Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

সুহৃদ্বরেষু হরি

হরি বাসুদেবন | শিক্ষাবিদ

অমর্ত্য মুখোপাধ্যায়

 



লেখক কল্যাণী এবং কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের প্রাক্তন অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান এবং কলা ও বিজ্ঞান অনুষদের ডিন।

 

 

 

 

সুহৃৎ মানুষদের অভিঘাত অন্যের উপর বেশ বড় করে পড়ে। হরিশঙ্কর বাসুদেবন ছিলেন আমার ক্ষেত্রে সুহৃৎ, হরিচরণার্থে, প্রাথমিকভাবে, ‘শোভনহৃদয়, উদারচেতাঃ, মহাত্মা’ মানুষ হিসেবে। দ্বিতীয়ার্থে ‘প্রত্যুপকার-নিরপেক্ষ উপকারক’ হিসেবে। তৃতীয়ার্থে মিত্র হন অনেক পরে, সখা কখনওই নন। কেন সে কথায় আসছি। বর্ধমানের কাটোয়া কলেজে চার বছরের স্বনির্বাচিত নির্বাসন কাটিয়ে যখন ১৯৭৮ সালে কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দিলাম, প্রায় সেইসময়েই হরি দিল্লির রামযশ কলেজ থেকে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগে যোগ দিলেন রিডার হিসেবে। কেমব্রিজের ট্রাইপোস, পিএইচডি, পোস্টডক করা হরি যখন পরিযায়ী ধবল হংসের মতো পৃথিবীর বিদ্যাকাশে উড়ে, নিচে কলকাতায় নামলেন তখনও নক্ষত্রখচিত কলকাতার ইতিহাস বিভাগে তাত্ত্বিক-সাংস্কৃতিক ঐতিহাসিক অমলেশ ত্রিপাঠী, নরেন্দ্রকৃষ্ণ সিংহ-র ঐতিহ্যে লালিত অর্থনৈতিক ইতিহাসবেত্তা বিনয় চৌধুরী, নীলমণি মুখার্জিরা বিরাজ করছেন তাঁদের খটোমটো পাণ্ডিত্য নিয়ে। সেইখানে একঝলক ঠান্ডা হাওয়ার মতো এলেন হরি। তাঁর গৌর সুদর্শন শরীর, দেখনহাসি মুখ, ভরাট গলায় কেম্ব্রিজীয় ইংরেজি উচ্চারণ, আর মিষ্টি ভাঙা বাংলা কথা ইত্যাদি নিয়ে হরি কলকাতার চিন্তাবলয়ে অনায়াস স্থান করে নিলেন। আমি তাঁকে সেই সময়ে বিভিন্ন সেমিনারে দেখেছি একেবারে অন্য ছাঁচে আলোচ্য বিষয়ের উপর মন্তব্য করতে। আর ইউরোপীয় ইতিহাসের কোনও জটিল  আলোচনার ঝকঝকে, চুম্বকপ্রতিম উপসংহার টানায় তাঁর অনায়াস দক্ষতায় মুগ্ধ ও একটু ঈর্ষান্বিত হয়েছি।

এর মধ্যেই কবে, কী করে, পারস্পরিক বন্ধুদের মাধ্যমে আমি আর হরি পরস্পরকে চিনলাম। এক বর্ষণবিধ্বস্ত দুপুরে ভাগিনেয়ীকে নিয়ে প্রায় কোমর অব্দি জলে প্রেসিডেন্সিতে ফর্ম আনতে গিয়েছি। সামনের প্রশাসনিক ভবনের বারান্দায় আমাকে দেখে হরি হেসে আকুল, ‘what a fine day you’ve chosen to take this young lady out!’ এর পর আস্তে আস্তে হরি আরও বিখ্যাত হয়ে উঠছেন। ভারতে রুশ পর্যটক আফানাসি নিকিতিনের উপর তাঁর বিপুল সময়ে বিস্তৃত গবেষণা চলছে। রাশায় সোভিয়েত আমলের অভিলেখ্যাগারগুলো  খুলে দেওয়ার পর রুশ ও ফরাসি ইতিহাসের এই বিশেষজ্ঞ পরে আমারই কর্মস্থল কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের শ্রদ্ধেয় সহকর্মী অধ্যাপক শোভনলাল দত্তগুপ্ত ও যাদবপুরের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের রুশভাষাবিদ্ পুরবী রায়ের সঙ্গে রাশায় গিয়ে ১৯১৭-৪৭ সময়কালের মধ্যে রুশ ভারত সম্পর্ক নিয়ে তথ্য আর দলিলের দুটি সঙ্কলনগ্রন্থ বের করলেন। জনশ্রুতি আছে রায়, দত্তগুপ্ত, বাসুদেবন ওই অভিলেখ্যাগারগুলো থেকে নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর সম্পর্কে কিছু জেনেছিলেন যা প্রকাশ করতে পারেননি। এর পরে তিনি রুশেতিহাস থেকে মধ্য এশিয়ার দেশগুলির ইতিহাসেও মনোযোগী হয়ে ওঠেন।

২০০৪ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে যোগ দেওয়ার পর আমি আবার আলিপুর ক্যাম্পাসে আধুনিক ইতিহাস বিভাগের একই বহুতলে থাকার ফলে হরির নৈকট্যে আসি। আমি তখন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে মনোমালিন্যের সূত্রে প্রোফেসর, বিভাগীয় প্রধান, ডীন ইত্যাদি থাকা অবস্থাতেই কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে ছাব্বিশ বছরের সম্পর্ক কাটিয়ে কলকাতায় এসে মাথার মধ্যেকার কিছু চিন্তার ভূত তাড়াতে লেগেছি। রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে যে ভূত ছিল, তাকে তাড়ানো গেছে কেম্ব্রিজের ফাউন্ডেশন ইম্প্রিন্টের একটি বইয়ে। কিন্তু এখনও ‘মগজের মৌচাকে খোঁচা খেয়ে বোলতা ভনভন করে কী যে’ হয়ে আছেন নিকিতিন আর গেরাসিম লেবেদেভ। অগত্যা রুশ ইতিহাসের বিশেষজ্ঞ আর নিকিতিনবেত্তা হরিকে পাকড়ালাম ইউনিভার্সিটির এলিভেটরে। হরির Shadows of Substance: Indo-Russian Trade and Military Technical Cooperation Since 1991 তখন ২০১০-এ মনোহর থেকে বেরিয়ে গেছে। বললাম, ‘হরি নিকিতিনের উপরে কাজ করতে চাই, হেল্প করবে?’ শুনে হরি হেসে আকুল, বললেন, ‘নিকিতিনের উপরে কাজ করবে? তার জর্নালের নাম জানো?’ Khozenie za tri morya শুনে, একটু থমকে জিগালেন, এর মূল পাণ্ডুলিপির কটি কপি আছে, আর তাদের তাৎপর্য কী? সংখ্যা সাতটি, আর ভাস্কো-ডা-গামার পাণ্ডুলিপির দুশোটি বয়ানের চেয়ে এরা অনেক বেশি একই কথা বলে শুনে, আরেকটু থমকে, এদের ইতিহাস জানতে চাইলেন। বললাম, সব চেয়ে পুরনো পাণ্ডুলিপিটি ১৮২১-এ আবিষ্কৃত; আর কারামাজিনের ১৮৪২-এর History of Russia-তে আরও প্রামাণ্য পাণ্ডুলিপির পরে আছে ১৮৫১-র পিটার্সবুর্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের পাণ্ডুলিপি; হ্যাকল্যুট সোসাইটির করা ১৮৫৭-র প্রথম ইংরিজি অনুবাদ ইত্যাদি। শুনে তাঁর সহাস্য মন্তব্য, আরে, শিওর আই উড হেল্প ইউ! ইয়োর আনসার্স আর বেটার দ্যান মাই রাশান হিস্ট্রি স্টুডেন্টস! কলকাতায় প্রোফেসর হিসেবে যোগ দিয়ে আমায় এইভাবে কাজের অধিকার পেতে হল। সদাহাস্য হরি যখন ‘gatekeeper of knowledge’ তখন ছাড়ান ছুড়োন নেই। কিন্তু এর পর নিকিতিনের ব্যাপারে আমার সব প্রশ্নের উত্তর অম্লানবদনে দিয়েছেন। বইটই দিয়েছেন গোটাকয়, যেগুলো কলকাতার লাইব্রেরিতে নেই। ফলে মনোহর পাবলিশার্স থেকে আমার India in Russian Orientalism: Travel Narratives and Beyond, যার দ্বিতীয় অধ্যায়ে নিকিতিন আছেন, ২০১৩-তে বেরিয়ে গেল। কিন্তু ওঁর দেড়দশকব্যাপী গবেষণার ফল In the Footsteps of Afanasii Nikitin: Travels Through Eurasia and India in the Twenty-first Century মনোহর থেকেই ২০১৫-তে বেরোল। সুহৃৎ ছাড়া অন্য কেউ ওই অবস্থায় নিজের কাজের এরিয়ায় অন্যকে টিপ্স দিত বলে আমার জানা নেই।

আবার বছর বারো আগে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের মডার্ন ল্যাঙ্গুয়েজেস-এর অংশ রুশভাষা বিভাগ আমায় ইন্দো-রুশ লেবেদেভ সম্মেলনে ডাকে। আর সেই পরিচয় আর বইয়ের সূত্র ধরে ২০১৮-য় রাশান অ্যাকাডেমি অফ সায়েন্সেস আমায় লেবেদেভ-এর দ্বিশতবার্ষিকীতে পিটার্সবুর্গের আন্তর্জাতিক সম্মেলনে ডাকে, ভারতের আইসিসিআর-এর আর্থিক মদতে। এই দুই ঘটনাতেই হরির আনন্দ দেখার মতো ছিল। যেন ছাত্রের কৃতিত্বে অধ্যাপকের সুখ। যদিও আসলে দুই বছরের অনুজ। জনে জনে ডেকে হরি এই বইয়ের বিজ্ঞাপন করেছেন। আমায় কতবার বলেছে্ন, ‘বইটা নিয়ে আরও ঘোরাঘুরি করো, যেমন অমিতাভ ঘোষ তাঁর প্রথম বই সার্কল অভ রিজন নিয়ে করেছেন।’ আমার সেটায় আলিস্যি দেখে হয়তো পরে বলেছেন ‘তুমি তো হাত গুটিয়ে বসে থাকার লোক তো নও! ইউ মাস্ট বি আপ টু সামথিং সিনিস্টার আগেন! আমি যে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের নতুন তত্ত্ব নিয়ে বই লিখছি সেজ-এর হয়ে তাতে খুশি হওয়া ছাড়াও, তার পর ইন্ডিয়ান মাস্টার্স অভ ইন্টারন্যাশন্যাল থট-এর মালমশলা জোগাড় করছি তাতে পরম আহ্লাদিত হয়েছেন। কেন সে কথায় পরে আসছি।

হরির কর্মজীবন, পণ্ডিত ও প্রশাসক হিসেবে খ্যাতি, ইত্যাদি নিয়ে বাংলা, ইংরেজি কাগজে অনেক লেখা বেরিয়েছে। তা নিয়ে আমার বেশি বলার অর্থ হয় না। তবে প্রাচীন থেকে আধুনিক ইউরোপীয় ইতিহাসের সমস্ত বিষয়ে ও প্রসঙ্গে, রুশ ইতিহাসের আর পশ্চিম ইউরোপীয় ইতিহাসের প্রাচীন ও আধুনিক স্পর্শবিন্দুগুলি বিষয়ে হরির মতো সাবলীল পণ্ডিত দেখিনি। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে অজস্র ছাত্রছাত্রীকে মন্ত্রমুগ্ধ করেছেন। অধ্যাপনা ছাড়াও দক্ষ প্রশাসক হরি জামিয়া মিলিয়া ইসলামিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে ২০০৩-২০০৫ সালে মধ্য এশিয়া বিষয়ক গবেষণার প্রোফেসর, এবং তৃতীয় বৈশ্বিক গবেষণা আকাদেমির ডিরেক্টর ছিলেন। ২০০৭-২০১১ সালের মধ্যে মওলানা আবুল কালাম আজাদ ইন্সটিটিউট অভ এশিয়ান স্টাডিজ-এর ডিরেক্টর হিসেবে এই প্রতিষ্ঠানকে অন্য উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছিলেন। সেই সময়ে আমি হরির ডাকে ওদের অনেক কর্মকাণ্ডে আলোচক (Discussant) হিসেবে গিয়েছি। পরে ২০১১-১৪ ইন্ডিয়ান কাউন্সিল অভ হিস্টোরিক্যাল রিসার্চ-এর সদস্য ছিলেন। আর ২০১৫ সাল তিরোধান অবধি হরি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের চায়না সেন্টারের ডিরেক্টর হন।

কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ২০১৬ সালে অবসর নেওয়ার আগে আমার সঙ্গে হরির আবার কাজের ব্যাপারে যোগ হয়। আমি তখন নিজের মত করে, নিজের পকেটের পয়সায় (যেমন করেছি আজীবন) রবীন্দ্রনাথের জাভাযাত্রীর পত্র আর সুনীতি কুমার চ্যাটার্জির রবীন্দ্রসংগমে দ্বীপময় ভারত ও শ্যামদেশ মিলিয়ে পড়ছি। সঙ্গে কালিদাস নাগ-এর Discovery of Asia। উদ্দেশ্য Greater India Society-র অনুষঙ্গে ভারতবর্ষের ‘পুবে তাকাও’ নীতির একটি বঙ্গীয় উৎস ও তার বিভিন্ন ধারা খোঁজা। আমার বিভাগ ও বিশ্ববিদ্যালয়ও ভারতবর্ষের ‘পুবে তাকাও’ নীতির উপরে যে রিসার্চ থ্রাস্ট-এর কথা ভাবছে, তার থেকে আলাদাভাবেই। হরি তার আগে থেকেই অনেক বড় করে ভারতবর্ষের ‘পুবে তাকাও’ নীতির কথা ভাবছেন, কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে গায়ত্রী স্পিভাকের ‘Radiating Globalities’ প্রকল্পের কাজের সঙ্গে বা পরে, অবজার্ভার রিসার্চ ফাউন্ডেশনের অংশ হিসেবে ভারতবর্ষের ‘পুবে তাকাও’ নীতির আর দূর প্রাচ্য নীতির মধ্যে অধিক্রমণ খুঁজতে; আর রুশ প্রতিষ্ঠানের/কর্তৃপক্ষের গ্রেটার ইউরাশিয়া নীতির প্রতি চৈনিক কর্তৃপক্ষের মনোভাব খতিয়ে দেখতে। উপরন্তু ঐতিহাসিক রমেশ চন্দ্র মজুমদারের বাড়িতে একটি মিউজিয়াম খোলানোর কথা ভাবছেন, কারণ দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার ইন্দোনেশিয়া, বর্মা, মালয়েশিয়া, কাম্বোডিয়া ও অন্য দেশের উপর আরসি-র কাজ Greater India Society-র ঐতিহাসিকদের মধ্যেও সর্বোত্তম। ফলে রবীন্দ্রনাথ, সুনীতি, আর নাগ নিয়ে আমার উৎসাহ দেখে ওই আকুল হেসে, চোখ মটকালেন। ভাবখানা এ আবার একটা মাভেরিকগিরি ধরেছে, একে বাঁচানোর উপায় নেই। জানি, কাজ শেষ হলে খুব বিজ্ঞাপন করতেন। কিন্তু আমার কাজ শেষ হয়নি। আর হরি চলে গেলেন। আর এই বাউন্ডুলের মতিগতিকে প্রশ্রয় দেবেন না। আসলে হরিও তো পকেটে চারটি অনিকেত, আর পাঁচটি অস্থিরতা নিয়ে ঘুরে বেড়াতেন। ‘স্রোতের শাঁওলি’-দের ফলেই বুঝতেন।

নিজের কথা একটু বেশি এসে গেল অ্যানেকডোটে, গপ্পে গপ্পে, এই স্মৃতিচারণায়। কিন্তু সূর্যের আলোকে কী করে বোঝা যাবে, ‘প্রতিফলনের বস্তু অবলুপ্ত হয়ে গেছে জেনে?’ অলিভার ক্রমওয়েলের কাজিনকে লেখা ১৬৩৮-এর একটি চিঠির একটি বাক্যের একটি শব্দ পাল্টাই। বাক্যটা: ‘One beam in a dark place hath exceeding much refreshment in it:- blessed be His Name for shining upon so dark a heart as mine!’ শব্দটা His স্থলে Hari’s।