এই ঘাট কোনো দাঙ্গা দেখেনি, খুনোখুনি দেখেনি।শুধু দু’-দুটো বিশ্বব্যাপী মহাযুদ্ধে হত্যালীলার রসদ জুগিয়েছে।অস্ত্র জুগিয়েছে, সেই অস্ত্র ব্যবহার করার পর্যাপ্ত মানবসম্পদ জুগিয়েছে।না জানি আরও কত ইতিহাসকে নিজের বুকে কুক্ষিগত করে রেখেছে সে।

গল্পটা বিংশ শতাব্দীর প্রথম দশকের।প্রিন্সেপ ঘাট তৈরির পর থেকে এই সময়পর্বের মধ্যেই হাওড়ার দিকে বেশ কিছুটা পিছিয়ে গেছে গঙ্গা। জাহাজ থামার পক্ষে প্রিন্সেপ হয়ে পড়েছে অচল।লর্ড কার্জনের পরবর্তীতে ব্রিটিশ রাজপুরুষেরা রেলব্যবস্থার শরণ নিলেও জাহাজের প্রয়োজনীয়তা তখনও শেষ হয়ে যায়নি।অথচ জাহাজ থামার জন্য জেটির অভাব।এই পরিস্থিতিতে কলকাতা বন্দরের বাদান্যতায় প্রিন্সেপ ঘাটের ঠিক পাশেই একটি জেটি তৈরির সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।

এরপরেই আসে ১৯১৪ সাল।আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হয়ে যায় প্রথম বিশ্বযুদ্ধ।জার্মানি, অস্ট্রিয়া ও ইতালিকে নিয়ে গঠিত ত্রিশক্তি চুক্তির বিরুদ্ধে ইংল্যান্ড,ফ্রান্স ও রাশিয়াকে নিয়ে গঠিত ত্রিশক্তি মৈত্রীর মহাযুদ্ধ। পরবর্তীতে জাপান, তুরস্ক সহ আরও কতকগুলি দেশ এই যুদ্ধে যোগ দিলে এটি আক্ষরিক অর্থেই হয়ে ওঠে বিশ্বযুদ্ধ।

বিশ্বযুদ্ধে অংশ নেওয়া সকল দেশগুলোর মতোই ইংল্যান্ডও প্রবল অর্থনৈতিক সংকটের মুখে পড়ে। এই সংকট মোকাবিলায় তারা ভারতের অর্থ ও মানবসম্পদ যুদ্ধের কাজে ব্যবহার শুরু করলে ভারতও পরোক্ষভাবে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের মাঠে পা রাখে। ভারতীয় সম্পদের অংশ হিসেবে এই যুদ্ধের সঙ্গে ওতোপ্রতো ভাবে জড়িয়ে পড়ে কলকাতা বন্দরও।তখন বন্দরের বয়স প্রায় পঁয়তাল্লিশ।

রক্তক্ষয়ী প্রথম বিশ্বযুদ্ধে এই বন্দরের প্রচুর লোকবল ও সম্পদহানি হয়েছিলো। প্রথম বিশ্বযুদ্ধকালীন এই বন্দরের নিজস্ব যুদ্ধ জাহাজগুলি যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে। পরবর্তীতে ট্রাস্টের চেয়ারম্যান টি. এইচ. এল্ডারটন সহ বন্দরের কর্মীরা যুদ্ধে মারাত্মক আহত হন এবং যুদ্ধক্ষেত্রে যাঁরা প্রাণ হারান, যেমন- ই. জে. এইচ. রবার্টসন, ই. ই. গ্রিমওয়াড, সহ সভাপতি এইচ. জে. হিলারি -এর নামে উৎসর্গ করা হয় বন্দরের স্মারক আর এই ঘাটটি।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার পরে কেটে গেছে ২০ বছর।বেজে উঠেছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের দামামা।দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন জাপানিরা কলকাতার খিদিরপুর ডকে বোমা নিক্ষেপ করায় মারাত্মক ক্ষয়ক্ষতি হয় বন্দর কর্তৃপক্ষের । বর্মা থেকে চাল, খাদ্য শষ্য আমদানিও ব্যহত হয়।ফলস্বরূপ কলকাতাসহ তার পাশ্ববর্তী অঞ্চলে দেখা দেয় মূল্যবৃদ্ধি ও দুর্ভিক্ষ।এই অতর্কিত বিমান আক্রমণের ফলে বন্দরের প্রায় ৪২জন কর্মী প্রাণ হারান। যদিও অল্প সময়ের মধ্যেই পরিস্থিতি সামাল দিতে পেরেছিল “ক্যালকাটা পোর্ট”।তারপরেই “আমেরিকান আর্মি”-র হাতে হস্তান্তরিত হয় বন্দরের মালিকানা। আর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় অগুনতি লোকের যোগান দিয়ে ইতিহাসের পাতায় কলকাতার এই বন্দর থেকে যায় ‘Man O war’ নাম নিয়ে আর তার সামনের বহমান গঙ্গা বয়ে নিয়ে চলে ইতিহাস, মিশিয়ে দেয় কোনো সাগরের জলে।ঠিক যেভাবে এই বন্দর যুদ্ধের রসদ পৌঁছে দিত পৃথিবীর অন্যপ্রান্তে ,— সেইভাবে।

কিন্তু কোথায় রয়েছে এই ঘাট? ওই যে বললাম, প্রিন্সেপ ঘাটের কাছেই। প্রিন্সেপ ঘাট থেকে উত্তরে কয়েক কিলোমিটার অংশ কলকাতা বন্দর ও পশ্চিমবঙ্গ সরকারের আর্থিক আনুকূল্যে সৌন্দর্যায়িত হয়েছে।হাঁটতে হাঁটতে খানিকক্ষণ সে দিকে পা বাড়ালে মিনিট দুয়েকের মধ্যেই একটি পরিত্যক্ত জেটি এবং একটি ছোটোখাটো সৌধ চোখে পড়ে।জেটিটির নাম ‘ম্যান ও ওয়ার জেটি’।এরপর প্রিন্সেপ ঘাটে হাওয়া খেতে গেলে ইতিহাসের এই হাতছানি দেওয়া অধ্যায়টাতে একবার চোখ বোলাতে ভুলবেন না যেন।


তথ্যসূত্র:-

১। “Calcutta Port Trust – Brief History”, Calcutta Port Trust
২। উইকিপিডিয়া