সত্যব্রত ঘোষ
লেখক নিবন্ধকার, চলচ্চিত্রনির্মাতা
আমফান বা উমপুন— যে নামই তার হোক, আড়ে আর বহরে সে ততটাই প্রকোপ ফেলেছে যতটা আবহাওয়া দপ্তর আগাম জানিয়েছিল। ঘটা করে রাজ্য সরকারও জানায় সুপার সাইক্লোনের মোকাবিলায় সে প্রস্তুত। কিন্তু তিন ঘণ্টার প্রবল ঝড়-বৃষ্টিতে আমরা দেখলাম সব ব্যবস্থা ধূলিসাৎ। লকডাউনের জেরে বেশির ভাগ মানুষ ঘরে থাকতে অভ্যস্ত হয়ে গেছে। তা না হলে প্রাণহানির সংখ্যা বাহাত্তরের অনেক বেশিই হত। সে কথা না হয় থাক।
অতিমারির আতঙ্কে দুই মাস লকডাউন, তার সঙ্গে জুড়ল ঝড়ের তাণ্ডব। সেই যে বলে না, ‘একা রামে রক্ষা নেই সুগ্রীব তার দোসর’। বলে মনে হচ্ছে কথাটার গভীরে আরও কিছু কথা লুকিয়ে আছে। কীরকম? না, সীতাকে রাবণের কবল থেকে উদ্ধার করতে রাম আর লক্ষ্মণ পৌঁছাল কিষ্কিন্ধ্যায়। সেখানে তখন বানর-রাজ বালির শাসন। রাম কিন্তু গেলেন রাজার ভাই সুগ্রীবের আসরে। মহাশয় সব শুনে বললেন একটা শর্তে সাহায্য করতে পারি। তুমি বালিকে মেরে আমাকে আবার কিষ্কিন্ধ্যার সিংহাসনে বসাও। এরপরে বালি আর সুগ্রীবের মল্লযুদ্ধ, আড়াল থেকে নিশান বাঁচিয়ে রামের তীরচালনা, বালির মৃত্যু, সুগ্রীবের রাজ্যাভিষেক, বালির স্ত্রী তারার সঙ্গে সুগ্রীবের বিয়ে এবং তারপরে বানরসৈন্যের সাহায্যে রাবণের লঙ্কায় পৌঁছানোর আয়োজন। কিন্তু এই যে বিশাল কিষ্কিন্ধ্যা পর্বের রাজনীতি, তা কার দৃষ্টিভঙ্গি থেকে লেখা? বাল্মিকী, তুলসীদাস অথবা কৃত্তিবাস— রামের গুণগানে প্রত্যেকেই লক্ষ্যভেদেই গুরুত্ব দিয়েছেন অধিক। রামের যে কূটনীতি, তা রয়ে গেছে নেপথ্যে। সুগ্রীব কেমন রাজা ছিল, আমরা জানি না। তবে তাঁর একান্ত সহচর হনুমান যে রামের পরম ভক্ত হয়ে উঠেছিল তা স্বর্ণাক্ষরে লেখা আছে।
কথাগুলি উঠল ঐ ‘দোসর’ শব্দটার জেরে। ইদানিংকালের রাজ্য-রাজনীতিতে আমরা লক্ষ করছিলাম, মুখ্যমন্ত্রী যে পদক্ষেপই নিন না কেন রাজ্যপাল মহাশয় তাতে খুঁত ধরছেন। বোঝাই যাচ্ছিল মুখ্যমন্ত্রীর অস্বস্তি বাড়ানোর কাজটা ওনাকে দেওয়া হয়েছে। মুম্বাইয়ের রাজ্য-রাজনীতিতেও এখন এই কাণ্ড চলছে। করোনা ভাইরাসের আক্রান্তের সংখ্যা রুখতে আচমকা লকডাউন ঘোষণার পর রাম ও হনুমানভক্ত দেশের প্রধানমন্ত্রী এখন নিরুপদ্রবে সঙ্ঘের প্রধান সেবকের দায়িত্বটি পালন করছেন। উনি যখনই মনের কথা বলেন, তখনই আমরা আতান্তরে পড়ি। দেশ বা মানুষের চেয়েও ওনার কাছে গুরুত্বপূর্ণ হল ‘বেওসা’। ব্যবসায়িক এই প্রবৃত্তির সঙ্গে যুক্ত হয়েছে এলাকা দখলের প্রবল ক্ষুধা। পশ্চিমবঙ্গে আসন্ন নির্বাচনে তৃণমূলের ঘর ভেঙে রাজ্যের মসনদ দখল করাটাই তাঁর লক্ষ্য। যেমন বাণিজ্যিক রাজধানী মুম্বাইয়ে শিবসেনা-কংগ্রেস জোট ভেঙে ফাডনাভিসকে যদি আবার মুখ্যমন্ত্রী পদে বসান যায়, তবেই না লকডাউনে সবাইকে চুপ করে রাখবার সার্থকতা! লঙ্কাদহনের কাজ হনুমানকেই মানায়। দুই প্রদেশের রাজ্যপাল এমন তৈত্তিরীয় উত্তরণে নিশ্চয়ই গৌরবান্বিতই হবেন।
এমন একটা জমকালো পৌরাণিক প্রেক্ষাপটে ঝঞ্ঝা-পরবর্তী পশ্চিমবঙ্গের হালহকিকত দেখছি এখন। প্রধানমন্ত্রী এলেন রাজ্যে ক্ষয়ক্ষতির স্বরূপ দেখতে। মুখ্যমন্ত্রী আর রাজ্যপালের সঙ্গে হেলিকপ্টার সফরে ওনারা কী বুঝলেন বা দেখলেন তা যাকে ইংরেজিতে বলে পাবলিক ইমাজিনেশন হয়েই থাকবে। তবে গুজরাতে বন্যার পর ইন্দিরা গান্ধির হেলিকপ্টার সফর নিয়ে প্রয়াত সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের কবিতাটির কয়েকটি পঙক্তি মনে পড়ছে—
উঁচু থেকে তুমি দেখতে পাও মাইল মাইল শূন্যতা
প্রকৃতির নিয়ম ও নিয়মহীনতা সর্বনাশা মহিমা
নতুন জলের প্রবাহ, তেজে স্রোত যেন মেখলা
আকাশ উলটো
হয়ে শুয়ে আছে পৃথিবীতে
মাঝে মাঝে দ্বীপের মতন বাড়ি ও কাণ্ডহীন গাছের
পল্লবিত মাথা
ইন্দিরা, তখন সেই বন্যার দৃশ্য দেখেও একদিন
তোমার মুখ ফস্কে
বেরিয়ে যেতে পারে, বাঃ, কী সুন্দর
সেই সৌন্দর্যের মোহেই কিনা জানা নেই, তবে সফরের পর থেকে বর্তমান তিন পদাধিকারীর মেজাজ কিন্তু দ্রবীভূত। প্রধানমন্ত্রী অবশ্য নবীন পট্টনায়কের ওড়িশাকে পরিস্থিতি মোকাবিলায় পশ্চিমবঙ্গের চেয়ে আগে রেখে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রস্তুতিকে সমালোচনা করেছেন। তবে ত্রাণ তহবিল থেকে একশো কোটি টাকা নবান্নের ঠিকানায় পাঠাতে দেরিও করেননি বিশেষ। সমস্যা যে তাতেও বিশেষ মেটেনি, তা পশ্চিমবঙ্গবাসী হাড়ে হাড়ে বুঝছেন। এই লেখা যখন লিখছি, খবর আসছে পরিযায়ী শ্রমিকদের নিয়ে ৪১টি ট্রেন বিভিন্ন রাজ্য থেকে কলকাতায় পৌঁছাতে শুরু করেছে। একদিকে তাণ্ডবের জের, অন্যদিকে নতুন সংক্রমণের আশঙ্কা– কলকাতা আর পার্শ্ববর্তী জেলাগুলির স্বস্তি বহুদিন হল নিরুদ্দেশ।
প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের রেশ মিটতে দিন আর মাস কেটে যেতে পারে। রাজ্যবাসীর তা অজ্ঞাত নয়। কিন্তু রাজ্যের বর্ষীয়ান কিছু তৃণমূল নেতা ইতিমধ্যেই অভিযোগ জানাচ্ছেন যে ঝড়ের পাঁচদিন আগে আবহাওয়া দপ্তরের সতর্কবার্তা দেওয়া শুরু হলেও রাজ্য প্রশাসন যথেষ্ট ব্যবস্থা নেননি। এই নিয়ে পুরমন্ত্রী বা দলের প্রধান সম্পাদকের যতই উষ্মা থাকুক না কেন, শহরবাসী গত ছয়দিন যে জেরবার হয়েছে একথা ঠিক। অতি প্রয়োজনীয় বিদ্যুৎ সংযোগ ছাড়াই এই ভ্যাপসা গরমে ঘরে আটকে থেকে অনেকেই বন্দিদশার অসহায় যন্ত্রণায় ছটফট করেছেন। রেফ্রিজারেটরে খাবার জমানোর অভ্যাসের কারণে খাদ্যাভাব ঘটেছে বহু পরিবারে। বন্ধ রেফ্রিজারেটরে রাখা খাদ্যবস্তুগুলি পচেছে। মোবাইল ফোন এবং ইন্টারনেট সংযোগে বিঘ্ন ঘটায় বহু পেশাদার মানুষের রাতের ঘুম কেড়েছে অব্যবস্থা। অসংখ্য রোগী, যারা টেলিমেডিসিন পদ্ধতিতে ডাক্তারদের সঙ্গে নিয়মিত সংযোগ রাখছিলেন লকডাউনে, সময়ে চিকিৎসার অভাবে তাঁদের অনেকের প্রাণ সংশয় এখন। আর যারা এই নয় সপ্তাহ ব্যাপী লকডাউনেও নিজেদের সুস্থ রাখতে পেরেছিলেন, পরিস্থিতির সাঁড়াশি চাপে তাঁদের শরীর ও মন কোনও কিছুই আজ ভাল নেই। রাস্তায় নেমে উপড়ে পড়া গাছগুলির ডাল সরানো থেকে শুরু করে অবস্থান বিক্ষোভে প্রশাসনকে সচল করবার চেষ্টায় তাঁরাও ক্লান্ত ও হতাশ।
প্রশাসক বললে যে দায়িত্বসম্পন্ন মানুষের আবছা চেহারাগুলি চোখে ভাসে, তেমন ব্যক্তিত্বের এখন বড়ই অভাব। আজ যারা দায়িত্বপ্রাপ্ত, তাঁরা প্রচারাভিলাষী। ক্যামেরার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেদের অকর্মণ্যতা ঢাকতে মানুষগুলি যত দড় হয়েছেন, তার অল্প এক ভগ্নাংশ যদি নিজের প্রদত্ত কাজটুকুতে মন দিতেন, তাহলে অব্যবস্থার এই চূড়ান্ত রূপটি হয়তো আমাদের সহ্য করতে হত না। বুঝতে পারি নেত্রীর মন জুগিয়ে চলার মধ্যেই তাঁদের দক্ষতার যত পরিচয়। এবং নেত্রীও তাঁর প্রতি বিশ্বস্ততার মাপকাঠিতে কাজ ভাগ করে দেন। ‘হ্যাঁ-তে হ্যাঁ আর না-তে না’— পরিকল্পনাসভাগুলি যেহেতু এই সুরেই বাঁধা, তাই রাজ্যবাসীকে সম্পূর্ণভাবেই মুখ্যমন্ত্রীর বিবেচনায় ভরসা করতে হয়। সেই তিনিই যখন বলেন “সর্বনাশ হয়ে গেল!” তখন রাজ্যবাসীদের দুরাবস্থার সুরাহা কল্পনাতীত। আরও দুঃখের কথা এই যে রাজ্যে যারা বিরোধী হিসেবে পরিচিত, তাঁরা নিন্দা আর প্রশংসার সাদা-কালো মানসিকতার মধ্যেই নিজেদের অস্তিত্বের জানান দেন। গঠনমূলক সমালোচনারও যে একটা আলাদা পরিসর থাকতে পারে, তা আমাদের রাজ্য-রাজনীতি থেকে দীর্ঘকাল অপসারিত।
সুগ্রীবের দোসর হওয়া থেকে শুরু করেছিলাম। রামকে যারা ভগবানরূপে পুজো করেন, হনুমানের ল্যাঙটধারণে যারা মোক্ষ খুঁজে পান, তাঁদের চোখে এই দেবতাদের ত্রুটিবিচ্যুতিগুলি অনুপ্রেরণা বিশেষ। লক্ষ্যসাধনে যতই মিথ্যাচার এবং অন্যায় করতে হোক না কেন, তাঁরা মনেপ্রাণে বিশ্বাস করেন ফলেন পরিচয়তে। তবে সেই বিষফলের জ্বালায় সাধারণ মানুষ অতিষ্ঠ। লকডাউনের আড়ালে বিভিন্ন ব্যবসায়িক চুক্তি সমাধা করবার পর মরা অর্থনীতিতে জোয়ার আনতে এবার তাঁরা চিনের সঙ্গে যুদ্ধ যুদ্ধ খেলায় ব্যস্ত। লকডাউন কবে উঠবে বা জীবনছন্দ আদৌ স্বাভাবিক হবে কিনা জানা নেই। তবে রাস্তার মাঝে ঝড়ে উপড়ে পড়া মৃত গাছগুলির ছেঁড়া শিকড়ে সেদিন তুলসীদাসের রামরাজ্য আর মোদির আচ্ছে দিনকে ধূলিকণার মতো হাওয়ায় মিলিয়ে যেতে দেখেছি।